somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পঁচাত্তরের নভেম্বরঃ নাগরদোলায় অনৈক্য,বিভক্তি ও সংঘাত (প্রথম পর্ব)

০২ রা নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

...সে রাতে আর্মি চীফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী খালেদা একটা ডিনারের আমন্ত্রনে গিয়েছিলেন। বাসায় আসতে দেরী হয়ে যায় তাদের; এসে দেখেন তাদের দুই ছেলে পিনো ও কোকো শুয়ে পড়েছে। জেনারেল জিয়া শোবার ঘরে চলে যান; খালেদা বেয়ারাদের পরবর্তী দিনের নাস্তার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়ে ঘরে আসেন। দুজনেরই ঘুম আসে দ্রুত কিন্তু স্থায়ী হয় না বেশিক্ষণ; কর্কশ কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায়।মধ্যরাতের আগন্তক শুভ হতে পারে না ভাবেন তারা। জিয়াউর রহমান খালেদাকে ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়ে বাইরে আসেন। ইতিমধ্যে কাজের লোক দরজা খুলে দিয়েছে। জিয়া ড্রইং রুমে এসে দেখেন ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ অস্ত্র হাতে দাড়িয়ে আছে। জিয়া তাকে শান্তভাবে প্রশ্ন করেন “কি ব্যাপার হাফিজ?” হাফিজুল্লাহ সামরিক কায়দায় স্যালুট করে বলে “স্যার আপনি চীফ অব জেনারেল স্টাফ বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নির্দেশে হাউজ এ্যারেস্ট”। জিয়া কোন প্রতিক্রিয়া দেখান না; বলেন “অলরাইট।” ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ তাকে বলে “স্যার আপনি এখানে ড্রইং রুমেই বসেন।” জিয়া এবার হাফিজুল্লাহর দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে বসেন। হাফিজুল্লাহ তার পাশে দাড়ানো এক সৈনিককে নির্দেশ দেয় টেলিফোনের লাইন কেটে দিতে।সেই সৈনিক ড্রইং রুমে থাকা টেলিফোনটির লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়।খালেদা শোবার ঘর থেকে এই দৃশ্য অবলোকন করে খাটের পাশে রাখা টেলিফোনের দিকে এগিয়ে যান; রিসিভার তুলে দেখেন লাইন আছে; তিনি কল করতে শুরু করেন শুভাকাঙ্খিদের।



রাত বাড়ছে। বঙ্গভবনে রাতের নিস্তব্ধতা একটু বেশি প্রকট হয়। ক্রমাগত মিটিং এবং টেনশনের কারনে লেফট্যানেন্ট কর্ণেল রশিদ আজ একটু ক্লান্ত। মাত্র শেষ হয়েছে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ, জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী ও মেজর জেনারেল খলিলের সাথে মিটিং। বিষয়বস্তু ছিল ক্যান্টনমেন্টের বর্তমান পরিস্থিতি এবং সিনিয়র অফিসারদের কার্যকলাপ।এ বিষয়েই গত তিন চার দিন আলোচনা হচ্ছে। ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতি অস্বাভাবিক; তাদের সযত্নে টেনে ধরা হ্রাস ধীরে ধীরে ঢিলে হয়ে গেছে; আর্মি চীফ জিয়াউর রহমান, চীফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল তলে তলে কিছু পাকাচ্ছেন বলে আন্দাজ করা যাচ্ছে। তবে এই তিনজন একজোট কিনা কিংবা কে কার পক্ষে তা অনুমান করা দুস্কর। জেনারেল ওসমানী ও জেনারেল জিয়ার সম্পর্ক ভাল নয় সেই ১৯৭১ সাল থেকেই তাই তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে সুপারিশ করেছেন জিয়াকে চীফ অফ আর্মি স্টাফ পদ থেকে সরিয়ে দিতে। মেজর জেনারেল খলিল মনে করেন জিয়াউর রহমান ও খালেদ মোশাররফ দুজনেই সমান বিপদজনক। অন্য দিকে ফারুক আর ডালিম স্পস্ট বলছে না কিন্তু বোঝা যায় তারা জিয়াকে আর পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। আজকের মিটিংয়েও কোন সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। একটু আগে ওসমানী ও খলিল বেড়িয়ে গেছেন বঙ্গভবন থেকে। রশিদ তাদেরকে বলেছে পরবর্তী আর্মি চীফ কাকে করা যায় সে ব্যাপারে আগামীকাল প্রেসিডেন্টকে সুপারিশ করতে। সে নিশ্চিত ওসমানী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে সুপারিশ করবেন।খলিল কার কথা সুপারিশ করবেন ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত রশিদ করিডর দিয়ে তার শোবার ঘরে যাচ্ছিল।এমন সময় একজন সৈনিক দৌড়ে এসে স্যালুট দিয়ে জানায় “স্যার বঙ্গভবনে পাহারায় থাকা ফার্স্ট বেঙ্গলের লোকজন সবাই পজিশন ছেড়ে চলে গেছে।” রশিদ এটা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না; বিপদ আসছে এটা জানা ছিল কিন্তু সেটা এত নিকটবর্তী তা ভাবেনি সে।হাটার গতি বেড়ে যায় তার; বাইরে এসে দেখে সত্যিই পাহারাতে কেউ নেই; ময়দান খা খা। দ্রুত সে ফারুকের রুমে যায়; দরজায় নক করে অশান্তভাবে। ফারুক সবে ঘুমিয়েছে; কাচা ঘুম থেকে উঠে রশিদের চোখে তাকিয়েই বুঝে যায় দুঃসংবাদ আছে।রশিদ জানায় মেজর ইকবালের নেতৃত্বে ফার্স্ট বেঙ্গলের সব সৈনিক বঙ্গভবন ছেড়ে গেছে। দুই বন্ধু, যারা একে অপরের ভায়রা-ভাইও হয়, নিঃস্পলক দৃষ্টি দেয় একে অন্যের দিকে।দুজনের চোখে একই জিজ্ঞাসা – is end near?

ফারুক রশিদকে বলে প্রেসিডেন্টের অফিস কক্ষে যেতে, সে আসছে; এরপর পরে নেয় ইউনিফর্ম। বুটটা খুজে পেতে একটু সময় লেগে যায়; বিরক্ত হয় যায়গার জিনিস যায়গায় নেই বলে। বুটের ফিতা বাধতে বাধতে সে ভাবে ত্বরিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেয়ে ট্যাংকগুলো সচল করতে হবে।গত আড়াই মাস লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান বঙ্গভবনের মার্সিডিস গাড়ী দাপিয়ে বেরিয়েছে; আজ ফিরে যেতে হবে তার একান্ত আস্থাভাজন, অতি পরিচিত ট্যাংক বাহিনীর কাছে।

ফারুককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রশিদ প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাকের অফিস কক্ষে যায়। প্রেসিডেন্ট উঠবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন; রশিদ তাকে পরিস্থিতি অবগত করে। মোশতাক বিচলতি হন; সামরিক শাস্ত্র তিনি কম বোঝেন কিন্তু এটা বোঝেন ঠিকই বন্দুকের নল আর ট্যাংকের গর্জনের উপর ভর করেই তার শাসন।এখন যদি বন্দুকের নল তাকে আর সমর্থন না করে তবে ক্ষণিকের মধ্যেই শেষ হবে প্রেসিডেন্টশীপ। এমনিতে তিনি রশিদকে ‘কর্নেল’ বলে ডাকেন কিন্তু এই বিপর্যস্ত সময় বলে উঠেন “এখন কি হবে বাবা?” রশিদ এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া জরুরী মনে করে না; সে দ্রুত টেলিফোনের দিকে এগিয়ে যায়। প্রথমে টেলিফোন করে ফার্স্ট বেঙ্গল হেডকোয়ার্টারে, কেউ ফোন ধরে না; এর পর সে ফোন করে তার ইউনিট টু-ফিল্ড আর্টিলারিতে।সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক তবে জানানো হয় ক্যান্টনমেন্টে ট্রুপস মুভমেন্ট হচ্ছে। রশিদ তার ইউনিটকে নির্দেশ দেয় তৈরী হয়ে থাকতে; এর পর একে একে ফোন করে চীফের বাসায়, সিজিএসের বাসায়, ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডারের বাসায়; কেউ ফোন ধরে না। এর মধ্যে ফারুক এসে ঢোকে রুমে।সে জানায় বঙ্গভবনের আটটি ট্যাংক সচল করা হয়েছে এবং সে এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাচ্ছে বাকি আটটি ট্যাংক সচল করতে। যাবার আগে ফারুক রশিদকে প্রশ্ন করে “হু ইজ ইট?” রশিদ বলে “আই এ্যাম নট শিওর ইয়েট”। ফারুক বের হয়ে যাবার আগে জানিয়ে যায় তার অনুমান “ইট মাস্ট বি কর্নেল শাফায়াত জামিল”।



বঙ্গভবন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার এবং জেনারেল জিয়াকে হাউজ এ্যারেস্ট দুটোই ঘটেছে চীফ অব জেনারেল স্টাফ বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নির্দেশে। তার সাথে আছেন ৪৬ পদাতিক বিগ্রেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল। এ দুজনই ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা অফিসারদের ও তাদের বানানো প্রেসিডেন্টকে বরদাস্ত করতে পারেন না। যেখানে আর্মি চীফ সহ প্রায় সব সিনিয়ার অফিসারেরা এদের তোষামোদ করে চলেন সেখানে কর্নেল শাফায়াত জামিল ব্যতিক্রম। তিনি প্রকাশ্যেই এদের বিচার চান এবং প্রেসিডেন্ট মোশতাকের পদত্যাগ দাবী করেন। খালেদ মোশাররফ একজন সুশৃঙ্খল, নিয়মনিষ্ঠ অফিসার।তিনি চান আর্মিতে চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোক। এজন্য বেয়াড়া,অবাধ্য খুনি অফিসারদের বঙ্গভবন থেকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। সেই প্রয়াসে এই দুজন ২ নভেম্বর মধ্যরাতের পর ফোর বেঙ্গল ব্যাটেলিয়ান হেডকোয়ার্টারে এসে অভিযানের সার্বিক দায়িত্ব গ্রহন করেছেন। বঙ্গভবন থেকে মেজর ইকবাল সৈন্য প্রত্যাহার করে চলে এসেছে এবং ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ জিয়াকে বিনা বাধায় হাউজ এ্যারেস্ট করেছে জেনে অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জন হয়েছে বলে প্রতিয়মান হয় তাদের কাছে। তবুও বাড়তি সতর্কতা হিসেবে ফোর বেঙ্গলের দুটি কোম্পানিকে এ্যান্টি-ট্যাংক গান নিয়ে কারওয়ান বাজার ও সাইন্স ল্যাবরেটরীতে মোতায়েনের নির্দেশ দেয়া হয়। অন্য এক কোম্পানিকে নির্দেশ দেয়া হয় শাহবাগে অবস্থিত রেডিও ষ্টেশন দখল নেবার জন্য। রেডিও ষ্টেশনে থাকা রশিদ-ফারুক-ডালিম গং এর সৈনিকরা বিনা বাধায় আত্মসমর্পণ করে।খালেদ মোশাররফ নির্দেশ দেন রেডিও সম্প্রচার বন্ধ করার জন্য। তাই করা হয়।


রাত পেরিয়ে যাচ্ছে। অরক্ষিত বঙ্গভবনের ভিক্টোরিয়া স্থাপত্যে নির্মিত সুদৃশ্য ঘরে বসে আছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশিদ রশিদ এবং তার বানানো প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক। দুজনেই বোঝেন ট্যাংকের গর্জনের উপরে ভর করে যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তারা দখল করেছেন ১৫ই আগস্ট, তার হুমকিগ্রস্ত। খন্দকার মোশতাক যে মন্ত্রীসভা গড়েছেন সেখানে মূলত বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পূবর্বর্তী আওয়ামী লীগের নেতারাই আছেন।তবে মূল নেতারা যারা বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসতেন, যাদের রক্তে দেশপ্রেম আছে তারা নতুন মন্ত্রীসভায় যোগ দেননি।সেইসব নেতাদের গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট মোশতাক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদকে জিজ্ঞেস করেন “কারাগারে রাখা আওয়ামী লীগের নেতাদের ব্যাপারে কি করা যায়?” পাকিস্তান আর্মির ভাবশিষ্য রশিদ, ফারুক, ডালিম। পাকিস্তান আর্মি ১৯৭১ সালে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন জেনে যায় নিশ্চিত পরাজয় আসন্ন তখন মেধাশুন্য ও নেতৃত্বশুন্য করার প্রয়াসে আলবদর বাহিনীকে নির্দেশ দেয় ধরে ধরে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করতে। আলবদর তা সাফল্যের সাথে পালন করে। এই একই ফর্মুলা রশিদ-ফারুক-ডালিম গং আগে থেকেই ঠিক করা রেখেছিল বাস্তবায়ন করবে যদি তাদের বিরুদ্ধে কোন পাল্টা-অভ্যুত্থান হয়।তাই রশিদ দ্বিধাহীন কন্ঠে প্রেসিডেন্টকে জানায় “পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ হবে। আপনি লিস্ট দেন।” খন্দকার মোশতাক “আলহামদুলিল্লাহ” বলে কাগজ আর কলম তুলে নেন হাতে; চারটি নাম লেখা হয়ঃ তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান ও মনসুর আলী। রশিদ ফোন করে রিসালদার মোসলেমউদ্দিনকে প্রেসিডেন্টের ঘরে আসার নির্দেশ দেয়। এই মোসলেমউদ্দিনই ১৫ই আগস্ট দায়িত্ব পেয়েছিল শেখ মনির বাসা আক্রমণ করার জন্য।সে অতি অল্প সময়ে শেখ মনি ও তার সাত মাসের অন্তসত্তা স্ত্রীকে গুলি করে হ্ত্যা করে মিশন কম্প্লিট করে। রিসালদার মোসলেমউদ্দিন সামরিক ইউনিফর্মে এসে হাজির হয় প্রেসিডেন্টের সামনে; এ্যাটেনশন হয়ে দাড়িয়ে থাকে। প্রেসিডেন্ট তাকে চার জনের নামের একটা লিস্ট দিয়ে বলেন “কর্নেল সাহেব আপনাকে বলে দিবেন কি করতে হবে”। মোসলেম স্যালুট দিয়ে প্রেসিডেন্টের ঘর থেকে বের হয়ে আসে। সাথে বেড়িয়ে আসে রশিদ; করিডরে হাটতে হাটতে রশিদ তাকে বলে “তোমার টিমকে নিয়ে যাও। জেলে বলে দেয়া আছে।ফিনিশ দেম অফ” নিরূদ্বেগ মোসলেম মাথা নাড়ায়।রশিদ ফিরে আসে প্রেসিডেন্টের ঘরে আর মোসলেমউদ্দিন তার টিম নিয়ে একটা পিকআপে রওনা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে।গন্তব্য বঙ্গভবন থেকে খুব একটা দুরে নয়।


কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌছে রিসালদার মোসলেমউদ্দিন ডিআইজি প্রিজন আব্দুল আওয়ালের খোজ করে। আব্দুল আওয়াল গেইটে উপস্থিত হলে সে চার আওয়ামীলীগ নেতার নাম নিয়ে বলে এদের আলাদা করে দিতে। আব্দুল আওয়াল মোসলেমউদ্দিনকে জানান তাকে জেল কোড মেনে চলতে হয় এবং তিনি সশস্ত্র সৈনিকদের জেলের ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিতে পারেন না। মোসলেমউদ্দিন জানায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশেই সে এসেছে। আব্দুল আওয়াল আইজি প্রিজন নুরুজ্জামানকে বাসা থেকে ডাকিয়ে আনেন। নুরুজ্জামান ইতিমধ্যে বঙ্গভবন থেকে ফোন পেয়েছেন; তাকে বলা হয়েছে কিছু সেনা সদস্য আসবে এবং দলনেতা মোসলেমউদ্দিন তাকে কিছু বলবে। নুরুজ্জামান তার অফিস কক্ষে নিয়ে আসেন মোসলেমউদ্দিন ও তার দলকে। অফিস রুমে নিয়ে আইজি বললেন যে বঙ্গভবনের নির্দেশ অনুযায়ী মোসলেমউদ্দিনের তাকে কিছু বলার কথা। এর জবাবে মোসলেম পরিষ্কার জানালো যে তারা এসেছে চার আওয়ামীলীগ নেতাকে গুলি করতে। এ কথা শুনে বিহ্বল হয়ে যান ডিআইজি প্রিজন আব্দুল আওয়াল ও আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান। ক্ষণিকের মধ্যে সম্বিত পিরে পেয়ে নুরুজ্জামান বলেন “দাড়ান, আমি বঙ্গভবনে ফোন করছি।” তিনি বঙ্গভবনে ফোন করেন। লাইন পেতে কষ্ট হয় তার। কিছুক্ষন পর লাইন পান, রশিদ ফোন ধরে। নুরুজ্জামান রশিদকে বলেন “ইনিতো অস্ত্র হাতে বন্দীদের সেলে যেতে চাইছেন এবং গুলি করার কথা বলছেন।” রশিদ বলে “সে যা চাইছে তাই হবে”। বিহ্বল নুরুজ্জামান বলেন “আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতির সাথে কথা বলতে চাই।” রশিদ ফোন খন্দকার মোশতাককে দেয়। নুরুজ্জামান কিছু বলার আগেই মোশতাক জানতে চান, তিনি পরিষ্কারভাবে কর্নেল রশিদের নির্দেশ বুঝতে পেরেছেন কিনা। নুরুজ্জামান ইতিবাচক জবাব দিলে মোশতাক তা পালনের আদেশ দেন। নুরুজ্জামান এরপর মোসলেমউদ্দিন ও তার দলকে নিয়ে অফিস কক্ষ থেকে বের হয়ে আসেন। বিমূঢ় ডিআইজি প্রিজন আব্দুল আওয়াল হঠাৎ বলে উঠলেন “কাজটা তো বেআইনী হচ্ছে,অস্ত্র হাতে জেলে ঢোকা নিষেধ,বেআইনী”। এ কথা শুনে মোসলেমউদ্দিন আব্দুল আওয়ালের কাধে জোরে ধাক্কা দিয়ে বলে উঠে “ভয় পাইছেন, ভয় পাইছেন?” নুরুজ্জামান আর পাশে থাকা জেলার আমিনুরের মনে হলো মোসলেমউদ্দিনকে রক্তের নেশায় পেয়েছে। জেলার আমিনুর আব্দুল আওয়ালকে আগলিয়ে রাখলেন; মোসলেম তখন বলে চলছে “যান যান আপনি চলে যান,আপনি ভয় পাইছেন।”

কেন্দ্রীয় কারাগারের ১ নং সেলে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম। পাশের সেলে ছিলেন কামরুজ্জামান ও মনসুর আলী। এই চারজনকে এক সেলে আনা হয়। মোসলেমউদ্দিন ও তার দলের দুইজন হাতের স্টেনগান দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। লুটিয়ে পরেন মুক্তিযুদ্ধের চার স্তম্ভ। সেলের বাইরে হতবুদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে থাকেন আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান। তার মনে হতে থাকে এটা একটা দুঃস্বপ্ন,একটু পরে ঘুম ভেঙ্গে যাবে। আসে পাশে সবাই শুনতে পান গুলিবিদ্ধ কেউ একজন পানি পানি করে আর্তনাদ করছেন কিন্তু মুখে একটু পানি তুলে দেবার মত সাহসও কেউ করে উঠতে পারলেন না; না কর্মচারিরা, না কারারক্ষীরা, না ডিআইজি প্রিজন, না আইজি প্রিজন। মোসলেমউদ্দিন যাবার সময় নেয়ামত নামের এক কারারক্ষীকে নির্দেশ দিয়েছিল কেউ বেঁচে গেলে যেন খবর দেওয়া হয়। নেয়ামত নিষ্ঠার সাথে সেই দায়িত্ব পালন করে। ফলে ভোর ৫টা ১৫ মিনিটে বঙ্গভবন থেকে নায়েক আলীর নেতৃত্বে আরেকটি দল এসে আহত নেতাদের শরীরে বেয়োনেট চার্জ করে। এবার তারা ঢুকে বিনা বাধায়,বিনা প্রশ্নে। তার কিছুপর ডিআইজি প্রিজন আব্দুল আওয়াল রশিদের সাথে যোগাযোগ করেন। রশিদ তাকে শান্ত স্বরে বলে “keep silent about the incident।” মৃতদেহ কি করা হবে জানতে চাইলে যে অবস্থায় আছে এ অবস্থায়ই ফেলে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। চার নেতার রক্তাক্ত মৃতদেহ পরে থাকে কেন্দ্রীয় কারাগারের ১ নং সেলে। রাত পার হয়, তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান ও মনসুর আলী বিহীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সূর্য উঠে।


যুদ্ধ বিমানের গর্জনে নির্মলেন্দু গুণ ঘুম থেকে ধরফড়িয়ে ওঠেন। তারিখ ৩রা নভেম্বর,সাল ১৯৭৫।কবি আছেন তার বন্ধু মহাদেব সাহার বাসায়। ঠিকানা ১১২, আজিমপুর। ঘুম থেকে উঠে বাসার কেউ ঠাওর করতে পারেনা কেন এই বিমান আকাশ কাপিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে উড়ে যাচ্ছে।কবি ভাবেন এ কিসের গর্জন? বঙ্গবন্ধুর নয়তো! বাসার সবাই রেডিও শুনতে বসেন; কিন্তু রেডিও একেবারে বন্ধ।

না, এ বঙ্গবন্ধুর গর্জন নয়। এগুলো বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নির্দেশে বঙ্গভবনের উপর ও সোহওয়ার্দী উদ্যানের উপর যে সব রাশান মিগ টুয়েন্টি-ওয়ান চক্কর দিচ্ছে তার আওয়াজ। উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ও প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাককে ভয় দেখানো।

ক্ষণিকের উত্তেজনায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান গুলি করে মিগ টুয়েন্টি-ওয়ান গুলো ভুপাতিত করতে চায়। সে গত রাত থেকেই সোহওয়ার্দী উদ্যানে তার ট্যাংক বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত। সে ফোন করে বঙ্গভবনে।ততক্ষনে প্রেসিডেন্টের সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানী উপস্থিত হয়েছেন প্রেসিডেন্টের কামরায়। প্রেসিডেন্ট পাইপ দিয়ে তামাক খাচ্ছিলেন আর ওসমানী রশিদের সাথে কি করনীয় তা আলোচনা করছিলেন। ফারুক জেনারেল ওসমানীর কাছে অনুমতি চায় যুদ্ধ বিমানগুলো গুলি করা নামানোর। ওসমানী অনুমতি দেন না; তিনি ফারুককে বলেন “তাতে মারাত্মক সংঘর্ষ বেধে যাবে”।ওসমানী ফারুককে জানান লেফটেনান্ট কর্নেল ডালিম ও মেজর নূর ইতিমধ্যে ক্যান্টনমেন্ট গেছে বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিলের সাথে কথা বলার জন্য।


এদিকে ক্যান্টনমেন্টের শহীদ মঈনুল রোডে অবস্থিত চীফ অফ আর্মি স্টাফ জিয়াউর রহমানের বাসা শুনশান।বাইরে সমস্ত সৈনিক ও নন-কমিশন্ড অফিসাররা দাড়িয়ে আছে।ভেতরের বারান্দায় একটা স্টেনগান গলায় ঝুলিয়ে পায়চারি করছে ক্যাপ্টেন তাজ। আর ভেতরে বসার ঘরে একটা সোফায় স্থির বসে আছেন জেনারেল জিয়াউর রহমান; একটু দুরে স্টেনগান হাতে তটস্থ দাড়িয়ে বিগ্রেডিয়ার খালেদ ও কর্নেল শাফায়াতের পাঠানো অফিসার ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ। তার প্রতি নির্দেশ আছে জিয়ার সাথে কথোপকথনে না যাবার।জিয়া একবার বলেছেন “টেল শাফায়াত, আই ওয়ান্ট টু টক টু হিম”। হাফিজুল্লাহ জিয়াকে জানিয়েছে “আই উইল কনভে দ্যা ম্যাসেজ টু হিম ইন ডিউ টাইম স্যার। ”

রাতে বাসায় সশস্ত্র অফিসারকে দেখে শোবার ঘর থেকে খালেদা জিয়া যাদেরকে ফোন করেছিলেন কর্নেল মইনুল হোসেন চৌধুরী তাদের একজন। মইনুল হোসেনের বাসাও একই এলাকায়। ভোরের আলো ফোটার পর পূর্ণ সামরিক পোষাক পরে তিনি তার বাসা থেকে বের হন। বাসার নিরাপত্তায় নিয়জিত গার্ড কমান্ডার জানায় ফার্স্ট বেঙ্গলের অফিসার এবং সৈনিকরা গভীর রাতে চীফ জিয়াউর রহমানের বাসায় ঢুকেছে এবং এখন পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করছে।মইনুল হোসেন ধীর পায়ে জিয়ার বাসার দিকে এগিয়ে যান; পৌছে দেখেন গেটে তালা ঝোলানো। মইনুল রাগান্বিত স্বরে দাড়িয়ে থাকা জেসিওকে বলেন গেট খুলে দিতে। জেসিও গার্ড রুম থেকে চাবী এনে তালা খুলে দেয়। মইনুল হোসেন জানেন না কার নির্দেশে এরা চীফকে আটকে রেখেছে, অস্ত্র হাতে সৈনিকেরাও জানে না এই কর্নেল কেন এখানে এসেছেন বা তিনি কোন দলের। মইনুল ধীর পায়ে বাসায় ঢোকেন। বাসার ভেতরে থাকা ক্যাপ্টেন হাফিজুলাহ তাকে দেখে আতকে উঠে।সোফায় বসা জিয়া কৌতুহলী দৃষ্টি দেন মইনুলের দিকে; মইনুল সেটা উপেক্ষা করে ঢুকে যান অন্দরমহলে। ভেতরে যেয়ে দেখেন খালেদা তার দুই পুত্র নিয়ে বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন; তিনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই খালেদাকে বলেন “ম্যাডাম আপনি বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাবার জন্য রেডী করুন।” খালেদা কোন পাল্টা প্রশ্ন করেন না; দুই ছেলেকে স্কুল ড্রেস পরাতে নিয়ে যান।মইনুল এবার ড্রইং রুমে এসে দাড়ান। হাফিজুল্লাহ দ্বিধানিত; সে জানে না বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ মইনুলকে পাঠিয়েছেন কিনা।এই মেজাজী কর্নেলকে ক্ষেপাতেও সে সাহস পায় না; প্রশ্ন করে বিব্রত হবার ঝুকিও সে নেয় না। মইনুল জিয়ার পাশে বসেন।জিয়া প্রশ্ন করেন “হোয়াট্স গোইং অন মইনুল?” মইনুল চাপা স্বরে বলেন “স্যার আমিতো পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিনা।আপনার স্ত্রীর ফোন পেয়ে আমি এসেছি।বাসায় ঢোকার সময় যা দেখলাম তাতে মনে হয় কর্নেল শাফায়াতের অফিসার ও সৈনিকরা আপনাকে গৃহবন্দী করেছে। আপনি ধৈর্য ধরেন।” এর মধ্যে খালেদা জিয়া দুই ছেলেকে নিয়ে এসেছেন।মইনুল তাদের নাস্তা করে নিতে বলেন; নাস্তা শেষ হলে ড্রাইভারকে ডেকে পিনো ও কোকোকে স্কুল পৌছে দিয়ে আসতে নির্দেশ দেন। এরপর মইনুল সামরিক কায়দায় জিয়াকে স্যালুট করে বেড়িয়ে আসেন এবং নিজের বাসায় চলে যান।

কর্নেল মঈনুলের বিনা বাধায় ঢুকে পড়া ও বেড়িয়ে যাওয়া এবং দ্বিধান্বিত হাফিজুল্লাহর অভিব্যক্তি দেখে সুচতুর জিয়া অনুমান করে নেন কর্নেল শাফায়াত জামিল কোন foolproof plan নিয়ে এগুচ্ছেন না। জিয়া এও বুঝে নেন পুরো আর্মি হয়ত কর্নেল শাফায়াতকে সমর্থন দিচ্ছে না। তিনি সিদ্ধান্ত নেন তার বহুল ব্যবহৃত ‘wait and see’ পলিসি আরেকবার বাস্তবায়নের।

কর্নেল মইনুলের মত আরেকজন অফিসারও ভোরে আর্মি চীফ জিয়াউর রহমানের বাসার দিকে ছুটে গিয়েছিলেন।তিনি চীফের কোর্সমেট ও বন্ধু স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ হামিদ। তার ডিউটি অফিসার ফোন করে জানিয়েছে বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও সৈন্যরা জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দী করেছে। তিনি তৎক্ষনাত জিয়ার বাসায় ফোন করেন। লাইন ডেড। তিনি তড়িঘড়ি করে তার অফিসিয়াল জীপে করে জিয়ার বাসায় ছুটে যান। বড় রাস্তার মোড়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা তার জীপ থামিয়ে জানায় “স্যার সামনে যেতে মানা আছে। আপনি ৪৬ বিগ্রেড হেডকোয়ার্টারে কথা বলুন।” হামিদের মনে পড়ে গেল ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে এগিয়ে যাওয়া কর্নেল জামিল আহমেদের কথা। জামিল আহমেদ সৈনিকদের নির্দেশ অমান্য করে এগিয়ে গেলে সৈনিকরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। হামিদ ঝুকি নিলেন না; জীপ ঘুরিয়ে নিজ অফিসের দিকে রওনা দিলেন।


ফোর বেঙ্গল ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টার ততক্ষণে জমজমাট। সব সিনিয়ার জুনিয়ার অফিসাররা আসা শুরু করেছেন। এসেছেন এয়ার চীফ এয়ার ভাইস মার্শাল এম জে তোয়াব, কর্নেল মালেক, কর্নেল চিসতি, কর্নেল গাফফার, বিগ্রেডিয়ার রউফ। সবাই আলোচনা করে বঙ্গভবনকে দেয়া হবে এরকম তিনটি শর্ত তৈরী করেনঃ এক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুকের অধীনের ট্যাংকগুলো ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদের অধীনের কামানগুলো বঙ্গভবন থেকে অতিসত্বর ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠাতে হবে। দুই, জেনারেল জিয়ার যায়গায় অন্য একজনকে চীফ অফ আর্মি স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। তিন, বঙ্গভবনে বসে রশিদ-ফারুকের কার্যক্রমের অবসান ঘটবে এবং তাদের আর্মির চেইন অব কমান্ডে ফিরে আসতে হবে। কর্নেল শাফায়েত চান আরেকটি শর্ত সংযুক্ত করতে;তা হলো প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাকের অপসারণ। কিন্তু আশ্চর্যভাবে বিগ্রেডিয়ার খালেদ তা নাকচ করে দেন। এককোণে বসে থাকা ব্রিগেডিয়ার রউফ হাত উচু করে নতুন একটি পয়েন্ট যোগ করতে চাইলেন তা হলো ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে আর্মি চীফ ঘোষণা করতে হবে। কর্নেল চিশতি এতে সায় দিলেন। খালেদ এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করলেন না।

স্কোয়ার্ডন লিডার লিয়াকত তখনও তার দল নিয়ে মিসাইল লোডেড হয়ে বঙ্গভবন ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উপর দিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরছেন। বঙ্গভবন থেকে জেনারেল ওসমানী ফোন করে বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে অনুরোধ করেন মিগ-টুয়েন্টি-ওয়ান যুদ্ধবিমান গুলোকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। খালেদ বলেন “মিগ উইল ফায়ার অনলি ইফ দ্যা ট্যাঙ্কস স্টার্ট টু মুভ”। এরপর খালেদ জেনারেল ওসমানীকে একে একে তাদের শর্ত গুলো জানান। ওসমানী “লেট মি ডিসকাস দিজ উইথ দ্যা প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড রশিদ” বলে ফোন রেখে দেন। একটু পর রশিদ ফোন করে খালেদ মোশাররফকে তার প্রেরিত শর্তের জবাবে জানায় যে খন্দকার মোশতাক আহমেদ আর প্রেসিডেন্ট থাকতে ইচ্ছুক নন। সে পাল্টা শর্ত দেয় সব ট্যাঙ্ক ক্যান্টনমেন্টে ফেরত যাবে তবে সে, ফারুক ও অন্য অফিসাররা ইউনিটে ফেরত যাবে না এবং জেনারেল জিয়াকে চীফের পদ থেকে অপসারণ করা হবে যদি তার পূর্ণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। রশিদ হুমকি দেয় যে এসব শর্ত মানা না হলে পরের দিন, অর্থাৎ ৪ নভেম্বর, ভোর ছয়টা থেকে খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট পদে থাকবেন না এবং তার জন্য দেশের যে কোন পরিণতির জন্য খালেদ মোশাররফ দায়ী থাকবেন। রশিদের হুমকি শুনে খালেদ ততোধিক উত্তেজিত হয়ে বঙ্গভবনে অবস্থানরত সকল অফিসারদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসতে নির্দেশ দিয়ে বলেন “এক্সট্রিম মেজারস উইল বি টেকেন ফর হুইচ ইউ উড বি হেল্ড রেসপনসিবল” রশিদ উত্তরে বলে “আই উইল সি এন্ড এন্ড টু দিজ।আমি আপনাকে দেখে নেব।”

সকাল নয়টার সময় হঠাৎ করে ফোর বেঙ্গলে এসে উপস্থিত হয় লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডালিম ও মেজর নূর। ডালিম জানায় দুপক্ষের মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়াতে যা করা প্রয়োজন তা সে করবে। খালেদ তাকে আশ্বস্ত করেন তিনিও সংঘর্ষ চান না। ডালিম খালেদের কাছে জেনারেল জিয়ার কথা জানতে চায়।খালেদ তাকে বলেন “নো হার্ম উইল বি ডান টু হিম। হি ইজ ইন সেইফ কাস্টডি।” ডালিম এবার জানতে চায় “স্যার আপনারা কি চান? আপনাদের দাবি কি?” বিগ্রেডিয়ার খালেদ একে একে তিনটি শর্ত ডালিমকে বলেন।ডালিম বলে “আমি বঙ্গভবনে যেয়ে রশিদকে বুঝাবার চেষ্টা করবো।” বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কর্নেল মালেক এবং কর্নেল মান্নাফকে তার প্রতিনিধি হিসাবে ডালিমের সাথে বঙ্গভবনে যেতে নির্দেশ দেন।


বঙ্গভবন পৌছালে ডালিম ঢোকে প্রেসিডেন্টের কক্ষে। সে রশিদ, জেনারেল ওসমানী ও প্রেসিডেন্ট মোশতাককে ক্যান্টনমেন্টের হাল হকিয়ত জানায়। প্রায় বিশ মিনিট সলা-পরামর্শ করে ঘরে ডেকে পাঠানো হয় কর্নেল মালেক এবং কর্নেল মান্নাফকে। খালেদ মোশাররফের দুই প্রতিনিধি স্যালুট করে দাড়ালে মোশতাক জানতে চান “বল তোমাদের কি বলার আছে?” কর্নেল মান্নাফ একে একে শর্তগুলো ব্যক্ত করে। খন্দকার মোশতাকের কাছে পরিস্কার হয় খালেদ মোশাররফ সংঘর্ষ ও হত্যা এড়াতে চান। মোশতাক মান্নাফ এবং মালেককে বলেন “Well I have heard you patiently, go back and tell the people at the cantonment, if they want me to continue as the President then I shall execute my responsibilities at my own terms. I am not at all prepared to remain as the head of state and government to be dictated by some Brigadier. Khaled should withdraw the troops from the relay station so that the national radio can resume normal broadcasting. My priority at this time is to bring back normalcy in the country. আমার নির্দেশ যদি খালেদ মানতে রাজি না হয়; তবে তাকে বলবে he should come over to Bangabhaban and takeover the country and do whatever he feels like. আমি একটা রিক্সা ডাইকা আগামসী লেনে যামুগা।”

প্রেসিডেন্টের জবাব নিয়ে কর্নেল মান্নাফ ও কর্নেল মালেক ক্যান্টনমেন্টে ফেরত আসেন। সাথে ডালিমও আসে। ফোর বেঙ্গল ব্যাটেলিয়ান হেডকোয়ার্টারে এসে বিগ্রেডিয়ার খালেদ, কর্নেল শাফায়েত জামিল ও অন্যান্য অফিসারদের উপস্থিতিতে কর্নেল মান্নাফ প্রেসিডেন্টের বক্তব্য হুবহুব তুলে ধরেন। এমন নগ্ন জবাব শুনে ক্রোধে ফেটে পরেন উপস্থিত সবাই।কর্নেল শাফায়েত জামিল দাড়িয়ে উঠে রাগত স্বরে বলেন “হাউ ডেয়ার হি স্পিকস লাইক দ্যাট!” খালেদ মোশাররফ তাড়াতাড়ি সবার আক্রোশ নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করেন; তিনি কর্নেল শাফায়েতের দিকে তাকিয়ে বলেন “অল রাইট,অল রাইট,উই শ্যাল সি”। শাফায়েত তখনও গজরাতে থাকলে খালেদ তাকে নিয়ে পাশের একটা কক্ষে যান।একটু পরে সে কক্ষে বিগ্রেডিয়ার নুরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন ইকবাল এবং কর্নেল মালেককে ডেকে নেন তারা। আলোচনা হয় কিভাবে এর পরের গুটি চালা হবে। সবাই এটা বুঝতে পারেন চতুর মোশতাক পিছলিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ কর্নেল শাফায়েতের সাথে একমত হন যে মোশতাককে অস্ত্রের মুখে সরিয়ে দেওয়া উচিত। কর্নেল শাফায়েত বলেন “ইট উইল টেক মি হাফ এ্যান আওয়ার টু ফ্লাশ আউট দোজ কিলারস ফ্রম বঙ্গভবন”। খালেদ শাফায়েতকে ঠান্ডা হতে বলেন। তিনি সবাইকে বলেন একটা সাংবিধানিক মিমাংসা হওয়া প্রয়োজন।

মিনিট বিশ-পচিশ পর তারা ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।বিগ্রেডিয়ার খালেদ ডালিমকে বলেন “লিসেন ডালিম, খন্দকার মোশতাক যখন আমাদের দাবিগুলো মেনে নিয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করতে রাজি হচ্ছেন না সে ক্ষেত্রে তিনি প্রধান বিচারপতি জাস্টিস সায়েমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।” ডালিম এ কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায়; সে আসা করেনি বিগ্রেডিয়ার খালেদ এরকম একটা প্রস্তাব রাখবেন। সে এবং বঙ্গভবনের সবাই ভেবেছিল খন্দকার মোশতাকের দৃঢ়তার কারনে খালেদ মোশাররফ পিছু হটবেন। জাস্টিস সায়েমকে মঞ্চে আনার প্রস্তাবে ডালিম বুঝতে শুরু করে তারা হেরে যাচ্ছে। সে খালেদের অনুমতি নিয়ে বঙ্গভবনে রশিদকে ফোন করে। সে রশিদকে বলে “তুমি এখানে এসে বিগ্রেডিয়ার খালেদের সাথে কথা বল।” রশিদও তখন বুঝে গেছে তাদের পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছে। সে রাজি হয় না ক্যান্টনমেন্টে আসতে।এক পর্যায়ে ডালিম ও রশিদ বাগবিতন্ডায় জরিয়ে পড়ে।ডালিম রাগত স্বরে রশিদকে বলে “ডু নট বি ‍এ্যা কাওয়ার্ড!ফেইস থিংস ব্রেইভলি। নো বডি ইজ গোইং টু কিল ইউ।হেয়ার উই আর এন্ড নো বডি হ্যাড টাচড আস।” রশিদ এক পর্যায়ে ডালিমকে প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলার জন্য অনুরোধ করে।এত ডালিম দ্বিগুণ ক্ষিপ্ত হয়ে বলে “আই ডু নট রেকগনাইজ খন্দকার মোশতাক! হু ইজ হি ইন দিজ ম্যাটার? আই আম টকিং টু ইউ রিগার্ডিং আওয়ারসেলভ্স এন্ড ফর ইউ এন্ড ফারুক, আই স্ট্যান্ড কমিটেড টু এনসিওর ইউর সেফটি”। এত ভরসাও রশিদকে টলাতে পারে না; সে স্পস্ট জানিয়ে দেয় ক্যান্টনমেন্টে সে আসবে না। ফোন রেখে ডালিম হতাশ চোখে বিগ্রেডিয়ার খালেদের দিকে তাকালে খালেদ বলেন “বল ইজ ইন ইউর কোর্ট ডালিম!” হতাশ ডালিম নূর কে নিয়ে বঙ্গভবনে চলে যায়।

১০
বিগ্রেডিয়ার নুরুজ্জামান বলেন “হাউ এ্যাবাউট উই এ্যারেস্ট খন্দকার মোশতাক বিফর হিজ আল্টিমেটাম এন্ডস”? কর্নেল শাফায়েত জামিল এ মতকে সমর্থন দেন। কিন্তু খালেদ এটা নাকচ করে দেন। নুরুজ্জামান প্রস্তাব রাখেন জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে। খালেদ এটাও নাকচ করে দেন।খালেদ ঠিক করেন বঙ্গভবনে রশিদ-ফারুক-ডালিম গং কে এবং খন্দকার মোশতাকের উপর মনস্তাত্তিক ও স্নায়ুবিক চাপ প্রয়োগ করবেন। তিনি স্কোয়ার্ডন লিডার লিয়াকতকে নির্দেশ দেন আবার দুটি যুদ্ধ বিমান ও মিসাইল সজ্জিত হেলিকপ্টার নিয়ে বঙ্গভবনের উপর লো ফ্লাইং করতে এবং কর্নেল শাফায়েতকে বলেন এ্যান্টি-ট্যাংক কামানগুলো বঙ্গভবনের কাছেধারে ডিপ্লয় করতে।


বেলা এগারটার দিকে বঙ্গভবনে ফোন করে খালেদ মোশাররফ জানিয়ে দিলেন দাবী না মানা হলে তিনি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবেন।তখন বঙ্গভবন এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উপর দিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরছে দুটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান এবং মিসাইল সজ্জিত এম আই ৮ হেলিকপ্টার। রশিদ বুঝতে পারে ষোলটি ট্যাংক আর কিছু কামান নিয়ে তারা বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না মিগ-২১, মিসাইল সজ্জিত এম আই ৮ হেলিকপ্টার, এ্যান্টি-ট্যাংক গান আর কর্নেল শাফায়েতের পদাতিক বাহিনীর কাছে। খন্দকার মোশতাক এক পর্যায়ে তাদেরকে বলেন “তোমরা বরং ক্যান্টনমেন্টে ফেরত যাও”। রশিদ এর উত্তরে বলে “ওরা আমাদের ছেড়ে দেবে বলে মনে করেছেন? প্রত্যেককে কোর্ট মার্শাল করবে।এর চেয়ে বরং আমাদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিন।” রশিদের প্রস্তাব মনে ধরে ফারুক বাদে সবার। তাদের মনে হয় দেশ ছেড়ে পালালেই ফাঁসির দড়ি এড়ানো যাবে।শুধু ফারুক গোয়াড়ের মতন সংঘর্ষে যেতে চায়; তার ধারনা ষোলটি ট্যাংক নিয়ে সে ক্যান্টনমেন্ট দখল নিতে পারবে। রশিদ ও ডালিম তাকে বুঝিয়ে শান্ত করে। এবার খন্দকার মোশতাক ঘাবড়ে যান। তিনি কাদো কাদো গলায় বলেন “তাহলে বাবারা আমাকেও তোমাদের সাথে দেশের বাইরে নিয়ে যাও।” এই মোশতাক ১৫ই আগস্ট রেডিওর ভাষনে রশিদ-ফারুক-ডালিম গং কে সূর্যসন্তান বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এসব সূর্যসন্তান আজ সূর্য ডোবার আগেই ভিন দেশে চলে গেলে তিনি হয়ে যাবেন পশম ছাড়া মোরগ এটা ভেবে বিচলিত হয়ে পড়েন ৮১ দিনের প্রেসিডেন্ট। গর্তে পড়ে তার আঞ্চলিক টান বেরিয়ে আসে; তিনি রশিদকে বলেন “বাবা আমার পাসপোর্ট আমার লগেই আছে”। রশিদ তাকে আশ্বস্ত করে বলে “বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আপনাকে যেহেতু প্রেসিডেন্ট পদে রাখতে চাচ্ছেন সে আপনার কিছুই করবে না।” এবার জেনারেল ওসমানী ফোন করেন ফোর বেঙ্গলে। তিনি খালেদকে জানান সব দাবী মেনে নেয়া হবে। এরপর তিনি অনুরোধ করেন ফারুক,রশিদ এবং তাদের অন্যান্য সঙ্গীরা যারা দেশ ত্যাগ করতে চাইবে তাদের দেশ ছেড়ে যেতে দিতে হবে। খালেদ ওসমানীকে বলেন “আমি কিছুক্ষণ পর আপনাকে আমার সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি।” ফোন রেখে খালেদ উপস্থিত সবার সাথে আলোচনায় বসেন।সবাই স্বস্তি পায় বঙ্গভবন পরাজয় মেনে নিয়েছে জেনে।বিগ্রেডিয়ার নুরুজ্জামান অবশ্য বলেন এদেরকে দেশের বাইরে যেতে দেয়া ঠিক হবে না; বঙ্গবন্ধুর হত্যার জন্য এদেরকে দায়ী করে বিচার করা হোক। কিন্তু অন্য কেউ নুরুজ্জামানের কথার খুব একটা গুরুত্ব দেন না। সিন্ধান্ত নেওয়া হয় জেনারেল ওসমানীর দেয়া প্রস্তাব মেনে নেওয়া হবে। সেই মোতাবেক বঙ্গভবনকে জানিয়ে দেয়া হয়। বিমান বাহিনীর প্রধান এম জে তোয়াব দায়িত্ব নেন দেশ ত্যাগে ইচ্ছুক অফিসারদের পাসপোর্ট ও ভিসার ব্যবস্থা করার।তিনি বঙ্গভবনে ফোন করে রশিদকে বলেন যারা যাবে তাদের নামের লিস্ট দিতে। রশিদ সতের জনের নাম দেয়। তোয়াব নামগুলো নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে যান পরবর্তী ব্যবস্থা নেবার জন্য।

১১
বঙ্গভবনে অবস্থিত অফিসারদের পলায়নী-প্রবৃত্তি বিগ্রেডিয়ার খালেদের এবং অভ্যূত্থানের সাথে জড়িত সবার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। এবার খালেদ বিগ্রেডিয়ার রউফকে পাঠান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর নেয়ে আসার জন্য। বিগ্রেডিয়ার রউফ সেখানে পৌছলে জিয়া কোন উচ্চবাচ্চ্য করেন না। তিনি পদত্যাগ পত্রে উল্লেখ করেন যে রাজনীতিতে নিজেকে জড়াতে চান না এবং এ কারনে সেনাবাহিনী থেকে সরে দাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একই পত্রে তাকে যেন পূর্ণ পেনশন সুবিধাদি দেয়া হয় তার অনুরোধ করেন জেনারেল জিয়া। বিগ্রেডিয়ার রউফ পত্রটি নিয়ে ফেরত আসেন ফোর বেঙ্গলে। উপস্থিত সবাই পূর্ণ পেনশন সুবিধাদির অনুরোধে বিস্মিত হন। একজন আর্মি চীফ এই অনুরোধ কিভাবে করেন তাদের বোধগম্য হয় না তবে তার মত একজন সৎ অফিসারের পক্ষে সামান্য পেনশন দিয়ে পরিবার চালনা কঠিন হবে অনুধাবন করেন অনেকেই। বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বলেন “ইফ পসিবল উই শ্যাল পোস্ট হিম ইন দ্যা ইউএন।”

ক্লান্তি জরিয়ে ধরেছে সবাইকে। মধ্য রাত থেকেই সবার উপর ঝড় বইছে। খালেদ ফোর বেঙ্গল থেকে বের হয়ে তার বাসার দিকে রওনা হন; তার ৫৬ স্টাফ রোড বাসায় যখন আসেন তখন সেটা জনমানবহীন। তিনি আগের রাতেই তার স্ত্রী ও সন্তানদের গুলশানে শশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাসায় এসে কিছুক্ষন ঘুমিয়ে নেন খালেদ। ঘুম থেকে উঠে স্ত্রীর সাথে ফোনে কথা বলেন। তার স্ত্রীর তখন অনেক প্রশ্ন। খালেদ আশ্বস্ত করেন স্ত্রীকে “আমি ঠিক আছি।অতিসত্বর তোমাদের ক্যান্টনমেন্টে ফেরত আনব।”

১২
দুপুর বেলা কবি নির্মলেন্দু গুন ও মহাদেব সাহা প্রেস ক্লাবে যান। সেখান কথা বলাবলি হচ্ছে মধ্যরাতে সামরিক বাহিনীতে একটা অভ্যুত্থান ঘটেছে যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন খালেদ মোশাররফ। তারা এও জানতে পারেন যে বিমান ও হেলিকপ্টার উড়ছে সেগুলো খালেদ মোশাররফের পক্ষের। কবির ভাল লাগে ভাবতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে কেউ একজন পাল্টা-অভ্যুত্থান করেছেন। কবির মনে পড়ে এক বছর আগে নিউমার্কেটের নওরোজ কিতাবীস্থানে খালেদ মোশারফকে একবার দেখেছিলেন।সচিত্র সন্ধানী পত্রিকার সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন দুজনের মধ্যে আলাপ করিয়ে দেন। কবি কৌতুহলী হয়ে জানতে চেয়েছিলেন “কি ধরনের বই খুজছেন আপনি?কবিতা না গল্প?” খালেদ হেসে বলেছিলেন “না ভাই আমি মিলিটারি স্ট্র্যাটেজির উপর বই খুজছি। তবে আমি কবিতাও পড়ি।”

১৩
নভেম্বর মাসের বিকেল। শীত তেমন জাকিয়ে বসেনি। বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আবার ফোর বেঙ্গল ব্যাটেলিয়ান হেডকোয়ার্টারে ফেরত এসেছেন।তার একটু আগে এসেছেন কর্নেল শাফায়েত জামিল। দুজনের সামনে চা দেওয়া হয়েছে। খালেদ জানতে চান দেশ ত্যাগ করতে ইচ্ছুক অফিসারদের পাসপোর্ট তৈরী হয়েছে কিনা।তাকে জানানো হয় ঠিক ঠাক হচ্ছে সব। এর মধ্যে অন্যান্য অফিসারাও এসে পৌছেছেন। খালেদ আশঙ্কা করেন, প্লেনে উঠে অফিসাররা যদি দেশের অন্য কোথাও নেমে পড়ে তাহলে কি হবে? বিগ্রেডিয়ার নুরুজ্জামান বলেন তারা যশোরে নামতে পারে এবং যশোরে বিগ্রেড কমান্ডার মীর শওকত তাদের আশ্রয় দিতে পারে। খালেদ নির্দেশ দেন দেশ ত্যাগ করা অফিসারদের নিয়ে বিমানটি যেন সন্ধ্যার পর উড্ডয়ন করে। যশোরে নাইট ল্যান্ডিং সুবিধা নেই তাই এই সিদ্ধান্ত।

১৪
লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদ যখন বঙ্গভবন থেকে তেজগাঁও এয়াপোর্টের উদ্দেশ্যে বের হয় তখন তাদের বিমর্ষ দেখা যায়। ফারুকের অনুগত বেঙ্গল ল্যান্সারের সদস্যরা এবং রশিদের অনুগত টু-ফিল্ড আর্টিলারির সদস্যরা নিজেদের ভবিষ্যতের সঙ্কায় ভেঙ্গে পরে। গত ৮১ দিন তারা বেশ হম্বিতম্বি করে কাটিয়েছে।ফারুক-রশিদ তাদের গরম গরম কথা বলে বেশ উদ্দীপ্ত করে রেখেছিল। আজ এই দুই অফিসারের পলায়নপরতা বেঙ্গল ল্যান্সার ও আর্টিলারি সদস্যদের মনস্তাত্তিকভাবে দুর্বল করে দেয়। তারা আশা করে ফারুক, রশিদ তাদের কোন স্বস্তির বাণী শোনাবে; কিন্তু ফারুক-রশিদের মুখে কোন বাণীই আসে না। কোন কোন সৈনিক কেদে ফেলে; রশিদ, ফারুক তা না দেখার ভান করে গাড়ীতে উঠে বসে।

তেজগাঁও বিমান বন্দরে সন্ধ্যার কিছু পর একটি ফকার-২৭ উড়োজাহাজের ইঞ্জিন চালু হয়। ফ্লাইটের (S2-ABO) পাইলট ক্যাপ্টেন সায়েক। তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ১৭ জনের এই দলকে ব্যাংকক এয়াপোর্টে নামিয়ে রাতেই আবার ঢাকায় চলে আসার জন্য।ক্যাপ্টেন সায়েক প্রশ্ন করেন “উইল দে বি আর্মড?” না বোধক উত্তর আসে।সতের জনের দলে আছে বঙ্গবন্ধু হত্যার সকল হোতা এবং তাদের স্ত্রী, সন্তান।ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের বান্ধবীও আছে এ দলে।আর আছে রেসলাদার মোসলেহউদ্দিন। শুধু দলে নেই আর্টিলারির মেজর মহিউদ্দিন। এই মহিউদ্দিন ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাসভবন লক্ষ্য করে আর্টিলারি গান দিয়ে সাত-আট রাউন্ড ফায়ার করেছিল; লক্ষ্যভ্রষ্ট সেই গোলা যেয়ে পড়েছিল মোহাম্মাদপুরের এক বাসায়। আর মাত্র চার দিন পর ৭ নভেম্বর রাতে এই মহিউদ্দিনই তথাকথিত সিপাহি বিপ্লবের লেবাসে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে টু-ফিল্ড আর্টিলারিতে নিয়ে আসবে নতুন ইতিহাস সূচনা করতে।

বাংলাদেশ বিমানের ফকার-২৭ উড়োজাহাজটি ব্যাংককের উদ্দেশ্যে উড়ে যাওয়ার পর বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ফোর বেঙ্গল ব্যাটেলিয়ান হেডকোয়ার্টার থেকে বঙ্গভবনের দিকে রওনা দেন। সাথে কর্নেল শাফায়েত জামিলকে নেন না এই আশঙ্কায় যে খন্দকার মোশতাকের সাথে সে দূর্ব্যবহার না করে ফেলে। খালেদ মোশাররফ মনেপ্রাণে চাইছেন সবকিছু সংবিধান মোতাবেক, আইন অনুযায়ী করতে; তাই তিনি চান খন্দকার মোশতাককেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাখতে। অভ্যূত্থানের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গভবনে বসে রশিদ-ফারুকের কার্যক্রম বন্ধ করা এবং আর্মির মধ্যে চেইন অফ কম্যান্ড ফেরত আনা। রশিদ, ফারুকের দেশ ত্যাগে সেটা সফল হয়েছে।

খালেদ বঙ্গভবনে ঢুকেন রাত নয়টায়। সাথে আছেন বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জে তোয়াব ও নৌবাহিনীর প্রধান কমোডর এম এইচ খান। খালেদ প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাককে জানান যে জেনারেল জিয়া দুপুরে আর্মি চীফ পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। খালেদ মুখে বলেন না তাকে প্রমোশন দিয়ে চীফ অফ আর্মি স্টাফ বানাতে হবে তবে ততক্ষণে সবার কাছে এটা বেশ স্পস্ট যোগ্য প্রার্থী তিনি একাই। মোশতাক এটা শুনে বলেন তিনি তো প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইতিমধ্যেই ইস্তফা দিয়ে দিয়েছেন তাই তিনি আজ রাতেই চলে যাবেন আগামসী লেনে অবস্থিত নিজ বাসায়।খালেদ মোশাররফ মোশতাককে অনুরোধ করেন প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে। খালেদ মোশাররফ চৌকশ সেনা অফিসার, মিলিটারি স্ট্র্যাটেজিতে তার জোর দখল কিন্তু জাতীয় রাজনীতি ও সাংবিধানিক ব্যাপারে তিনি অজ্ঞ। খালেদ মনে করলেন মোশতাক প্রেসিডেন্ট থাকলেই সংবিধান অক্ষুন্ন থাকবে। তার মনে আসল না যে এই খন্দকার মোশতাকই বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করে আছেন।তার মনে আসল না যে রশিদ-ফারুক-ডালিম গংয়ের উপর ভর করে মোশতাক ৮১ দিন ধরে দেশ চালাচ্ছেন।তার মনে এও আসল না মোশতাক কোন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নন।খালেদ অভ্যূত্থান করেছেন আর্মির মধ্যে চেইন অব কম্যান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এবং তিনি এই একটি লক্ষ্যেই স্থির থাকলেন।ঘাঘু রাজনীতিবিদ মোশতাক বিগ্রেডিয়ার খালেদের এই দূর্বলতা বুঝে ফেলে খালেদকে বললেন “আমি প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারি যদি সেনাবাহিনী আমার প্রতি অনুগত থাকে এবং তিন বাহিনীর প্রধান আমার মন্ত্রীসভার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়।” খালেদ জানালেন আর্মি অনুগত আছে। তখন তোয়াব ও এম এইচ খান ইঙ্গিত করলেন খালেদ মোশাররফকে আর্মি চীফ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হোক। মোশতাক তাদেরকে জানালেন সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানী ও কেবিনেটের অনুমোদন ছাড়া তিনি নতুন চীফের নিয়োগ দেবেন না।খালেদ এটা শুনে একটু ক্ষুণ্ণ হলে মোশতাক জানান আগামীকালই, অর্থাৎ ৪ নভেম্বর কেবিনেট মিটিং আছে; সেখানেই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। রাত তখন ১১ টা। খালেদ, তোয়াব ও এম এইচ খান বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে নিজ নিজ বাসভবনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।


তথ্য সূত্রঃ
পঁচাত্তরের রক্তক্ষরণ
মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি

এক জেনারেলের নিরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক
মে.জে. মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.)

তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা
লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ হামিদ

৩ নভেম্বর-জেল হত্যার পূর্বাপর
শারমিন আহমদ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর
কর্নেল শাফায়াত জামিল

বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় (১৯৭৫-৮১)
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত হোসেন, পালক পাবলিশার্স

যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
মেজর ডালিম

Bangladesh A Legacy of Blood
Anthony Mascarenhas

রক্তঝরা নভেম্বর, ১৯৭৫
নির্মলেন্দু গুণ

ইতিহাসের নিরেট বাস্তবতায় নভেম্বর ১৯৭৫
মিনহাজ আল হেলাল

একজন তাজউদ্দিন ও একটি আত্মবিস্মৃত জাতি-শেষ পর্ব
আদিল মাহমুদ

খালেদ মোশাররফ, ‘আঁতাতকারী’ প্রসঙ্গ ও যুক্তির প্রয়োজনীয়তা
নাদির জুনাইদ

একটি সেনা অভ্যুত্থান এবং জেনারেল খালেদ মোশাররফ-২
দিবস

১৯৭৫ সালের নভেম্বরের উত্তাল কয়েকটি দিন
মীর সাব্বির

নভেম্বর ৩, ১৯৭৫
মুক্তমনা; নিরব কবি

খালেদ মোশাররফ
উইকিপিডিয়া

জিয়াউর রহমান
উইকিপিডিয়া.।

উইকিপিডিয়া

জিয়াউর রহমান
উইকিপিডিয়া

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১:২৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×