somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'আলোর পথযাত্রী'ঃ পর্ব ১

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী, একসময় পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞানের পীঠস্থান যার আস্তিত্ব এখন কেবল ইতিহাসের পাতায়। আর সেই বিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর সর্বশেষ গবেষক ছিলেন একজন নারী।

পরাবৃত্ত, অধিবৃত্ত এবং উপবৃত্ত নিয়ে তাঁর বিখ্যাত রচনা “On the Conics of Apollonius”। ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেয়া এই মহান গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ এর ঝোঁক ছিল মূলত ব্যবহারিক প্রযুক্তির উপর, যা তাকে অ্যাস্ট্রবেল(Astrobell) আবিষ্কারে উদ্বুদ্ধ করে। অ্যাস্ট্রবেল ব্যবহৃত হত সূর্য ও নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয়ে, পাওয়া যেত গোলীয় জ্যোতির্বিদ্যার সঠিক সমাধান। এছাড়াও তিনি তরলের আপেক্ষিক গুরুত্ব এবং পরিস্রাবণ ও তরল তলের উচ্চতা মাপক যন্ত্র উদ্ভাবন করেন, যার নাম দেয়া হয় হাইড্রোস্কোপ(Hydroscope)।

মাত্র উনিশ বছর বয়সে তিনি টলেমির 'Almagest' উপর লেখা তাঁর পিতার বিশ্লেষণধর্মী একটি গ্রন্থের সম্পাদনা করেন। 'Almagest' হচ্ছে তের খন্ডের সেই বিশাল গ্রন্থ যাতে টলেমি তাঁর সমসাময়িক যাবতীয় গণিত ও মহাকাশ জ্ঞান সংকলিত করেন এবং আরবীয় পণ্ডিতগন যার নামকরণ করেন 'Al-kitabul-mijisti' বা 'মহান গ্রন্থ'। তিনি নিয়মিত আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীতে বিজ্ঞানবিষয়ক বক্তৃতা দিতেন, তুলে ধরতেন বিভিন্ন বিষয়ের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। দেশ বিদেশের জ্ঞানী গুণী গবেষকেরা সুদূর পথ পাড়ি দিয়ে আসতেন তার বক্তৃতা শুনতে। বিভিন্ন দেশে তার অনেক ছাত্র ছিল। তার প্রচেষ্টায় সে সময়কার মানুষ ধীরে ধীরে বিজ্ঞানমনষ্ক হতে থাকে, দূর হতে থাকে সামাজিক এবং ধর্মীয় বিভিন্ন কুসংস্কার। আর এটিই তাঁর জীবনে কাল হয়ে দাড়ালো। ফুঁসে উঠলেন খ্রিষ্টীয় ধর্মব্যবসায়ীরা। কারণ তিনি ছিলেন প্যাগন ধর্মাবলম্বী।

সে সময় খ্রিষ্ট ধর্মের প্রচার শুরু হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই যেখানে ধর্ম থাকে, সেখানে অধর্ম দানা বাঁধে। প্যাগান ও খ্রিষ্টানদের মাঝে দ্বন্দ লেগেই থাকত। প্যাগানদের জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চাকে ধর্মান্ধ খ্রিষ্টানরা সহ্য করতে পারল না, প্যাগানদের তারা ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিতে লাগলো। তখনকার খ্রিস্টান আর্চ বিশপের নাম ছিল সিরিল। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করে জ্ঞান বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি হচ্ছিল, তা সিরিলকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। আর সেই ভাবনা থেকেই জন্ম নিল ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য কালো অধ্যায়ের।

৪১৫ সালে একদল ধর্মান্ধ খৃস্টান জনতার হাতে তিনি নিহত হন। তারা তাঁকে নগ্ন করে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যায় চার্চ সিজারিয়ামে, ঝিনুকের খোল দিয়ে তাঁর দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে এবং জলন্ত আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এবং জলন্ত টুকরোগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে দেয়া হয়! আর এই জঘন্য কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আর্চ বিশপ 'সিরিল'কে 'সেইন্ট' উপাধী দেওয়া হয়! কি নির্মম রসিকতা!! মর্মান্তিক এই ঘটনা ছিল গণিত ও বিজ্ঞানের উপর এক ভয়ংকর আঘাত। মার্গারেট ওয়ের্থহেইম তাঁর 'পীথাগোরাসের ট্রাউজার' গ্রন্থে বলেন, "গ্রীক গণিতবিজ্ঞানের মহান যুগ, যার সুচনা এক পুরুষের জন্মের মধ্য দিয়ে, তা সমাপ্ত হয় এক নারীর মৃত্যুতে।"

সেই নারীটি আর কেউ নন, মহান গ্রিক গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ 'হাইপেশিয়া'...

সমসাময়িক খ্রিস্টান ঐতিহাসিক সক্রেটিস তাঁর চার্চের ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণনা করেন- "একদা আলেকজান্দ্রিয়াতে ছিল এক নারী-দার্শনিক থিওনের কন্যা হাইপেশিয়া, যিনি সাহিত্য ও বিজ্ঞানে এরুপ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন যা ছাড়িয়ে যায় তাঁর কালের সব দার্শনিকের জ্ঞান। প্লেটো এবং প্লুটোনিয়াসের উত্তরসূরী হিসেবে তিনি উন্মোচিত করতেন দর্শনের তত্ত্ব দূরদূরান্ত থেকে আগত তাঁর শ্রোতাদের সামনে। আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবহারের সাবলীলতায় প্রায়ই তিনি বের হতেন জনসমক্ষে, যা তিনি অর্জন করেছিলেন মনের উৎকর্ষে। এমনকি পুরুষের সমাবেশে তার অবস্থান ছিলনা মোটেও ব্রীড়াবনত। কারণ অনন্য আত্মমর্যাদা এবং গূণের দরূন তিনি ছিলেন সকল পুরুষের শ্রদ্ধার পাত্র।"

তাঁকে মনে করা হত শাস্ত্রের পণ্ডিত, বলা হত 'আফ্রোদিতির দেহে প্লেটোর আত্মা'। হাইপেশিয়ার মৃত্যুর সাথে সাথে নিভে যায় আলেকজান্দ্রিয়ার বহু যুগের জ্ঞান চর্চার শেষ প্রদীপটুকু। পৃথিবী নিমজ্জিত হয় গভীর অন্ধকারে। নিউটন গ্যালিলিওরা সেই অন্ধকার দূর করার আগে প্রায় এক হাজার বছর মানব সভ্যতা ডুবে ছিল কুসংস্কারের অতল গহ্বরে।

'তোমার চিন্তা করার অধিকার সংরক্ষণ কর। এমনকি ভুলভাবে চিন্তা করা একেবারে চিন্তা না করা থেকে উত্তম' কিংবা 'কুসংস্কারকে সত্য হিসেবে শিক্ষা দেয়া একটি ভয়ংকরতম বিষয়' - তাঁর উক্তিগুলো থেকে তাঁর জ্ঞান বা প্রজ্ঞার কিছুটা আন্দাজ করা যায়। ধর্মান্ধরা তার কন্ঠরোধ করলেও মুছে ফেলতে পারেনি তার আবদানকে তাই আজও মানুষ গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরন করে এই মহান নারীকে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৩৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×