‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’বইটির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নয়, লেখক নিজেকেই বিতর্কিত করেছেন।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
একাত্তর পরবর্তী প্রজন্মের একাত্তরের ঘটনাপ্রবাহ তথা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস জানার একটাই পথ আর তা হল এর ঐতিহাসিক দলিল। এ ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রজদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ! তারা যে সর্বদা সংকীর্ণ দলিয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে সত্যি কথাটা বলতে পেরেছেন তার কোন উদাহরণ আমরা আজো খুঁজে পাইনি।
আমরা এমন এক জাতি, যারা অবলীলায় নিজেদের সবথেকে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে ছিনতাই করি, বিক্রি করি, ব্যবহার করি!জাতীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করি!পিতাকে অস্বীকার করি!
আমরা এমন এক জাতি, ক্ষমতার জন্য যারা দেশকে বহিঃশত্রুর কাছে বন্ধক রাখে তাদের বন্দনায় বিভোর হয়ে থাকি।
দুর্ভাগ্য আমাদের, এ দেশে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের ইতিহাসের পাতার লেখাগুলোও পরিবর্তিত হয়ে যায়। এর জন্য দায়ী আমাদের সেই অগ্রজরাই। অনুজদের অধিকার ঐতিহাসিক সত্য জানার। সেই অধিকার বঞ্চিত করে তার পরিবর্তে তাদেরকে এই যে ক্রমান্বয়ে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে এর দায় অগ্রজদেরই।
‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’বইটির লেখক আর কেউ নন ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ’ এ কে খন্দকার বীর উত্তম। তাঁর কাছ থেকে নতুন প্রজন্ম সেই ইতিহাসই আশা করবে যা হবে সন্দেহাতীত। যা থাকবে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। অথচ আমরা অবাক বিস্ময়ে এই প্রথম লক্ষ করলাম কোন গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আগত অতিথিরাই গ্রন্থে সন্নিবেশিত কিছু তথ্য সম্পর্কে বলেন এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের অবকাশ রয়েছে! একটি গ্রন্থের কিছু তথ্য যদি অসত্য বা বিতর্কিতই হয় তাহলে সেই গ্রন্থটি কি করে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হিসেবে আলাদা মর্যাদা পায় তা সেই বিজ্ঞজনেরাই ভাল বলতে পারবেন।
আমরা সাধারণ জ্ঞানে বুঝি কোন মিথ্যেকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে হলে বা সত্য বলে প্রমাণ করতে হলে সেই মিথ্যের সাথে অনেকখানি সত্যের মিশেল দিতে হয়। সেটা নিশ্চয়ই একজন সৎ ইতিহাসবিদ বা কোন সম্মানিত ব্যক্তির কাছ থেকে কেউ আশা করেন না।
ঐ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, বইটি কিছু তথ্য নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাতে ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অংশ। এতে করে নতুন প্রজন্ম অনেক কিছু জানতে পারবে। আমাদের প্রশ্ন হল নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে কেন বিতর্কিত তথ্য উপস্থাপন করতে হবে। এ প্রশ্নটি কেন লেখকের কাছে করা হল না?
বর্তমান সময়ে আওয়ামীলীগের ঘোর বিরোধী বলে পরিচিত বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, “এ কে খন্দকারের লেখা বইটি আমি পড়ছি। তাকে যে মাপের মানুষ বলে মনে করতাম, তার লেখায় তা দেখা যাচ্ছে না। ৭ মার্চের ভাষণকে তিনি যেভাবে বিতর্কিত করেছেন, তা ভবিষ্যতে জাতি তাকে নিন্দা করবে"।
এটা নিশ্চয়ই লেখকের জন্য সম্মানজনক নয়? বঙ্গবন্ধুর রণকৌশল ভুল ছিল কথাটি তখনই প্রযোজ্য হত যদি একাত্তরে তিনি ব্যর্থ হতেন বা তখন যদি দেশ পরাধীনতা মুক্ত না হতে পারত। বাস্তবতা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও রণকৌশলেই একাত্তরে দেশ স্বাধীন হয়েছে । আজ এতদিন পরে কি করে লেখকের মণে হল বঙ্গবন্ধুর রণকৌশল সঠিক ছিল না। তিনি যেমনটি করলে ভাল হত বলে মণে করছেন সেটি তো বুমেরাংও হতে পারত। এখন এ সব কথা বলে বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্বকে খাটো করার চেষ্টা কি দুরভিসন্ধিমূলক নয়?
এ প্রসঙ্গে কাদের সিদ্দিকী যথার্থই বলেছেন, “যেভাবে একটি ভূখণ্ডকে স্বাধীন করতে হয়, যখন যেটা বলা দরকার, বঙ্গবন্ধু সেটা পেরেছিলেন বলেই আমরা স্বাধীন হতে পেরেছি"। ইতিহাসও সে সাক্ষী দেয়। আর তাই তিনি বলেন, “এ কে খন্দকার, ৭ মার্চের ভাষণ এবং সেই সময় যুদ্ধ করলে কত ভাল হতো না হতো- এমন যে মূল্যায়ন করেছেন তা তার নির্বুদ্ধিতার শামিল। ওনার বইয়ে কোনো ইতিহাসের ঘটনা নাই। তিনি যা ভেবেছেন, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন পাকিস্তানি দৃষ্টিভঙ্গিতে। তিনি সেনানিবাসে ছিলেন, সেখানে থেকে সামরিক দৃষ্টি কোন থেকে বিচার করেছেন”। অথচ এই গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তা অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকে জানতে হলে এ কে খন্দকারের এই বইটি সকলেরই পড়া উচিত!
আমাদের দুর্ভাগ্য এখানেই। আমরা কাকে বিশ্বাস করব, কাকে মিথ্যেবাদী বলে ঘৃণা করব? এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত তথ্যের সত্যাসত্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একাত্তর টিভি কর্তৃপক্ষ আজ পাকিস্তানের জিও টিভীর সাত মার্চের ভাষণ নিয়ে করা ডকুমেন্টারির একটি ক্লিপিং দেখায়। যেখানে দেখান হয়েছে বঙ্গবন্ধু ঐ ভাষণ “জয় বাংলা” বলে শেষ করেছেন। আমাদের অগ্রজ গন আজ এতটাই দেউলিয়া হয়ে গেছেন যে তাদের মিথ্যাচারকে প্রমাণ করতে আমাদের সেই পাকিস্তানের কাছেই হাত বাড়াতে হয়! যাদের সাথে দীর্ঘ নয়টি মাস যুদ্ধ করে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হতে হয়েছে। এটা লজ্জার, এটা যে কত বড় লজ্জার তা কি তারা বুঝতে পারছেন?
‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ বইটি এমনই এক সময় প্রকাশ করা হল যখন আওয়ামীলীগ নয় জামায়াত-বিএনপির প্রধান লক্ষ বঙ্গবন্ধু। আর তারও একটিই কারণ বঙ্গবন্ধু তো নিছক একজন নেতাই নন। তিনি একটি জাতির রূপকার। বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ-বাংলাদেশ এ সবই এক সূত্রে গাথা। বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করে তুলতে পারলেই মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করা সহজ হয়ে যায়। আর মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করা গেলে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এর সবই দুর্বল হতে বাধ্য। যেটি বিএনপি-জামায়াতের বর্তমান রাজনীতির মূল এজেন্ডা। তারা গত কয়েক বছর যাবত যে ভাষায় কথা বলছেন ঠিক একই ভাষায় যখন এই বইটি লেখা হয়েছে তখন আওয়ামী ঘরানার বলে পরিচিত হলেও সঙ্গত কারণেই লেখকের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠবে এটাই স্বাভাবিক। খন্দকার মুশতাকও তো আওয়ামীলীগেরই নেতা ছিলেন, তাই না? তার কর্মকান্ড নিশ্চয়ই এ জাতি ঘৃণা ভরে চিরকাল মন রাখবে।
আর এই সন্দেহটা আরো পোক্ত হয়েছে যখন দেখা গেল বিএনপির নেতৃবৃন্দ সোৎসাহে লেখকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তারা আজ সবাই সমস্বরে বলে উঠেছেন আমরা নিজ কানে শুনেছি। তাদের এই নিজ কানে শোনার কথা শুনে আজকের প্রজন্ম যদি প্রশ্ন ছুড়ে দেয় এই বলে যে, এখন যারা বলছেন "আমি নিজ কানে শুনছি শেখ মুজিবর রহমানকে বলতে " জয় পাকিস্তান"।" তাদের কাছে প্রশ্ন; আপনাদের এই নিজ কান কি এতদিন ধরে খন্দকার সাহেবের কাছে গচ্ছিত ছিল? এই নিজ কানও বুঝি ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ গ্রন্থের সাথে একই সাথে অবমুক্ত করা হয়েছে? তার উত্তরে তারা কি বলবেন সেটা তারাই ভাল জানেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে আমরা তাদের মাথায় তুলে রাখি এটা যেমন ঠিক তেমনি এটাও ঠিক এই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ পনের আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন। জেলের মধ্যে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন। কর্নেল তাহের, খালেদ মোশাররফদের মত অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছেন। এদেরই কেউ কেউ হত্যাকারীদের সহায়তা করেছেন। পরবর্তীতে বীরের মর্যাদা পর্যন্ত দিয়েছেন। কাজেই দুঃখের সাথে একথা পুনরায় বলতেই হচ্ছে, সব মুক্তিযোদ্ধা সারা জীবন মুক্তিযোদ্ধা থাকেন না। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে আজ অবধি এ জাতী তা বার বার দেখেছে আজো দেখছে। এবার অন্তত এর শেষ হওয়া উচিৎ।
সেক্টর ফোরাম ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ বইটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতিতে লিপ্ত দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীদের হাতে বিভ্রান্তি ছড়াবার নতুন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে বইটির দ্রুত তথ্য সংশোধন ও পরিমার্জনের আহবান জানিয়েছে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ৭১।এর পরেও যদি কেউ বলেন বইটির সকল তথ্য সঠিক তাহলে তা সত্যের অপলাপ বৈ কি?
কারো সমালোচনা করতে হলে তাকে যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করেই করতে হয়। এতে তিক্ততার সৃষ্টি হলেও সাধারণত সত্যের অপলাপ হয়ে ওঠে না। এই গ্রন্থের লেখকের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেই বলছি তিনি তাঁর লেখায় বঙ্গবন্ধুকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছেন। আর তাঁর এই ব্যর্থতাই তাকে বিএনপি-জামায়াত জোটের কাছে মহান করে তুলেছে। প্রকারান্তরে এর মাধ্যমে তিনি নিজেকেই ছোট করেছেন। পঁচাত্তরে তাঁর ভূমিকা যতটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল এই লেখনীর মাধ্যমে তিনি কেবল তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন। কাজেই বলতেই হয়; বঙ্গবন্ধু নয়, তিনি নিজেকেই বিতর্কিত করেছেন।
[email protected]
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
তালগোল
তুমি যাও চলে
আমি যাই গলে
চলে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফুরালেই দিনের আলোয় ফর্সা
ঘুরেঘুরে ফিরেতো আসে, আসেতো ফিরে
তুমি চলে যাও, তুমি চলে যাও, আমাকে ঘিরে
জড়ায়ে মোহ বাতাসে মদির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন
মা
মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।
অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।
একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প
তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে
ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন