গতকাল সন্ধায় গিয়েছিলাম প্রেসে, যেখানে সদ্য প্রকাশিত “অগোছালো গল্প-কথা” র ১০০ টি প্যাক করে রাখা হয়েছে, সেগুলো আনার জন্য। প্রকাশকের সহকারী বার বার বলেছে যে আমাকে যেতে হবেনা, তিনিই এনে দেবেন, কিন্তু আমার কেন যেন তর সইলোনা, তাই চলেই গেলাম। গিয়ে এক অদ্ভুত শিহরিত অনুভূতি হল! কি সেটা? বলছি......
প্রেসের অবস্থান শ্যামলীতে। ঠিকানা নিয়েই গিয়েছি, তবুও কিছুটা হিমশিম খেতেই হল খুঁজে পেতে। যাইহোক একে ওকে জিজ্ঞাসা করে খুঁজে পেলাম অবশেষে। দারোয়ানকে ঠিকানা ঠিক আছে কিনা আর এটাই প্রেস কিনা জিজ্ঞাসা করাতে সম্মতি দিল যে হ্যাঁ ঠিক আছে, এটাই শ্যামলী প্রেস।
ঢুকলাম ভিতরে। বেশ চুপচাপ। এ ঘর, ও ঘর করে পৌঁছে গেলাম মানুষজন আছে এমন এক ঘরে। যেতে যেতে দেখলাম বিশাল বিশাল সব বইয়ের স্তূপ। কোনটা বাইন্ডিং এর জন্য অপেক্ষা করছে, কোনটার সেট আপ চলছে, কোনটার আঠা লাগছে, আর কোন কোনটা প্যাক হয়ে আছে বিতরণের জন্য।
এসব দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ভিতরের অফিস রুমে। গিয়ে দেখি বেশ বনেদী ঘরানার, স্টাইলিশট, আর কিছুটা নেতা গোছের দুইজন ভদ্রলোক বিশাল আরাম কেদারায় আয়েশ করছেন। সালাম দিয়ে, অনুমতি নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। এবার ওনাদের জিজ্ঞাসা
“কে ভাই আপনি, কোত্থেকে আসছেন?”
“ভাই ১০০ বই প্যাক করা আছে শুনেছি ওগুলো নিতে আসছি”
“কোন বই?”
“ভাই অগোছালো শব্দ-কথা” নামে আছে।
“ওহ, আপনাকে কে পাঠাইছে?”
“প্রকাশকের সহকারীর সাথে কথা হইছে, উনি বললেন এখানে আছে, চাইলে নিয়ে নিতে পারি”
“আপনি কে”
“ভাই আমারই বই”
“আপনার বই মানে, লেখক কে নাম বলেন?”
এইবার আমি একটু বিব্রত, কিভাবে বলি যে আমারই লেখা বই! বেশ সংকোচ আর লজ্জা লাগছে!
ওনাদের আবার জিজ্ঞাসা, “ভাই বলেন লেখকের নাম বলেন?”
“না মানে ঠিক লেখক না, এই এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করি আর তাই নিয়ে দুই চার লাইন লিখি, সেটাই এই প্রকাশকের কোন কারণে হয়তো ভালো লেগেছে, তাই সেই ভ্রমণের কিছু গল্প নিয়ে উনি বই আকারে প্রকাশ করছেন!”
“মানে আপনিই লিখছেন! এটা আপনার লেখা বই!!”
“না মানে, হ্যাঁ সবগুলোই আমার ফালতু গল্প”
এই কথা শোনা মাত্র দুইজন, দুই চেয়ার থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন একসাথে! আমি তো তাজ্জব বনে গেলাম ওনাদের চেয়ার ছাড়ার ধরন দেখে! উঠে দাড়িয়েই ওনাদের একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন আমার দিকে! এবার আমি কিংকর্তব্য...!! কি করবো বুঝতে পারছিলামনা।
অবশেষে যতক্ষণ না বসলাম, ততক্ষণ ওনারা দাড়িয়েই ছিলেন! যে কারণে নিজে অসস্থি থেকে বাঁচতে আর ওনাদেরকে বিব্রত হওয়া থেকে রক্ষা করতে বসতেই হল নিরুপায় হয়ে। এরচেয়েও অদ্ভুত ছিল আমি বসার পরেও ওনারা বসছেননা!! ঘটনা কি?
ভাই আপনারা বসেন না কেন?
এবার আরও আরও বিস্ময়ের পালা...... কি রকম?
ওনারা বললেন, “না ভাই ২০-২২ বছর ধরে প্রেসের কাজ করি, কমপক্ষে হাজার খানেক বইয়ের কাজ করেছি, আজ পর্যন্ত কোন লেখক কে দেখিনি প্রেসে আসছে তার বই নিজে নিতে!! বিশ্বাস হইতেছেনা ভাই!”
আরে ধুর কি বলেন এই সব, সেতো যারা বিখ্যাত তারা আসেনা আর আসবেওনা। আর যারা প্রফেশনাল লেখক তারা আসেনা, আসবে কিভাবে সেই সময়ই যে তাদের নাই। খুব খুব ব্যাস্ত থাকে সবাই-ই। আর আমি তো লেখক নই, এমনি মনের ভ্রমণ ও অন্যান অনুভূতিগুলো নিজের মত করে লিখে ফেলি আর এক আছে আজকালকার ফেসবুক, সেখানে পোস্ট করি। তাই দুই একজন পড়ে, কারো কারো ভালো লাগে হয়তো, কারো মেজাজ খারাপ হয়, কারো কারো আমাকে মারতেও ইচ্ছা হয় জানি। এ আর কি?
এরপর আন্তরিক আপ্যায়ন, আর আমাকে বইয়ের বান্ডিল ছুঁতে পর্যন্ত দিলেননা, লেবার দিয়ে বই গুলো রাস্তায় এনে সিএনজিতে পর্যন্ত তুলে দিলেন। সবচেয়ে বড় কথা সেই রাস্তা পর্যন্ত এলেন ওনারা দুইজন এগিয়ে দেবার জন্য, প্রেসের মালিক হয়েও!!
যেখানে ছিল অদ্ভুত এক আন্তরিকতা আর বিরল এক সম্মান! আমি ওনাদের অনেক অনেক ছোট হওয়া সত্ত্বেও!
সবচেয়ে বড় কথা হল, অন্যরকম একটা ভালোলাগা ছিল গতকালের বই নিয়ে আসার সন্ধ্যাটা, ছিল একটা অন্য রকম প্রাপ্তি, যেটা টাকা-পয়সা বা আনুষ্ঠানিক সম্মাননার মধ্যে পাওয়া যায়না।
এটা এক অন্য অনুভূতি আর ভিন্ন আবেশে ছুঁয়ে গিয়ে, কিছুটা ভেসে যাওয়া, একান্ত উচ্ছ্বাসে.........!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:২৬