somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

৩য় পর্ব : বাংলা বানানে যত বিভ্রান্তি

২৯ শে মার্চ, ২০১৪ বিকাল ৫:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রবীন্দ্রনাথ একবার ক্ষেদ করে বলেছিলেন, আমরা লিখি সংস্কৃত ভাষায়, কিন্তু সেটা পড়ি প্রাকৃত বাংলায়।

হ্যাঁ, আমরা এমন এক অদ্ভুত ভাষা ব্যবহার করি যার বানান পদ্ধতি আর উচ্চারণ পদ্ধতি এক নয়।

অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস বলেন, আমাদের ভাষার লিখিত রূপ আর উচ্চারিত রূপ সর্বত্র এক নয়। কারণ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের বানান পদ্ধতি মূলতঃ সংস্কৃত ভাষা প্রভাবিত এবং উচ্চারণ পদ্ধতি প্রাকৃত প্রভাবিত। ফলে লিখিতরূপে যেখানে সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসরণ; উচ্চারিতরূপে যদি প্রকৃত ব্যাকরণের অনুসরণ হয় তবে এই দ্বৈরাজ্যিক প্রভাব, আমাদের ভাষার এই নৈরাজ্যিক অবস্থার জন্য দায়ী।

একটু উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। যেমন- বিশ্ব, আত্মীয়, নি:স্ব, ভস্ম, বিদ্বান, উদ্যান। বানান অনুযায়ী পড়তে গেলে পড়তে হবে - বিশবো, আতমীয়, নিসবো, ভসমো, বিদবান, উদদেন। অথচ আমরা উচ্চারণ করি- বিশশো, আত্তীঁয়, নিস্সো, ভস্সো, বিদ্দান, উদ্দান।

মূলত এগুলো সংস্কৃত লিখিতরূপে আলাদা ছিল এবং উচ্চারণও ছিল ভিন্ন। কিন্তু বাংলাতে বানানটি নেওয়া হলো, কিন্তু উচ্চারণটি পৃথক হয়ে গেল। ফলে আমাদের লেখায় যেমন লিখতে হয়, বলাটাও তেমনি শিখতে হয়।

বানানের এমন বিভীষিকা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরো লিখেন, বাংলা বর্ণমালায় আর-একটা বিভীষিকা আছে, মূর্ধন্য এবং দন্ত্য ন’এ ভেদাভেদ -তত্ত্ব। বানানে ওদের ভেদ, ব্যবহারে ওরা অভিন্ন। মূর্ধন্য ণ’এর আসল উচ্চারণ বাঙালির জানা নেই। কেউ কেউ বলেন, ওটা মূলত দ্রাবিড়ি। ওড়িয়া ভাষায় এর প্রভাব দেখা যায়। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : বাংলাভাষা-পরিচয়)

এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রখ্যাত বাঙালি শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, লেখক ও দার্শনিক হুমায়ুন কবির (১৯০৬-১৯৬৯) লেখেন, বাংলাদেশ ও ভাষার দুর্ভাগ্য, সে ভাষার সংস্কারের ভার পড়েছিল সংস্কৃত-শিক্ষিত পণ্ডিতদের উপর।..... ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সংস্কৃত পণ্ডিতরা নিল বাংলায় সাহিত্য রচনার ভার। পরিচিত চলিত অসংস্কৃত কথার বদলে তারা আনল বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দ...। বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’ আমাদের সময়ে ম্যাট্রিক ক্লাসের পাঠ্য ছিল। ক্লাসে তা পড়াবার ব্যর্থ চেষ্টায় মাস্টার এবং ছাত্রের মাধ্যে হাসির পাল্লা লেগে যেত। সে দাঁত-ভাঙ্গা ভাষা হাসির হররায় টিকল না বটে, কিন্তু মরেও বাংলা ভাষার কাঁধে ভূতের বোঝার মত চেপে রইল। রবীন্দ্রনাথের কল্যাণে সে বোঝা অনেক খানি নেমেছে। কিন্তু আজও বাংলা ভাষার উপর তার প্রভাবের পরিচয় মেলে। (হুমায়ুন কবির: বাংলা ভাষা ও মুসলমান সাহিত্য; মাসিক মোহাম্মদী, ১৩৪১, জ্যৈষ্ঠ; বাংলাদেশ : বাঙালী - আত্মপরিচয়ের সন্ধানে, পৃ ১৩৭)

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহবুবুল হক তাঁর 'বাংলা বানানের নিয়ম' (১৯৯১) গ্রন্থে বলেছেন, "বাংলা বানান নিয়ে আমাদের বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্খলা ও সমস্যার যেন শেষ নেই। এর কারণ, একদিকে বাংলা বর্ণমালার উচ্চারণের সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার লিখনপদ্ধতির অসংগতি, অন্যদিকে বাংলা বানানের নিয়ম সম্পর্কে আমাদের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত অজ্ঞতা।"

একটু পেছনে ফিরে দেখি। ঊনবিংশ শতকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) আমলেও ইংরেজ পাদ্রি জন মারডক বিদ্যাসাগরকে বাংলা বানান সংস্কারের এক সুলিখিত প্রস্তাব দিয়েছিলেন (Letter to Babu Iswarchandra Vidyasagar on Bengali typography)। তখন সে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় নি। এ প্রসঙ্গে বরুণকুমার মুখোপাধ্যায় লেখেন, "বাংলা ভাষা শিক্ষা ও বাংলা মুদ্রণ সহজতর করার জন্য ক্রিশ্চিয়ান ভার্নাকুলার এডুকেশন সোসাইটির এজেন্ট পাদ্রি জন মার্ডকের ভাবনা ও প্রযত্নের কথা এখানে উল্লেখ্য। স্কুলপাঠ্য বই প্রকাশনায় দীর্ঘকাল যুক্ত থেকে তিনি বাংলাভাষার প্রয়োগকৌশলগত যে সব অসুবিধার সম্মুখীন হন তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি বিদ্যাসাগরকে লেখা একটি খোলা চিঠিতে বাংলা অক্ষর সংস্কারের কয়েকটি প্রস্তাব করেন।" (বাংলা মুদ্রণের চার যুগ- বরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন--আনন্দ পাবলিশার্স, কোলকাতা, পৃঃ-১০০)।

মারডক তাঁর চিঠিতে বাংলা ভাষার জন্য যে প্রস্তাব দেন তা বিদেশির নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখা বাংলা ভাষার জন্য এক সুদূরপ্রসারী গতিশীল উন্নয়ন প্রস্তাব। যদিও সে প্রস্তাব অনুসারে সে কালে কোন সংস্কারই করা হয় নি, তবু তা এ যুগেও অস্বীকার করা যায় না, বরং এ যুগে সে ধরনের প্রয়াসই যুক্তিশীল মানুষকে টানছে। মারডক (Murdoch) জানতেন যে তাঁর এই প্রস্তাব হয়তো গ্রহণ করা হবে না, তাই তিনি এটাও বলেন যে, "Though the proposal may now be treated with ridicule (পরিহাস), its adoption is a mere question of time." (বাংলা মুদ্রণের চার যুগ- বরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন--আনন্দ পাবলিশার্স, কোলকাতা, পৃঃ-১০০)।

বাংলা লেখা যখন মুদ্রণে যায়, তখন বাংলা বানানের স্থায়ী রূপ পায়। সে সময় সংস্কৃত পণ্ডিতদের প্রভাব থাকায় বাংলা ভাষাটা তখন অনেকটা সংস্কৃৃতের উপভাষায় পরিণত হয়। প্রথমে বঙ্কিমচন্দ্র পরে ব্যাপকভাবে রবীন্দ্রনাথ এ প্রভাব কাটানোর চেষ্টা করেন। তারা ভাষার ক্ষেত্রে অনেকটা সফল হলেও কিন্তু বানানটা পুরোপুরি সংস্কৃত প্রভাবমুক্ত করতে পারেন নি। তাই বাংলা বানানে কিছু ঝামেলা রয়ে যায়। কারণ বানানের ক্ষেত্রে আমাদের গোড়ায় গলদ। ফলে বানান নিয়ে দেখা দেয় অনেক বিতর্ক-বাহাস। আর এতে করে কতগুলো পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। যেমন --

১. বানান হবে উচ্চারণ অনুসারে :
বাংলা বানান সংস্কৃতি প্রভাবিত হওয়ায় এবং অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চারণ অনুযায়ী না হওয়ায় একদল ভাষাবিদের মতে বর্তমান বাংলা বানান কৃত্রিম। তারা মনে করেন, বাংলা বানানকে ঢেলে সাজাতে হবে। সবক্ষেত্রে বানান হতে হবে উচ্চারণ অনুযায়ী। এ মতের পুরোধায় ছিলেন প্রিন্সিপ্যাল আবুল কাসেম। তিনি ১৯৬৩, ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালের বানান সংস্কার কমিটি সমূহের সদস্য, বাংলা একাডেমির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও বাঙলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন। তিনি এ ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নেন। তাঁর প্রণীত বইগুলোতে তিনি তার নিজস্ব বানান প্রয়োগ করেছিলেন। যেমন, বিজ্ঞান শব্দের বানান লেখতেন বিগ্যান।

এ ধরনের বানানকে অনেকটা সমর্থন করে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত ভাষাবিদ অধ্যাপক অরুণ সেন বেশ ক্ষোভের সাথে বলেন, “সংস্কৃত বা তৎসম শব্দের বানানে যে রক্ষণশীলতা তা কিন্তু চিরকালের। সেই ভাষার বহু চিহ্নই অনেকাংশে তাদের অর্থ হারিয়ে ফেলেছে ঠিকই, সংস্কৃত চর্চাও প্রায় বিলুপ্তির পথে, তবু তৎসম শব্দের চেহারা সেই চিহ্নসহ এমন গেঁথে আছে লোকস্মৃতিতে যে তাকে ‘বৈজ্ঞানিক’ বুদ্ধিতে লোপ করার চেষ্টা করলে বাঙালির মনোজগতের শৃঙ্খলাকেই ব্যাহত করা হবে। বাংলা ভাষার তৎসম শব্দের এই ‘অবৈজ্ঞানিক’ বানানই এখন বাঙালির সংস্কৃতির অঙ্গ।” (বানানের অভিধান : বাংলা বানান ও বিকল্প বর্জন একটি প্রস্তাব-- অরুণ সেন। প্রতিক্ষণ, ডিসেম্বর, ১৯৯৩, পৃঃ-১৯)

পশ্চিমবঙ্গের প্রবন্ধকার মনোজকুমার দ. গিরিশ লেখেন, "দুস্খে কৃষ্ণ বোল্যা ডাকেন নহেত সোমান। কৃষ্ণ মুখে তব গুন য়নেক সুন্যাছি" এটাই তো বাংলা বানান। প্রাচীন দিনের সমাজবৃত্তে বানান নিয়ে বেশি উদ্বেগ ছিল বলে মনে হয় না, বরং শব্দের উচ্চারণ নিয়ে বেশি সংপৃক্ত ছিলেন তাঁরা। উচ্চারণই তো ভাষা, বানান হল সেই ভাষাকে বহন করার মসীধৃত লিপি ব্যবস্থা। উচ্চারণ সজীব, বানান নির্জীব। মাটির বাংলা বাদ দিয়ে সংস্কৃতের বাংলা দিয়ে কাজ কতটা হবে?

২. ডানপাশে স্বরচি‎েহ্নর ব্যবহার :
একদল ভাষাবিদের বক্তব্য হলো, বাংলা সব কার-চিহ্ন বর্ণের ডানপাশে বা বর্ণের পরে বসবে। কারণ পৃথিবীর প্রায় সকল ভাষায় স্বরচিহ্ন বর্ণের পরে বসে। ইংরেজিতে vowel যখন ধ্বনি হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন consonant-এর পরে বসে। যেমন, cat, sit, red, head অর্থাৎ বর্ণের বিভিন্ন ধ্বনি প্রকাশ করতে তার পরে স্বরবর্ণ বা স্বরচিহ্ন ব্যবহার করা হচ্ছে। ফরাসিতে তেমন অবস্থা। আরবি, ফার্সি, উর্দুতেও একই অবস্থা। কিন্তু বাংলাতে কিছু কিছু স্বরচিহ্নের উল্টো অবস্থা। ’ি ‘, ’ে ‘, ’ৈ' - এ তিনটি কার চিহ্ন বর্ণের পূর্বে বসে। সংস্কারকারীদের বক্তব্য হলো, ৈ-কার যৌগিক স্বরচিহ্ন, অর্থাৎ ‘ওই’ স্বরে প্রকাশ করা যায়। এর কোন প্রয়োজন নেই, একে লোপ করা যায়। কিন্তু ি, ে - কার নিয়ে যত সমস্যা। এগুলো বর্ণের পূর্বে বসে। বর্ণের পূর্বে বসা একটা ভুল ব্যাপার। এ জন্য এ দুটোকে বর্ণের পরে বসাবার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন, ‘কি’ যেন ‘ই(ি)ক’ লেখা হয়। বিদেশিদের কাছে এটা অনেক উদ্ভট ঠেকে। তারা বলে, “তোমরা লেখ ‘ইক’--(ি )ক-- আর পড়ো ‘কি’। তাজ্জব ব্যাপার বটে!”

ব্যঞ্জনের ডানে বা পরে বসাবার ক্ষেত্রে তাদের কিছু প্রস্তাব হলো, ‘ী’-কার যেহেতু বাংলায় উচ্চারণ নেই, সেহেতু ‘ী’ (দীর্ঘ ই)-কার লোপ পাবে। তাই দীর্ঘ ই-কারের চিহ্ন ‘ী’-টিই হ্রস্ব ই-কারের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা যায়। উল্লেখ্য, তাদের এ ধারণা থেকেই ইউনি কোডে কার চিহ্নগুলো বর্ণের পরে টাইপ করতে হয়। কিন্তু টাইপের পর কারচিহ্নগুলো নির্দিষ্ট স্থানে বসে যায়।

এ প্রস্তাব সর্বপ্রথম ১৯৬৭ সালে ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কর্তৃক গঠিত কমিটি প্রদান করে। তবে ধারণা করা হয় ১৯৪৯-এ 'পূর্ববঙ্গ সরকারি ভাষা কমিটি'ও ঠিক এরকম প্রস্তাব করেছিল। এ কমিটির সদস্য ছিলেন ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ১৯৭৮-এ দেশ পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখে ডঃ জগন্নাথ চক্রবর্তী একে জোড়ালো সমর্থন দেন। এছাড়া মনোজকুমার দ. গিরিশসহ পশ্চিমবঙ্গের প্রমুখ ভাষাবিদ এ মতকে সমর্থন করেন।

৩. অপ্রয়োজনীয় কিছু বর্ণ লোপ :
বাংলা ভাষায় এমন কিছু বর্ণ আছে যেগুলোর আলাদা উচ্চারণ নেই। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এমন কিছু বর্ণ পূর্বেই লোপ করেছিলেন। তারপরও কিছু বর্ণ রয়ে যায়। এসব বর্ণের ব্যাপারে খোদ রবীন্দ্রনাথও উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। বিভিন্ন সময় অনেক ব্যক্তি বা কমিটি এসব বর্ণ লোপের প্রস্তাব দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এগুলো এখনো বাতিল করা হয় নি।

সেই ১৯১৪ সালে সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরীর মন্তব্য দেখুন। তিনি লেখেন, “বাংলায় যখন শ,ষ এবং হস্ত, স্রাব ইত্যাদি শব্দে ছাড়া স-এর; ণ, ন-এর; ঙ, ঞ, ং-এর উচ্চারণের কোনো তফাৎ নাই, তখন সেগুলিকে রাখিয়া ছেলেপিলের অনর্থক মাথা খাওয়া কেন, তাহা বুঝি না। যখন প্রাকৃতে উচ্চারণ অনুসারে বানান হয়, তখন তাহার কন্যা বাংলায় কেন হবে না?” (সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী : বঙ্গ ভাষার গতি; ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলন, ১৩২১ বৈশাখ)

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বর্ণ লোপের প্রস্তাব আসে। যেমন-
১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমির বানান-সংস্কার কমিটি বাংলা বর্ণমালা থেকে ঙ, ঃ, ঈ এবং ী-কার বাদ দেবার সুপারিশ করে।

১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আগ্রহে গঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পর্ষদ বাংলা বর্ণমালা থেকে ঈ ঊ ঐ ঔ ঙ ঞ ণ ষ এবং ঈ-কার, ঊ-কার, ঐ-কার এবং ঔ-কার ইত্যাদি বর্জন, যুক্তবর্ণের উচ্ছেদ, ব-ফলা ও য-ফলার পরিবর্তে বর্ণদ্বিত্ব গ্রহণ, জ-য এবং স-শ ব্যবহারের জন্য নতুন নিয়ম উদ্ভাবন -এর প্রস্তাব করে।

১৯৮০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলা বানানের নিয়ম সমিতি’ বাংলা বর্ণমালা থেকে ঙ, ঞ, ণ, ঈ-কার এবং য-ফলা বাদ দেবার প্রস্তাব করে।

১৯৪৯-এ 'পূর্ববঙ্গ সরকারি ভাষা কমিটি', ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমির বানান-সংস্কার কমিটি, ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পর্ষদ ইত্যাদি কমিটি যেসব প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাদের প্রস্তাবকে সে সময় সন্দেহের চোখে দেখা হতো। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের গবেষক মনোজকুমার দ. গিরিশ-এর বক্তব্য প্রনিধানযোগ্য। তিনি উপরোক্ত কমিটিগুলোর বিভিন্ন সংস্কারকে সমর্থন দিয়ে বলেন, "১৯৪৯-এ 'পূর্ববঙ্গ সরকারি ভাষা কমিটি' ঠিক এরকম প্রস্তাব দেওয়ায় তাঁদের "বাংলাভাষা বিরোধী" বলে সে যুগে সন্দেহ করা হতে থাকে। কারণ তখনকার বাংলাদেশে তথা পূর্বপাকিস্তানে বাংলা ভাষাকে বিকৃত করার প্রয়াস ছিল বাংলাভাষা-বিরোধী সরকারি তরফে। সে কারণে সেই প্রস্তাব অঙ্কুরে মারা যায়। কিন্তু এবার তো তার ধুলো ঝেড়ে নতুন করে উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ এটা ছিল এক সঠিক এবং অতি আধুনিক উদ্যোগ, কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তা মানুষের মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছিল।"

৪. আরো কিছু দীর্ঘস্বর বর্ণ বা কার যোগ :
কারো কারো মতে ঈ, ঊ তুলে দেওয়ার তো কোন প্রয়োজনই নেই, বরং আরো কিছু দীর্ঘ স্বর বর্ণের সংযোগ প্রয়োজন। বাংলায় দীর্ঘ আ (া), দীর্ঘ এ (ে) , দীর্ঘ ও ( ো) নেই। ইরেজিতে ee, ea, ey, ei, ie এভাবে পাশাপাশি দুটো vowel ব্যবহার করা যায়, তাদের বাড়তি alphabet দরকার হয় না স্বর দীর্ঘ করার জন্য; অন্য রোমান ভাষাগুলোয় বিভিন্ন রকমের অ্যাক্সেন্ট মার্ক আছে; আরবীতেও ‌'আলিফ' 'ইয়া' 'ওয়া' 'মাদ-চিহ্ন' আছে স্বরকে দীর্ঘ করার জন্য। থাই ভাষায় দেখা যায় প্রতিটি স্বরবর্ণের পাঁচটি করে অ্যাক্সেন্ট আছে হ্রস্ব, দীর্ঘ, চাপা, তীক্ষ্ম বিভিন্ন রকম উচ্চারণের জন্য। এই ব্যবস্থাগুলো শুধুই তাদের নিজ নিজ ভাষার উচ্চারণে সহায়তা করে তাই নয়, বিদেশি শব্দ উচ্চারণেও কাজে লাগে। বাংলায় যেহেতু দুটো স্বরবর্ণ পাশাপাশি ব্যবহারের বিধান নেই, বা আরবীর মতো 'মাদ' চিহ্ন নেই, থাইয়ের মতো অ্যাক্সেন্ট নেই; আরো কিছু দীর্ঘ স্বরবর্ণ আমাদের অবশ্যই দরকার আছে। এ মত আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীদের।

৫. আরবির প্রতিবর্ণায়নে দীর্ঘস্বর রাখা

একদলের বক্তব্য হলো তৎসম তথা সংস্কৃত শব্দের জন্য যেমন দীর্ঘ স্বরবর্ণ ব্যবহারের বিধান রাখা হয়েছে, আরবির ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। অনেক সময় দেখা যায়, দীর্ঘ আর হ্রস্ব স্বরের প্রভেদ না থাকলে অর্থই পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। যেমন- সিরাত অর্থ পথ, তা থেকে সিরাতুল মুসতাকীম : সরল পথ। দীর্ঘ ই-কার দিয়ে সীরাত অর্থ জীবনচরিত, তা থেকে সীরাতুন্নবী : নবীর জীবনচরিত। সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ নীতি অবলম্বন করে তাদের গ্রন্থ প্রকাশ করে চলছে।

৬. বাংলা একাডেমির প্রমিত বানান :
বাংলা একাডেমি প্রণীত প্রমিত বানান আমি মনে করি বাংলা ভাষা প্রগতির এ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ অর্জন। বাংলা একাডেমির বানানের ব্যাপারে সবাই একমত না হলেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, পত্র-পত্রিকা (ব্যতিক্রম প্রথম আলো বানানরীতি, সেটাও বাংলা একাডেমির বানারীতির অনেক নিকটবর্তী) সহ সর্বত্র এটা গ্রহণ করায় বাংলা বানান বাংলাদেশে অনেকটা সার্বজনীন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে যদিও এখনো বিভিন্ন বানান দেখা যায়, এখনো সেখানে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।

বানানের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন কোনো সর্বজনগ্রাহ্য নিয়ম চালু করা সম্ভব হয় নি। বাংলা একাডেমি ১৯৯২ সালে এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। কমিটির রিপোর্ট জরিপের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠানো হয়। প্রাপ্ত মতামতের ভিত্তিতে ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রকাশ করে, যা ১৯৯৮-এ পরিমার্জিত হয়ে ২০০০-এ পুনরায় সংশোধিত হয়। ১৯৯৪ সালে ‌‌'বাংলা একাডেমী বাংলা অভিধান'-এর প্রথম প্রকাশনা বের হয়।

বাংলা একাডেমীর প্রমিত বানানের নিয়মে অ–তৎসম এবং বিদেশী শব্দের বেলায় ণত্ববিধি ও ষত্ববিধি মানা হয় নি। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নিয়মে চ–বর্গের পূর্বে সর্বত্র ঞ এবং অঘোষ চ–বর্গের কেবল শ, ট–বর্গের পূর্বে সর্বত্র ণ এবং অঘোষ ট–বর্গের পূর্বে কেবল ষ এবং ত–বর্গের পূর্বে সর্বত্র ন এবং অঘোষ ত–বর্গের পূর্বে স লিখবার সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়েছে। ও, এ এবং অ্যা–স্বরের জন্য পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলা একাডেমী, বিশ্বভারতী এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অভিন্ন।

বাংলা একাডেমী কোনোরূপ বানান সংস্কারের প্রয়াস করে নি, কেবল দু–একটি ক্ষেত্রে বিকল্প বর্জন করেছে। বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম বিশ্বভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানের নিয়ম থেকে খুব দূরবর্তী নয়।

আমি এ দীর্ঘ আলোচনা এ জন্য করি নি যে, এর মাধ্যমে আমি বিভেদকে আরো উস্কে দিব। বরং আমি চেয়েছি, পাঠকরা যাতে বাংলা বানানের ব্যাপারে গভীরতা অর্জন করে। যাতে করে সহজেই বানানকে বুঝতে পারে, শুধু বানান বা বিধি মুখস্ত করতে না হয়।
(চলবে...)

১ম পর্ব - আমরা বাংলা বানান কতটুকু শুদ্ধ করে লেখি? View this link
২য় পর্ব - বাংলা বানান : আসুন এক ছাতার নিচে View this link

তথ্যসূত্র :
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; বাংলাভাষা-পরিচয়
২. বাংলাদেশ : বাঙালী - আত্মপরিচয়ের সন্ধানে
৩. বরুণকুমার মুখোপাধ্যায়; বাংলা মুদ্রণের চার যুগ, দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন--আনন্দ পাবলিশার্স, কোলকাতা
৪. অরুণ সেন; বানানের অভিধান : বাংলা বানান ও বিকল্প বর্জন একটি প্রস্তাব
৫. অধ্যাপক মাহবুবুল হক; বাংলা বানানের নিয়ম
৬. বাংলা একাডেমী বাংলা বানান-অভিধান
(সফট কপির জন্য ব্লগার সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই-এর নিকট বিশেষ কৃতজ্ঞ)
৭. ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলন, ১৩২১ বৈশাখ
৮. মনোজকুমার দ. গিরিশ, বাংলা বানান-- এক হউক, এক হউক, এক হউক
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩০
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×