ক্লাস ফোর ফাইভ-এ পড়া অবস্থায়, যখন লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা অথবা আমাদের দেশের কনক চাঁপা-র পুরনো দিনের আধুনিক বাংলা গান শুনতাম, আর হ্যেভি মেটাল মিউজিক-এর ব্যান্ড সঙ্গীত শুনে কান-এ হাত দিতাম, একটা প্রশ্নের উত্তর কেউ খুঁজে পেতো না, ‘আমি ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রী হয়ে, কীভাবে সম্ভব পুরনো দিনের আধুনিক বাংলা গান শোনা?’
একই ক্লাসে পড়া অবস্থায়, সহপাঠীরা যখন জিজ্ঞাস করত, ‘কুসুম দেখো, কাসর্টি দেখো?’
শুকন মুখে বলতাম, ‘না, আমাদের বাসায় ডিশের লাইন নাই।‘
বাসায় ডিশের লাইন আসার পরেও, কেন যেন ভারতীয় সিরিয়ালে অভ্যস্ত হতে পারিনি। যদিও zee bangla-য় প্রচারিত, আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাস অবলম্বনে ‘সুবর্ণলতা’ সিরিয়ালটি আমার জীবনে বেশ কিছু ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, এবং সেই থেকে আমার বই পড়ার যাত্রা শুরু।
বাংলা সাহিত্যর একজন স্বনামধন্য লেখকের একটি কালজয়ী উপন্যাস পড়া অবস্থায়, মলাট উল্টে ‘ইয়াক’ শব্দে একজন বলেই ফেলেছিলেন, ‘এগুলা বই দেখলে আমার বমি আসে’।
ল্যেটেস্ট কোন সুপার হিরো মুভি দেখার পর, কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞাস করে, ‘কেমন লাগলো?’
কেন যেন বলতে পারিনা, ‘আমি সেই কবে থেকে wait করতেসিলাম কবে মুভিটা সিনেপ্লেক্স অথবা ব্লকবাস্টার-এ আসবে………’
এক কথায় শেষ করি, ‘তিন ঘণ্টার এন্টারটেইনমেন্টের জন্য ঠিক আছে, কিন্তু এই মুভি গুলি আমাকে কখন ভাবায় না।‘
হল-এ গিয়ে সুপারহিরো মুভি দেখে দুই তিন মিনিট ঘুমানোর যেমন রেকর্ড আছে, আবার তথাকথিত বোরিং কোন আর্ট ফিল্ম অপলক ভাবে দেখারও রেকর্ড আছে।
মাঝে মাঝে চিন্তা করতাম, সবার কাছে যেই জিনিষটা ট্রেন্ড, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমি কেন সেই জিনিষটা আত্মস্থ করতে পারিনা? আমার দেখা অনেক মানুষ আছে, যারা যেকোনো সময় যেকোনো অবস্থায়, ট্রেন্ড-এর সাগরে ঝাঁপ দিতে পারে, সেটা তার জীবনযাত্রার সাথে মানানসই হোক আর নাই হোক। কারণ তাকে তার আশেপাশের মানুষ গুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে কিছু ক্ষেত্রে সেটাকে তৈলমর্দনও বলা যেতে পারে। এই বিশেষ গুনটি কেন যেন আমার মধ্যা নেই, তাই গুটি কয়েক মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতাও হারিয়েছি। যেই যায়গায় হারিয়েছি, সেই যায়গা গুলো আমার কাছে পৃথিবীর বুকে এক প্রকার ‘কুয়া’, তাই বেশীদিন কুয়ার ব্যাঙ হওয়ে সেখানে আটকে থাকতে হয়নি।
সব মিলিয়ে ভেবে দেখলাম, আমি আসলে মানুষটাই ‘খ্যাঁত’ , তাই ল্যেটেস্ট ট্রেন্ড সামলাতে, কোন কিছু দেখতে, শুনতে, ব্যাবহার করতে, ফিল্টার দিয়ে কুকুর বিড়াল সেজে ছবি তুলতে অথবা ফেইসবুক প্রোফাইল সেলফি-ময় করে তুলতে, শুধু একটা দুইটা না, পুরা এক বোতল হজমির ট্যাবলেট খেয়ে হজম করতে হয়।
আরও চিন্ততার বিষয় হচ্ছে, আমার মেয়েরাও আমার সাথে সাথে ‘খ্যাঁত’ হয়ে যাচ্ছে। তারাও আমার সাথে সাথে লো মিউজিকের রবীন্দ্র, নজরুল অথবা ইসলামিক সংগীত শোনে, আবার মুখস্থ করে, গেয়েও শোনায়। ভারতীয় মিউজিক চ্যানেল ছেঁড়ে কেন বাচ্চাদের নাচতে দেই না, সেটা নিয়েও শুনতে হয়েছে, ‘অন্য বাচ্চাদের থেকে বোকা হয়ে থাকবে, তাল মিলিয়ে চলতে পারবেনা’।
‘মোটু-পাতলু’ দেখার সুযোগ না পাওয়ায়, হিন্দি ভাষাটা মাতৃভাষা হিসেবে আত্মস্থ করতে পারেনি। তাই ভবিষ্যতে, ‘ইসকো পিছে কিসকা হাত হোগা’ কীভাবে বলবে, সেটাও একটা চিন্তার বিষয় বৈকি।
আমার লেখাটা পড়ে অনেকেই হয়ত মুখ বাকিয়ে বলবেন, ‘আধুনিক কোন কিছুই বুঝি ব্যবহার করেন না? তো নানী দাদির যুগে চলে গেলেই পারেন’।
তাদের আধুনিকতার প্রতি সম্মান রাখেই বলছি, ‘আমার কাছে আধুনিকতার অর্থ, যুগের সাথে অহেতুক ট্রেন্ড-এ তাল মিলিয়ে চলা নয়, আধুনিকতা আমার মন মানসিকতায়, নৈতিকতায়, বিদ্যায়, এবং অবশ্যই রুচিশীলতায়, যা কখনই যুগের সাথে বুড়িয়ে যায় না। আর আধুনিকতার সবটাই খারাপ, এই কথাটি যেমন অযৌক্তিক, তেমনই আধুনিকতা থেকে ভালটা কে জীবনে কাজে লাগানটাও যৌক্তিক।
লেখাটা আমার নিজস্ব মতামত, তাই কারো রুচি পছন্দে আঘাত লেগে থাকলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।