somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ কাঁচের মেয়ে

০১ লা অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১০:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




আমার বিয়ে হয়েছিলো মাঘ মাসের উনিশ তারিখে, সেদিন আমি প্রতিদিনের মতই স্কুলে গিয়েছিলাম ক্লাস নিতে, পড়াশোনা ইন্টারের পর আর হয়নি, অভাব অনটনে আর বখাটেদের উৎপাতে সেটা ছেড়ে দিয়েছিলাম তখন প্রায় পাঁচ বছর। আমি ছিলাম প্রাইমেরি স্কুল শিক্ষক। সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর মা বাবা ছোট ভাই বোনের মুখে শুনলাম যে ওই দিনই আমার বিয়ে। বর পক্ষ ঢাকা থেকে রওয়ানা দিয়েছে সন্ধার আগেই পৌঁছে যাবে।
বাবা বলল ছেলে ভালো শহরে থাকে নিজের ফ্যাক্টরি আছে তুলার না কিসের যেন। বাবা নিজেও জানেনা ছেলে ঢাকা কোথায় থাকে কি করে কিংবা কীসের ফ্যাক্টরি, অথচ তার মেয়েকে তার হাতে বিনা দ্বিধায় তুলে দিতে যাচ্ছে সারাজীবনের জন্য।
আমি একটু মিন মিন করে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু মায়ের অসহায় দুঃখী চেহারাটা আমায় বাধ্য করলো অন্যায় মেনে নিতে। বিয়ের রাতে দেখলাম সে মোটেও ছেলে নয় বছর পঞ্চাশ তো হবেই বয়স। ভাসা ভাসা এও কানে এলো আগে আরও দুইটা বিয়ে তার, তারা তাকে ফেলে কোথায় নাকি চলে গেছে। তাদের মতে খারাপ মেয়েমানুষ ছিল তারা। কোন ছেলেমেয়েও তাদের হয়নি।
সে আমার বয়সে দিগুণ এবং বড্ড কুৎসিত ব্যবহার ঠিক যেমন সে দেখতে, আমি চোখ মুখ বুজে সমাজের নিয়মের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে লাগলাম।
এসবের মাঝেই নিজেকে সুখি করার কি যে অদম্য চেষ্টা আমার। আমি এই কুৎসিত লোকের সাথেই দিন দেখি রাত দেখি বাইরে বের হই আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাই।
এইরকম ভাবেই বছর দুই কেটে গেলো আমার কোল আলো করে এলো আমার প্রথম সন্তান। কিন্তু সে মেয়ে বলে স্বামী শশুর শাশুড়ির কাছ থেকে প্রতিদিন শুনতে হচ্ছে অবর্ণনীয় গালি গালাজ, কেননা তাদের বংশের প্রদীপ দেয়ার জন্য ছেলে সন্তান চাই-ই চাই। মেয়ে কোন মানুষের পর্যায়ে পড়ে নাকি!! এভাবে আরও একটা বছর কেটে গেলো, আমার গর্ভে আর সন্তান কেন এখনও আসছেনা তাই তাদের অত্যাচার বেড়েই চলল। আমি কেবল দাঁত মুখ চেপে সহ্য করতে থাকলাম যন্ত্রনা।
এমনি এক সময়ে একদিন এক অদ্ভুত
মেয়েকে দেখলাম। মেয়েটিকে আমি একবার দেখলে হয়ত অত মাথা ঘামাতাম না। কিন্তু পরপর অনেকবার দেখা হওয়ায় ব্যাপারটা আমায় ভাবাচ্ছে।

আমি মেয়েটিকে প্রথম দেখেছিলাম শপিংমলে সে হেসে হেসে ২টা মেয়ের সাথে খুব জমিয়ে গল্প করছিলো, কেউ বলে না দিলেও বোঝা যায় ওই ২টা মেয়ের মধ্যে সেই বস। ওর কথার উপরে একটা কথা বলার সাহস মনে হয় না মেয়েগুলোর মধ্যে কারো কখনো হয়েছে।
মেয়েটিকে রূপবতী বললে ভুল বলা হবে, মেয়েটি যেন তুলনার ও উর্ধে, ওর স্বচ্ছ কাঁচের মতন ত্বক অদ্ভুত তেজী চোখ স্বাভাবিক ভাবেই ভীষণ রকম আলাদা করে ফেলে সবার থেকে।
আমি একটা মেয়ে হয়েও বার বার ঘুরে ঘুরে মেয়েটিকে দেখছিলাম কারন, হয়ত কখনো নিজেকে ওর মতই ভাবতাম কিংবা এই রকম একটা মেয়ে হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম।
মেয়েটা আমার দিকে একবারও তাকায়নি তবু যতবার আমি ওর দিকে তাকাচ্ছিলাম একটু অজানা অস্বস্তিতে চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছিলাম, কেনোনা আমার ভীষণ রকম মনে হচ্ছিলো মেয়েটি এত দূর থেকেও আমার ভেতরটা পড়ে ফেলতে পারছে, ওর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওকি আমার দিকে চেয়ে ঈষৎ হাসলো!! কি জানি!
আমার সাথে আমার দিগুন বয়সের কুৎসিত স্বামী বিকট শব্দ করে নাক দিয়ে গোৎ গোৎ শব্দ করতে করতে আমার পিঠে হাত রাখতে রাখতে বলল খানকী মাগী এদিক ওইদিক কি দেখোস আরও বিয়া বসার শখ হইছে নাকি? জামাই খুঁজোস? আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম! আশেপাশের মানুষ কি শুনতে পেয়েছে কিছু!!!

মেয়েটিকে আরেকদিন দেখলাম ফাল্গুন বাসে, গাড়িতে উঠেই দেখলাম সে সামনের দুই সারি পরেই বসা, সাথে ওই মেয়ে দুইটিও, একি রকম মেয়েটি আমার দিকে তাকাচ্ছে না, যদিও মনে হচ্ছিলো ও আমাকে দেখছে, আমার স্বামী জানালার পাশে বসেছিলো কেনোনা বাসে উঠলেই সে বাঁধ ভাঙ্গা বানের জলের মত হরহর করে বমি করতেই থাকে, এত বমি কি করে যে আসে কে জানে, সেদিনও একই ঘটনা, বাসে উঠেই সে তার বিখ্যাত বমি করা শুরু করলো, মেয়েটি আমাকে দেখছে না কিন্তু আমার কেন মনে হচ্ছে যে ও আমার দিকেই চেয়ে আছে!! এবং এই যে আমি যন্ত্রনায় লজ্জায় একদম মরে যাচ্ছি ও যেন তা বইয়ের পাতার মত পড়ে ফেলতে পারছে।
আমার দিগুন বয়সের স্বামী বমি করেই যাচ্ছে দুই এক সেকেন্ডের জন্য আমার দিকে ফিরে কুৎসিত হাসি হাসছে, একবার বলল মাগী পানি দে পানি নিয়া আসোস নাই!! আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো বাসের জানালা দিয়ে বাইরে ঝাঁপিয়ে পরে পালিয়ে যেতে। আমার বাচ্চা মেয়েটি সেদিনই আমাদের সাথে প্রথম বাসে চড়েছে , সে তার বাবার এই রুপের সাথে পরিচিত নয়, বার বার আমাকে বলছিল মা মা বাবা বোধহয় মরে যাচ্ছে। বাবা বোধহয় মরে যাচ্ছে।
সত্যি সত্যি যদি মরে যেত!!
মেয়েটিকে তৃতীয়বার দেখেছিলাম গুলশান লেকের পাড়ে। সাথে ওই দুই বান্ধবী। প্রথমে তাকে চিনতে পারছিলাম না, সে দিনের আলোয় আরও ঐশ্বরিক রুপে যেন ঝকঝক করছিলো। কাঁচের মেয়ে; মনে মনে বললাম। আমার স্বামী গেছে সামনের এক ঝোপে প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে, রাস্তায় বের হলেই ঘন ঘন প্রকৃতি তাকে ডাকে। আমার ধারনা তার ডায়াবেটিস আছে। ঝোপ থেকে বের হয়ে এসে বলল বেশ্যা নিয়া সংসার করি কোথাও গেলে কত যে জ্বালা! এসব নিয়ে রাস্তা ঘাটে চলা যায়! লজ্জায় ঘৃণায় আমার চোখ ভরে এলো টপ টপ করে পড়তে লাগলো গাল বেয়ে, সারাক্ষন এসবই শুনতে হয় তবু কেন যে এত কষ্ট লাগে!

আমি মেয়েটিকে চতুর্থ বারের মত দেখেছিলাম! অবশ্য ওটা ছিল চতুর্থ এবং শেষবারের মত দেখা। এরপর মেয়েটিকে আর কখনো দেখিনি। যদিও আমি মনে প্রানে চাই মেয়েটির সাথে আমার আর একবার দেখা হোক। ওকে একটু জড়িয়ে ধরে কাঁদার জন্য হলেও আর একবার দেখা হোক।
সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত, আকাশে রূপালী রঙের ঝকমকে চাঁদ উঠেছে। দিনের আলোর মত স্বচ্ছ সব। আমি আমার শশুর বাড়ির চারতলার ছাঁদে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম। সব কিছু এত পরিস্কার!! আমার শ্বশুর বাড়ির সামনে দিয়ে যে মেঠো পথ এঁকেবেঁকে একবারে নালায় যেয়ে মিশেছে সেই পর্যন্ত সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো, এমনি কোন এক সময় উনারা এলো ঠিক আমার পেছনে, যেই না আমি ঘাড় ঘুরাতে যাব এমনি সময় তাদের একজন পেছন থেকে আমার চুলের মুঠি খামচে ধরলো, চুলের মুঠি সম্ভবত আমার স্বামী ধরেছিলো কেনোনা পেছন থেকেও আমি তার মুখের কড়া ওই গ্যাসটিকের পঁচা গন্ধ পাচ্ছিলাম। আমি ধরে নিয়েছিলাম ওটা আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত।
পেছন থেকে উঁচু করে খুবি দ্রুতগতিতে ধাক্কা দিলো কেউ আমাকে।
আমি নীচে পড়ে গেলাম না। পড়ে যেতে যেতে অনুভব করেছিলাম আমি স্থির হয়ে আছি, বাতাসের উপর ভাসছি।
আর খুব মমতা নিয়ে সেই কাঁচের মেয়েটি আমার মুখের দিকে ঝুঁকে আছে, হায় তার দুই চোখ দিয়ে কি দুই ফোঁটা কাঁচের জল গড়িয়ে পড়লো। এত রাতে সে কি করে এলো এখানে!

এরপর কত কিছু হয়ে গেলো আমার আর কিছুই মনে পড়েনা।
আমি আমার মেয়েটিকে নিয়ে এখনও বেঁচে আছি, সে এবার একুশ বছরে পা দিবে। মাঝে মাঝে তার চেহারা কাঁচের মত ঝকমক করে ওঠে আর আমি ভেতরে ভেতরে ভীষণ চমকে যাই।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১০:৫৮
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×