
দূর থেকে নীলা হেঁটে আসছে। লম্বা ছিপছিপে দেহ, গায়ে একটা ধূসর রঙের কুর্তি। মেয়েটার গায়ের রঙ শ্যামলা তবুও এই রং ভালই মানিয়েছে। সব গল্প-উপন্যাসের নায়িকা হয় স্বর্গের হুরের মত, নাহয় আকাশের পরীর মত। কিন্তু মাঈদের ভালোবাসার মানুষটি তেমন কিছুই না। একদম সাদাসিধে একটা মেয়ে। দেখতে আহামরি সুন্দর না। অন্যসব মেয়ের মত আহ্লাদি না। একটু সিরিয়াস টাইপ, একটু বেশি প্র্যাক্টিকাল। এই অন্যরকম মেয়েটাকেই কেন যেন মাঈদের অনেক ভাল লাগে। হয়তবা এমন একটি মেয়েই সে জীবনসঙ্গী হিসেবে মনে মনে চেয়েছে। মাঈদ একটা কালো শার্ট পরেছে। অনেক বেশি হ্যাংলা পাতলা, মনে হয় একটু জোরে বাতাস হলেই উড়ে যাবে। নীলা সামনে এসে দাঁড়ালো।
- মাঈদ, রাইট?
- হুম।
দুজনই খুব অস্বস্তি ফিল করছে। এক মিনিটের নীরবতা। কেউ বুঝে উঠতে পারছেনা কি বলবে। উসখুস করছে দুজনই। এভাবে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়। মাঈদ বলল ‘চল রিকশায় উঠি’। দুজন পাশাপাশি বসে আছে। দুদিকে চাপতে চাপতে এমন অবস্থা যে আরেকটু হলে পড়েই যাবে।
সম্পর্কের ৩ মাস পর মাঈদ আর নীলার আজ প্রথম দেখা। এর আগে দুজন দুজনের কয়েকটা ছবি দেখেছে শুধু। সুযোগ হয়ে ওঠেনি দেখা করার। তাই অনেক পরিকল্পনার পর সব কল্পনা জল্পনার অবসান ঘটিয়ে দুজন আজ মুখোমুখি। বসুন্ধরা সিটির সামনে রিকশা থেকে নেমে পড়লো। দু' মগ কফির অর্ডার দিয়ে মাঈদ নীলার সামনে বসল। কারো মুখে রা নেই। এমন বোধহয় খুব কমই হয় যে প্রেমিক প্রেমিকা দুজনই এতটা ঘাবড়ে যায়। নীলাই মুখ খুলল ‘ম্যাসেঞ্জারে আসো’। সামনাসামনি বসে দুজন ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করছে।
মাঈদ- কেমন আছ?
নীলা- ভাল। তুমি?
মাঈদ- তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
নীলা- মুখে বলা যায়না?
দুজনের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে আছে। নীলা মনে মনে ভাবছে একটা ছেলে কিভাবে এতটা লাজুক হয়! আগেই জানত যে মাঈদ একটু লাজুক স্বভাবের। তাই বলে এতটা? তবে কিউট লাগছে ছেলেটাকে। এজন্যই মাঈদ কে ভালো লাগে নীলার। একদম অন্যরকম। সবার চেয়ে আলাদা। হাল ফ্যাশানের ধার ধারে না। নিজের মত চলে। বিশাল বড় ফ্রেন্ড সার্কেল নেই। মেয়ে ফ্রেন্ড তো নেই ই। শুধু নীলার কয়েকটা ফ্রেন্ড এর সাথে টুকিটাকি কথা বলে, এই যা। একা থাকতেই বেশি পছন্দ করে। কোন বদ অভ্যাস নেই। একটু বেশি রাগী তবে ম্যানেজ করা যায়। ছেলেটা লজ্জায় মুখ তুলতে পারছেনা। কফি এতক্ষণে বরফ শীতল হয়ে গেছে। কেউ একটা চুমুকও দেয়নি। কিছুক্ষণ চ্যাট করার পর দুজন সেখান থেকে উঠে গেল। পাশাপাশি হাঁটছে। নীলা ভাবছে কিভাবে ছেলেটার লজ্জা ভাঙ্গানো যায়। সে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে কিভাবে মাঈদকে স্বাভাবিক করবে। সে মেয়ে, লজ্জা পেতেই পারে কিন্তু মাঈদ? হাঁটতে হাঁটতে মাঈদের গা ঘেঁষে এলো নীলা। নীলার গায়ের স্পর্শ পেতেই চমকে উঠল মাঈদ আর লজ্জায় গাল দুটো রাঙ্গা হয়ে গেল। কি বোকা ছেলেটা! নীলার একটু রাগই হল। তবুও ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিল। যেমনই হোক মাঈদ তো তারই। শুধু ওর একার।
মাঈদ মফস্বলের ছেলে। শহুরে হালচাল তেমন বোঝেনা। রেস্টুরেন্টে গেলে এত মানুষের ভিড়ে সে অস্বস্তিবোধ করে। তাই কোনো নিরিবিলি রেস্টুরেন্টে যাওয়া চাই। কোলাহল তার পছন্দ না। তাই বেশিরভাগ সময়ই দুজন লেকের ধারে কাটায়। নীলা চায় মাঈদের সাথে ছবি তুলতে। চায় তাদের ভালোবাসার স্মৃতি একটু একটু করে জমুক। কিন্তু ছবি তুলতে মাঈদের একদম ভাল লাগেনা। তবুও মাঝে মাঝে দু' একটা তুলতে রাজি হলেই নীলা খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। মাঈদ বুঝে উঠতে পারেনা ভ্যালেন্টাইন্স ডে, বার্থডে তে কি গিফট দেবে। এসব আদিখ্যেতা তার ভালোও লাগেনা। তবুও যখন নীলার বার্থডে তে ছোট্ট একটা ফ্লাওয়ার বুকে নিয়ে আসে আর বলে ‘চল তোমাকে একটা ড্রেস নিয়ে দি। আমিতো পছন্দ করতে পারিনা। তুমি ই পছন্দ করে নাও’। নীলা খুশিতে গদগদ হয়ে যায়। এভাবেই একজন আরেকজনের সাথে ভালোই মানিয়ে নিয়েছে।
সেদিন আবার দুজন সেই লেকপাড়ে গিয়ে বসেছিল। নীলার একই জায়গা বারবার ভালো লাগেনা। তাই বলেছিল চল এবার অন্য কোথাও যাই। কিন্তু মাঈদ না করে দিল। তার মতে সে আর নীলা একসাথে থাকলে পৃথিবীর যে কোন জায়গায় সে ঘণ্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে পারবে। তা যত বোরিং জায়গাই হোক না কেন। তাহলে নীলা কেন পারবেনা। কিন্তু মাঈদ বোঝেনা সবাই তো এক না। একেক মানুষ একেক রকম। তাই একেক জনের চাওয়া পাওয়াও অন্যজন থেকে আলাদা। আর একেক জনের অনুভূতির প্রকাশ ভঙ্গিও স্বকীয়। তার মানে এই না যে প্রকাশ ভঙ্গি মেলেনা বলে অনুভূতিরও মিল নেই। নীলা মাঈদ কে বোঝাতে পারেনা এসব। ফেরার পথে রিকশায় বসে অন্যদিকে ফিরে চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করে। মাঈদ হয়ত বুঝতে পারে, কিছু বলেনা। সে পারেনা সরি বলে বুকে টেনে নিতে অভিমানী মেয়েটাকে। এসব তার ধাতে নেই। রাতেই আবার সব ভুলে গিয়ে ছেলেটাকে আপন করে নেয়। নীলা বুঝতে পারে ছেলেটা এমনই। সে যেমন আছে সেভাবেই ভালোবাসবে নীলা। কোন অভিযোগ করবেনা। মাঈদ ও তো এই চার বছরে অনেক চেঞ্জ হয়েছে শুধুমাত্র নীলার জন্য। নিজেকে অনেকখানি বদলে নিয়েছে নীলার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য। তবুও চায় যেভাবেই হোক দুজন দুজনের পাশে থাকতে। তাদের জীবনের গল্প তপুর গাওয়া সেই গানটির সাথে মিলে যায়,
''তুমি চাও রোদ্দুর, আমি চাই আকাশ মেঘলা....
মেলেনা, আজ কিছু মেলেনা
ভালোবাসা বাঁচতে চাওয়া ছাড়া;
এ দুটোই মিলে যায়, বসে একা ভাবি তাই
এইকি বেশি না?''
কিন্তু এমন কম্প্রোমাইজ করে কতদিন চলবে? এভাবে কি ভালোবাসার বন্ধন টা আরো গভীর হবে? নাকি আস্তে আস্তে ভালোবাসাটুকু নিঃশেষ হয়ে যাবে? মাঈদ আর নীলার এর উত্তর জানা নেই। শুধু জানে দুজন দুজনকে ভালোবেসে যাবে আজীবন। অবশ্য এটা ঠিক কম্প্রোমাইজ না, আন্ডারস্ট্যান্ডিং। দুজন দুজগতের বাসিন্দা। দুটি ভিন্ন রং মিলেই তো নতুন রঙের সৃষ্টি হয়। টুকটুকে লাল আর গাঢ় সবুজ মিশে হলদের আবির্ভাব। তেমনি দুটি ভিন্ন রঙের মন যদি একে অন্যকে রাঙ্গাতে পারে তখনই তো ভালোবাসা পূর্ণতা পায়। হোক না একটু মনোমালিন্য। হোক না একটু ঝগড়াঝাটি। তবু তো দিনশেষে শুনতে পায় মিষ্টিমাখা একটি শব্দ ‘ভালোবাসি’......।
১৩.০২.২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৭ সকাল ৭:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




