ইশ্বর কি চাহেন জানি না। শুধু দেখি রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে, উলুখাগড়ায়য় প্রানে মরে। এই আধুনিক যুগের এই যুদ্ধের দামামা বিশেষ করে বাণিজ্যপথের যুদ্ধে কেউ মরুক আর বাচুক তৃতীয় বিশ্বের উপর দিয়ে আসল খড়গটা যাবে বলে দিলুম। চীন আআমেরিকা পারমানবিক যুদ্ধ লাগলে আমি ভাবতাম না তবে বানিজ্য যুদ্ধ তাই ভাবছি। অনেকেই ভাবছেন চীন, আম্রিকা, কানাডা ইইউ লড়ছে আমাদের কি! ভায়া যত জাঁতাকল সব তার এই তৃতীয় বিশ্বের উপর। বানিজ্য যুদ্ধের প্রভাব পারমানবিকের থেকেও কঠিন ভাবে সারা বিশ্ব জুড়ে পড়বে। বিশ্ব ব্যাংক আই এম এফ সকলের ধারক বাহক ইউরোপীয় আর আমেরিকানরা। ইহারা নিজের স্বার্থ দেখবে। আর তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন ঋণে সুদের হার ও চাপ বাড়বে।
ঘটনার সূত্রপাত হল তখন যখনি আমেরিকা ইস্পাতের উপর ২৫ পারসেন্ট আর অ্যালুমিনিয়াম এর উপর ১৫পার্সেন্ট ট্যাক্স বসিয়েছে। জবাবে চীন ৩০০ কোটি ডলারের আমেরিকান পন্যের উপর ট্যাক্স বসিয়েছে। ইইউ আমেরিকার হার্লি ডেভিসন মটরবাইক, হুইস্কি, কমলার রসের উপর ট্যাক্স ২৫ পার্সেন্ট থেকে শতভাগ করেছে। এতে আপাতত ৩ বিলিয়ন খসবে। ভবিষ্যতে সেটা আরো বাড়বে।
কানাডাও জি-৭ সম্মেলনের পর আর বসে নেই। বসিয়ে দিয়েছে ট্যাক্স। ফলে আমেরিকার হাসফাস অবস্থা শুরু হতে দেরি নেই। সেন্টার ফর পলিসির প্রধান নির্বাহী মোস্তাফিজুর রহমানের মতে এতে বাংলাদেশ শুরুর দিকে বেশ লাভবান হবে। বানিজ্য যুদ্ধের ফলে চীন থেকে পোষাক আমদানি কমাতে পারে ইউ এস এ আর সাথে সাথে খুলে যাবে বাংলাদেশের ভাগ্য। কেননা চীনের পোষাক শিল্প ধাক্কা খেলে বাংলাদেশের জন্যে তা সুবর্ন সুযোগ। অপরদিকে ভিয়েতনাম টিপিপি সদস্য ফলে আমেরিকার পোষাক ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করতেও প্রচুর খরচ হবে। ফলে আমেরিকায় বাংলাদেশের পোষাক শিল্প একচেটিয়া বানিজ্য করতে পারবে বলে আশা করা যায়। তবে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে কোন সন্দেহ নেই। কেননা আমেরিকায় মন্দা হলে তা দেশের পোষাক শিল্পের বাজারে ধাক্কা দেবেই। আর এটাই আমাদের বিকল্প বাজারের গুরুত্ব আরো স্পষ্ট করে তোলে।
যাকগে, আসল কথায় আসি। ট্রাম্প সাহেব আগে বিজনেসম্যান পরে প্রেসিডেন্ট। আর তিনিই কিনা এমন এক বানিজ্য যুদ্ধ শুরু করলেন যাতে ভেঙে পরতে পারে আমেরিকার বানিজ্য। ইতোমধ্যে মার্কিন শেয়ার বাজারে আগুন লেগেছে। আর সেটা ইউরোপ থেকে ছড়িয়েছে এশিয়া অব্দি। অর্থনীতির মূলে যে বিষবৃক্ষ গজিয়ে উঠছে তাতে ২০০৮ এর পর আরেকটি বিশ্বমন্দা শুরু হলে অবাক হবার কিছুই নেই। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ এই বানিজ্য যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কোন সন্দেহ নেই। আমেরিকার ইস্পাত শিল্প ও কিছু মানুষের চাকুরী বাঁচাতে যে প্রয়াস ট্রাম নিয়েছেন তাতে বলা যায় তিনি খাল কেটে কুমির এনেছেন। কেননা বহুদিনের মিত্র কানাডা ও ইইউ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবচেয়ে বেশি। আর এতে চীনের সাথে তার যে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বানিজ্য ঘাটতি তা কমার সম্ভবনা খুবই কম। কেননা আমদানি রপ্তানির এই যুগে চীনাদের বানিজ্য দাপটের বিরুদ্ধে তার উৎপাদন খাত বড়ই নাজুক।
কেননা, চীন থেকে প্রতি বছর আমেরিকার আমদানির পরিমান প্রায় ৫০৬ বিলিয়ন ডলার আর রপ্তানির পরিমান প্রায় ১৩০ বিলিয়ন ডলার।এই আমদানি বানিজ্যের ৬০ বিলিয়ন ডলারের পন্যের উপর আমেরিকা শুল্ক আরোপ করেছে।এতে হয়ত আমেরিকার স্টিল এবং এলুমিনিয়াম শিল্পের উপকার হতে পারে কিন্তু আদতে আমেরিকা ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।কারন চীনের পক্ষ থেকেও পাল্টা শুল্ক আরোপের হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।বিশ্ব বানিজ্য সংস্থার প্রধান বলেছেন যে দুই দেশের বানিজ্য যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য হুমকি স্বরূপ।দুনিয়ার দুই বৃহত অর্থনীতির এই যুদ্ধে ইতিমধ্যেই শেয়ার বাজারগুলু তাদের মুল্য হারাতে শুরু করেছে।এই বানিজ্য যুদ্ধে চীনের তেমন ক্ষতি হবে তেমন কেউ আশা করে না।কারন আমেরিকার সাথে বানিজ্যে চীনের জিডিপির ৩% জড়িত।আর আফ্রিকামুখী চীনের নির্মাণ শিল্পের কারনে সে তার স্টিলের বাজার খুঁজে নিতে পারবে।কিন্তু চীন যদি পাল্টা শুল্ক আরোপ করে তাহলে আমেরিকার ক্ষতিটা হবে মারাত্মক।কারন আমেরিকার সয়াবিনের বিশাল মার্কেট হল চীন।আছে ওয়াইন এবং স্ক্র্যাপ।
আমেরিকাকে চড়া মুল্য দিতে হতে পারে সয়াবিন এবং স্ক্রাপের ক্ষেত্রে।আমেরিকায় সয়াবিন শিল্পের সাথে জড়িত ৩ লক্ষ্য লোকের চাকরি এবং স্যািকা প শিল্পে জড়িত দেড় লক্ষ চাকরি।চীন প্রতি বছর ৬.৫ বিলিয়ন ডলারের স্ক্র্যাপ আমদানি করে আমেরিকা থেকে।স্ক্র্যাপ ম্যানেজমেন্টে চীনের ধারে কাছেও দুনিয়ার কেউ নেই।চীন এটার আমদানি বন্ধ করলে এই বিশাল স্ক্র্যাপ ম্যানেজমেন্টে আমেরিকা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।চীন যদি এই দুই পন্যেও শুল্ক আরোপ করে তাহলে এই দুই শিল্প চরম পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে।এছাড়াও চীনের বিমান সংস্থাগুলু আমেরিকান বোয়িং এর সাথে প্রায় ৫৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিও বাতিল করতে পারে।যদি তাই হয় তাহলে বলা যায় দুনিয়া নতুন এক অর্থ যুদ্ধের মুখোমুখি।
এর বাইরে আমেরিকার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখা ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের বন্ডের মালিক হল চীন।যেটা আমেরিকাতে সুদের হার কম রেখে আমেরিকাকে গতিশীল রেখেছে।চীন যদি এটা ফেরত চায় সেক্ষেত্রে আমেরিকাকে চরম এক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করাবে। কিন্তু এই দুই দেশের আসল সমস্যা হল ভিন্ন জায়গায়।আমেরিকা চায় চীন আমেরিকার সাথে ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের বানিজ্য ঘাটতি কমিয়ে সেটা ১০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে আসুক।কিন্তু সেটা আসলেই সম্ভব নয়,প্রচলিত উপায়ে।তবে আমেরিকার কমার্স সেক্রেটারি আমেরিকার চাওয়া সত্যি কথাটি বলে ফেলেছেন।সেটা হল এই বানিজ্য ঘাটতি কমানো যায় যদি চীন আমেরিকা থেলে এলএনজি(গ্যাস) আমদানি করে।আমেরিকার এই বানিজ্য যুদ্ধের উদ্ধেশ্য পরিস্কার।চীন এই মাস থেকেই তার জ্বালানী মুল্য পরিশোধ শুরু করে ইউয়ানে।সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে শুরু হবে পেট্রো ইউয়ানের ব্যাবসা। যেটা আমেরিকান ডলারের জন্য একটা চরম হুমকি বা আমেরিকার অস্তিত্বের জন্য হুমকি।আমেরিকা বানিজ্য ঘাটতির কারন দেখিয়ে চীন এই কর্ম থেকে বিরত রাখতে চায়। এখন দেখার বিষয় এই যুদ্ধ কোন দিকে যায়।কে জিতে এই যুদ্ধে,চীন নাকি আমেরিকা। তবে ট্রাম্প সাহেব গোঁয়ার্তুমি করে আরো ৫০ বিলিয়ন ট্যারিফ আরোপের যে হুমকি দিয়েছেন তাতে চীনারা সয়াবিনের উপর শুল্ক বসিয়ে ঝালটা ঝাড়বে এটা নিশ্চিত। এই যুদ্ধে কে যে জিতবে আর কে যে হারবে সেটা বলা মুশকিল।
যেই জিতুক কিংবা হারুক না কেন এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে গোটা আমেরিকা ইউরোপ জুড়ে। আর সেই অবস্থার বলি হবে সেদেশের জনগন। কেননা তাদের উচ্চ মূল্যে অনেক জিনিস কিনতে হবে। এর প্রভাব পড়বে বাজার জুড়ে। পণ্য বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে বিভিন্ন দেশের শিল্পগুলো ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে। ফলে বিভিন্ন দেশের কর্মসংস্থান, বানিজ্য, উন্নয়ন, অবকাঠামো, অগ্রগতি ব্যাহত হবে।
অনেকেই মনে করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে যদি বানিজ্য যুদ্ধ হয় সে ক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ হবার সম্ভবনা রয়েছে। তাতে করে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলো এক ধরনের চাপে পড়বে। যা কিনা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষতি তো করবে তার সাথে সমাজ ব্যবস্থার উপর এক ধরনের খারাপ প্রভাব পড়বে। আর এতে করে বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলো বানিজ্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির শিকার হবে এটা নিশ্চিত।
প্রতিকারের উপায়ঃ
১। ব্যবসার উদ্দেশ্য লাভ করা। আর সে জন্যেই সবাই বানিজ্য করে। আমেরিকা-চীন বানিজ্য ঘাটতি মেটাতে আমেরিকাকে নিজের উৎপাদন উন্নত করতে হবে এবং আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে।
২। বিশ্ব জুড়ে যে বানিজ্য যুদ্ধ জুজু ছড়িয়ে পড়েছে তার সমাধান করতে বিশ্বব্যাংক ও আই এম এফ কে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।
৩। ডাব্লিউ টি ও এর সকল নিয়মকানুন মেনে আমদানি রপ্তানি বানিজ্য নিশ্চিত করতে হবে।
৪। পাল্টাপাল্টি বানিজ্য শুল্ক আরোপ অতিসত্বর বন্ধ করে তা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে।
৫। বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থা যেমন ইইউ, নাফটা, এপেক, আসিয়ান পর্যায়ে বানিজ্য যুদ্ধের প্রভাব ও তার থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে বৈঠকে বসতে হবে।
৬। চীন ও রাশিয়াকে বিশ্ব শান্তির লক্ষ্যে এই বানিজ্য যুদ্ধের অবসানে ছাড় দিতে হবে।
৭। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে মধ্যস্থতাকারী রূপে চীন-আমেরিকার বানিজ্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে।
৮। আমেরিকাকে বানিজ্য যুদ্ধ নিরসনে অহেতুক শুল্কহার বাড়ানো বন্ধ করতে হবে।
কৃতজ্ঞতাঃ
মোস্তাক রিপন
কালের কন্ঠ
সমকাল
যুগান্তর
জনকণ্ঠ
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৮ সকাল ১১:০৫