এক বড় ভাই তার এই গল্প বলেছিলেন। আজ সেটা নিয়েই লিখে ফেললামঃঃ~
ভাইয়ের ভাষায়ঃ-~
~~~আমি তখন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন বিআইটি)-এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার মেজ দুলাভাই মালয়েশিয়ায় পড়াশুনা করতে গেছেন। তার জন্য একটি পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট সংগ্রহের জন্য রাজপাড়া থানায় গেছি। কাজ শেষে দায়িত্বরত একজন পুলিশ কর্মকর্তা টাকা চাইলে আমি বললাম- টাকা কী জন্য ভাই? তিনি অবাক হয়ে বললেন- মিষ্টি খাওয়ার জন্য শ’ পাচেক টাকা দেন। আমি বললাম- থানায় কতোজন আছেন আপনারা? আমিতো কাজের বিনিময়ে নগদ টাকা দেবো না। মিষ্টি খেতে চেয়েছেন। আমি মিষ্টি এনে খাওয়াচ্ছি। একথা বলে পুলিশ কর্মকর্তাটিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিকটস্থ মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি এনে তাকে বললাম- থানার সবাই মিলে খান। আর আমার কাগজটা দিন। হাত থেকে কাগজটি নিয়ে তার হতভম্ব চেহারার দিকে হাসি দিয়ে বের হয়ে এলাম। ক্যাশ ফর্মে ঘুষ না দিয়ে কাইন্ড ফর্মে ঘুষ দেওয়া সেই শুরু।
এবার ঘুষ দিতে অপারগতা প্রকাশের জন্য একটি ভোগান্তির কথা বলি। আমার এসএসসি, এইচএসসি’র মার্কশিট, সার্টিফিকেট ইংরেজি করবার সময় একটা সমস্যা বের হলো। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সনদপত্রে ভুল হয়েছে। তাই মূল রেজিস্ট্রেশন পেপার খুঁজে সেখান থেকে ভুল সংশোধন করতে হবে। রাজশাহী বোর্ডে গেলাম। নানাজনে নানা পথ দেখায়। একটাই কথা- মাল ছাড়ুন। সব হবে। ওদিকে তো আমিও গোঁ ধরে আছি- ঘুষ দেবো না। শেষে আমার কাজও হয় না। এ ঘটনার প্রায় ৬ বছর পর ১৯৯৮ সালের দিকে আমার মামাতো বোনের ভাশুর রাজশাহী বোর্ডের চেয়ারম্যান যখন হলেন, তার সরাসরি হস্তক্ষেপের পরেও কাজ উদ্ধার শেষে মিষ্টিমুখ করাতে হয়েছিল।
ঘুষ যাতে না দিতে হয় সেজন্য সরকারি চাকরিতে ঢোকার সময় পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ফর্মে কোনো ‘বিসিএস কর্মকর্তা পরিচিত আছে কিনা’ কলামে নাম দিয়েছিলাম আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বড় দুই ভাই পুলিশ বিভাগে কর্মরত ফনীভূষণ চৌধুরী (বর্তমানে লোকান্তরিত) ও নওশের আলীর (বর্তমানে ডিআইজি) নাম। এবার আর কাইন্ড ফর্মে কাজ হলো না। দুজন পুলিশ কর্মকর্তার নাম লেখার পরও ক্যাশ ফর্মে ঘুষ দিতে হয়েছিল।
তারপর দীর্ঘদিনের বিরতি। ২০০৫ সালের দিকে আবার ঘুষ দিতে হলো- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। অনেক তদবিরের পর (অবশ্যই টাকা ছাড়া) স্ত্রীকে বদলি করতে পেরেছি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তার পারসোনাল ফাইল রেকর্ড রুম থেকে আনা, ফাইল পুট-আপ করা, অফিস অর্ডারে মেমো নাম্বার বসানো শেষে অর্ডার হাতে পেতে সেকশন অফিসার থেকে শুরু করে পিয়নকে টাকা দিতে হয়েছিল। যদিও টাকার পরিমাণটা খুব অল্প ছিল।
আব্বা ঢাকায় মারা যাবার পর আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। প্রথম দু’বছর কবরটি অক্ষত ছিল। তারপর এলো কবর চালা দেবার সময়। আব্বার কবর দেখাশোনার জন্য একটি লোক ঠিক করেছিলাম। সে বললো- কবর চালা দেবার জন্য যারা কাজ করছে, তাদের কিছু টাকা দিলে আপনার আব্বার কবরটা তারা ভাঙবে না। আমি বললাম- আব্বা সারাজীবন সৎ ছিলেন। তার কবর ঠিক রাখার জন্য ঘুষ দেবো? দরকার নেই। তাদের বলবা- ভালো করে যেন কবর চালা দেয়। এ ঘটনা থেকেই বোঝা যায় ঘুষের বিস্তার কোথায় গিয়ে ঠেকেছে!
ঘুষের কালচার ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝেও ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। আমার একসময়ের কর্মস্থলে তাবলিগ করা এমন একজন ছিলেন যিনি ক্যাশ ফর্মে ঘুষ নিতেন না। অলওয়েজ কাইন্ড ফর্মে। ঈদে বাসায় যাবেন, ঠিকাদারকে বলতেন- গাড়ি ঠিক করে দেন। ঢাকায় শ্বশুর বাসায় যাবেন, ঠিকাদারকে বলতেন- এসি বাসের টিকেট কেটে দেন। তাবলিগের মেহমান এসেছে মসজিদে, হিন্দু ঠিকাদারকে বলতেন- খাসির মাংস কিনে দেন। আর মুসলমান ঠিকাদারকে বলতেন- গরুর মাংস কিনে দেন।
চাকরি নেবেন, বদলি হবেন, রিটায়ারমেন্টের ফাইনাল সেটেলমেন্ট নেবেন, পেনশন তুলবেন, ব্যাংক থেকে লোন নেবেন, রাজউক বা সিটি কর্পোরেশন থেকে বাসা বানানোর নকশা অনুমোদন করাবেন, গাড়ির লাইসেন্স করাবেন, বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাবেন, রোগীকে হাসপাতালের কেবিন বা আইসিইউ-এ ভর্তি করাবেন, ঠিকাদারি কাজ করার বিল নেবেন- কোথায় ঘুষ না দিতে হয়?
একটা সময় ঘুষকে অন্যায় ও লজ্জাকর মনে করে গোপনে দিতে হতো। এখন সেই লজ্জাটা উঠে গেছে। ওপেনলি ঘুষ নেবার কালচার শুরু হয়ে গেছে। ঘুষ দেবো না- একটা বলতেও নিজেকে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়। ঘুষটাকে অনেকে স্পিড মানি হিসেবে গণ্য করা শুরু করেছেন। আবার অনেকে ঘুষ দিয়ে বলে থাকেন- স্যার, প্রফিট শেয়ারিং করলাম। কিছু মনে করবেন না। এটাকে ঘুষ হিসেবে নেবেন না, প্লিজ।
একটা সময় ছিল, যখন ঘুষখোরদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতেও অনেকে দ্বিধান্বিত ছিল। এখন আর সেই মানসিকতা নেই কারো। ঘুষখোরদের অঢেল সম্পদের কাছে নিজের ছেলে বা মেয়ে অভাবের মধ্যে থাকবে না, এটা ভেবেই এখন ঘুষখোরদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে অনেকেই অতি উৎসাহী হয়ে পড়েছেন। একজন ঘুষখোর সরকারি চাকরিজীবী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও এই ভাবনা কখনো আসে না যে, তাদের বাবা বা মার মাসিক ইনকাম কতো, আর মাসিক খরচ কতো? বাচ্চারাও এখন ভোগবাদী বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে বাবা-মা’র অসাধু উপায়ে উপার্জিত টাকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
শুধু সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীই যে অসাধু তা বললে ভুল হবে। বেসরকারি চাকরিজীবীদের একটা বড় অংশও ঘুষ কালচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এমনকি যারা ঘুষ নামক দুর্নীতিকে রোধ করবেন তাদের ভেতরেও গলদ। এই জাতির পচন এমনভাবে শুরু হয়েছে যে এ থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই। ঘুষকে প্রতিরোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমাদের নিয়তি বাঁধা পড়েছে ঘুষের সঙ্গে অভিযোজনেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৫০