somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘চাকা’র গমনপথে

২০ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


‘চাকা নাটকের একটি দৃশ্য

আগস্ট মাস এলেই ভর করে খানিক শঙ্কা। এমাসটিকে মনে হয় মৃত্যুমুখর মাস। ইতিহাসের বর্বরোতম অনেক অধ্যায়ের জন্ম হয়েছে এই মাসেই। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আনবিক বোমার ক্ষত এখনো দগদগে ঘায়ের মতোই আমাদের মানবিকতার শরীরে। স্বদেশ ভূগোলের ইতিহাসেও রয়েছে বিপুল বেদনার গল্প। আগস্ট মাসেই স্বপরিবারে হত্যা করা হয় এ দেশের স্থপতিকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও আমরা শোকাবহ অনেক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। রাজনৈতিক সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, অন্যতম প্রধান দুই কবির প্রয়াণ, দুই চলচ্চিত্র নির্মাতার নিদারুন মৃত্যু যে মাস ধারণ করে আছে, তাকে সমীহ না করে উপায় কি? আর এ মাসেই কি না এক মৃতকে অনামা গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার আখ্যানের মঞ্চায়ন দেখতে হাজির হলাম নাট-মন্ডলে। দিনটি ছিল ২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট। সন্ধ্যার আকাশ। কিছুটা কালচে মেঘ জড়ো হয়েছে। দীর্ঘ লাইন প্রেক্ষাগৃহের বাইরে। ঠিক ৭ টায় ইস্রারাফিলের শিঙ্গার মতোই বেজে ওঠে ধ্বনি। সবাই প্রবেশ করে আলো-আঁধারির ঘরে। নীলার কণ্ঠে তখন অবিরত সুরের স্রোত। পাতা আর ফুল নিবেদনে মঙ্গলাচরণ পর্ব শেষ হলে অকস্মাৎ লালচে আলোয় একজন মঞ্চে থাকা গোলাকার উঁচু পাটাতনে দাঁড়িয়ে চক্রাকারে ঘুরে বাদ্য বাজাতে বাজাতে সবাইকে যেনবা আহ্বান জানান আজকের প্রদর্শনী দেখবার। শুরু হয় ‘চাকা’। তরুণ মেধাবী নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তীর হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ প্রথমবারের মতো সেলিম আল দীনকে মঞ্চায়ন করে। এ ক্ষেত্রে তারা বেছে নেয় অসামান্য কথাশৈলীতে গাথা কথানাট্য আঙ্গিকের প্রথম রচনা ‘চাকা’। বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার অংশ এই প্রযোজনা।



‘চাকা’ নাটকের স্রষ্টা সেলিম আল দীন

অপঘাতে মৃত এক যুবকের লাশ বহনের গল্প ‘চাকা’। এলংজানি হাসপাতাল থেকে ডাক্তারের নির্দেশে বাহের নামীয় এক গারোয়ান একজন প্রৌড় ও তরুণ এই দুইসঙ্গীসহ লাশটিকে লেখা ঠিকানায় পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিতে বাধ্য হয়। তাদের সঙ্গে থাকে হাসপাতালের প্রতিনিধি সাঁওতাল ধরমরাজ। কিন্তু কাগজে ভাসমান অক্ষরে চিত্রিত গন্তব্যের কোন খোঁজ মেলে না কোথায়। লাশটি ক্রমশ পচে যেতে থাকে। গন্ধ বেরোয়। কোনো গ্রাম একে গ্রহণ করতে সম্মত হয় না। সমাহিত করার জন্য একটুকরো ভূমির ব্যবস্থাও কেউ করে না। অতঃপর লাশটিকে যারা ঠিকানায় পৌঁছে দিতে চেয়েছিল তারাই তার সহমর্মী হয়ে ওঠে। কোন এক নদীর তীরে লাশটিকে মাটিচাপা দেয় পরম মমতায়। গল্পের এই আপাত সহজ চলনে একে একে যুক্ত হয় সাঁওতাল সৃষ্টিতত্ত্ব, কারবালার বেদনাবহ ঘটনার টুকরো।
প্রায় দুই যুগ আগে ঢাকা থিয়েটার জামিল আহমেদের নির্দেশনায় ‘চাকা’ মঞ্চায়ন করেছিল। শিল্পোত্তীর্ণ ওই প্রযোজনা আজ মিথের পর্যায়ে। আজ এই সময়ে আবার সুদীপ চক্রবর্তীর হাত ধরে মঞ্চে ফিরে এল ‘চাকা’। তিনি ভূমিসমতল বৃত্তমঞ্চকেই ‘চাকা’ মঞ্চায়নের জন্য উপযুক্ত ভেবেছেন। এটি একই সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্যসংলগ্ন আবার নাট্যের নামাকরণের সঙ্গেও মিলে যায়।


নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী

মাত্র ৭ জন পরীক্ষার্থী ও কয়েকজন শিক্ষার্থী দিয়েই মঞ্চে রূপ পেয়েছে নাটকটি। পৌনে ২ ঘণ্টার এই প্রযোজনায় নির্দেশক লেখকরচিত প্রায় সবটুকু আধেয়ই মেলে ধরেছেন মঞ্চে। ফলে মাধ্যমভিন্নতা থাকলেও নির্দেশকের পাশাপাশি সমভাবেই বিচরণ করেছেন লেখক। সেলিম আল দীনের রচনা মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে যা প্রায় বিরল।

শিক্ষার্থী অভিনেতৃ বাহেররূপী মাহ্জাবীন, প্রৌঢ়রূপী নুসরাত, তরুণ শকুরচান সুশান্ত, ধরমরাজ রফিকুলের চরিত্রানুগ অভিনয় এককথায় মনকাড়া। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের বয়স অতিক্রম করে চরিত্রের বয়স, ভঙ্গি, চলন, বলনকে যেভাবে জড়িয়ে নিয়েছিলেন তা মুগ্ধতা জাগায়। কথকত্রয় মেহেদী, ইফাত, লাবণী বর্ণনার পাশাপাশি অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চরিত্রে নিজেদের ব্যাপৃত করেছিলেন যখন তখন তা বিশ্বাসযোগ্যতায় ঘাটতি তৈরি করেনি মোটেও। পোশাক চরিত্রানুগ আর তা আমাদের দেশজ ঐতিহ্যকে মান্য করে পরিকল্পিত। মেকআপের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আলো বৃত্তাকার মঞ্চটিতে পথ দেখিয়েছে যথাযথভাবেই। সঙ্গীতের পরিকল্পনা সুন্দর।

মহড়া থেকেই এই প্রযোজনাটিকে অনুসরণ করছি। একটি নাটককে মঞ্চে সার্থক করে তুলতে যতটুকু পরিশ্রম, সময় এবং নিষ্ঠার দরকার হয়, তার ঘাটতি চোখে পড়েনি কোথাও। গরুরগাড়ি চালনার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য মানিকগঞ্জে যাওয়া, সাঁওতালদের জীবনাচরণ আর সংস্কৃতি বোঝার জন্য রাজশাহী ভ্রমণ, নাট্যকারকে উপলব্ধি করার জন্য তার সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা ইত্যাদি নানাবিধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তবেই তারা মঞ্চের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। আর তার ফলাফলও আমাদের চোখের সামনেই নান্দনিক এক উপস্থাপনার মধ্যদিয়ে উদ্ভাসিত।


জামিল আহমেদ নির্দেশিত ঢাকা থিয়েটারের ‘চাকা নাটকের একটি দৃশ্যে শিমূল ইউসুফ ও ফওজিয়া শিবলী

চরিত্রাভিনয় এবং কথক বিযুক্ত করার মধ্যদিয়ে সুদীপ নাটকটিকে সাফল্যের তীরে পৌঁছে দিয়েছেন ঠিকই। তবে কথক আর চরিত্রের অভেদাত্মক যে রূপ, যা আমাদের ঐতিহ্যনিঃসৃত সেই অতুলনীয় ম্যাজিকের অভাবটুকু বোধ করেছি। এরমানে এই নয় যে, প্রত্যেক নির্দেশককেই একই ধারার অনুবর্তী হয়ে নাট্যপ্রযোজনায় আসতে হবে। বৈচিত্র্যের মধ্যদিয়েই স্বাতন্ত্র্য এবং রূচির বিকাশ ঘটে। নইলে সোনালী ধান বহনে অভ্যস্ত গরুর গাড়িতে কেনই বা লাশ তোলা হয়, শস্য তো জীবিতের প্রয়োজনে, মৃতের জন্য নয়!

চাকার অন্তিমে যখন কৃত্রির নীলচে আলোয় লাশ নামীয় সাদা কাপড়টিতে মাটি বলে শুকনো পাতা দিয়ে ঢেকে দেয়া হচ্ছে, যখন বিশের কোটার এক সুশ্রী তরুণী ষাটোর্ধ্ব এক প্রৌড়ের ভূমিকায় আকাশবিদারী পুঁথিপাঠে কারবালার করুণমৃত্যুর শ্লোক উচ্চারণ করছে, যখন তার আর অপরাপর সঙ্গীদের ক্রন্দনে ভেসে যাচ্ছে ছোট্ট প্রেক্ষাগৃহটি, যখন আশপাশের সবার চোখে জল, যখন আমার বিপরীত দিকে বসা ভারতীয় অভিনেত্রী শাহানা গোস্বামীকেও চোখ মুছতে দেখি, তখন মনে হয়, তরুণ এই অভিনেতৃগণ তবে স্পর্শ করতে পেরেছেন দর্শকের সর্বান্তকরণ। একটি নাটকের সাফল্যের শিরোপা এরচেয়ে বেশি কিছু কি রয়েছে? মনে হয় না।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:১২
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×