somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কালের অতল গর্ভে হারিয়ে যেতে বসা কিছু প্রযুক্তি – দ্বিতীয় পর্ব

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজকে দেয়া হলো এর ২য় কিস্তি। কেউ প্রথম কিস্তি পড়তে চাইলে এই লিঙ্কে যেতে পারেন।
প্রথম কিস্তি

ট্রানজিস্টর রেডিও:



‘সাধারণ জ্ঞানের আসর’ ‘শার্লক হোমস, ‘অনুরোধের আসর গানের ডালি’, সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান-‘দুর্বার’, নতুন মুক্তি প্রতীক্ষিত সিনেমার প্রোমো, রাত ৮টার ‘খেলার সংবাদ’ বা দেশ বিদেশের ‘সংবাদ’, ক্রিকেট বা ফুটবল খেলার অসাধারণ ধারাবিবরণী শোনা, প্রতি সপ্তাহে একটি ‘খন্ড নাটক, সন্ধ্যার পরে মজাদার কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান… আসলে কোনটা রেখে কোনটা বলি। আরো কত কত অনুষ্ঠান শোনার অন্যতম মাধ্যম ছিল প্রাণের ট্রানজিস্টর রেডিও। তখন গ্রামের অনেকের হাতে হাতে রেডিও শোভা পেত। রেডিও ছিল আমাদের ‘হাতের লাঠি’। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি এটি ছিল মানুষের একান্ত সঙ্গী। এখন যেমন পাড়া-মহল্লার টি-স্টলে খরিদ্দারদের আকৃষ্ট করতে ক্যাবল টিভি বাধ্যতামূলক একটা ব্যাপারে পরিণত হয়েছে তেমনি সে সময় ছিল রেডিও। এমনও দেখা গেছে নতুন জামাইয়ের হাতে উপহার হিসেবে রেডিও তুলে দেয়া হত! আহারে! সাধের রেডিও!

মূলত গণমানুষের গান শোনার যন্ত্র রেডিও। এর জনপ্রিয়তা, প্রয়োজনীয়তা, চাহিদা কোনটাই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যুগের পর যুগ মানুষের কাছে এর অবস্থান ছিল এক নম্বরে। গান, দেশ-বিদেশের খবর, নাটক, নতুন সিনেমার প্রমো সহ অন্যান্য সকল প্রোগ্রাম শোনার অন্যতম মাধ্যম ছিল ট্রানজিস্টর রেডিও। রেডিও বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আরো ছিল তিন ব্যান্ডের রেডিও। বিবিসির সংবাদ ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নানা অনুষ্ঠানসহ দেশী-বিদেশী নানা অনুষ্ঠান শোনার অন্যতম মাধ্যম ছিল এ সকল রেডিও। মনে আছে, আমাদের গ্রামের এক টি-স্টলে দুপুর কিংবা সন্ধ্যা হলেই ভীড় লেগে যেত। কারণ তখন বিবিসিতে ইরাক-ইরান কিংবা আমেরিকানদের ইরাক বা আফগানিস্তান আগ্রাসন ইত্যাদি যুদ্ধের নানান খবরাখবর প্রচার করা হত।

ইদানিং ক্ষয়িষ্ণুতার শেষ প্রান্তে তথ্য-বিনোদনের প্রধানতম মাধ্যম রেডিওর জনপ্রিয়তা। এফএম রেডিওর শ্রোতাপ্রিয়তায় বাংলাদেশ বেতারের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে। এদিকে রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন এলাকায় কমিউনিটি রেডিও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠানও এফএম ব্যান্ডে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে, যা শোনার মূল মাধ্যম সেলফোন। উন্নয়ন ও কৃষিবিষয়ক তথ্য তৃণমূল মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই কমিউনিটি রেডিওর অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এখন আর কারো হাতে ট্রানজিস্টর রেডিও দেখা যায় না।তবে বিভিন্ন ফরমেটে রেডিওর চাহিদা এখনো আছে।

ক্যাসেট প্লেয়ারঃ



'হাওয়া মে উড়তা যায়ে, মেরা লাল দোপাট্টা...মল মল কা হো জি...হো জি” ।

তখন প্রাইমারীতে পড়ি। আমাদের স্কুলের সামনের একটা হোটেলে বড় সাইজের একটা ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল। সেখান থেকে প্রতিদিন এমন পুরানো দিনের গানের আওয়াজ ভেসে আসত। এই স্মৃতি এখনও মনের গভীরে প্রোথিত।

এক যুগ আগেও পছন্দের গান শোনার অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল ক্যাসেট প্লেয়ার। আমরা সাধারণত রেডিওতে গান শুনতে অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এতে কী আর মন ভরে? কেননা এতে নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের কোন অবকাশ ছিল না। এ সময় বিনোদনের আকাশে নতুন যন্ত্র ক্যাসেট প্লেয়ারের আমদানি হলো। এটি ছিল টু ইন ওয়া, মানে ক্যাসেটের পাশাপাশি রেডিও শোনার ব্যবস্থাও ছিল। কাজেই এক ঝটকায় বাজিমাত করল সে। এতে গান শুনতে প্রয়োজন পড়ত ক্যাসেট টেপের। বাজারে দেশী-বিদেশী প্রায় সকল জনপ্রিয় শিল্পীদের গানের ক্যাসেট পাওয়া যেত। একটি ক্যাসেট টেপে কম-বেশী ১২-১৪টি গান ধরত। একপাশ শেষ হলে উল্টিয়ে অন্যপাশ করে বাকী গানগুলো শোনা হত। পছন্দের শিল্পীর গানের ক্যাসেট কিনে ঘর ভরিয়ে ফেলত অনেকেই। প্রেমিক-প্রেমিকাদের উপহারের তালিকায় অন্যতম স্থান দখল করলো গানের ক্যাসেট। বাড়ি বাড়ি উচ্চ ভলিউমে বাজত রোমান্টিক গান, বিরহের গান, ব্যান্ড সংগীত বা দেশাত্ববোধক গান। বিয়ে বাড়িতে সাউন্ড বক্স ভাড়া করে উচ্চ ভলিউমে ক্যাসেট বাজানো একটা রেওয়াজে পরিণত হলো। অবসর সময়ের প্রিয় সঙ্গী হলো এটি। বন্ধু-বান্ধবদের আড্ডায় বাজতে থাকল প্রিয় গান। আসলে তখন মানুষের জীবনে অনেকখানি জুড়ে ছিল গান।



ক্যাসেট প্লেয়ারে অনেক রকমের সুবিধা যেমন ছিল তেমন অসুবিধা ছিল। বেশি চলতে চলতে এক সময় তার ফিতা ফেসে যেত হঠাৎ করেই। বেশ কট কট করে আওয়াজ করে তা আটকে যেত। তারপর তা প্লেয়ার থেকে বের করা হত অনেক সাবধানে যাতে ফিতা না ছিড়ে যায়। একবার জট ছাড়ানো গেলে পেন্সিল বা কলম দিয়ে তা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঢুকানো হত। এই কাজটির কথা নিশ্চয় মনে আছে অনেকের। বড়ই মজার ছিল সেসব বিষয়গুলো। হয়ত চিরতরে হারিয়ে গেছে সেসব দিনগুলো!

আমাদের বাড়িতে সনি-র একটা ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল। গান ভীষণ পছন্দ করতাম। আমি একটু ধীরলয়ের গান বেশী শুনতাম। বিরহের গানও ভীষণ টানত আমাকে। ইদানিং মোবাইলে বা কম্পিউটারে গান শোনা হয়। লাস্ট কবে কাউকে ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শুনতে দেখেছি মনে করতে পারছি না।

REEL TO REEL



তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। প্রিয় এক বন্ধুকে গানের ক্যাসেট উপহার দেয়ার জন্য একটা ‘ব্লাঙ্ক’ ক্যাসেট টেপ কিনলাম। পড়ে নীলক্ষেতের এক দোকানে গিয়ে পছন্দের কিছু গান দিয়ে রেকর্ড করে দিলাম কুরিয়ার করে। একটা সময়ে এর ব্যাপক চাহিদা ছিল। একসময় শুধু বাজারে চলতি ক্যাসেটে তরুণ বা যুবসমাজের মন ভরে উঠত না। তারা নিজেদের পছন্দনীয় গান দিয়ে তা রেকর্ড করানো শুরু করতে লাগল। মিউজিক শপে কী পরিমাণ যে ভিড় লেগে থাকত। আজকাল সেই মিউজিক শপের কি অবস্থা তা আমার জানা নেই।

ক্যাসেট থেকে ক্যাসেটে গান রেকর্ড করার জন্যে সর্বপ্রথম এই যন্ত্রটিই মার্কেটে সাড়া জাগায়। যদিও এখন কোথাও এটি ব্যবহৃত হয়না। এখন এই কপি-পেস্টের যুগে এর উপযোগ বহু আগেই নিঃশেষিত হয়েছে।

সিডি প্লেয়ারঃ


সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে গান শোনার বাদ্যযন্ত্রেও পরিবর্তন আসতে লাগল। এ সময় গানের সঙ্গীতাকাশের নতুন রাজারুপে আবির্ভাব ঘটল সিডি প্লেয়ারের। উন্নত সাউন্ড সিস্টেম, গান সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি, ফিতা প্যাচ লাগার ঝুট-ঝামেলামুক্ত, ক্যাসেটের মত উলটে দেবার ব্যাপার-স্যাপার নেই, এক সিডিতে অনেক গান ইত্যাকার সুবিধা সংবলিত এই সিডি ধীরে ধীরে ক্যাসেটের স্থান দখল করতে থাকে। অতি দ্রুত মানুষ এর দিকে ঝুঁকে পড়ে। এক সময় ক্যাসেটের বিলুপ্তি ঘটতে থাকে।


যখন সিডি প্লেয়ার আসে তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমার রুমমেটের একটা সিডি প্লেয়ার ছিল। সকাল-সন্ধ্যা-রাত নেই যখন-তখন গান বাজত আমাদের রুমে। কখনো ‘এখন অনেক রাত, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’, কখনো ‘পেয়ার কিয়া ত ডরনা কিয়া’, ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানী’ কিংবা কখনো ‘ওয়েলকাম টু দ্যা হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া’ ইত্যাদি হরেকরকম গান।

কিন্তু ইন্টারনেটের যুগ আসার সাথে সাথে মানুষ সিডি প্লেয়ার থেকেও মুখ ফেরাতে শুরু করে। ক্যাসেট, সিডি রিলিজ হবার আগেই ইন্টারনেটে যেখানে গান পাওয়া যায় সেখানে কে আর অপেক্ষা করবে? রয়েছে বিভিন্ন মিউজিক ওয়েবসাইট, সার্চ বাটনে দাও সার্চ আর করে নাও ডাউনলোড। ব্যস, আর কি চাই এত সহজ উপায় থাকতে? পয়সা খরচ করে গান শোনা? সে আবার কেমন হাস্যকর কথা?

এভাবেই হারিয়ে গেল ক্যাসেট আর সিডির সেই স্বর্ণযুগ। আমাদের মিউজিক শিল্প কিভাবে যে চলছে এর মাঝে বর্তমানে আমার তা জানা নেই। তবে আগের সেই রমরমা ক্যাসেট ব্যবসা এখন আর নেই তা গানগুলোর মান দেখলেই বোঝা যায়। হায় ক্যাসেট! হায় ডিস্ক!

দ্বিতীয় কিস্তির এখানেই সমাপ্তি। আগামী কিস্তিতে শেষ করার ইচ্ছে আছে। দু’একদিনের মধ্যে এর ৩য় বা শেষ কিস্তি দেয়া হবে।আশা করি সাথেই থাকবেন।

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ লেখাটি তৈরী করতে বাংলাপিডিয়া, বেশ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকা, অনলাইন পত্রিকা এবং ইন্টারনেটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আরো বেশ কিছু লেখা থেকে সাহায্য নেয়া হয়েছে। আমি সবার প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:১৮
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রোড জ্যাম ইন ভিয়েতনাম

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৭



আমার ধারনা ছিল জটিল জ্যাম শুধু বাংলাদেশেই লাগে । কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিল । ভিয়েতনামে এরকম জটিলতর জ্যাম নিত্য দিনের ঘটনা । ছবিটি খেয়াল করলে দেখবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×