somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তমসাকালের অর্থবহ প্রযোজনা

২০ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দিনটি ছিল ২০১৩ সালের ২৭ এপ্রিল। সন্ধ্যা সাতটায় ঢুকলাম শিল্পকলার জাতীয় নাট্যশালায়। দেখব পদাতিক নাট্য সংসদের (টিএসসি) নয়া প্রযোজনা ম্যাকবেথ। কী অবাক! ঠিক এক বছর আগে এই দিনের একই ক্ষণে আমি ছিলাম মঞ্চে। ঢাকা থিয়েটারের দ্য টেম্পেস্ট-এর উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়েছিল সেদিন। এখন বছরের আবর্তনে সেই আমি দর্শকসারিতে! এই এক বছরের মধ্যে দুই দলের নাট্যপ্রযোজনায় ‘কমন’ শুধু একজন—উইলিয়াম শেক্সপিয়র।নাট্যশালার ভেতরে অন্ধকার, মূল মঞ্চে চোরা আলো আর তাতে আভাসিত হয়ে আছে একটি দাবার ছক। খাড়া, দণ্ডায়মান। দাবা খেলা যাঁরা জানেন কিংবা বোঝেন, রাজা, মন্ত্রী, সেপাই ইত্যাদি রাজকীয় ঘুঁটি ও চালের বিষয়টি তাঁদের অজানা নয়। ফলে ম্যাকবেথ-এর কাহিনি কিংবা এ-সম্পর্কিত কিছু না-জানা একজন দর্শক অনায়াসে একটি রাজন্যবর্গকেন্দ্রিক নাট্য—এ পূর্বাভাস নিয়ে নিতে পারেন মুহূর্তেই। মজার বিষয়, প্রথমে বুঝতে পারিনি, ওই ছক, প্রতিটি পৃথক বাক্স আর এই বাক্সকেন্দ্রিক জাদুই প্রকৃত অর্থে এই প্রযোজনার প্রাণ।তরুণ উদ্যমী নাট্যনির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী পাশ্চাত্যের পরিবেশনা আঙ্গিকেই সাজিয়েছেন ম্যাকবেথ-এর দৃশ্যপরম্পরা। তাতে ওই চারকোনা বাক্সগুলো কখনো রাজদরবার, কখনো গহিন বনের পথ, কখনো প্রাসাদ, কখনো ক্ষমতালিপ্সার সিঁড়ি, আবার কখনো বা ধাবমান বৃক্ষের অর্থে রূপান্তরিত হয়েছে। মঞ্চে সেটের এই চলমানতা, এই বহুবিধ ব্যবহার স্মরণকালের কোনো প্রযোজনায় চোখে পড়েনি। পাশ্চাত্যের প্রয়োগ-কৌশলের মধ্যেও সেটি পৃথক কোনো চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে—এই প্রযোজনা থেকে এ নান্দনিক অভিজ্ঞতাটুকু দর্শক নিয়ে নিতে পারবেন অনায়াসে।

এর আগে যাঁরা নাটকটির মঞ্চায়ন দেখেছিলেন, তাঁদের কারও কারও কাছে অভিনয়ের খামতির কথা শুনেছিলাম। বসে ছিলাম সেই প্রস্তুতি নিয়ে। অথচ চোখে পড়েনি তেমন গুরুতর কোনো খামতি; বরং একদল তরুণ অভিনয়শিল্পীর প্রবল উদ্যমই তো প্রকাশ পেয়েছে প্রতিটি মুহূর্তে। প্রধান চরিত্র রূপায়ণকারী শিমুলের দেহকাঠামোয় মানানসই ছিল বীর ম্যাকবেথ। বলতে পারি, প্রায় নবাগত হিসেবে সমগ্র জীবন বলার মতো একটি চরিত্রে ভালোভাবেই উতরে গেছেন তিনি। লেডি ম্যাকবেথরূপী সায়কা উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর কূটচালের প্রকাশে সাবলীল পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। ব্যাংকো চরিত্র রূপায়ণকারীর ভঙ্গিতে স্বাতন্ত্র্যের ঝলক আছে।

কিন্তু এই তিন চরিত্রের বিপরীতে আর কোনো চরিত্র তেমন আধিপত্য দেখাতে পারেনি। তবে সেটা অভিনয়শিল্পীদের ব্যর্থতা নয়, চরিত্রগুলোই খানিকটা ম্রিয়মাণ।

তবে সৈয়দ শামসুল হকের মাধুর্যমণ্ডিত ভাষায় অনূদিত এই নাটকের সংলাপ উচ্চারণে আরও একটু সতর্কতা প্রয়োজন। সেটি যেমন সংলাপের অন্তর্গত তাৎপর্যের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি শাব্দিক উচ্চারণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই নাট্যদলে সবে যাত্রা শুরু করা ম্যাকবেথ আগামী দিনের মঞ্চায়নগুলোয় এই সামান্য ঘাটতি পূরণ করে নেবে বলে বিশ্বাস রাখি।

নাটকটিতে সংগীত আর আলোর পরিমিত ব্যবহার লক্ষণীয়। কারণ, ট্র্যাজেডি নাটকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মূল নাট্যক্রিয়াকে সংগীত আর আলোর বিশেষ ব্যবহারে পর্যুদস্ত করে তোলার একটা প্রবণতা থাকে। এখানে সেটি ঘটেনি। ফলে দর্শকের পক্ষে মূল নাটকেই অধিক মাত্রায় মনোনিবেশ করা সম্ভব হয়। পোশাকে তেমন বাহুল্য চোখে পড়েনি; বরং তা ছিল চরিত্রানুগ।

সুদীপ চক্রবর্তী নাট্যপরিকল্পনা ও নির্দেশনা প্রসঙ্গে এক স্থানে বলেছেন, ‘ম্যাকবেথ উপভোগের জন্য নির্মিত নয়।’ বিনয়ী সুদীপের এ কথা সর্বৈব সত্য নয়। ‘ট্র্যাজেডি’ মাত্রই আমরা ‘ক্যাথারসিস’-এর মুখোমুখি হই। সেও একধরনের উপভোগ বটে। নাট্যদর্শনে নিজের ভেতরে যে অনুতাপ আর হাহাকারের সৃষ্টি এবং পরক্ষণে তা থেকে পরিত্রাণের যে শিক্ষা, সে তো উপভোগের নৌকা বেয়েই সুবর্ণ তীরে পাড়ি জমানো।

আমাদের জাতীয় জীবনের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ক্ষমতালিপ্সার চোরাবালিতে এই দেশকে বারবার ঠেলে দিয়েছি অন্ধকারে। চারপাশে নানা অপশক্তির আস্ফাালন। সেই অপশক্তির প্রেতাত্মাদের প্ররোচনায় আমাদের বিবেক বিক্রি করে দিচ্ছি প্রতিনিয়ত। এই ঘোর তমসাচ্ছন্নকালে পদাতিকের ম্যাকবেথ খুব প্রাসঙ্গিক আর অর্থবহ প্রযোজনা। সেখানে পরাক্রমশালী বীরের বীরত্ব যেমন আছে, আছে ক্ষমতার মোহ ও তার ক্ষয়—শেষ পর্যন্ত নতুন আশাবাদ। আমরা সবিস্ময়ে দেখি, বীর ম্যাকবেথ যেন বা বাংলাদেশেরই একটি মানবীয় রূপ, যে মহান আর কল্যাণময় হতে পারার বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছিল; কিন্তু ভুল বিবেচনা আর সিদ্ধান্তের চোরাবালিতে ডুবে শুধু নিজেকেই শেষ করেনি, বিশাল স্বপ্নেরও মৃত্যু ঘটিয়েছে, যেমনটা ঘটে চলেছে বাংলাদেশে।

ম্যাকবেথ প্রযোজনায় নানামুখী স্রোতকে একসূতোয় গেঁথেছেন সুদীপ চক্রবর্তী। পদাতিকের ম্যাকবেথ অর্জন করুক অন্ততপক্ষে শত রজনী মঞ্চে থাকার গৌরব।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:২৭
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×