জীবনে বহু রোগের নাম শুনেছি ; যেমন মানব প্রেম,প্রকৃতি প্রেম ,জীবে প্রেম,কিন্তু আত্মপ্রেম বলে যে আদৌ কোন রোগ থাকতে পারে তা আমার মস্তিষ্কে কোন দিন আসেনি।আমি জানতাম সবাই নিজেকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু এই অধিক ভালোবাসাটাওযে এক সময় রোগে পরিনত হয় তা জানতে পারলাম একদিন।
সেদিন অনলাইন এক্টিভিটিসদের নিয়ে বিশাল এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটে।দেশের নানান অঞ্চল থেকে ব্লগারদের আগমন ঘটেছিল,একত্রিত হয়েছিল সেলিব্রিটি অনলাইন এক্টিভিটিস্টরা।উদ্দেশ্য একটাই –অনলাইনে যারা লিখছি তাদের কিছু ধরা বাঁধা নিয়ম শেখানো, কি লেখা উচিত আর কি না।সহজ ভাষায় বলতে গেলে দেশের নাম করা জজ ব্যারিস্টাররা এসেছেন পানি দিয়ে ৫৭ ধারা গুলিয়ে খাওয়ানোর জন্যে।আমি ভাবলাম এইতো সুযোগ আমার খালাতো বোনটাকে এই চান্সে কিছু শেখানো যাবে।মেয়েটা কলেজের গন্ডিও পার হয়নি ,কিন্তু সারাদিন ফেইস বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকে।ক্ষানিক হাসে,আবার ক্ষানিক বাদে বিরহের স্ট্যাটাস দেয়।আর ঘন্টায় ঘন্টায় প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন অনেকটা ডাল দিয়ে ভাত খাবার মতোন অবস্থা।
যেমন ভাবনা তেমন কর্ম করে ফেললাম।খালতোর হাতে নোটবুক আর কলম ধরিয়ে দিয়ে পাশের ডেক্স টেনে বসলাম।তখন আইনের প্রয়োগ আর লেখার সীমাবদ্ধতা নিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ন আলোচনা আরম্ভ হয়ে গেছে,এর মধ্যে দর্শক শারি থেকে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে,মঞ্চ থেকে উড়ে আসছে ভাড়ি ভাড়ি উত্তর।এর মাঝেই আমার মোবাইলে নোটিফিকেশন এলো-জুহি হ্যাজ আপডেট এ স্ট্যাটাস।আমি স্ট্যাটাস অপেন করলাম,দেখি খালতো অনুষ্ঠান নিয়ে কিছু লিখেছে নিশ্চই।স্ক্রীনে টাচ করতেই গোটা গোটা অক্ষরে লেখা তাকিয়ে রইলো,পুরো ইংলিশে না।ভেঙ্গে ভেঙ্গে-fling bore…
আহা মেয়েটা সেই কোন সকালে বাশি পেটে বের হয়েছে ,খারাপ তো লাগবেই।আমি ফিসফিস করে কানের কাছে গেলাম-টেনশন নিস না। একটু পরেই লাঞ্চ দিবে,বিরানী আছে।
কিন্তু বিরানীর আশ্বাস দিয়েও কোন লাভ হলো না,তার বাঁকা মুখ বাঁকাই রয়ে গেল।একটা বাজতেই ব্রেকের ঘন্টা বাজলো,মনোরম খাবারের গন্ধ ভেসে আসছে ডাইনিং থেকে।আমি মুখে পানি দিয়েই খাবারের ইশারায় পা বাড়ালাম।সেই সাথে খুঁজতে থাকলাম আমর খালাতোকে।।কিন্তু আশে পাশে না দেখে খুব চিন্তিত হয়ে বড় লনের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে খানিক দূরেই দেখলাম-খালাতোর মুখ ভরা হাসি,দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এই অনুষ্ঠানের সব চেয়ে বড় দুইজন আলোচক যাদের নাম আমি নিজেও ভালো করে জানতাম না।এখানে এসেই প্রথম পরিচয়।ওমনি আমার হাতের স্মার্ট ফোন আওয়াজ করে উঠলো-জুঁহি হ্যাজ আপডেট এ ফটো।উৎফুল্ল হয়ে আমি ফোনের দিকে তাকিয়ে আছি।একি সেই হাসি মাখা মুখ যা আমার বোনের মুখ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল খানিক আগেও।স্পষ্ট ইংরেজীতে লেখা –feeling great with……
যাদের নাম লিখেছে তাদের বয়স কম করে হলেও ৬০ বছর।একটি ১৯ বছরের মেয়ের পক্ষে এদের কাজের অবদান সম্পর্কে আইডিয়া পাওয়া সম্ভব নয়,কারন এরা বেশীর ভাগ সময়ই দেশের বাইরে থাকেন।এমন বড় মানুষের সাথে আমার নিজেরো পরিচয় নেই।তাহলে তাদের পেয়ে কেন গ্রেটফুল হতে হবে,তাদের নিয়ে মুখে বিগ সাইজের হাসি দিয়ে কেন প্রোফাইল পিক বানাতে হবে-তাই বুঝতে পারছিনা।নাকি সেলিব্রেটিদের সাথে সেলফি তোলাই মহৎ একটা কর্মের মধ্যে পড়ে।
আমার খালতো সারা সেমিনারে কাজের কাজ একটাই করেছে।ধারা ফাড়া সে কিছুই বোঝেনি,সমানে সেলফি তুলে গেছে,কখোন একা,কখনো বান্ধবীদের নিয়ে,আবার কখনো সেলিব্রেটিদের কাছে দাঁড়িয়ে।আর বড় বড় অক্ষরে লিখে দিয়েছে-flng gr8 at krrishibid….
আত্মপ্রেমের এই রোগীকে ইংরেজীতে বলা হয়- নার্সিসিস্টিক
কিন্তু কিছু ঘটনা দেখে বোঝার উপায়ি নেই এটা আত্মপ্রেম নাকি আত্মঘাত।কিছুদিন আগে টর্নেডোর সামনে
দাঁড়িয়ে এক লোক সেলফি করছিল।ভাবটা এমন –“মরলে মরুম,তবু সেলফি ছাড়ুম না।“
আবার একটা মেয়েকে দেখলাম শেজদারত অবস্থায় হাত বাড়িয়ে সেলফী নিচ্ছে।এই ছবি সে সৃষ্টি কর্তাকে পাঠায়নি,কারন উনি সব দেখতে পান।তাই বন্ধুদের দেখানোর জন্যে নিজের টাইমলাইনে পাবলিক করে দিয়েছে।
দাদার মৃত দেহের পাশে হাসি মুখে নাতির সেলফি –good bye grandpa…-এই ঘটনাতো অনেক পুরোন।গরু –ছাগলের গলা ধরে সেলফি না দিলে এখন কোরবানীই হয় না। ঈদের দিন পুরো ফেইসবুক জুড়ে কেবল রক্তা-রক্তি চিত্র,তার পাশে হাসি মুখের সেলফি।টানা তিন দিন ফেইসবুক খুলিনি ভয়ে।এই কিছুদিন আগেও বিষধর সাপের সাথে সেলফি তুলতে গিয়ে তার কামড় খেয়ে একজনকে হাসপাতালের বিল গুনতে হয়েছে এক কোটি ১৬ লাখ ৫৮ হাজার টাকা।
আমরা ভুলেই যাই ,নিজের অপরাধ জগতের কোন কিছুই আমরা অনলাইনে দিতে পছন্দ করিনা।যা দেই সবটাই ভালো বা পবিত্র ধরে নিয়ে দেই যা অন্যের জন্যে মোটেও সুখকর নয়।আর যদি সত্যি কথাই আমরা প্রকাশ করতে চাইতাম তাহলে হাইজাকাররা কবেই স্ট্যাটাস দিয়ে সেলফি দিত-feeling great, just hacked a laptop.
আমি সেই সব স্ট্যাটাস সমৃদ্ধ সেলফির জন্যে অপেক্ষা করি প্রতিদিন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৫৩