ইব্রাহীম, বুদ্ধ, যীশু, মুহাম্মদ এদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। সাম্প্রতিক কালে ‘বাব’ ও‘বাহাউল্লাহ’ এই বার্তাবাহকের ক্রম বজায় রেখেছেন।
বাহাউল্লাহ’র অনুসারীদেরকে বাহাই বলা হয়। আরবী শব্দ ‘বাহা’ অর্থাৎ সমুজ্জল থেকে অনুসৃত। বাহাইরা ইশ্বরের একত্রিকরণ, ধর্মের একত্রিকরণ আর মানবকুলের একত্রিকরণে বিশ্বাস করে। সাধারন মুসলিমদের মত এরাও একইশ্বরেই বিশ্বাস করে।
২৩শে মে ১৮৪৪ সালে ইরানের ‘শিরাজ’ শহরে ‘বাব’ জনসমক্ষে ঘোষনা দেবার সাথে সাথেই পারশিয়ান প্রশাসন ও অটোমান সাম্রাজের চক্ষুশূল হন। ‘বাব’ এর পরে ‘বাহাউল্লাহ’র ১৮৯২ সালের মৃত্যুর সময় এশিয়া ও আফ্রিকার ১৩টি দেশে এর প্রসার দেখে গেছেন। তার ছেলে ‘আব্দুল বাহা’ পরে তা ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রসার করেন। এই ধর্মের জন্মভূমি ইরানে এখনো এই ধর্ম নিগৃহীত। ১৯২১ সালে আব্দুল বাহার মৃত্যুর পরে এই ধর্ম নতুন এক রূপ পায়, ব্যাক্তিকেন্দ্রীক প্রচারনার চাইতে একটি সংগঠন হিসাবে কাজ শুরু করে যেখানে নির্বাচিত ও নিয়োযিত দুইধরনের প্রতিনিধি কাজ করে।
২৩শে মে ১৮৪৪ সালে ইরানের সিরাজ নগরীর ‘শিয়া’ ধর্মাবলম্বী ‘সাঈয়েদ আলি মুহাম্মদ’ নিজেকে ‘আল বাব’ ঘোষনা করেন, বাব আরবী শব্দ যার অর্থ ‘দরজা’। তার অনুসারীদের তারপর থেকে ‘বাবী’ বলা হত। তারপর থেকে এইমত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে তৎকালীন ইসলাম শাসকরা এটাকে হুমকী হিসাবে গন্য করে এইমতানুসারীদের বিরুদ্ধে মামলা ও চরম অত্যাচার শুরু করে। তাৎকালীন ‘শাহ’ এর সামরিক বাহিনীও কয়েক জায়গায় এতে জড়িয়ে যায়। বাবকে আটক করা হয় আর ১৮৫০ সালে তাকে হত্যা করা হয়।
বাহাই ধর্মের মূলমন্ত্রঃ
• ধর্মের একত্রিকরণ
• নারী ও পুরুষের সমান অধিকার
• বর্ণবৈষম্য দুরীকরন
• বিশ্ব শান্তি
• বিজ্ঞান ও ধর্মের সামঞ্জস্য
• সত্যানুসন্ধানে নিরপেক্ষ তদন্ত
• বাধ্যতামূলক শিক্ষা
• সহায়ক ভাষা
• সরকারের প্রতি আনুগত্য ও রাজনীতিতে অংশগ্রহন না করা
• ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য দুরীকরন
‘মীর্জা হুসাঈন আলি নূরী’ ‘বাব’ র প্রথম অনুসারীদের একজন। পরে তিনি ‘বাহাউল্লাহ’ নাম ধারন করেন। ১৮৫২ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয় পরে তিনি বলেন ‘সিয়ায়চাল’ নামক জেলে থাকা কালীন ১৮৫৩ তার কাছে ‘বাব‘ এর বানী আসে যে তিনি ‘বাব’ এর উত্তরাধীকার নির্বাচিত হয়েছেন।এর কিছুদিন পরেই তাকে তেহরান থেকে অটোমান সাম্রাজের বাগদাদে বহিস্কার করা হয় পরে কন্সটান্টিনেপল (বর্তমান ইস্তানবুল) এবং পরে আড্রিয়ানপোল পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৮৬৬ সাল থেকে নিজেকে ইশ্বর প্রেরিত বার্তাবাহক দাবী করে বিশ্বের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের কাছে চিঠি পাঠান, তাদের মধ্যে, রানী ভিক্টোরিয়া, পায়স নাইন্থ, ও নেপোলিয়ান থ্রি ও আছেন।
১৯৬৮ অটোম্যান সুলতান ‘আব্দুল আযিয’ শেষবার বহিস্কার করেন শাস্তিমূলক এলাকা ‘আক্কা’য় যা এখন ইসরায়েল নামে পরিচিত। পরে ধীরে ধীরে তার উপর নিষেদ্ধাজ্ঞা সিথিল করা হয়, আক্কায় তার বাসায় থাকতে দেয়া হয় যদিও তার পরিচিতি ছিল বন্দী হিসাবে। এখানেই তিনি ১৮৯২ সালে মারা যান। বাহাইরা ‘বাহজী’তে তার কবরকে তাদের ‘কিবলা’ মনে করে এবং প্রতিদিন প্রার্থনার সময় সে দিকে মুখ করে। বাহাউল্লাহ বেশ কয়েক্টি বই লিখে গেছেন, তাদের মধ্যে কিতাবে আকদাস, ‘কিতাব-ই-ইকান’কে ধর্মীয় বই এর সন্মান দেয়া হয়।
স্থানীয়, আঞ্চলিক ও রাষ্টীয় পর্যায়ে নয় সদস্যের ‘স্পিরিচুয়াল ’ ধর্মীয় বিষয় দেখা শোনা করে। ১৯৬৩ সালে প্রথমবার ‘ইউনিভার্সাল হাউস অফ জাস্টিস’ গঠন করা হয়, এতে বিভিন্ন বিষয় দেখার জন্য বিভিন্ন কমিটি আছে যারা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। পুরুষ মহিলা ২১ বছর বয়সী যে কোন বাহাই এই কমিটির সদস্য হবার জন্য আবেদন করতে পারে।
১৯৮৬ সালে বাহাইরা দাবী করে সারা দুনিয়ায় তাদের সংখ্যা ৪৭ লক্ষ ৪০ হাজার যা ৪.৪% হারে বাড়ছে। ১৯৯১ সালে তার ৪০ লক্ষ আর ২০০১ সালে প্রকাশিত ‘দি ওয়ার্ল্ড খ্রিশটিয়ান এন্সাইকোপডিয়া’ জানায় এই সংখা প্রায় ৭১লক্ষ যা প্রায় ২১৮টি দেশে ছড়িয়ে আছে। ২০০৪ সালে প্রকাশিত ‘দি ওয়ার্ল্ড আলম্যানাক এ্যান্ড বুক অফ ফ্যাক্ট’ বলেঃ অধিকাংশ বাহাই এশিয়া মহাদেশে বসবাস করে প্রায় ৩৬লাখ, আফ্রিকায় ১৮লাখ ল্যটিন আমেরিকায়ন নয় লাখ। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ভারতে প্রায় ২২লাখ পরে ইরান প্রায় তিন লাখ ৫০হাজার আমেরিকায় দেড় লাখ। তবে কোন দেশেই সংখ্যাধিক্যের ধর্ম ‘বাহাই’ না।
১৯৯২ সালের মতে ‘ব্রিটানিকা বুক অফ দি ইয়ারের’ মতে বাহাই হচ্ছে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ধর্মের মধ্যে দ্বিতীয়। এটা ১.৭% হারে বাড়ছে। ২৪৭টি দেশের প্রায় ২১০০ সম্প্রদায় এটা প্রতিনিধিত্ব করে। প্রায় ৮০০টি ভাষায় বাহাই ধর্মগ্রন্থ অনুদিত হয়েছে।
বাহাই আঈন ‘কিতাব-ই-আকদাস’ থেকে অনুসৃত। বাহাই প্রার্থনা দুইটি ভাগে বিভক্ত, বাধ্যতামূলক ও সাধারন প্রার্থনা। ১৫ বছরের অধিক বয়স্ক প্রত্যেক বাহাই প্রতিদিন একবার বাধ্যতমুলক প্রার্থনা করে।
• পর নিন্দা পরচর্চা নিষিদ্ধ।
• সুস্থদেহের অধিকারী সব বাহাই মার্চের ২ থেকে মার্চের ২০ তারিখ পর্যন্ত সুর্যোদয় থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস রাখে।
• বাহাইদের জন্য এ্যাল্কোহল, ও মাদক নিষিদ্ধ (ডাক্তারের ব্যাবস্থাপত্র ছাড়া)
• বিবাহের সংজ্ঞ্যা একটি পুরুষ ও একটি নারীর মধ্যে হতে হবে, পার বৈবাহিক ও সমকামীতা নিষিদ্ধ
• জুয়া নিষিদ্ধ
• উগ্রবাদীতা নিষিদ্ধ
• লোকিকতা নিষিদ্ধ বাধ্যতামূলক প্রার্থনা ছাড়া
বাহাই বিবাহ অত্যন্ত সাধারন, আনুষ্টানিকতা বিবর্জিত, শুধু নারী পুরুষ উভয়ে দুইজন স্বাক্ষীর সামনে “অবশ্যই আমরা ইশ্বরের ইচ্ছামত চলব” উচ্চারন করে বিবাহিত হয়ে যায়।
বাহাইরা নিজগৃহ স্থানীয় বাহাই কেন্দ্র অথবা ভাড়া করা যায়গায় প্রার্থনার জন্য মিলিত হয়। পৃথিবীতে বর্তমানে সাতটি চিহ্নিত প্রার্থনাগার আছে ওদের। অস্টম টি চিলিতে নির্মিনাধীন। ভারতের নয়া দিল্লীতে এদের পদ্মফুলের আকারে লোটাস মন্দির এক্টি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য। বাহাইদের এই প্রার্থনা কেন্দ্র গুলিকে ‘মাস্রিকুল আধকার’ বলে, এইগুলিতে হাসপাতাল, ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি সন্নিবেশিত থাকে। তুর্কিমেনিস্তানের ইস্কাবাদ এ প্রথম ‘মাস্রিকুল আধকার’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
‘বাব’ এর প্রতিষ্ঠিত দিনপঞ্জী ব্যাবহার করে এরা। এদের বর্ষপঞ্জীতে ১৯মাস, প্রতি মাসের ১৯ দিন এর মধ্যে ৪/৫দিন ‘ইন্টার কেলারী’ দিবস রয়েছে যা মিলে সৌরবর্ষ নির্ধারন করে। পার্শিয়ান নববর্ষের মত এদের নববর্ষকে নওরোজ বলে, মার্চ ২১ তারিখ, উপবাসের মাস শেষ হবার পরে (মার্চ ২ থেকে ২০)। এছাড়াও মাসের প্রথমদিন সব বাহাইরা একত্রিত হ্য়, এইদিনটিকে প্রার্থনা ভোজন, আলাপ আলোচনা আর সামাজিক কর্মকান্ডের জন্য ব্যবহার করা হয়। ১৯ মাসের নামও ইশ্বরের বিভিন্ন গুনাবলীর নামের অভিহিত করা হয়েছে, যেমন, সমুজ্জল(বাহা) জ্ঞ্যান(ইল্ম), সৌন্দর্য(জামাল)। এদের সপ্তাহে সাত দিন, সারা বছরে সর্বমোট ১১দিন ছুটির দিন পালনকরে। এরমধ্যে ৯দিন কোন কাজ করেনা, এদিনগুলিকে ধর্মীয় কর্মকান্ডে ব্যপৃত হয়।
৯ কোন বিশিষ্ট তারা হচ্ছে এদের প্রতীক, এটা নেয়া হয়েছে বাহা বা সমুজ্জল থেকে তার সংখ্যামুল্য ৯।
বাংলাদেশে হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ গলিতে এর একটি শাখা আছে।