বিগত শতকের ৯০ সালের নভেম্বর মাস। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন চলছে। সব কিছুতেই কেমন একটা থমথমে ভাব। বাংলাদেশে তখন হেমন্তকাল। হেমন্তে সব কেমন ঘুমঘুম ভাব হয়ে উঠে। ঝিমানো একটা অবস্থা। বৈশাখের প্রচন্ড তাপ নয়। বর্ষার ঘনঘোর অন্ধকার নয়। অবিরাম বৃষ্টি, বন্যায় ভেসে যাওয়া অস্থির চঞ্চল ভাব নয়। শরতের উজ্জ্বল রোদ সাদা মেঘের নীল আকাশও নয়। নিস্তেজ হলুদ আলো শান্ত মৃদুমন্দ বাতাস, কুয়াশায় ধোয়াটে। প্রকৃতির এই নিরবতার সাথে সারাদিন ব্যাপী হরতাল, কলকারখানা বন্ধ, গাড়ির চলাচল নেই, নেই কোন শব্দ, হেমন্তের মতনই শুনসান স্তব্ধতা চারদিকে।
হঠাৎ হঠাৎ নিরবতার বাতাস চিরে বোমা ফাটার শব্দ ভেসে আসে। এলোমেলো গোলাগুলি বা মিছিলের শ্লোগান, হুটহাট দৌড়, আক্রমন, পাল্টা আক্রমন, ইট পাথর ছুড়ার শব্দ খানিক অস্থিরতা, জানালা দরজা, ফাঁক ফোকর দিয়ে আড়াল থেকে দেখার চেষ্টা কি হচ্ছে, কোথায়? কেন ? আকস্মিক এই নিস্তব্ধতা ভঙ্গের পরপরই আবার শুনশান নিরবতা।
বাচ্চা-কাচ্চারাও খেলাধুলা ভুলে গেছে যেন। মাঠে কেউ খেলতে নামে না। হৈচৈ ব্যস্ততা নেই কোথাও। বাজার-ঘাট শুনশান লোকে যেন সব কাজ করছে চুপিচুপি যেন কার্তিকের মরা আলোয় নির্জীবভাব।
আজিমপুরে তখন আমি থাকি। ছেলের বয়স ছয়। উদয়ন স্কুলে ক্লাস টুতে পড়ে। সকাল আটটায় ক্লাস শুরু হয়। তখন ও ওর বাবার সাথে স্কুলে যায়। বারোটায় ছুটি আমি গিয়ে নিয়ে আসি।
দেশের এমন অবস্থায় অফিসের কাজ-কামের চেয়ে, বিপ্লবী মিটিং-মিছিলে বেশী ব্যস্ত। দিনের খাওয়া, রাতের খাওয়া, বাসায় ফেরা কোনো কিছুরই কোনো ঠিক নেই। হরতালের জন্য হেঁটে অফিস যেতে হয় তাই অনেক দিন রাতে বাসায়ই আসতো না। তখন নভেম্বর মাস, ব্যবসার মৌসুম কাজের প্রচুর চাপ। আমাকে এভাবেই বুঝিয়ে দিত। দিন-রাত বাইরে বাইরে। আমি ভাবতাম কাজ নিয়েই আছে। এখন বুঝি, আসলে যতটা কাজে থাকতো তার চেয়ে বেশি সময় দিচ্ছিল আন্দোলনে। একদিন আমাকে বলল, বাসায় থাকাটা ঠিক না, যে কোনো সময়ে পুলিশ আসতে পারে আর আমাকে ব্যবসার কাজে ব্যাংকক যেতে হবে। ”কিছুদিনের জন্য ব্যাংককে কাজের জন্য চলে যাই ফিরে আসব সিঙ্গাপুর হয়ে। তোমাকে তাহলে ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না, আমাকেও পালিয়ে বেড়াতে হবেনা”। ভিসা টিকিটের ব্যবস্থা চলতে থাকলো। এদিকে বাসা ছেড়ে কোথায় নিরাপদে থাকা যায়? ঠিক হলো আমার বোনের বাসায় মিরপুরে থাকবে। দিন পাঁচ ছয়ের মধ্যে ব্যাংকক চলে যাবে। আসলে তখন জানতাম না অনেক পরে শুনেছি। আন্দোলনের পরিকল্পনাকারি বেশ কয়েকটা বড় বড় পরিকল্পনা অনুযায়ী এ্যাকসন হয়েছে ঢাকায়। এর মাঝে বেক্সিমকোয় আক্রমণের দুজন বিপ্লবী ধরা পরে গেছে। যদি পরিকল্পনাকারির নাম বলে দেয় তবে যে কোন সময় বিপদের সম্ভাবনা। তাই আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ার আয়োজন ব্যবসার প্রয়োজন বলে আমাকেও ধোঁকা দেওয়া। এতই গোপনে এরা সব কাজ করত যে প্রিয়জনরাও কিছুই জানতে পেতো না।
রাতের বেলা ছেলেসহ আমিও মিরপুর চলে যেতাম। সকালে ছেলেকে নিয়ে স্কুলে আসতাম। ওর মতন কাজে বেরিয়ে যেত সারাদিন কারো কোনো যোগাযোগ ছিল না। এভাবে কয়েকদিন কাটার পরে একদিন রাতে বোনের বর, বিপ্লবীকে এয়ারপোর্টে দিয়ে এলো। চলে গেল থাইল্যান্ড।
আমরা পরদিন সকালে চলে আসলাম বাসায়, ছেলে আর আমি বাসায় থাকা শুরু করলাম। দিন দুই পরে বোনরা চলে গেলো ঢাকার বাইরে শ্বশুড়বাড়ি। সারা ঢাকা শহরে আমি আর আমার আত্মজ।
ছেলের স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা শুরু হলো। দুই অথবা তিনটা পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সেদিন সাতাশে নভেম্বর ছিল অংক পরীক্ষা। সকালে ওকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে এসেছি। এগারটায় ওর পরীক্ষা শেষ। সাড়ে দশটায় ছেলেকে আনার জন্য বের হলাম। পাড়ার রিকশাওলারা জানতো এ সময়ে স্কুলে যাই নিজে থেকেই এগিয়ে আসত। সেদিন একজন বুড়ো মতোন রিকসাওয়ালা ছিল। আমরা ইডেনের মোড়ে পৌঁছতেই পলাশির দিকে রিকশা যেতে পুলিশ বাধা দিলো।
কেন কী ব্যাপার, কী হয়েছে আমরা কিছুই জানি না? রিকশাওয়ালা বললো, উনি স্কুলে বাচ্চা আনতে যাবে আমাকে যেতে দিন। পুলিশ বলল, তুই বেটা মরতে চাস নাকি! এই বলে দুই হাতে রিকশা পেছনে ঠেলতে লাগলো কর্তব্যরত পুলিশ। রিকশাওয়ালা বলে, আপা আমারে যাইতে দিবো না। আমি বললাম, ঠিক আছে আমাকে তো যেতেই হবে, আমি হেঁটে যাচ্ছি। ও বলে আমি এখানে অপেক্ষা করি।
আমি তখন অস্থিরভাবে হেঁটে যাচ্ছি আমার বাচ্চা ছেলে ওখানে। স্কুলে কি হয়েছে কে জানে, কি করছে আমার ছেলে? রিকশা ঢুকতে দিল না পুলিশ। গোলাগুলি হচ্ছে কি? আমি যদি এখন গুলি লেগে মরে যাই আমার ছেলেটা কি করবে? কে ওকে দেখবে? ওকি বাসায় পৌঁছাতে পারবে? ওখানে তো কেউ নেই দরজায় তালা! কে ওকে দেখবে?
ভাবনাগুলো এসে যাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে হাঁটছি না, দৌঁড়াচ্ছি। এস এম হলের কাছে এসে গেছি। অভিভাবকরা দলে দলে ফিরছে বাচ্চা সাথে।
আমি স্কুল থেকে একশ-দেড়শ গজ দূরে তখন হঠাৎ দেখি গেটের বাইরে একা আমার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা শার্ট, নীল হাফ প্যান্ট, পায়ে কেডস, পিঠে লাল ব্যাগ। আমাকেও ও দেখতে পেয়েছে। দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে ছেলে আমার।
কি অভূতপূর্ব ব্যবস্থা! স্কুল কতৃপক্ষের। যাদের কাছে সন্তানের দায়িত্ব দিয়ে গেছি, তারা নিজেরা চলে গেছেন, ছোট ছোট বাচ্চাদের ফেলে। কী নিরাপত্তা ব্যবস্থা! দায়িত্বশীলতা! বাচ্চা বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে টিচাররা সবাই চলে গেছেন। যাদের উপর আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের দায়িত্ব দিয়ে ফিরে গেছি। তারা ছোট ছোট অসহায় ছেলে-মেয়েদের একা ফেলে রেখে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে চলে গেছেন। বুড়ো দারোয়ান একা গেটের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছেন। গেটের পাল্লাগুলো হাট করে খোলা। যে সব অভিভাবক স্কুলের বাইরে অপেক্ষা করেন সারাক্ষণ। গোলাগুলি শুরু হতেই তারা নিজেদের বাচ্চাদের নিয়ে যেতে চেয়েছেন। খুব ভালো তারা তাদের বাচ্চা নিয়ে চলে গেছেন কিন্তু যে সব বাচ্চাদের অভিবাবক ছিলেন না তাদের অভিভাবক তো শিক্ষকরা বিশেষ করে প্রধান শিক্ষিকা, তিনি তো প্রত্যেকটি বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলের ভেতরে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করবেন এবং অভিভাবক এলে বাচ্চা তাদের হাতে দেবেন। এভাবে দারোয়ানের জিম্মায় নিরাপত্তাহীনভাবে বাচ্চাদের রেখে চলে যাওয়া কি ঠিক হয়েছিলো?
ছেলেকে নিয়ে কিছুদূর হেঁটে রিকশা পেলাম। বাসায় আসলাম, কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। এত নৈঃশব্দতায় কান ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন। এত নিরবতা সহ্য করা যাচ্ছে না। সব ভুলে থাকার চেষ্টায় সাংসারিক কাজে মন দিতে চাইলাম। ছেলেকে বললাম চলো গোসল করিয়ে দেই। ওকে গোসল করিয়ে তোয়ালে পেঁচিয়ে ঘরে এসেছি। দূরে কোথায় গুলি হচ্ছে। একটু পরে ফোন বেজে উঠলো। ফোন করেছেন জাসদের আজিজ ভাই। বিপ্লবীর খোজ করলেন, সে কোথায়? দেশের বাইরে গেছে একথা কাউকেই বলতে নিষেধ করে গেছে। তাই বললাম, বাসায় নেই। উনি বললেন ওকে দরকার, আমরা মিছিল করবো। ডাক্তার মিলনকে মেরে ফেলেছে। ওহ্ কি বললেন? মারা গেছেন নাকি গুলি লেগেছে? কেন যেন একটু আশা করা? কেন যেন সত্যকে অস্বীকার করতে চাওয়া। এত বড় বাস্তব সহ্য করা যায় না।
এতো ভদ্র, শান্ত লোকটা কি করেছে যে তাকে মেরে ফেলতে হলো। কোমল চোখের শ্যামল একটি মুখ, আহা মায়ের কেমন লাগছে! স্ত্রী কবিতা কি করছে? একটা মেয়ের জীবন শূন্য হয়ে গেল, চার বছরের ছোট মেয়েটা!ওদের বাবাকে হারিয়ে ফেলল সারা জীবনের জন্য। মায়ের এক মাত্র সন্তান, মা কী খবর পেয়ে গেছেন?
আজিজ ভাই বললেন, টিএসসি’র পাশ দিয়ে পিজিতে যাচ্ছিলেন। তখন সোরওয়ার্দি উদ্যানের ভেতর থেকে গুলি করেছে, এখন লাশ মেডিকেলে আছে। আহা একটা মানুষ আর মানুষ থাকে না লাশ হয়ে যায়।
সারাদিন কিছুই করতে পারলাম না। খাওয়া দাওয়া কিছুই করলাম না। ছেলেকে খেতে দিলাম শুধু। আর মগমগ পানি মাথায় গায়ে ঢাললাম কি এক জ্বালায় জ্বলছে যেন শরীর মন। একী অসভ্য বর্বর অবস্থায় বাস করছি আমরা? কেন এতো নিষ্ঠুরতা। কত পরিচিত মুখ চলে গেলো একে একে পৃথিবী ছেড়ে স্বৈরাচারীর নিষ্ঠুরতায়। জয়নাল জাফর, সেলিম, দেলওয়ার, রাওফুন বসনিয়া, শাহজাহান সিরাজ এখন ডাঃ. শামসুল আলম থান মিলন? আরো কত অপরিচিত মুখ অকালে প্রাণ হারিয়েছে একটি পিশাচ মানুষের নিজেস্ব বিভৎস আনন্দ উৎসবের কারণে কত পরিবারে নেমে এসেছে বিষাদের কালো ছায়া। জোড় করে ক্ষমতা দখলকারী স্বৈরাচারী, কে দিয়েছে তোকে অত্যাচার করার অধিকার।
রাতে ফোন এলো সিঙ্গাপুর থেকে। কান্না ভেজা কণ্ঠে বলছে, ঢাকার খবর বলো। কি হয়েছে ঢাকায়? বললাম, মনে হচ্ছে সবই জান। বলল, হ্যাঁ, ভালো লাগছিল না কোনো খবর না পেয়ে তাই আজই একটা রেডিও কিনে এনেছি। এইমাত্র বিবিসির খবরে বললো, ডাক্তার মিলনকে মেরে ফেলেছে? বললাম, হ্যাঁ মিলন আর নেই, মিলন উৎসর্গ হয়ে গেলো স্বৈরাচারীর ধ্বংসে। যা ঘটেছে সকাল থেকে বললাম। কোথায় কিভাবে মারা গেল মিলন, বললাম। বললো, আমি আর থাকতে পারবো না এখানে, পারলে এখনি চলে আসতাম, বুকিং দিচ্ছি টিকেট পাচ্ছি না, দুই তারিখে একটা সম্ভাবনা আছে টিকেট পাওয়ার।
ডিসেম্বরের দুই তারিখ দুপুরে বাসায় এলো সিঙ্গাপুর থেকে। কতদিন পরে ফিরে এলো কিন্তু আমাদের কোনো উচ্ছ্বাস আনন্দ হলো না। আমাদের শুধু কষ্ট আর কষ্ট বুকের মধ্যে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। দেশের পরিস্থিতির সাথে আমাদের পারিবারিক জীবন মিশে গেছে। আমাদের আলাদা কোনো আনন্দ বেদনা নেই।
এসেই টেলিফোন নিয়ে বসল সবার সাথে যোগাযোগ করলো খবর নিল। বিকেলে বেরিয়ে গেলো রাত দশটার দিকে ফিরে এলো। তিন ডিসেম্বর ভোর বেলা ও উঠে পড়ল। তৈরি হচ্ছে, আমি তখনও শুয়ে আছি বিছানায়, দেখছি ওর অন্ধকারে, নিঃশব্দ তৈরী হওয়া, ঘুম ভাঙ্গা চোখে। কখন আবার ঘুমিয়ে পড়েছি খানিক পরে ঘুম ভেঙে দেখি,ঘরে কেউ নেই চলে গেছে কিছুই বলেনি আমাকে, নাস্তা করেনি। ভেবেছিলাম যাওয়ার আগে কাছে আসবে বলে যাবে অন্তত। যার কাছে দেশ বড় আর সব কিছুই তুচ্ছ। আমাকে বলে যাবার প্রয়োজনীয়তা টুকুও মনে পড়েনি। শুধু আন্দোলন, হরতাল মিছিলের ডাকে আচ্ছন্ন। আজ সারাদিন হরতাল, মিছিল, আন্দোলন। মিলন মারা যাবার পর থেকে একটানা হরতাল চলছে, এ সময়ে এতো সকালে ও যে অফিসে যায়নি খুব ভালো বোঝা যায়। কোথায় কোন মিছিলে,পিকেটিং এ, মারামারিতে,গোলাগুলিতে,বোমাছোঁড়ার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দৌড়াদৌড়ি, কাঁদুনে গ্যাস, ধাওয়াপাল্টা ধাওয়া ভাবতে পারি না। ভাবতে গেলে দম বন্ধ হয়ে আসে। যে কোন সময় অঘটনের আশংকা বুকে নিয়ে জীবন যাপন। চোখবন্ধ করে আচ্ছন্নের মতোন শুয়ে থাকি। আমি কিছু ভাবতে চাই না, আমি কিছু শুনতে চাই না।
বেলা দশটার দিকে উঠতে হয় তবু, কত আর চোখ কান বুজে শুয়ে থাকা যায়। এককাপ চা নিয়ে কেবল বসেছি ফোন বেজে উঠল। ফোন করেছেন এক ভাবী।
বলেলেন, বিপ্লবীর খবর শুনেছেন?
না, বুকের ভিতর মুচড়ে উঠছে, শিরদাড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে এক সিরসিরে অনুভুতি তবু শুনতে হবে, বাস্তবতা, মোকাবেলা করতে হবে বর্তমান। র্নিবিকার কন্ঠে জানতে চাই কি হয়েছে? বললেন, উনি তো ধরা পড়েছেন। পুলিশ ধরেছে?
না, হাসনাতের বাড়িতে ওনাকে আটকে রেখেছে।’ শরীরের মাঝে যেন সাড়াসির চাপ অনুভব করি। মাথার ভিতর সব ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। হাসনাত তখনকার মেয়র ছিলো। এরশাদের যোগ্য দোসর, সাহায্যকারী। দমবন্ধ হয়ে আসছে, এখন কি হবে? কিভাবে ওকে ছাড়ানো যাবে? কিন্তু না কান্না, না অস্থিরতা, কোথা থেকে যেন সব সহ্য করার একটা শক্তি এলো। ধীর স্থিরভাবে কি করা যায় তাই ভাবলাম। আমার এক আত্মিয় পুলিশের এসপি ছিলেন তখন। তাকে ফোন করলাম। অনেক চেষ্টার পরে তাকে পেলাম, খবর শুনে তিনি রেগে গেলেন। কেন যে ও যায় এসব করতে, ও না বিদেশে ছিল আসল কবে? তিনি জানতেন, এই আন্দোলনের স্বভাব, তাই সব সময় আমার খোঁজ খবর রাখতেন। পুলিশ বিভাগ ছিলো স্বৈরাচারীর হাতের পুতুল, তারা যা বলবে তাই হবে। তাদের ইচ্ছার বাইরে কাজ করা ছিল দুঃসাধ্য। তিনি বললেন, দেখি কি করা যায়? পুলিশের কাছে ধরা পড়লে তবু কিছু করা সহজ হতো অন্তত মারপিট থেকে রক্ষা করা যেতো। যাক আমি একটা ফোর্স পাঠাচ্ছি।
দলের নেতাদের বাসায় ফোন করলাম। ফোন পাওয়া ভীষণ কঠিন, যদি বা পেলাম কেউই বাসায় নেই। কিছুই করার নেই আমার একা একা সব সহ্য করা ছাড়া। ফোনের পাশে বসে আছি একে ওকে ফোন করছি সব নাম্বার ব্যস্ত। ফোনের দিকে চেয়ে আছি যদি কোনো খবর আসে। ঘন্টা তিন পরে আবার ভাবী ফোন করে বললেন, ভাই আমাদের বাসায়, ছেলেরা উনাকে নিয়ে এসেছে। দুঃসহ এক কলিজা ছেড়া সময় পার হয়ে জীবনের স্পন্ধন বাজে।
স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে দৌঁড়ে আমি বেড়িয়ে যাচ্ছি। ছেলে বললো, মা, আমি যাবো তোমার সাথে, বাবার কি হয়েছে? কেমন করে বুঝল ও তো একা একা খেলা করছিলো। আমি তো ওকে কিছু বলিনি। একা কষ্ট সহ্য করতে যখন পারছিলাম না তখন ভেবেছি ছেলেকে বলি। আবার ভেবেছি ও তো ছোট মানুষ। ওর কোমল বুকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ। তবু ও কেমন করে আন্দাজ করেছে, যে কিছু একটা ঘটেছে ওর বাবাকে ঘিরে। ছেলেকে নিয়ে দৌঁড়ে এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তা পেরিয়ে ওদের বাসায় পৌঁছালাম।
খালাম্মার ঘরে বিছানার উপর বসে আছে। খালি গা একটা লুঙি পরনে। নিচে গামলা ভর্তি বরফ আর ঠান্ডা পানি। তাতে ওর দুই পা ভেজানো। হাত, পিঠ এসব জায়গায় কাপড় ভিজিয়ে ঠান্ডা পট্টি দেয়া হচ্ছে। ঘরভর্তি অনেক লোক।
আমার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকলো আমিও ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমি বিছানায় পাশে বসলাম। সাহস আমার বুকের মধ্যে সেটে আছে, কিছু বলছে না।
সবাই বলাবলি করছে এখানে থাকাটা নিরাপদ নয়। ওকে অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে হবে। বাসায় যাওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। ওকে অন্য কারো বাসায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো ভীষণ গোপনভাবে। এমনকি আমাকেও বলা হলো না কোথায় ওকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওকে নিয়ে দু’তিনজন ছেলে চলে গেলো আধঘন্টার মধ্যে।
আমি ছেলেকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। তবু সান্তনা ও এখন নিরাপদে আছে, না থাকুক আমার পাশে।
যে পথে কখনো হাঁটিনি। সব সময় পরিপাটি রিকশায় চলেছি। সে পথে আজ আলুথালু বেশে, এলোমেলো চুলে দৌঁড়ে চলে গেছি। ফেরার পথে খেয়াল করলাম দোকানদার, রিকশাওয়ালা, পথচারী পরিচিত লোক দেখছে আমাকে। ওরা নিশ্চয়ই জানে সব ঘটনা। ওরা সবাই ওকে সম্মান করে। আমাকে কেউ কিছু বলল না, আমি বাসায় চলে এলাম।
অস্থির অস্থির একটা সময় কাটছে। রাত সাড়ে নয় পৌনে দশটার দিকে হঠাৎ দীর্ঘ নিস্তব্ধতার দেয়াল ভেঙে চারদিক থেকে একটা সোরগোল উঠলো। বহু মানুষের কণ্ঠস্বর কোলাহলে রূপ নিয়েছে। কি হলো আবার হঠাৎ এতো হৈ চৈ কেন আবার? মন ভালো ছিল না, টিভি দেখার আগ্রহ ছিল না। হৈ চৈ শুনে টিভি ধরলাম, দেখি তো কোনো খবর বলে নাকি, হ্যাঁ জন রোষের কাছে স্বৈরাচারী এরশাদ টিকতে পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্থান্তর করেছে। তাই তো এত হৈ চৈ, এতোদিনের নিরবতা ভেঙে মানুষ আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছে। এ যেন সেই মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মতো উৎসব মুক্তিযোদ্ধারা দেশে ফিরে এলে আনন্দ উচ্ছাস, জয়ধ্বনি, ফাঁকা গুলির শব্দে মুখরিত হয়েছিল। তেমনি আরেক বিজয় উৎসব। নয় বছরের স্বৈরশাসনের অবসান।
একটু পরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। এখন তো আর পুলিশ আসবে না। তবে এত রাতে কে কড়া নাড়ে? ”কে তুমি কড়া নেড়ে বলো খুলো দরজা”
ছেলেকে নিয়ে একা আছি দরজা খুলবো কি খুলবো না ভাবছি। দরজার বাইরে থেকে পরিচিত কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘দরজা খোল।’ একি ও কেমন করে এলো? তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেখি দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে, সারা শরীরের ব্যথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । বললাম, কি গোপনীয়তা ছেড়ে চলে এলে?
বললো, হ্যাঁ, এরশাদের পতন হয়ে গেলো আর পালিয়ে থাকতে হবে না।
পরদিন মানুষের জোয়ার পথে দেশটা যেন সত্যিকারের স্বাধীন হয়েছে আবার মানুষের মনে আশা আবার নতুনযাত্রা শুরু হবে। জিরো পয়েন্টে সাংস্কৃতিক কর্মিদের এক নাগাড়ে অনুষ্ঠান, হাটুতে প্রচণ্ড ব্যাথা নিয়ে তবু আমার কাঁধেভর করে মঞ্চে যাওয়া।
মিলনের বাড়িতে তিন প্রজন্মের তিনজন মেয়ে একা- ছেলে, স্বামী, বাবা হারানোর শোকে তাদের পাশে ভাষাহীন বসে থাকা সময়গুলো মনে পড়ে যায়।