সভ্যতার এক চরম উৎকর্ষতার যুগে আমরা বসবাস করছি। নিত্য নতুন প্রযুক্তি এসে আমাদের জীবনকে প্রতিনিয়ত রাঙ্গিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি বিকাশের গতি এতটাই প্রবল যে, এখন একটা সামগ্রী কিনে আনতে না আনতেই শোনা যায় সেটাও নাকি পুরোনো ধাঁচের। ইদানিংকালের প্রযুক্তির ব্যাপ্তি এমনই ক্ষনস্থায়ী। আধুনিকায়নের প্রবল স্রোতে এক সময়ের বহুল ব্যবহৃত ও জনপ্রিয় নানা প্রযুক্তিগুলো ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মাঝে এসবের কদর কমতে কমতে একেবারেই শূন্যের কোঠায় পৌঁছে গিয়ে প্রায় পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আজ তেমনি হারিয়ে যেতে বসা কিছু প্রযুক্তি যা এক সময় আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল তা নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনা করবো। আশা করি আপনারা সাথেই থাকবেন।
বায়োস্কোপঃ
'কি চমৎকার দেখা গেল, রহিম-রূপবান এসে গেল'।
গ্রামে গ্রামে ডুগডুগি বাজিয়ে বড় লাল বাক্সের বায়োস্কোপ দেখানোর দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। এক সময় মেলা-পার্বণে বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল বায়োস্কোপ। মাথায় ইয়া লম্বা একখান টুপি, রঙিন জামা আর পায়জামা পরা সঙ সাজা মানুষটাকে দেখেই ছোট ছোট ছেলেপুলেরা হেসে খুশিতে একাকার হয়ে যেতো। তিনিও নেচে-গেয়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের আনন্দ দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন।
সুর ধরে গান গেয়ে বাক্সের সামনে রাখা মুখগুলোতে চোখ রাখতে উদ্বুদ্ধ করতেন তাদের। আর মাত্র চার আনা কিংবা আট আনা দিয়ে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়তো যাদুর বাক্সের সামনের টিনের মুখগুলোতে। ভেতরে অপার আনন্দ। ‘রহিম বাদশা আর রূপবানের কাহিনী’, ‘ডালিম কুমার আর মালকা বানুর গল্প’। কিংবা ‘ক্ষুধিরামের ফাঁসি’, ‘সম্রাট শাহজাহান আর মমতাজের তাজমহলের গল্প’। একটার পর একটা ছবি আসতো। আর সুর ধরে সঙওয়ালা গান গেয়ে সেই কাহিনী বলে যেতেন। যেন চোখের সামনে ভেসে আসতো জীবন্ত ছবি।
মেলা-পার্বণ ছাড়াও কখনো কখনো বায়োস্কোপের সেই লাল বাক্স কাঁধে নিয়ে সঙওয়ালারা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে ধান চাল ও নগদ অর্থের বিনিময়ে এসব কাহিনী দেখাতেন। সে অনেকদিন আগের কথা। গ্রামীণ জনপদে বায়োস্কোপের বাক্স নিয়ে আলখেল্লা পড়া কোন ব্যক্তি ঢুকলেই ছোটবেলায় দল বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়তো। বাবা-মার কাছে বায়না ধরতো বায়োস্কোপ দেখার জন্য। তখন বায়োস্কোপ দেখা মানেই বড় আনন্দ।
আজকালকার সন্তানেরা বায়োস্কোপ কি? দেখতে কেমন? তা জানেই না। উঠতি প্রজন্মের প্রতিনিধিরা দলছুটের 'বায়োস্কোপ' গানটির কারণে নতুন করে বায়োস্কোপের সাথে পরিচিত হওয়ার যে সুযোগ পেয়েছিল তা কেবল গান আর ছবির ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন হয়ত বিশেষ কোন উপলক্ষ্যে এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তবে সময়ে কালের অতল গহব্বরে আজ হারিয়ে গেছে একদা আনন্দের অন্যতম উতস বায়োস্কোপ।
টকিজ (Talkies):
বায়োস্কোপের অনুকরণ। আঞ্চলিক ভাষায় একে টকি বলে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে আবিষ্কৃত নির্বাক ছবির এ বায়োস্কোপে প্রযুক্তির বিকাশের সাথে এক পর্যায়ে কথা সংযোজিত হয়।তখন এর নাম হয় টকি (Talkie)। কালক্রমে টকি নাচ, গান, নাটক আর যাত্রাপালার পাশাপাশি একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে স্থান করে নেয়। জেনারেটর, প্রজেক্টর, ১৬ মিমি ফিল্ম, টানানো পর্দা ইত্যাদি বিরাট বহর নিয়ে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে টকি প্রদর্শনের আয়োজন করা হত।
শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে টকি অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। যে কোনো জটিল বিষয়কে সহজ-সরল ও আকর্ষণীয়ভাবে জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে এর বিকল্প নেই। তাই নিরক্ষর, পিছিয়ে পড়া গ্রাম্য মানুষের চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ। বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর দারুণ আকর্ষণ রয়েছে। বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি টকি হিসেবে মূলত প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শিত হতো।
টকিই আমার ব্যক্তিগত জীবনে দেখা প্রথম জিনিষ। তখন প্রাইমারিতে পড়ি। আমাদের এলাকার খেলার মাঠে দেখেছিলাম। এখনও টাটকা সেই স্মৃতি। এই শক্তিশালী মাধ্যমটির কার্যক্রম দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এলেও কারিগরি দিক থেকে টকি পূর্বতন অবস্থায়ই রয়ে গেছে।
এনালগ ক্যামেরাঃ
আজ থেকে দেড় যুগ আগেও ছবি তোলার জন্য এনালগ ক্যামেরা ছিল অন্যতম জিনিষ। বলা বাহুল্য, মানুষের কাছে এর চাহিদা ছিল আকাশ্চুম্বী। আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে একটা ইয়াশিকা ক্যামেরা কিনেছিলাম। এক ক্যামেরা দিয়েই গোটা পাড়ায় ব্যাপক ‘হিট’ হয়েছিলাম। এই ক্যামেরায় ছবি উঠানোর জন্যে ক্যামেরার মধ্যে এক ধরনের ফিল্ম ব্যবহার করা হত। ফুজিফিল্ম, কনিকা ইত্যাদি কোম্পানীর একেকটি ফিল্মে মোট ৩৬টির মত ছবি তোলা যেত। তখন এর দাম ছিল ১১০/- টাকার মত। যেকোন একটির স্ন্যাপ গোলমাল হয়ে গেলেই ওটা বাদ। টেস্টিং এর কোন সুযোগ ছিল না। এতে ছবি তোলার পর ফিল্মটিকে প্রসেস করে (যাকে আমরা ‘ওয়াশ’ বলে জানি)ছবি আউটপুট হত। সিঙ্গেল ফটো ইউজার, বিয়ে বাড়িতে, ভ্রমণে, অফিসিয়াল প্রোগ্রামে এর চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী।
কিন্তু একসময়ের জনপ্রিয় এই ক্যামেরা আজ ডিজিটাল ক্যামেরা, এসএলআর সহ আরও উন্নত মানের ক্যামেরা কাছে তাদের বাজার হারিয়েছে। আর সর্বশেষ বিভিন্ন কোম্পানির স্মার্ট ফোনগুলো আসার পর এনালগ ক্যামেরার সমাধি রচিত হয়েছে।
ভিসিআরঃ
একসময়ের প্রবল জনপ্রিয় ভিসিআর এর কথা বড়ই মনে পড়ে! ৮০র দশকের মাঝামাঝি থেকে ৯০ দশকে এর জমজমাট অবস্থা ছিল। জানা যায়, ১৯৮৬ সালে এদেশে বিনোদনের সহায়ক ইলেকট্রনিক্স ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডার (ভিসিআর) ও ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ার (ভিসিপি) এর প্রচলন শুরু হয়। প্রথমে এ ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রটি শহরকেন্দ্রিক ব্যবহার পরিলক্ষিত হলেও এর পরবর্তী বছর থেকে ক্রমান্বয়ে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।পরবর্তী বছরগুলোতে ঘরে ঘরে ব্যাপক হারে ভিসিআর ও ভিসিপি ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালের পরে দেশে ভিসিডি (ভিডিও কমপ্যাক্ট ডিস্ক)এর প্রচলন শুরু হলে ভিসিআর ও ভিসিপির কদর কমতে শুর করে। এর আরো কিছু সময় পর ডিভিডি প্লেয়ারের আগমনে ব্যাপকহারে সিডি ভিসিডি গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
তখন ক্লাস এইটে পড়ি। হঠাত শুনলাম পাশের বাড়িতে ভিসিআর এনেছে। যুগপত শংকা, ভয় ও প্রবল উত্তেজনা নিয়ে ভাইসহ গেলাম ঐ বাড়ীতে। জীবনে প্রথমবার টিভি-র বাইরে কোন ছবি দেখলাম। তখন দিনগগুলোই ছিল এমন। যেকোন উপলক্ষ্য পেলেই বড় ভাইয়েরা ভিসিআর এনে তা সেলিব্রেট করত। তবে যারা একটু বেশী পাকনা তারা আবার হিন্দি সিনেমার পাশাপাশি কিছু ন্যুড সিনেমাও আনত। আমি অবশ্য কখনো সেই গোপন আসরে থাকতাম না। পরের দিন নানা রকম ফিসফিসানি থেকে তা জানা যেত।
পরবর্তী সময়কালে ধীরেধীরে ভিসিআর, ভিসিপি ও ভিডিও ক্যাসেটের কদর কমতে কমতে একেবারেই বর্তমানে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
গ্রামোফোনঃ
বয়সে তখন খুবই ছোট আমি। আব্বার মুখে ‘কলের গান’ বলে প্রায়ই একটা শব্দ শুনতাম। ‘কেমন শোনা যায় কলের গান’ এটা জানার বড়ই কৌতূহল ছিল। খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, আমাদের এলাকায় একজন আযান দিত বড় অদ্ভুত সুরে (আমি আজ অবধি ঐরকম কন্ঠস্বর শুনিনি)। আমার প্রবল ধারণা ছিল ‘কলের গান বুঝি এমনই’। হাহাহা। পরে জানলাম আমি যেটাকে ‘কলের গান’ বলে জানি সেটার খুব সুন্দর একটা নাম আছে, তাহলো, গ্রামোফোন বা ফনোগ্রাফ। গ্রামোফোন বা কলের গান একটি রেকর্ডকৃত গান শোনার যন্ত্র। ফনোগ্রাফ দিয়ে চাকতিতে শব্দ ধারণ করা হতো। এই চাকতি বা রেকর্ড কলের গানে বাজানো হতো।
এটি একটি অভিজাত গান শোনার যন্ত্র। ১৮৭৭ সালে টমাস এডিসনের যুগান্তকারী এই আবিস্কারের মোহ থেকে শত বছরেও মানুষের মুখ ফেরাতে পারে নাই। এখনও শৌখিনেরা ড্রয়িং রুমে গ্রামোফোন শুনে নষ্টালজিক হয়। তবে এটা শোপিস হিসেবেই এখন টিকে আছে।
প্রথম কিস্তির এখানেই সমাপ্তি। দুই/তিন কিস্তিতে লেখাটি শেষ করার ইচ্ছে আছে। দু’একদিনের মধ্যে এর ২য় কিস্তি দেয়া হবে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ লেখাটি তৈরী করতে বাংলাপিডিয়া, বেশ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকা, অনলাইন পত্রিকা এবং ইন্টারনেটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আরো বেশ কিছু লেখা থেকে সাহায্য নেয়া হয়েছে। আমি সবার প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ভুল-ত্রুটি হলে ক্ষমা করবেন।
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৪