উনি মেয়ে অথবা মহিলা কলিগদের সাথে কথা বলবার সময় তার মুখের দিকে না তাকিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলেন, অফিসের রুলস অনুযায়ী স্যুট বুট ব্লেজার টাই না পড়ে একটু লম্বা কালো অথবা ছাই অথবা সবুজ রঙের পাঞ্জাবির উপর দিয়া ম্যাচিং কটি এবং অবশ্যই মাথায় টুপি পড়েন, সম্ভবত উনার পোশাকের ব্যাপারে অনুমতি নিয়ে নিয়েছেন এডমিন থেকে; হোয়াটএভার সেইটা তার ব্যাপার! উনি হচ্ছেন কোম্পানির আইটি ডিপার্টমেন্ট হেড, আগেরজন চলে যাওয়ায় তার জায়গায় নতুন জয়েন করেছেন, বয়সের তুলনায় চেহারায় প্রচুর লোক দেখানো গাম্ভীর্য, মুখ ভর্তি দাড়ি না থাকলেও যা আছে তাতে বেশ কিছু পাঁক ধরা সত্ত্বেও যুবক ভাব প্রবল কিংবা অত বয়স হয়নাই।
যারা নিউ জয়েন করেন তারা কি জানি কি হয়ে গেছেন কি করতে কি করে ফেলছেন; এই বুঝি সবাইকে চমকে দিয়ে পুরা পৃথিবী উলটাইয়া ফেলবেন একসাথে শত রকম কাজ করে ফেলতে পারেন এবং উনি পুরানো লোকজন থেকে অবশ্যই বেশি জানেন বেশি বোঝেন; তার বেশি বেশি রেসপেক্ট প্রাপ্য এই জাতীয় বিচিত্র আচরণ অধিকাংশই করে থাকেন।
গ্রুপ অফ কোম্পানিস হেডঅফিসগুলোতে শুধু মাত্র মালিক পক্ষের লোকজন এবং ডিরেকটর পোস্টে যারা কাজ করেন এবং ষাট কিংবা ষাটোর্ধ লোকজন যদি ছোট পোস্টে থেকেও থাকেন এই সকল মানুষকে স্যার সম্বোধন করা হয়; কারন অফিসে মামা চাচা বলে ডাকা যায় না, বাকীদের গড়ে সবাইকে ভাইয়াই ডাকা হয় হোক সে এজিএম হোক সে ডিজিএম হোক সে ডিপার্টমেন্ট হেড।
সেই সুন্নতি দাঁড়িওয়ালা ভাইয়ার কথায় আসি, তার সাথে আমার অফিসিয়াল টেকনিক্যাল ডেইলি স্টেটমেণ্ট যা আগে প্রিন্ট কপি দিতো এখন তা তাদের নতুন সফটওয়ারে সম্ভব হচ্ছেনা এবং তা যেন আমি আগের মতই পেতে পারি তাই তাদের পার্সোনাল ওয়েবের কিছু এক্সসেস আমাকে দেবে এই প্রস্তাব তিনি নিজেই আমাকে দিয়ে শুরু হল আমাকে ঘুরাবার পালা। আজ দেই তো কাল দেই, আজ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আসে নাই তো কাজের প্রেশার যাচ্ছে খুব, এইভাবে দিনের পর দিন যায় এক্সেস আর দেয় না।
এই দিকে আমার ডিপার্টমেন্ট হেড প্রচণ্ড ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষায় আছেন রোজ রোজ এক্সেস পেয়েছি কিনা জানতে চাইছেন সুতরাং যেহেতু আমার স্বভাব চার বার/পাঁচ বার সহ্য করার মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং সেই মেয়াদ বার বার পার হয়ে যাওয়ায় আমি তাকে খুবই রুক্ষ ভাবে ধমক দিয়ে কথা বলতে বাধ্য হওয়ায়, তাৎক্ষনিক সে একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে তার মেয়েদের দিকে না তাকিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকার রুলস ব্রেক করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন,
এর কিছুক্ষন পরই সে আমার কাছে আমার ভিজিটিং কার্ড চেয়ে নেয় কেননা ওয়েব ইউআরএল দেয়ার জন্যও তো আমার মেইল এড্রেস লাগবে নাকি।
ওয়েল ভিজিটিং কার্ড দেয়ার কিছুক্ষণ আগেই তাকে অডিটের ইতিমধ্যে কি এক এক্সেল ফাইল মেইল করেছি কাজেই আমার মেইল এড্রেস অলরেডি সে পেয়ে গেছেন সেটা বেমালুম ভুলে গিয়ে আমি তার হাতে আমার ভিজিটিং কার্ড তুলে দিলাম।
তার দুই ঘণ্টা পর আমার ডিপার্টমেন্ট এর একজন নাকে চোখে মুখে আনন্দ নিয়া হাসি লুকিয়ে রাখতে রাখতে কিছুতেই লুকানো যাচ্ছে না এই চেহারা নিয়ে আমার কাছে জানতে চাইলেন ম্যাডাম কি কাউরে ভিজিটিং কার্ড দিছেন?
তার হাসি চাপা চেহারার দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠলো, একলক্ষ্ পার্সেণ্ট শিওর আমার মান ইজ্জত ধুলায় মিশে বাতাসে ভাসতেছে এইরকম কিছু ঘটেছে, শুধু মাত্র আমার ক্ষতি এবং অপমানেই আমার ডিপার্টমেন্ট এর ভাইদের এত আনন্দ।
বললাম ভিজিটিং কার্ড হুজুরকে দিছিলাম ভাইয়া হইছে কি? সে কিছুতেই হাসি চেপে রাখতে পারতেছেনা এমন ভাবে মুখে হাত দিয়া হাসি চাপিয়ে বলল ছেলেদের ওয়াশ রুমের মেঝেতে দেখি কি আপনার কার্ড পড়ে রইছে, আমি বলি কি ব্যাপার কি ব্যাপার ম্যাডামের কার্ড এইখানে আসলো ক্যামনে, পড়ে তুইলা বিনে ফালাইয়া দিয়া আসছি।
তার কথা শুনতে শুনতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যেতে যেতে কোন রকম বললাম আমাকে দেখে বোঝা যায় যে আমি একটা গাধা? মানুষের ন্যূনতম যে বুদ্ধি বেঁচে থাকার জন্য দরকার সেই বুদ্ধিও আমার নাই ভাইয়া, দেখেন আমার দিকে তাকান গাধারে দেখেন, সে হাসি চাপতে চাপতে বলে না ম্যাডাম, জি না ম্যাডাম।
ততোক্ষণে রাগে ক্ষোভে আমার দুই কান দিয়া ধোঁয়া বের হতে শুরু করলো, উনি এইটা করছেন আমার ডেসিগনেশন দেখার জন্য, যেহেতু বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও তাকে দুইটা ধমক দিয়া কথা বলছি কিংবা ভাই বলে কথা বলছি তাই আমি কি পোষ্টে আছি এইটা দেখার জন্যই উনি আমার কার্ড নিয়েছিলেন।
আমি তার সীটে গিয়া আগুন চোখ নীচে নামাইয়া বুঝতে দিতে চাইনা রেগে আছি বললাম ভাইয়া আমার ভিজিটিং কার্ডটা কই?
সে হয়তো কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে তাই তার পকেট, টেবিল, ড্রয়ার সব খুঁজতে খুঁজতে অস্থির, আমি বললাম ওটা পাবেন না, আপনি ছেলেদের ওয়াশ রুমে ফেলেছেন, সে মিন মিন করে বলল মনের ভুলে পকেট থেকে পড়ে থাকতে পারে। তার জবাবে ঠাণ্ডা গলায় শাসিয়ে আমার সীটে চলে এলাম।
এবং রিয়ালাইজ করলাম অবশ্যই আমি অফিসের ইনভাইরোনমেণ্টের সাথে ম্যাচ করে চলার জন্য ফিট না। আমি নিজের মতন চলি মেশিনের মতন কি বোর্ডে, এক্সেলে হাত চালাই, অতিরিক্ত কাজ করি, ফোনে কথা বলিই না, কথা কম কাজ বেশি লজিকে বিশ্বাসী, কারো সাথে খাতির করে চলিনা, কেউ বিপদে পড়লে তাকে যতটুকু পারা যায় সাহায্য করি। আমার আচরণ অফিসের ইনভাইরোনমেণ্টের সাথে ম্যাচ করে চলার জন্য আনফিট ।
চলতে হবে এইভাবে-
১) মুখে হাসি থাকতে হবে সবার সাথে সবসময়, হাহা হিহি ভাইয়া/আপু/ স্যার, ঠিকাছে ঠিকাছে ভাইয়া হেহেহে এক্সেস দিতে দেরি হবে হিহিহি কোন অসুবিধা নাই হাহাহা এই জিনিষ আচরনে থাকতেই হবে।কাজ ডিলে হচ্ছে? হোক তাতে আপনার কি?
২) সারাক্ষন টেবিলে ফাইল মেলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে হবে আর শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে হবে আল্লাহ্ আমার এত কাজ জমে গেছে! এত কাজ! এত কাজ!!
৩) ঘণ্টা খানেক পর পর নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে অকারনে কারনে ফাইল পত্র নিয়ে ছোটাছুটি করতে হবে।
৪) কাজের ফাঁকে ফাঁকে রফিক সাহেব আনোয়ার সাহেব সেলিম সাহেব অমুক সাহেব তমুক সাহেব সবার ঘরের বউ ছেলে মেয়ের খোঁজ খবর এবং তাদের জন্য ভালো ভালো সাজেশন শুনাতে শুনাতে নিজের সম্পর্কে ভালো ভালো কথা অবশ্যই ঢুকিয়ে দিতে হবে।
৫) ভালো ভালো রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার এনে খাওয়াতে হবে।
৬) সত্য মিথ্যা মিশিয়ে নানা গাল গল্প করতে হবে।
৭) অল্প বয়সী মেয়েরা কথা বলতে বলতে বলতে ওড়না পড়ে যাবে।
৮) কাজ করতে করতে মুখ চোখ শুকিয়ে এই দুনিয়ায় নাই এমন ভাব ধরতে হবে।
৯) বেশি বয়স্করা কোন কাজ ভুল করে আটকে গেলে সামান্য ব্যাপারে ডাক দিয়া কান্দন শুরু করতে হবে যেন স্যাররা সেই কান্দন থামাতে টিস্যু এগিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
১০) স্যারদের সামনে তোতা পাখির মতন স্যার স্যার স্যার করতে হবে এবং অন্যদের কাজ নিজের করা বলে চালিয়ে দিতে হবে।
১১) এমনিতে সাধারণ দিনগুলোতে নিজের কাজ আরেকজনের ঘাড়ে দিয়া বিন্দাস ঘুরতে হবে।
১২) প্রোমোশনের আগে মন দিয়া বেশি বেশি কাজ করতে হবে।
১৩) ডেইলি মেইল চেক করে নিয়মিত কোম্পানির এবং নিজেকে আপডেট রাখতে হবে,
১৪) সারাক্ষন ফোনে কথা বলে টাইম পাস করতে হবে।
১৫) আপনি খুব ধার্মিক এই ভাব নিয়াও বেশ উন্নতি করা যায় ।
আরও আরও অসংখ্য পয়েন্ট আছে মনে পড়লে এড করবো।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৪০