somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্বিতীয় জন্মের আগে

২২ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাত চারটা বেজে চেতাল্লিশ মিনিট।
আমাকে যখন পিরোজপুর সদর হাসপাতাল থেকে এম্বুলেন্সে তোলা হয় তখন ঝাপসা চোখে উল্টাক্ষরে লেখা বড় হরফের AMBULANCE লেখাটিকে দেখি। 'মায়ের দোয়া এম্বুলেন্স'।
এম্বুলেন্সের নামও যে 'মায়ের দোয়া' হয় তা আমি জানতাম না। বাল্যকাল থেকেই টেম্পু আর বেবি টেক্সিতে 'মায়ের দোয়া' নামটি দেখেই আমরা অভ্যস্ত। টেম্পোওয়ালাদের মায়েদের প্রতি তাদের একটা বিশেষ টান আছে বোধহয়। মায়ের সেবা করুক না করুক মায়ের দোয়া নিয়েই দিনের যাত্রা শুরু করতে চায় এরা। আমার এম্বুলেন্সও মায়ের দোয়া নিয়েই যাত্রা শুরু করেছে বলে আশা করা যায়।

ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সি বিভাগের সামনে যখন আমাকে নামানো হলো একটা ট্রলি নিয়ে সামনে আসলো একজন।
'কি সমস্যা রোগীর? ভর্তি করাইছেন?'
'ওহ আচ্ছা শ্বাস কষ্ট? গলাতে টিউমার?'

'ইএনটিতে নিতে হবে। ৫২০ টাকা দেন,আমিই সব ব্যাবস্তা কইরা দিতাসি'

কোন কিছু বুঝে উঠবার আগেই আমার বউ ললিতা ৫২০ টাকা লোকটাকে দিয়ে দিল। লোকটাকে দেখে দালাল মনে হলো। কিন্তু বিপদের সময় ফেরেশতা আর শয়তানের মধ্যে পার্থক্য করার বোধটা থাকেনা। মিনিট বিশেক পর লোকটা একটা অফহোয়াইট পেপার নিয়ে এসে উপরের দিক ছুটছে, আমাকে নিয়ে। কাগজের উপর বোল্ড হরফে লেখা আছে 'রোগী ভর্তি ১৫টাকা'। ১৫ টাকার কাজ ৫২০ টাকায় হলো। যাক, এইসব নিয়ে দু:খ করলে চলে না। এই শেষ রাতে কাউকে হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে পাওয়া গেছে এই বড়।
হাসপাতাল আমার ভাল লাগতোনা কখনোই। পুরো হাসপাতাল জুড়ে থাকে ফিনাইল এর গন্ধ। এই গন্ধকে আমার মৃত্যুর গন্ধ্যের মত লাগে। মৃত্যু মনেহয় আমাকে ডাকছে, তাই এই গন্ধকে আজ থেকে আমার প্রিয় গন্ধের তালিকায় রাখা উচিত। তাহলে মরবার সময় প্রিয় গন্ধের আচ্ছন্নে থেকে মরা যাবে অন্তত।

আমার যখন জ্ঞ্যান ফিরে তখন আমি ৩০৩ নাম্বার ওয়ার্ডে ভর্তি। ওয়ার্ডের ভিতরে জায়গা হয়নি বলে বারান্দায় ফেলে রেখেছে। চোখ মেলে দেখি শত শত মানুষ শুয়ে আছে বারান্দায়। আমার স্ত্রী আমার পাশে বসা।

দু'দিন বাদে সব টেস্ট শেষে নিশ্চিত হওয়া হওয়া গেল আমার ক্যান্সার হয়েছে। তাও ক্যান্সার কোষটা বেশ সিরিয়াস পর্যায়ে আছে। বুঝে গেলাম জীবন সায়াহ্নে চলে এসেছি। জীবনে প্রথমবারের মত 'সিগারেট ক্যান্সারের কারণ' বাণীটাকে সত্য বলে মনে হলো। কত হাসাহাসি করেছি সিগারেট পেকেটের এই অমর বাণী নিয়ে। কিন্ত আজ মনে হচ্ছে একটি সিগারেটের প্যাকেট আমার দিকে তীব্র ব্যাঙাত্মক দৃষ্টি নিয়ে হাসছে এবং বলছে 'সিগারেট ক্যান্সারের কারণ হাহ হাহ হা'! সেই হাসিতে যেন প্রকম্পিত হচ্ছে পুরো হাসপাতালের দেয়াল।

আমার মনে পড়ছে চুয়াল্লিশ বছর আগের একটি সন্ধ্যা। সদ্য শৈশব থেকে কৈশোরে পা দিয়েছি। স্বরুপকাঠি বাজারের স-মিলের পিছনে বসে বন্ধুরা তামাক খেত। একবার বন্ধু অতীশ কলকাতা থেকে বিদেশী সান সিগারেট নিয়ে এসে বললো-
'কি রে বাবুল, খাবিনি?'
'আমি তামাক খাইনা, তোরা খা'-
জবাব দিলাম।
আমার জবাবে ওরা হাসি-ঠাট্টা শুরু করে দিল। 'দুধের বাচ্চা' বলে গালিও দিলো। 'দুধের বাচ্চা'ত্যামন কোন গালি না। কিন্তু আমার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কৈশোরে এমন অনেক সাধারন কথাকেই মেনে নিতে কষ্ট হয়। সকল কথাকেই বিদ্রুপ বলে মনে হয়। 'তুই যা পারিস, আমি তার ডাবল পারি' ভাবটা এই বয়সেই প্রকট থাকে। আমারও ছিলো। সেই সান সিগারেট দিয়েই আমার শুরু। দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে খেয়ে যাচ্ছি। এই দীর্ঘ সময়ে তামাক পাণে শুধু ব্র‍্যান্ড পাল্টেছে, অভ্যাসটা না। ক্যান্সারটা না হলে অবশ্য প্যাকেটের গায়ে এই উদয় বাণীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হতো। যাক আমার আজকের এই দশা আমার জীবনের প্রথম সাড়ীর একটি শিক্ষাও বটে।

আমার চার মেয়ের প্রত্যেকেই স্বামী-সন্তান নিয়ে এখন নিজ নিজ শ্বশুরালয়ে অবস্থান করছে। প্রচন্ড ব্যাস্ত স্বামী সংসার নিয়ে। তাই এই মৃত্যুলগ্নে আমাকে শুশ্রূষা করার জন্যে এক স্ত্রী ছাড়া কেউ পাশে নেই। আমি তার কথাই ভাবছি। আমি মারা গেলে সে মরবেও একা ঘরে। শুনেছি মৃর্ত্যুর আগ মূহুর্তে পানির পিপাসা লাগে। তাকে পানিটাও কেউ এগিয়ে দিতে আসবেনা। আসার মতো কেউ থাকবেনা আসলে।
'আচ্ছা আমার কি পানির পিপাসা লাগছে?'
নাহ! লাগছে না'।
তার মানে আমি বোধহয় এখনি মারা যাচ্ছিনা।

বিকালের খাবার খাওয়ার সময় ওয়ার্ডের ভিতর থেকে তীব্র চিল্লানোর শব্দ এলো। এমন শব্দ গত দুই দিনে বার দশেকের মত শুনেছি। তীব্র চিল্লানো নিশ্চিত করে এক-একটি মানুষের মৃত্যু।
'আচ্চা আমার মৃত্যুর পর ললিতার কান্নার আওয়াজ কতদূর যাবে?
নাকি সে শোকে হতবিহ্ববল হয়ে পড়বে? চোখ দিয়ে পানি পড়বে ঠিকি, বুক ভেঙে কান্না আসবে ঠিকি শুধু আওয়াজ আসবে না। হটাত করে বায়ু শুন্য হয়ে যাবে ললিতার জগত?'
এইসব ভাবতে ভাবতে নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। চোখ দিয়ে জল এলো মনে হচ্ছে। চোখ বন্ধ করলেই আমার সামনে ভেসে আসছে আমার সজ্ঞ্যাত পাপগুলো।
থানার শিক্ষা অফিসের সাধারন একজন ৩য় শ্রেনীর কর্মচারী ছিলাম। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন থেকে 'উপহার' আদায় করেছি বছর জুড়ে। আমার মূল বেতনের চেয়ে উপহারের মূল্যমান হতো দ্বিগুণ কিংবা তিনিগুণ। এই টাকা দিয়ে মেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছে যদিও তারা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার গৌরব অর্জন করতে পারিনি কিন্তু সহজ বাংলায় তাদেরকে 'মানুষ করেছি' বলে দায়ীত্ব শেষ করে দেয়া যায়।

আমিও তাদের দায়ীত্ব শেষ করে ধুমধাম বিয়ের আয়োজন করেছি। খরচও করেছি প্রচুর। কিন্তু আজ আমার পাশে ওরা কেউ নেই। মনে হচ্ছে সেদিনের সেই অসাধু টাকাগুলো আমাকে আজ নিংড়ে খাচ্ছে। কচমচ কচমচ করে চিবাচ্ছে আর চিবাচ্ছে!

মৃত্যুর সময় মানুষের সকল পাপগুলো চোখের সামনে এসে ভাসে। আমারও ভাসছে। ছোট খাট সব পাপগুলো। যেগুলো আমি জেনেশুনে করেছি এবং বারবার করেছি। ঘুষ খেয়েছি, সুদ খেয়েছি, মিথ্যে বলেছি, অত্যাচার করেছি, রিক্সাওয়ালার সাথে দু'টাকা নিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে পিটিয়েছি, ভিক্ষুককে ভিক্ষা না দিয়ে গালি দিয়েছি, ব্যাবিচার করে বউকে ঠকিয়েছি - আজ সবকিছুর জন্যে আমার ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করছে কিন্তু লজ্জায় মুখ যেন ছোট হয়ে আসছে।
মৃত্যুর সময় কতটা অসহায়-ই না হয়ে পড়ে মানুষ। সামান্য পাপগুলোর জন্যে অদৃশ্য কারো কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করে।
আমারও করছে। শ্বাস কষ্টটা বাড়ছে। গলাটা আটকিয়ে আসছে। আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু পারছিনা। হাত-পা গুলো অবশ হয়ে আসছে। ফিনাইলের গন্ধটাও নাকে লাগছে না। ঝাপসে চোখে দেখি ললিতা কাঁদছে। খুব ছোটাছুটি করছে। আমাকে আইসিইউ তে নিয়ে যাওয়া হবে। ইতোমধ্যে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিয়েছে। আমি কিছু বলতে পারছিনা। কিন্তু আমারতো বলতে ইচ্ছে করছে। খুব বলতে ইচ্ছে করছে-
'ঈশ্বর, যাবতীয় পাপের জন্যে আমাকে ক্ষমা করো। ক্ষমা করো। আমি আসলেই তোমার কাছে ক্ষমা চাই'

আচ্ছা, আমি কি এইটা বলতে পেরেছি??
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:০৯
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×