somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

রোকসানা লেইস
স্রোতের অজানা টানে সমুদ্র বালিয়াড়ি বেয়ে বোহেমিয়ান- গৃহকোন, জীবন যাপন ফেলে চলে যায়। তুমি দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গনে বাঁধতে চাও জোছনা গলে হারিয়ে যায় সুখ । আছড়ে পরা ঘূর্ণিজল মনে বাজায় অচেনা সবুজ দিগন্ত ..

ফুলের ভাষা

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




সে আমার জন্য সব করতে পারে। খুব ভোরে শিউলি ফুল কুড়ানোর জন্য অন্ধকার থাকতেই শিশিরের হিম মাথায় চুপিসারে বেরিয়ে পরত বাড়ি থেকে। কুয়াশার চাদর ঘেরা রাস্তায় একা দ্রুত হাঁটত। শিউলি গাছের ফুলগুলো সবার আগে কুড়িয়ে নিতে হবে। ঝুড়ি ভর্তি ফুল নিয়ে আবার এক মাঠ পারি দিয়ে অপেক্ষার পালা।
ভোর পেরিয়ে সকালের রোদের আলো যখন আম গাছের কচি পাতা ছাড়িয়ে নিচে নামতে নামতে সব ঘন পাতার দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ঝরকা কাটা আলপনা আঁকত। জানলা গলে বিছানায় আমার চোখের পাতা ছূঁয়ে দিত সূর্য রশ্মি তখন আমি চোখ মেলে তাকাতাম। কিন্ত শীতের জন্য লেপের উম ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করত না। মা ডাকাডাকি শুরু করতেন, এবার উঠো নবাবজাদী, নাস্তা সেরে আমাকে ধন্য করো। তোমাদের সেবায় নিয়োজিত আছি। চাকর বাকর কামলা দাসী; এক কাজ নিয়ে বসে থাকলে হবে না আরো কাজ আছে। টেবিল সাফ করে, ঘর পরিস্কার করতে লাগবে।
মা যখন শুরু করবে আর থামবে না একটানা রের্কড বাজিয়ে বলতেই থাকবে, বলতেই থাকবে।
আমি লেপের উষ্ণতায় কান ঢেকে রাখি। শুনতে চাই না ঘুম ভেঙ্গে উঠেই; এই একঘেয়ে ঘ্যান ঘ্যান। কিন্তু থামে না তীব্র শেলের মতন কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে থাকে, মার তীক্ষ্ণ তিক্ত বাক্য বান। দূর্গা দেবীর মতন যদি দশখানা হাত থাকত তবে তোমাদের কিছু বলতাম না। লেপ তেমন দেয়াল তুলতে পারে না।
তবে যতটা আঘাত করার জন্য মা নবাবজাদী বলে সম্ভোধন করে সেটা বকা না হয়ে মধুর হয়ে উঠে আমার কাছে।
নিজেকে নবান বাড়ির আয়েসি মেয়ে ভাবতে বড় ভালো লাগে। বিশাল দেয়াল ঘেরা বাড়ি। মর্মরে বাঁধানো দেয়ালে কারুকার্য। ঘরের পর ঘর কোরিডোর, মেহগনি কাঠের দরজা জানাল ভাড়ি ভাড়ি সব আসবাব পত্র। বিশাল পালঙ্কে আমি শুয়ে আছি। ময়ূর ফুল লতাপাতার নকশা। পালঙ্ক থেকে পা নামাতেই দাসী আমার পায়ে মখমলের চটি পরিয়ে দিবে। আমি অলস ভঙ্গিতে হেঁটে গরাদের সামনে দাঁড়াব। দাসী ত্রস্ত ব্যাস্ত হয়ে এসে বলবে, সাহেবান পর্দা কি সরিয়ে দিব? খড়খড়ি কি খুলে দিব? আমি কোন কথা না বলে মেহগনি কাঠের সিঁড়ি ভেঙ্গে ছাদে চলে যাবো। সেখানে গিরিবাজ পায়রা আমার পায়ের কাছে বকবকুম বকবকুম করতে থাকবে। আমি ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে রোদের তাপ নিব ছাতার আড়াল থেকে। পাশে রাখা আধার থেকে দানা ছূঁড়ে দিব পায়রাদের জন্য। দাসী ত্রস্ত ব্যাস্ত ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি বলব, যা তুই এখান থেকে। একদম নিচে চলে যা কোথাও লুকিয়ে থাকবি না আসে পাশে।
দাসী চলে গেলে, এক সময় সে দরজায় উঁঁকি দিবে হাতে ধরা শিউলি ফুলে ভরা ঝুড়ি। আমার কাছে এসে এগিয়ে দিবে ঝুড়িটা। আমি নাক ডুবিয়ে ফুলের ঘ্রাণ নিব আমার কোল ছাপিয়ে নিচে কিছু ফুল উপচে যাবে। শিউলির মিহিন ঘ্রাণে জড়িয়ে যাবে আমার হৃদয়।
ওর খালি পায়ে তখনও শিশির ভেজা ঘাস লেগে আছে। গায়ে হালকা একটি মলিন শাল অথচ কালো মুখে গ্যাজ দাঁতের হাসি চকচক করবে মায়ায় ভরে থাকবে চোখের দৃষ্টি শুধু এই মূহুর্তটি জেগে থাকবে পৃথিবী জুড়ে।
শিউলি ঘ্রাণের মধুর স্পর্শে জড়িয়ে থাকব আমরা। পৃথিবী শূন্যতায় ভরে যাবে । এই একটি মাত্র দৃশ্য ছাড়া আর কিছু থাকবে না।
চমকে উঠি স্বপ্নে বিচরণ থেকে কল্পনার আবাস থেকে ধপাস করে পড়ি। মায়া ভরা উত্তাপে জড়িয়ে রাখা লেপ খানা আমাকে ছেড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে কোথায়। বিশাল একটা ধমক সাথে, নবাবজাদী উঠলি। আমি এক লাফে বিছানা ছেড়ে মাটিতে পা রাখি, দৌড়ে বাথরুমে আড়াল করি নিজেকে পেছনে রেকর্ড বাজতে থাকে। খেয়ে পড়ে আর কোন কাজ নাই ........আমার হয়েছে জ্বালা.......
পানির শব্দ বাড়ে রের্কড চাপা পরে। শিউলির ঝুড়িটা আমার অপেক্ষায়। এখনো ভোরের শিশির ভেজা ফুল গুলো নেতিয়ে পরার আগে আমার হাতে তুলে দেয়ার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে সে। আমি বরান্দায় দাঁড়াতেই নিচে রাস্তা থেকে চাদরের ভিতর ঢাকা ঝুড়িটি দেখায় আমাকে। আমি দরজা খুলে নিচে নামতে থাকি, মা চিৎকার করে, কই যাস নবাবজাদী।
আমার পায়ের নিচে শ্বেত পাথরের সিঁঁড়ির স্পর্শ যেন। লোহার কলাস্পিবল গেট যেন মেহগিনি কাঠের খিলান, ঘ্রাণ ছড়ায় অপূর্ব। সে চুপচাপ এড়িয়ে এসে শিউলি ফুল গুলো আমাকে দেয়। আমি ফুলের মাঝে মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নেই। মুখ তুলে তাকাতেই ওর চোখে চোখ পরে। অপূর্ব আলো খেলছে, সে চোখের দৃষ্টিতে দারুণ তৃপ্তি। সে আর এক মুহুর্ত আমার দিকে দেখে তারপর উচ্ছাসিত ভঙ্গীতে যাই, বলে নাচতে নাচতে চলে যায়।
আমি ফুলের ঘ্রাণে ডুবে ধীরে ধীরে উপরে এসে ডাইনং টেবিলে বসি। ঠিক মাঝখাানে সাদা কমলা রঙের ফুল ঢেলে দেই টেবিল জুড়ে মা এসে বসে আমার পাশে। ফুল গুলো দেখে অবাক হয়ে। এখন মা আর কোন কথা বলতে পারে না। ফুলের ঘ্রাণ যেন মার কথা কেড়ে নিয়েছে। নাস্তার প্লেট আর চা এর কাপ এগিয়ে দেয় আমাকে নিঃশব্দে।
আমি আর মা চুপচাপ টেবিলে বসে থাকি ফুলগুলো শুধু কথা বলে যায় আমাদের মৌনতাকে ঘিরে।
ক্লাস শেষে ফিরতে একদম বেলা শেষ। আকাশ লাল ও গোলাপী আলোয় মাখামাখি। সূর্যটা এখনই টুপ করে ডুবে যাবে রাস্তার ওপারে দেয়ালের আড়ালে। রিকাসা থেকে নামতেই একগাদা লাল পদ্ম ধরা হাতটা এগিয়ে এলো। ঘুরে তাকিয়ে দেখি তার ভেজা চুল বেয়ে পানি ঝরছে । মুখের পানিতে মনে হচ্ছে সে কাঁদছে কিন্তু সাদা দাঁতের হাসিটা অদ্ভুত সুন্দর। আমার ভিতরটা কেমন করে উঠল।
মনে হলো সে যেন ঠাণ্ডায় কাঁপছে। আমি ধমকের সুরে বললাম, এভাবে এই শীতের সন্ধ্যায় ভিজেছো কেন?
ফুলগুলো তুলোর জন্য। আপনার পছন্দ হয়নি? হবে না কেনো ফুল সবারই ভালোলাগে তাই বলে ফুল তোলার জন্য মরতে হবে নাকি। অসুখ বাঁধালে কে দেখবে?
কিছু হবে না বলতে বলতে সে অন্য দিকে হাঁটা দিল। টলটলে চোখের আলোর ভালোলাগা আর মুক্তার মতন দাঁতের ঝিলিক ফুলগুলোর সাথে আমাকে ছূঁয়ে থাকল।
আমি দুহাত উপচানো লাল পদ্মদল হাতে নিয়ে টগবগিয়ে সিঁড়ি ভাঙ্গি যেন সারাদিনের ক্লান্তি নিমিশে উধাও হয়ে কোন অজানায় পালিয়ে গেল। ফুলের ভাষা বোঝার আশায় অনেক চেষ্টা করি। কিন্তু বুঝে উঠতে পারি না।
দরজার কড়া নাড়তে মায়ের হাঁক শুনতে পাই ভিতর থেকে। নবাবজাদী আসছো?
আমি চুপ করে থাকি। দরজা খুলতেই পদ্মফুলের গোছা এগিয়ে দেই মার মুখের সামনে নিজেকে আড়াল করে রাখি। নবাবজাদী.. বলার পর মার কথা থেমে যায় ফুলের ঘ্রাণে ফুলের ভাষায়। আমাদের ঘিরে মৌনতা কথা বলে। নিরবে যেন সারাদিনের সব কথা বলে যাই আমি। নিরবে মার সারাদিন কেমন কাটল, মা একটি শব্দ করে কিছু না বললেও আমি বুঝে যাই।
ফুলগুলো একটা বড় ফুলদানীতে মা যত্ন করে সাজায়। আমি মনোযোগ দিয়ে দেখি। ক্লান্ত ঘরের চেহারাটা কেমন বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে। সারাদিন মা এঘর ওঘর ঝাড় পোছ করেছে। নানা পদের খাবার বানিয়েছে। মোটাসোটা শরীরে নানা জায়গায় ব্যথায় অনেক কাঁকিয়েছে। কিন্তু কাছে কাউকে পায়নি। যাদের জন্য সারাদিন এক অনন্ত অপেক্ষা মনে মনে। যার যন্ত্রনায় থেকে থেকে সব কাজ বন্ধ করে গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে মায়ের।
কেউ এসে পাশে বসে না, বলে না মা, তোমাকে এত কাজ করতে হবে না। মা, তুমি বসো, আমি তোমার মাথায় কাঁকই দিয়ে বিন্যাস করে দেই চুল। মা তোমার কি কোথাও যেতে ইচ্ছে করে, পাহাড়ে অথবা সমুদ্রে? কী ভালোলাগে তোমার। অথবা আজ তোমার ছুটি মা। তোমাকে হেঁসেল ঠেলতে হবে না। আজ সব আমরা সবাই মিলে করব। তোমার দুই মেয়ে এক ছেলে তোমার স্বামী আজ তোমার জন্য নিবেদন করবে তাদের দিন। তুমি তো প্রতিদিন তাদের জন্য উৎসর্গ করো তোমার সময়। মা আজ তুমি রাজরাণী এ সংসারে। তুমি শুধু উপভোগ করো।
এমন কথা বলার সময় কারো হয় না। যদিও সবাই ভাবে করবে অথচ মা ব্যথা নিয়ে সব সেরে রাখে। নিরেট ভালোলাগায় অপেক্ষা জড়িয়ে থাকে হৃদয় জুড়ে; চারপাশ ঘিরে বসবে প্রিয়জনরা। অনেক কিছু করতে চাইবে আগ্রহ ভরে কিন্তু কিছুই আর প্রয়োজন হবে না। শুধু ভালোলাগায় চোখ ভিজে উঠবে চোখের বৃষ্টি নামার আগে মা উঠে যাবে আড়াল করে খাবার আনার অজুহাতে। ফুলের ভাসা মার মনের গহীন কথাগুলো আমাকে বুঝতে সাহায্য করে। কি অপরূপ মনে হয় মায়ের নিপুন ফুল সাজানোর ভঙ্গিমা।
ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে বর্ষাকালের অক্লান্ত বিরামহীন আকাশ ও মাটির কথা বলা। অনেকদিন পর দেখা হওয়া সখীদের কলকল চলছে। বৃষ্টির ছাটে ভিজে যাচ্ছে গাছ, পাতা, কবুতর, ফড়িং, প্রজাপতি, রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ, গাড়ির চালে, রিকসার হুডে, পলিথিনের দেয়ালে। স্রোতের নদী বইছে রাস্তা জুড়ে, ছড়িয়ে যাচ্ছে আঙ্গিনায়। মার হেঁসেলে তুলকালাম রান্না চলছে। ইলিশ ডিম, কই আরো কত রকমের মাছ। সারাদিন ঘরে বসে থাকো এই বৃষ্টির পানি ঘাটার জন্য কেউ বাইরে বেরুবে না। মায়ের তুখড় বারণ। এ অমান্য করে পরীক্ষার জন্য ক্লাসে যাওয়া যাবে না। বসার ঘরে বসে বসে ক্লান্ত সবাই মেঝেতে গড়াগড়ি খায় আর খাবার টেবিলে মায়ের সুস্বাদু খাবার খেয়ে ক্লান্তিকর সময় কাটানোর চেষ্টা টেলিভিশনে চোখ রেখে। বারান্দার গ্রীলে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছূঁই মার চোখ এড়িয়ে।
মনে হয় মায়ের রান্নার কড়াই থেকে ইলিশের ডিম ঝাপ দিয়ে রাস্তার নদীতে পরে সাঁতার কাটছে। বাচ্চা ইলিশে ভরে গেছে শহরের কোনাকাঞ্চি। অদ্ভুত এক দৃশ্য! কেউ ঘরে থাকছে না ইলিশ ধরার জন্য ঘরে বসে থাকা মানুষ পানিতে সাঁতার কাটছে। ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ, ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ হাবুডুবু লুকোচুরি খেলছে জলে।
সত্যি পানির ভিতর সাঁতার দিয়ে উঠে এলো এক মানব। সারা শরীর যখন রাস্তার ঘোলা জলে ডোবা একহাত উঁচুতে তুলে পরম যত্নে ধরে আছে এক গুচ্ছো কদমফুল। প্রার্থনার মতন উপরে মুখ তুলে আমাকে দেখে যেন সকল যন্ত্রনার অবসান হয়ে গেল বিদ্যুতের মতন ঝিলিক দিয়ে উঠল হাসি। আর স্পর্শ বিদ্ধ হলাম আমি।
নিষেধের সব বারতা ভুলে চলে গেলাম সাঁই সাঁই করে নিচে। জল ছূঁই ছূঁই করছে নিচতলার ফ্লোর। ঢেউ উঠছে নামছে। সেখানে এসে দাঁড়াল সে পরম মমতায় ফুলগুলো আমার হাতে দিল। কঠিন ধমকের সুরে বললাম এভাবে ফুল আনতে কে বলেছে?
আর কদিন পর যে এমনটি আর পাওয়া যাবে না। তাই নিয়ে এলাম।
যাও তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে শুকনো কাপড় পরো।
ধীরে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে ফিরল যাওয়ার জন্য।
আর শোন, ভালো পানিতে গোসল করবে বাড়ি ফিরে। রিকসা করে যাবে? ভাড়া নিয়ে যাও।
না লাগবে না এই তো কাছেই।
কোথায় থাকে এই চিকন কালা? কখনও জানতে চাইনি। কখনও জিজ্ঞেস করিনি কেমন তার বাড়ি ঘর। কেনই বা এমন ঝড় বাদল মাথায় করে ফুল নিয়ে আসে আমার জন্য। আমার হাতে ফুল তুলে দিয়ে আমার ভালোলাগাটুকু দেখেই তার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। শুধু এটুকু সুখের জন্য সে পাহাড় নদী সমুদ্র পাড়ি দেয় যেন। আমি সুখ অনুভব করি সে আমার জন্য দুহাত উপচানো ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে এটা যেন জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে।
শূন্য মরুভূমি সময়, কেমন সুজলা সুফলা প্রাণবন্ত হয়ে যায় তার একটু খানী উপস্থিতি। কথা নেই বার্তা নেই এই ফুলের ভাষায় কথা বলা রূপকাহিনীর দেশে টেনে নিয়ে যায়। সেখানে ফুলে ফুলে ছাওয়া বাগান পাখির কাকলী। আনন্দ বৈভব। পেখম মেলে নাচে ময়ূর; ময়ূরির মনরঞ্জণ করার জন্য। মধুর সুরে বাঁশি বাজে। হরিণ মায়াবী চোখ মেলে তাকায়। কত বছর থেকে ফুলের ভাষার এই কথা চলছে । বিনিময়হীন এই দেওয়ায় কি তার সুখ। ঠিক কবে কিভাবে শুরু হলো মনে নেই।
বসন্তদিন অনেক ফুলের বাহার। দেশিবিদেশী বাজার উপচে পরা থৈ থৈ প্লাবন। খুশিখুশি মন মানুষ ভালোবাসার উৎসবে ব্যস্ত। চারদিকের এতো ফুলের মাঝে কোন ঘ্রাণ পাই না আমি। কীট যেন কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে ফেলেছে পাপড়ি। অনেকদিন কালো মুখটাকে দেখি না। সে ছেলেটি কোথায় আছে? আসে না কেনো আর। ফুলের ভাষায় কথা হয় না। যেদিন কয়েকটা গাড়ি করে অনেক মেহমান আসল বাড়িতে পয়গাম প্রস্তাব কথাবার্তার লেনদেন শুরু হলো সেদিন থেকে ফুলের ভাষা হারিয়ে গেছে।
আজ আমাকে আংটি পরাতে এসেছে ওবাড়ির লোক। সোনার ফুলদল দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছে আমাকে। অনেক ধনী তারা। কিন্তু হীরে যহরতের ভাড়ে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার। সবাই বিদায় হলে একা ছাদে এলোমেলো বসে থাকি। ঝকঝকে ছুড়ির মতন চকচক করছে একফালি চাঁদ। সে চাঁদের হার, গলায় পরতে ইচ্ছে হচ্ছে। সন্ধ্যাতারা নাকছাবি। চুল ভর্তি দোলনচাঁপার ঝাড় দুলিয়ে ঘ্রাণ নিতে চাই। কিন্তু কোথায় পাবো কে এনে দিবে? কেমনে হবে এমন শখ পূরণ। হঠাৎ নেমে আসে দোলনচাপার ঝাড় নাচে আমার সামনে। মিশমিশে কালো মানুষটি মিশে আছে অন্ধকারে। শুধু শাদা দোলনচাপা দোলা দেয় আমার হৃদয় জুড়ে। সারাদিনের অবসাদ ঝরে যায় আমি চাঙ্গা হয়ে উঠি। ক্লান্তি সরিয়ে উঠে বসি তার সাথে অনেক কথা বলতে চাই আজ। জানতে চাই অনেক কথা, যে কথা কখনো হয়নি বলা। কিন্তু নাই কখন অগোচরে সে চলে গেছে। আমার ফুলের ভিতর মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নেয়ার ভিতর।
স্বপ্নের মতন শূন্য সময় মাতাল দিন পেরিয়ে যায়। আমাকে ঘিরে চারপাশের ব্যস্ততা আমার দম বন্ধ করে রাখে। অথচ কে তা বোঝে। অনুষ্ঠান আয়োজন আলোর ঝাড়বাতি সৌরভহীন ফুলে মনে হয় শশ্মানে পুড়ানোর আয়োজন, আমাকে ঘিরে। ইচ্ছে করে তাকে খুঁজে আনি যার ঠিক মনে থাকে কখন আমার কোন ফুল চাই। হাস্নুহেনা, গোলাপ, বেলি, জারুল, পলাশ, গাঁদা অপরাজিতা, চন্দ্রমল্লিকা এতফুল সে কোথা থেকে তুলে এনে দেয় আমাকে যখন তখন। আমার নিঃশ্বাস সতেজ হয়ে যায়। জীবনটা পাখির ডানার মতন ফুরফুরে হয়ে যায়। আমি নেচে উঠি প্রজাপতির রঙিন আলো মেখে। কখনো চাইনি কিন্তু কত বছর ধরে এই ফুল দেয়ার খেলা নিরবে চলছে আমাদের মাঝে অথচ সে আর আসে না। অনন্ত অপেক্ষা কুঁড়ে কুঁড়ে খায় নীরব বেদনায় হৃদয় আমার। যে কথা বলতে পারি না।
শিকলে বাঁধা পাখির মতন খাঁচা থেকে খাঁচা বদল হয়ে আমি চলে যাই, বাড়ি থেকে বিয়ের আসর ঘরে, সেখান থেকে অন্য বাড়ির আলোর ঝলকানি, ফ্লাস লাইটের চমক চোখ ধাঁধায়। আমি কিছু দেখতে পারি না। মুখে প্রলেপের পর প্রলেপ। কনের লতি, গলার ঘের, বাহু লতা জড়িয়ে আছে হরেক রকমের গহনা। এসবের ভাড়ে নুয়ে পরছি আমি। চোখের পাতা তুলে তাকাতে পারছি না ভালো করে নানা রকম সাজের যন্ত্রনায়। আমার পাশের মানুষটির চেহারাও দেখতে পারছি না ভালো করে, যার সাথে আমার জীবনের গাটছরা বেঁধে দেয়া হলো। আমি ছটফট করছি টাটকা বাতাসের জন্য। ফুলের সৌরভের জন্য। যদিও অনেক ফুলে সাজানো আমার চাপপাশ। ঘিরে আছে আমাকে লক্ষ মৃত ফুল, যাদের নাই কোন সুগন্ধ,প্রাণ।
তুমুল শব্দে ফোন বাজছে। অবসাদে ক্লান্ত শরীর তুলে, কোন মতনে চোখ মেলে তাকালাম ফোনের স্ক্রীনে মা এর ছবি। এত সকলে কী ব্যাপার। মা আমাকে ছেড়ে থাকতে পারছে না।রাত না পোহাতেই ফোন করল।
আস্তে উঠে গেলাম বিছানা থেকে পাশের মানুষের হাত গলে। ব্যালকুনিতে এসে বসলাম।
বললাম বলো মা, কেমন আছো? বেশী কষ্ট হচ্ছে আমাকে ছেড়ে থাকতে মা? তুমি না একটা পাগল। বিয়ে দিয়ে বিদায় করার জন্য কী যে ব্যাস্ত হয়ে ছিলে এখন আবার থাকতে পারছো না।
আমি মাকে আহ্লাদে আক্রমণ করি কিন্তু মা কোন কথা বলছে না।
কি মা নবাবজাদী বলে বকা দিবে, দাও না। আমি শোনার অপেক্ষা করছি তোমার আদরের বকা।
নাহ ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কোন কথা ভেসে আসে না। হঠাৎই শুনতে পেলাম ফোঁস ফোঁস শব্দ কি ব্যপার মা কাঁদছো কেনো? মন খারাপ করো না। আমি আসব তোমাকে দেখতে।
শোন মা...
মা আমাকে মা, বলে ডাকছে অজান্তে আমার চোখ ভিজে উঠে।
মা আরো কি যেন বলতে চায় কিন্তু কান্নার জন্য বলতে পারছে না।
আমারও দুচোখে জলের ধারা। মুখে কথা থেমে আছে। কোন রকমে বললাম, মা, মন খারাপ করে না। আমি আসব তোমাকে দেখতে। এরা মানুষ ভালো মনে হচ্ছে, আমাকে যেতে দিবে তোমাকে দেখতে।
মা আমার কথা শুনতে পায়নি মনে হলো জোড়ে করে কথা বলছে.... ঐ.. ঐ যে...ছেলেটা, যে তোকে ফুল এনে দিত সে এ্য এ্য ....প্রচণ্ড কান্না করছে মা।
কি হয়েছে মা? আমি সোজা হই আমার শিড়দাঁড়া বেয়ে একটা শীতল অনুভুতি নামতে থাকে। আমার পেটের মধ্যে ব্যাথা জমা হয়। আমি কেন যে আতংকিত হই মার কথা শোনে বুঝতে পারি না।
অস্থির হয়ে জোড়েই জানতে চাই, বলো কি হয়েছে?
ছেলেটা আত্মহত্যা করেছে, রেললাইনের উপর এক থোকা কৃষ্ণচূড়ার মতন সে পরে আছে।
এরপর থেকে লাল ফুল দেখলেই আমি আতংকগ্রস্ত হয়ে যাই ভয়ানক রকম।




সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ২:৫৩
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×