জীবনানন্দ দাশ বলেছেন – ‘সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি’। আমরা যারা কবিতা পড়ি তাদের অধিকাংশই কবির এ বাণীকে সত্যি বলে মেনে নেই এবং অনেক ক্ষেত্রে উদাহরণ দেই। যদি তাই হয় তাহলে কবির এ বাণীকে বদলে বলা যায় – ‘সকলেই কবিতার পাঠক নয়, কেউ কেউ পাঠক’। এই যে না বোঝার দায় এককভাবে কবিকে দেওয়া হয়, এর দায় কি পাঠকের হতে পারে না? পাঠক কি মনে করেন না কবিতা পাঠের জন্য তার প্রস্তুতি দরকার? কবিতায় যে নন্দনতত্ত্ব,শিল্প, অলঙ্কারের কথা বলা হয় তা কি তার পাঠের বিষয়ব্স্তু নয়? সাধারণত কবিতার বিশেষত্ব এই যে তাকে দণ্ডায়মান স্কুল শিক্ষকের সামনে মুখস্তপাঠের মতো শব্দুগলো পড়ে গেলে হবে না। তাকে অনুভব করে পড়তে হবে, কিছু সময় তার জন্য বরাদ্ধ রেখে। পাঠকের সে সময়টুকু কি তার আছে? সাধারণত ব্লগে, নেটে যে কবিতা পাঠ করা হয় তাকে আমি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কবিতার সত্যিকারের পাঠ বলবো না। কারণ নেটে একান্ত মনোযোগ দিয়ে অথবা একাগ্রতার সাথে কবিতা পাঠ করা হয় না। একজন পাঠক নেটে এসে অনেকগুলো লেখা একসাথে পাঠ করেন, মতামত দেন। আর এ করতে যেয়ে তার মনোযোগ ভাগ হোয়ে যায় অথচ কবিত তো পাঠকের একান্ত পাঠ দাবী করে। যে কবিতাটি অন্য দশটি লেখার সাথে পাঠ করে গেলেন তা একান্ত নির্জনে, খানিকটা সময় দিয়ে তাকে পাঠ করুন, দেখবেন কিছু ভিন্ন অনুভব হলেও হতে পারে।
সাহিত্যিক ডেভিড ফস্টার বলেছেন- ‘সাহিত্য শুধু মগজের বস্তু নয়, হৃদয়েরও এবং অনুপাতে হৃদয়ের ভাগটাতেই বেশি পড়া উচিত’। তাঁর এ উক্তিটি আমাদের কারও না বোঝার কথা নয়। তাঁর সাথে তাল মিলিয়ে আমিও বলতে চাই ‘কবিতা কেবল চোখ দিয়ে পাঠ করার বিষয় না, হৃদয় দিয়েও তাকে পাঠ করতে হয়’। তবে সব কবিতা বোঝা যাবে তা নয়, তাই বলে একজন পাঠকের ভালো লাগা বা না লাগা সামগ্রিকভাবে ভালো লাগা বা না লাগাকে নির্দেশ করতে পারে না। যে পাঠক সবসময় মনে করেন কবিতার ভাষা সহজ-সরল সহজে বোধগম্য হবে সে পাঠকের চিন্তা ও বোধ শক্তি প্রখর নয়, তারা ভাবনার অতলে ডুব দিয়ে মুক্তো তুলে আনতে পারেন না কেবল জলের ওপর ভাসমান কিছু দেখেই অভিভূত হতে পারেন। তবে অস্বীকার করবো না যে কোনো কোনো কবির কবিতার চিত্রকল্প উদ্ভ্রান্ত-এলোমেলো, কিছু শব্দের কারসাজি থাকলেও তা কোনো বার্তা প্রদান করে না। যে কবি বাস্তবের হাতি আকাশে ওড়ান তার ভাষা পাঠক কেন কবিই বোঝেন কিনা তা বলা মুশকিল।
সাহিত্যের যতগুলো শাখা রয়েছে তার মধ্যে কবিতা প্রাচীন এবং উৎকৃষ্টতম শাখা। কবিতা এমন এক শাখা যা বুঝতে হলে অনুভব করতে হবে, আর অনুভবের জন্য দরকার সাধনা যেমনটা লালনসঙ্গীত বুঝতে সাধনার প্রয়োজন। আর্ট ফিল্ম (Art Film) বলে যে ফিল্ম (Film) তৈরি হয় তার সবশ্রেণীর দর্শক হয় না, ঠিক তেমনি সাহিত্যের অন্যান্য শাখার সাধারণ-অসাধারণ সব শ্রেণীর পাঠক থাকলেও কবিতার পাঠক নির্দিষ্ট শ্রেণীর। আধুনিক কবিতা প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশ বলেছেন –‘মানুষের মনের চিরপদার্থ কবিতায় বা সাহিত্যে মহৎ লেখকদের হাতে যে বিশিষ্ট্তায় প্রকাশিত হয়ে ওঠে তাকেই আধুনিক সাহিত্য বা আধুনিক কবিতা বলা যেতে পারে’ (কবিতার কথা)। আধুনিক কবিতার এ ধারাটি নিরীক্ষাধর্মী এবং এর মধ্যে মহৎ উদ্দেশ্য নিহিত। যুগে যুগে কবির সাতন্ত্রই তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে সময়ের বিচারে তাই আধুনিককালে কবিতার এই নিরীক্ষাকে না বোঝার দায় খুব সহসাই দেওয়াটা বুদ্ধিমান পাঠকের কাজ হবে না।
জীবনানন্দ দাশে’র উক্তিটি আবার দিয়ে শেষ করবো। ‘সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি’। সুতরাং সব লেখাকে কবিতা এবং সব লেখককে কবি ভাবার হয়তো গুরুতর কোনো আবশ্যকতা নেই (কবিতা ও কবির ক্ষেত্রে) । যিনি সত্যিকারের কবি তাঁর কবিতার কতটুকু সমঝদার পাঠক আমি- এ-ভাবনাই আমাকে বরং ভাবাক। সত্য তো এই যে, প্রকৃত কবি সমকালের বিচারে খুব একটা সমাদৃত হয় না, মহাকাল তাঁকে ঠিক একদিন গ্রন্থিত করে ইতিহাসে পাতায় আর আমরা হয়তো এই বলে আফসোস করতে থাকি, হায়! তিনি সত্যিকারের কবি ছিলেন।