somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সহবাসের অভিমুখ

১২ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৮:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর পারস্পরিক সম্মতিতে ঘটা সহবাসের অভিমুখ কোনদিকে? ভালোবাসায় না শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক যৌন পরিতৃপ্তিতেই সীমাবদ্ধ? নাকি বৈবাহিক পরিণতির অভিমুখেই। এই বিষয়টি তো সেই দুইজন নরনারীর পারস্পরিক চাহিদা ও পরিকল্পনার উপরেই নির্ভরশীল হওয়ার কথা। সেখানে সমাজের মাথা গোলানোর দরকারই বা কি? এখন মুশকিল হলো নরনারী যখন পারস্পরিক বিশ্বাস ভালোবাসা থেকে বেড়িয়ে এসে তাদের একান্ত সম্পর্ককে জনসমক্ষে নিয়ে এসে পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ শুরু করে তখনই। জনসাধারণ তাদের কোন একজনকে বিশ্বাস করে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। চলতে থাকে বিতর্ক। কিন্তু এই বিতর্কের মধ্যে দিয়েই ফুটে ওঠে আমাদের সমাজের সামগ্রিক একটি চিত্র। সাধারণ ভাবে আমাদের বাঙালি সমাজের রক্ষণশীল ধারায়, বিবাহের আগে সহবাস অনুমোদন যোগ্য বিষয়ই নয়। যেসব পরিবার খুব বেশি গোঁড়া, তা সে বাঙালি হিন্দুই হোক আর মুসলিম, সেইসব পরিবারে প্রাক বিবাহ সহবাসের ব্যাপারে বিধিনিষেধ রীতিমত কড়া ধরণের হয়ে থাকে। কিন্তু যৌবনের ধর্মই হরমোন নিয়ন্ত্রীত। সেই অমোঘ নিয়ন্ত্রণের সুতীব্র টান এড়াতে না পেরে অনেক যুবক যুবতীই প্রাক বৈবাহিক সহবাসে সঙ্গোমসুখে লিপ্ত হতে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। এ বিশ্বপ্রকৃতির বিধান। কিন্তু মানুষের সমাজ সভ্যতায় এক এক অঞ্চলে এক একটি ধর্মীয় সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় সমাজবদ্ধ মানুষ সেই সমাজের ধর্মীয় কিংবা সমাজিক বিধান মেনে চলতেই অভ্যস্থ থাকে। যৌবনের প্রমত্ত উল্লাসে সেই বিধান কেটে বেড়িয়ে আসা যুবক যুবতীকে নিয়েই সমাজে আলোড়ন ওঠে সবচেয়ে বেশি।

যে কোন সমাজই স্থিতবস্থায় বিশ্বাসী। নিরন্তর পরিবর্তন বিপ্লব ইত্যাদির ঘোর বিরোধী। কিন্তু কালের নিয়মে সব সমাজকেই সময় ও সংস্কৃতির বিবর্তনের মধ্যে দিয়েই যেতে হয়। যার ফলে, হাজার বার চাইলেও কোন সমাজই একই জায়গায় নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। যদি বা থাকার জন্যে প্রাণপনে চেষ্টাও করে, তবে সেই সমাজকে সমকাল থেকে ক্রমাগত পিছিয়েই পড়তে হয়। ঠিক যেমন মুসলিম সমাজকে বিশ্বের নানা প্রান্তের নানান ধরণের সমাজ ও সংস্কৃতির তুলনায় ক্রমাগত পিছিয়েই পড়ে থাকতে হচ্ছে। হচ্ছে তার কারণ নিহিত আছে ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরীণ দূর্বলতার মধ্যেই। সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু এই যে বাপ ঠাকুর্দার মানসিকতায় অবহমান চলে আসা রীতি পদ্ধতি, বিধিবিধান প্রথায় আবদ্ধ থেকে একই জায়গায় স্থাণু হয়ে থাকার মানসিকতা, এই মানসিক স্থবিরতা কম বেশি সকল মানুষের মধ্যেই বিরাজমান। বিশেষত সমাজের অভিভাবক শ্রেণীর মধ্যে।

আমাদের বাংলার সমাজ বাস্তবতায় সহবাসকে কোনভাবেই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেওয়ার চল নাই। বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিম উভয় সমাজের চিত্রটাই এই বিষয়ে উনিশ বিশ সমান। সহবাসে লিপ্ত যুবক যুবতী কিংবা বিবাহিত দম্পতির পরকীয়া কোনটাই সমাজে সমর্থনযোগ্য নয় আজও। তাই সহবাসে আসক্ত নরনারীদের সমাজে লোকচক্ষুর আড়ালে আবডালেই তাদের যৌন পরিতৃপ্তির মৌতাত খুঁজে নিতে হয়। সব কিছুই ঠিকঠাক চলতে থাকে। কিন্তু মুশকিল হয় দুই ধরণের। একধরণের মুশকিল এসে উপস্থিত হয় সামাজিক জ্যাঠামশাইদের চোখে ধরা পড়ে গেলে। আর এক ধরণের মুশকিল হয় নরনারীর পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি হলে, বা কেউ কাউকে ঠকাতে চাইলে। সামাজিক জ্যাঠামশাইদের নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা নাই। নাই কাজ তো খই ভাজ মানসিকতার রুগীর অভাব আমাদের সমাজে কোন কালেই কম ছিল না। আর আজকালতো রাজনৈতিক দাদাগিরির সংস্কৃতিতে এইসব জ্যাঠামশাইদের বাড়বড়ন্তের পেছনে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যই সমধিক। সেও অন্য প্রসঙ্গ।

আমাদের আলোচনার বিষয় নরনারীর পারস্পরিক সম্পর্কের রসায়ন নিয়েই। দুটি মানুষতো সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে শারীরীক উত্তেজনা প্রশমনে পরস্পরের যৌন আবেদনে সাড়া দেওয়ার জন্যেই সহবাসে লিপ্ত হয়। যে সঙ্গমের আনন্দে অবগাহনে পরস্পরের তৃপ্তি পরস্পরের সম্পূরক। সেই আনন্দের মধ্যে অন্তঃসলিল ভালোবাসা না থাকলে তো আর সহবাস হয় না। হতে পারে না। সেক্ষেত্রে বিষয়টি হয় ফেল কড়ি মাখো তেল। যার জন্যে প্রত্যেক সমাজেই বেশ্যালয় রয়েছে। তাই নরনারীর সহবাসে যৌনসুখের মৌতাতের পরিসরে ভালোবাসার রামধনু থাকাটাই স্বাভাবিক। আমাদের আলোচনা জোর করে কাউকে সহবাসে বাধ্য করানোর বিষয় নিয়ে নয়। আমাদের আলোচনা প্রাপ্ত বয়স্ক নরনারীর পারস্পরিক সম্মতিক্রমে অনুষ্ঠিত সহবাস নিয়েই।

বস্তুত প্রাপ্ত বয়স্ক নরনারীর বিষয় হলেই যে সমাজেরও প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার তাগিদ থাকার দরকার, এই সামান্য ধ্যানধারণাটাই বা কতটুকু রয়েছে বাংলার সমাজবাস্তবতায়? সহবাস মানেই ধরেই নেওয়া হয়, বৈবাহিক পরিণতির প্রাকপর্ব। এই বদ্ধমূল ধারণা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি বাংলার সমাজ। ফলে একটি ভেঙ্গে যাওয়া সহবাসের ঘটনা নিয়ে কাদা ছোঁড়াছুঁড়িই বেশি হয়ে থাকে মূলত। এ বলে ওর দোষ। ও বলে এর দোষ। দুজনেই পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের ও লোক ঠকানোর অভিযোগ সামনে নিয়ে আসে। সমাজও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বিতর্কে নেমে পরে পারস্পরিক দোষারোপের বাগবিতণ্ডায় মেতে। রোজকার নিস্তরঙ্গ সমাজ জীবনে বেশ একটা জলঘোলা হয়। অনেকেই সেই ঘোলাজলের মৌতাত উপভোগ করে থাকে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগ ওঠে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস করার ও পরে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার। সাধারণত এই অভিযোগটি মূলত তোলেন নারীরাই। কিন্তু কেন? কারণটি লুকিয়ে আছে আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অস্থিমজ্জায়। আমাদের সমাজে নারীর জীবনে বিবাহ মূলতই ভালোভাবে জীবনধারণ করার একটি আর্থিক নিশ্চয়তামূলক বন্দোবস্ত। সেই নারী উপার্জনক্ষম হোক আর নাই হোক। নারীর মনে বিবাহের মানসিকতা ও উদ্দেশ্য মূলত পুরুষের সম্পদের উপর অধিকারজাত। বাঙালি সমাজে শাশুড়ী বৌয়ের দ্বন্দ্বরেও মূল উৎপত্তি সেইখান থেকেই। সে যাহোক, বিবাহবন্ধনের মাধ্যমেই একমাত্র নারীর পক্ষে তার ভালোবাসার পুরুষের অর্থ বিত্ত সম্পত্তির উপর আইনী অধিকার জন্মায়। সেই অধিকারের জন্যেই একজন নারীর কাছে বিবাহের মূল্য তাঁর বেঁচে থাকার সংগ্রামের সমার্থক ও পরিপূরক। প্রত্যেক নারীই চায় তার ভালোবাসার পুরুষটির অর্থ বিত্ত সম্পত্তির ভাগীদার হতে। এই কারণেই যে নারী যত বেশি শিক্ষিত, সেই নারীর তত বেশি বড়োলোক পাত্রের প্রতি লোভ বা মোহ জন্মায় সহজেই। ব্যতিক্রম সবসময়েই থাকে। কিন্তু আমাদের আলোচনার বিষয় সমাজের সামগ্রিক রূপ নিয়ে। এই লোভ বা মোহ গড়ে ওঠে পারিবারিক সংস্কৃতির ঘেরাটোপেই। অনেক ক্ষেত্রেই অভিভাবকরাই এই লোভের ইন্ধনে গড়ে তোলেন ঘরের মেয়েকে। এটাই বাংলার সমাজচিত্র। তাই একজন পুরুষ, তা সে প্রেমিকই হোক আর বিবাহের পাত্রই হোক, তার অর্থ বিত্ত সম্পত্তির পরিমানেই একটি নারীর কাছে গ্রহণযোগ্য বা লোভনীয় হয়ে ওঠে। পুরুষ যেমন একটি ভালো চাকুরী বা পেশা বা আয়ের উৎস খোঁজে, নারীও তেমনই মনে মনে একটি উপার্জনক্ষম সক্ষম পুরুষ খোঁজে যার কাঁধে ভর দিয়ে জীবনের আর্থিক ঝুঁকিগুলি বহন করা যায় অক্লেশে। নারীর মানসিকতায় বিবাহের এই আর্থিক অনুষঙ্গটিই বিবাহের প্রতি অনুরাগের মূল। নারীর মানসিকতায় যদি পুরুষের অর্থ বিত্ত সম্পত্তির উপর এই লোভ ও প্রয়োজনীয়তা না থাকতো, তবে অধিকাংশ নারীই হয়তো বিবাহ নামক প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্তের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠতো। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর মন মানসিকতা যে ধাঁচে গড়ে ওঠে, বা আরও সঠিক ভাবে বললে, পারিবারিক ও সমাজিক পরিমণ্ডলে মেয়েদেরকে যে ছাঁচে গোড়ে তোলা হয়; তাতে সেই মানসিকতার নারী দূর্লভ। যার কাছে পুরুষের অর্থের থেকে পুরুষের ভালোবাসা অনেক বেশি মহার্ঘ্য।

না আমাদের সমাজে নারীর মানসিক বলয়ে তার মন মননের নিভৃততম কোঠায় পুরুষের অর্থ বিত্ত সম্পত্তির থেকে পুরুষের ভালোবাসা বেশি মহার্ঘ্য নয় আদৌ। ভালোবাসা অনেকটাই সেই ফাউয়ের মতো। বিয়ে করলে ভালোবাসা ফ্রী। পুরুষের উপার্জিত, অর্জিত অর্থের পরিমাপেই পুরুষের ভালোবাসার মূল্য। নারীর কাছে। এটাই পিতৃতন্ত্রে নিয়ম। প্রকৃতি। এই মানসিকতার বাইরে আমরা কেউই নই। পিতা হিসাবে অভিভাবক হিসাবে বাড়ির মেয়েটির ভবিষ্যতের জন্যেও সকল পুরুষই এই একই মানসিকতার শিকার। আর সেই ধারাতেই গড়ে ওঠে প্রতিটি নারীর মন মননের নিভৃততম দিগন্ত আমাদের বাঙালি সমাজে। কি হিন্দু কি মুসলিম। কোনই তফাৎ নাই।

তাই বিবাহের প্রতিশ্রুতি একটি মেয়ের কাছে এতটাই মহার্ঘ্য। যে প্রতিশ্রুতি অন্যপক্ষ ভেঙ্গে দিলে সেটি হয় দাঁড়ায় জীবন মরণ সমস্যা। আবার অনেক ক্ষেত্রেই এমনও ঘটে, যেখানে দেখা যায়, আরও বড়ো এলেমদার পাত্রের খোঁজ পেয়ে মেয়েটিই নিজে ভেঙ্গে দেয় আগের প্রতিশ্রুতি। কারণ তার হিসাব নিকাশে ততক্ষণে উঠে এসেছে উভয় পাত্রেরই ব্যালেন্সশীট। ফলে পাল্লা যে দিকে ভারী, বুদ্ধিমতী নারী যে সেই দিকেই ঝুঁকবে সে আর বিচিত্র কি। নিজের পারিবারিক ও সমাজিক গণ্ডী থেকেই তো এই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে সে। এটাই আমাদের সমাজের প্রকৃত চিত্র। যদিও আমরা আগেই বলেছি ব্যাতিক্রম আছে ও থাকবেও। কিন্তু ব্যতিক্রম মূল আলোচনার বিষয় হতে পারে না।

এখন বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ে ভাঙা এক বিষয়। কিন্তু বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস করে নারীর শরীর সম্ভোগ করে নিয়ে কেটে পড়া সম্পূর্ণ অন্য বিষয়। যদিও আমাদের আলোচনার শুরুই হয়েছে পারস্পরিক সম্মতির প্রেক্ষিতে ঘটা সহবাস নিয়েই। তবুও এই যে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটি মেয়েকে নিজের শারীরীক আওতায় নিয়ে এসে সম্ভোগ করা এটি যে কোন বিচারেই অপরাধ। সেই বিষয় নিয়ে তো আর বিতর্ক থাকতে পারে না। কিন্তু বিষয়টি যে সব সময়ে মিথ্যা প্রতিশ্রুতির গণ্ডীতেই আবদ্ধ থাকে এমনও হয়তো নয়। অনেক সময়েই দেখা যেতে পারে পারস্পরিক যৌনতার মিল হচ্ছে না। কিংবা মিল হচ্ছে না যৌন সম্ভোগের ছন্দসুষমাতেই। মিল হচ্ছে না দুজনের চিন্তা ভাবনা অভ্যাস রুচি বিশ্বাস ও বোধের পরিসরেই। এমনটিও তো হয়তেই পারে। ওপর থেকে মানুষ সম্বন্ধে আমাদের যে ধারণা জন্মায় তা মূলত কাল্পনিক আশাজনিত অন্ধ বিশ্বাসজাত। কাছে থেকে পরস্পর পরস্পরের শরীর মন ছুঁয়ে ছেনে দেখলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাল্পনিক আশাজনিত অন্ধবিশ্বাসের বেলুনটি চুপসে যেতে বেশি দেরী নাও লাগতে তো পারে। পারেই। সেই ক্ষেত্রে যদি একজনের ভালোবাসায় ভাঁটা পড়ে যায়, যদি কেউ সম্পর্কটি থেকে বেড়িয়েই আসতে চায় তবে তাকে কি দোষ দেওয়া যায় কোনভাবে? কেননা পারস্পরিক সম্মতিতে ঘটা সহবাসে তো আর কেউ কারুর উপর জোর খাটেতে যাবে না!

কিন্তু গোল বাঁধে এইখানেও। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গোল বাঁধে নারীর দিক থেকেই। একজন পুরুষের পক্ষে একটি সহবাসের সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে আসা যতটাই সহজ, একজন নারীর পক্ষে ঠিক ততটাই কঠিন, যদি না নারী নিজেই চায় সেই সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেতে। এখনে মুলত দুইটি কারণের উল্লেখ করা জরুরী। এক, নারী যদি সহবাস কালে গর্ভবতী হয়ে পড়ে, তবে সেই দায় কিন্তু নারী পুরুষ দুজনারই সমান। দুজনকেই মিলিত ভাবে তার ভার নিতে হবে। নেওয়া উচিৎ। সেইক্ষেত্রে কোন পুরুষ যদি সেই দায় নিতে অস্বীকার করে সম্পর্ক ভেঙ্গে বেড়িয়ে যেতে চায়, তবে সেই পলায়নবাদী লম্পটের পক্ষে সওয়াল করা কোন সভ্য সমাজেরই উচিৎ নয়। শোভনীয়ও নয়। বিশেষ করে আমাদের সমাজে যেখানে অধিকাংশ নারীরই নিজস্ব জীবিকা নির্বাহের ক্ষমতা থাকে না। সেক্ষেত্রে একটি সন্তানের লালান পালনের ভার নেওয়া সেই নারীর পক্ষে শুধু যে দুসাধ্য বা কষ্টকর তাই নয়, সেটি অমানবিকও বটে। সেই ক্ষেত্রে বিবাহের প্রতিশ্রুতি থাকুক আর নাই থাকুক, সম্পর্ক ভেঙ্গে বেড়িয়ে চলে যেতে চাওয়া পুরুষটির অপরাধের ক্ষমা হয় না। আবার এইখানে খুব কম ক্ষেত্রেই যদিও সেটি হওয়া সম্ভব, যেখানে নারীর একার পক্ষেই তার গর্ভজাত সন্তানের লালন পালনের আর্থিক সক্ষমতা বিদ্যমান; সেক্ষেত্রে পুরুষটির বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ আনার বিষয়টি কিন্তু আসলেই পুরুষটির অর্থ বিত্ত সম্পত্তির উপর লোভজনিত লালসা থেকেই ঘটে থাকে মূলত। না শুধুই সেটিও নয়, সেইক্ষেত্রেও একার দায়িত্বে গর্ভজাত সন্তানের লালন পালনের আর্থিক দায়িত্ব নেওয়ার সক্ষমতাও যদি থাকে একজন নারীর, তবুও সেই দায়িত্ব পুরুষ সঙ্গীর সাথে সমান ভাবে বহন করার মানসিক আকাঙ্খা পুরুষের অর্থ বিত্ত সম্পত্তির উপর লোভ লালসা না থাকলেও তৈরী হতেই পারে। আর সেটাই তো স্বাভাবিক। পারস্পরিক সম্মতির সহবাসে। আর তেমনটি ঘটলে কি করেই বা দোষের ভাগী করা যায় সেই নারীকে?

কিন্তু সহবাসের সম্পর্ক ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসার ব্যাপারে একজন নারীর অসম্মতির দ্বিতীয় যে কারণটি থাকে, সেটি আসলেই পুরুষের অর্থ বিত্ত সম্পত্তির উপর আকাঙ্খিত ভোগদখলের রঙিন স্বপ্নের ফানুসটি ফেটে যাওয়া জনিত। সেই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা কোন নারীর পক্ষেই বহন করা সহজসাধ্য হয় নয়। তা সেই নারী আর্থিক ভাবে স্বউপার্জনের সক্ষমতায় স্বাবলম্বী হোক আর নাই হোক। আর বিশেষ করে সেই নারীর যদি নিজস্ব উপার্জনের পথ খোলা না থাকে তো কথাই নাই। তাই সহবাসের পর নরনারীর সম্পর্কের অবনতির ফল মারাত্মক ভাবেই দেখা দেয় আমাদের সমাজে। যার প্রধান এবং প্রধানতম কারণই হলো নারীর জীবিকা নির্বাহের অক্ষমতা ও নারীর মননে পুরুষের ভালোবাসার থেকেও পুরুষের অর্থ বিত্ত সম্পত্তিই মহার্ঘ্য হয়ে ওঠার আবহমন কালের পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি।

এই সংস্কৃতির আলোতেই প্রাকবিবাহ সহবাস থেকে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস ইত্যাদি বিষয়গুলি ঘটে থাকে আমাদের সমাজ বাস্তবতায়। আর পুরুষ আধিপত্যবাদের মানসিকতায় অধিকাংশ পুরুষই নারীর এই দুর্বলতার সুযোগটি নিয়েই নারীসঙ্গ ভোগ করে সময় সুযোগ মতো নারীকে ইউজ এণ্ড থ্রো করে কেটে পড়ারই চেষ্টা করে। এই যদি হয় একটি সমাজের এক অংশের পরিচয় তাহলে বোঝাই যায় সমজটি গভীর ভাবেই অসুস্থ। এখানে সহবাসের একটিই অনুষঙ্গ, অবাধ যৌনসম্ভগ। যতক্ষণ দুইজনের চাহিদা ও আকাঙ্খার পরিপূরক থাকে সেই সম্ভোগের মৌতাত, ততক্ষণই ভালোবাসা আদর খুনসুটির মধুর বীণা বাজতে থাকে পরস্পর রাগিণীর যুগলবন্দীতে। কিন্তু যেইমাত্র পারস্পরিক দাবি দাওয়ার হিসাব নিকাশেই গরমিল দেখাদিতে শুরু করে তখনই সুরেলা রাগিনী বেসুর রাগে বেজে ওঠে। যার আওয়াজ ক্ষেত্র বিশেষে সমাজের কান ঝালাপালা করে দেওয়ার পক্ষে যেথেষ্টই। এবং অধিকাংশ সময়েই এই সময়েই সংঘঠিত হয় নানান রকমের অপরাধ। ভাঙ্গা সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেতে অনেক সময়ই বীভৎস অপরাধের আশ্রয় নিতে স্বচেষ্ট হয় কোন না কোন পক্ষ। নষ্ট হয় এক একটি অমূল্য জীবন।

সমাজের অভ্যন্তরে এই অসুখের কোন প্রতিষেধক না থাকার কারণেই বর্তমান সময়ে এই ধরণের ঘটনাগুলি ঘটে চলেছে আকছাড়। মানুষের অতিরিক্ত ভোগলিপ্সা ও যেন তেন প্রকারে চটজলদি সকল চাহিদাগুলি পুরণের সুতীব্র বাস‌না মানুষের অন্তর প্রবৃত্তির উপর নৈতিকতা ও আদর্শের কোন রকম নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে দিচ্ছে না। উচিৎ অনুচিৎ বোধ আদর্শ ইত্যাদি মানবিক গুনগুলি এখন দিনে দিনে ক্রমশই ব্রাত্য হয়ে পড়ছে। ফলে প্রেম ভালোবাসার অনুভুতিগুলিও হয়ে গিয়েছে মূলত ভোগবাদী চাহিদা কেন্দ্রিক। মূল অসুখের উৎপত্তি হয়তো এইখান থেকেই। এখন কথা হচ্ছে এই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ ও এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় কি? এর সত্যই কোন একরৈখিক চটজলদি উত্তর হয় না। ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় খুঁজে বার করতে হবে সমাজকেই। নিজেরই গরজে। দেখতে হবে সামাজিক রীতি রেওয়াজ বিধিনিষেধ নানাবিধ সাম্প্রদায়িক প্রথাগুলির কোথায় কোথায় কি ধরণের গলদ রয়েছে। দূর করতে হবে সেইগুলি। মানুষের জীবন বিশ্ব প্রকৃতির সাথে যত বেশি রকম ভাবে সামঞ্জস্যহীন হয়ে পড়বে ততই বেশি করে ছড়িয়ে পড়তে থাকবে এই রোগ। তাই বিশ্বপ্রকৃতির সাথে সামাজিক জীবনের সামঞ্জস্য বিধানেরও রয়েছে আশু প্রয়োজন। এইসব বিষয়গুলি নিয়ে ভাবনা চিন্তা আলাপ আলোচনার মূল দায়িত্ব কিন্তু সমাজতাত্বিকদের। নানান পেশায় নিযুক্ত বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্বও কিছু কম নয়। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব ঘরে ঘরে অভিভাবকদেরই। তারাই মূলত মানুষ গড়ার প্রধান কারিগর। সেইখান থেকেই যদি অতিরিক্ত ভোিগবাদী মানসিকতার প্রতিষেধকের বন্দোবস্ত করা যায়, তবে সেইটিই হতে পারে অন্যতম প্রধান ও কার্যকরী একটি পদক্ষেপ। এরপর মুক্ত চিন্তার পরিসর, ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশার স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সার্বিক বিকাশের সুযোগ সুবিধার সামগ্রিক উন্নতি ইত্যাদি বিষয়গুলিও সমধিক জরুরী। অর্থাৎ সমাজবিবর্তনের আশায় বসে থেকে কালক্ষেপ না করে সমাজ পরিবর্তনের ধারাটিকে ক্রমাগত বলশালী ও গতিশীল করে তোলার প্রতি যত্নবান হতে হবে প্রতিটি শুভবোধ সম্পন্ন দায়িত্বশীল নাগরিককেই।

শ্রীশুভ্র


সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৮:৩১
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×