২
শীতের রাত, আটটা বাজতে না বাজতেই ঢাকা শহরের রাস্তা-ঘাট নীরব হয়ে যায় । আবার কোথাও কোথাও তখনও সবে সন্ধ্যা । ধানমন্ডি ক্লাব থেকে মাইকে ভারতীয় বাংলাগান বাজতে থাকে – বাঁশি শুনে আর কাজ নেই, সে তো ... । তারই মাঝে হাউজির ঘোষকের ভরাট কন্ঠে শোনা যায়, মাথা খারাপ , ফোর এন্ড নাইন ফরটিনাইন । মাথা খারাপ করে দেওয়ার মতই ব্যাপার ! একটু রাত হতেই এলাকার ছেলেপেলেরা সেখানে ভিড় করে, বিভিন্ন এলাকা থেকেও প্রচুর লোক আসে হাউজি খেলতে । হাদি কখনো ওদিকে যায়নি । ও কলোনীর মসজিদে নামাজ পড়ে সোজা বাসায় যায় কিংবা আলো জ্বালিয়ে মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলে বন্ধুদের সাথে । হাদির মা জানালার ধারে বসে অপেক্ষা করেন স্বামীর জন্য । ছেলেমেয়েরা সব খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ে, হাদি ছাড়া । ও পড়ে । ভাত ঠান্ডা হয়ে যায় । ১১টা কখনো ১২টার দিকে হাদির বাবা আসেন । তখন আর মানুষটাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে আতিয়ার মন সায় দেয় না । কিন্তু কলোনীতে কিছু গোপন থাকে না । পাড়াপড়শীদের কাছ থেকে খবর পান, হাদির বাবা হাউজি খেলে বিভিন্ন ক্লাবে । তবে ধানমন্ডি ক্লাবে খেলেন না । ঠান্ডা ভাত, তরকারি গরম করে দুজনে খান । তোহা সাহেব সিগারেট ধরান, আতিয়া হাই তুলতে থাকে । খুক খুক করে কাশেন, আতিয়া নিষেধ করে সিগারেট খেতে । উনি নির্বিকার ।
হাদির মার আর ভালোলাগে না । তোহার সাথে সরাসরি কথা বলা দরকার । কিন্তু সময় বের করতে পারেন না । ছুটির দিনেও মানুষটা কি-সব কাগজ-পত্র নিয়ে বসেন । আগে ওদের নিয়ে কত জায়গায় বেড়াতে যেতো, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় যেতো । হাউজি মানুষটাকে ফরটিনাইন করেছে – কি যে বাজে জুয়ার নেশা !
মানুষ যন্ত্র না । দিনের পর দিন রাত জেগে হাদির মার শরীরে আর কুলায় না । তাছাড়া এই শীতে ফাহাদের প্রায়ই ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে । ঘুমের মধ্যেই কেঁদে ওঠছে । কাঁদতে কাঁদতে জোরে জোরে শ্বাস নেয় – চোখ উল্টে যায় । একদিন আতিয়া ছেলের পাশে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়লেন । তখন হাদি ওর বাবা আসলে দরজা খুলে দিল ।
উনি ঘরে ঢুঁকে গম্ভীর গলায় বললেন, তোর মা কই ?
‘ফাহাদের শরীর ভাল না । মা ওকে নিয়ে ঘুমিয়েছে ।’
‘হুম ।’
হাদি মাকে ডাকতে যায় । ঘর অন্ধকার । লাইটের সুইচ টিপে আলো জ্বালে । দেখে মার একটা হাত ফাহাদের পিঠে আর ফাহাদের ছোট্ট হাতটা মার গালে – বড় সুন্দর দৃশ্য । হাদি সুইচ অফ করে দেয় । রান্নাঘরে যেয়ে কেরোসিনের চুলা জ্বালিয়ে বাবার খাবার গরম করে ।
টেবিলে খেতে বসে তোহা সাহেব চোখ তুলে ছেলের দিকে তাকাতে পারেন না । নিজেকে অপরাধী মনে হয় । নরম গলায় ডাকেন, হাদি ।
‘জ্বি বাবা ।’
‘আমি তোদের খুব কষ্ট দেই, না ?’
হাদি বানিয়ে কথা বলতে পারে না । তাই চুপ থাকে ।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উনি আবার খাওয়ায় মন দেন ।
দুজনেই কম কথা বলে । তাই কথা আর এগোয় না ।
উনি খাওয়া শেষ করে ওঠে একটা সিগারেট ধরান আয়েশ করে । কিন্তু কাশিটা উনাকে মোটেই আরাম দিচ্ছে না । খুক খুক কাশিটা ক্রমেই জোরালো হয়ে উনার প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তোলে । কিছুক্ষণ পর পর কফ ফেলতে ফেলতে হাঁপিয়ে ওঠেন । বেশ ঠান্ডা । তাও উনার গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে যায় । পিঠে একটা নরম হাতের স্পর্শে বুঝতে পারেন আতিয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেছে । প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় ও বললো, এত কাশছো কেন ?
মুখে জোর করে একটু হাসির ভাব আনার চেষ্টা করে তোহা সাহেব । তারপর বলে, ও কিছু না ।একটু পানি খাওয়াও তো ।
হাদি পাশেই দাঁড়িয়েছিল । ও বললো, মা, আমি আনছি ।
কাশির দমকে পানিটাও ঠিকমত খেতে পারছেন না । অনেকক্ষণ সময় নিয়ে খেলেন ।
একটু সুস্থির হলে আতিয়া স্বামীকে বললো, তোমার গেঞ্জিটা বদলে দিই ?
উনার এখন আর কথা বলার শক্তি নেই । মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন ।
আতিয়া ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হাদি, আলনা থেকে বাবার একটা গেঞ্জি নিয়ে আয় তো । স্বামীর গেঞ্জিটা খুলে উনার মন খারাপ হয়ে যায় । হাড্ডিসার রুগ্ন দেহ । উনি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে স্বামীকে জড়িয়ে ধরেন । তোহা সাহেব তাঁর লম্বা সরু সরু আঙুল দিয়ে স্ত্রীর চুলে বিলি কেটে দেন । একটু লজ্জ্বা লাগছে । ছেলে কখন ফিরে আসে । আবার ভালোও লাগছে ।
নিস্তব্ধ রাতে সামান্য শব্দও কানে আসে । হাদির পায়ের আওয়াজ পেয়ে আতিয়া সরে যায় । খুব স্বাভাবিক গলায় স্বামীকে শুধায়, তোমার বুকে তেল মালিশ করে দেই ।
‘দাও ।’
‘হাদি, রান্নাঘর থেকে সরষের তেলের বোতলটা নিয়ে আয় তো ।’
হাদি বোতলটা নিয়ে আসে । আতিয়া বলেন, বাবা, অনেক রাত হয়েছে, তুমি শুয়ে পড়ো ।
তেল মালিশটায় তোহা সাহেবের খুব আরাম লাগে । ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে । আতিয়া নরম সুরে বলে, তুমি কালকে অবশ্যই ডাক্তার দেখাব । ওষুধ না খেলে এই কাশি যাবে না ।
‘হু ।’
আতিয়া আরো অনেক কথা বলে, তোহা সাহেব ঘুমের ঘোরে শুধু ‘হু’, ‘হা’ করে যান ।
গেঞ্জিটা আর পরানো হয় না । আতিয়া পরম মমতায় লেপটা স্বামীর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরেন । রাজ্যের ঘুম চোখে নেমে আসে ।
চলবে..
১ম পর্বের লিংক:
০৪/০২/২০১৭ ইং