somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিদায় বেলার গল্প

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ ভোর ৬:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

-নিহিন আর কতক্ষণ লাগবে তোমার? আমার ট্রেন আসার সময় হয়ে এল।
-এইত আর ৫-৭ মিনিট লাগবে। আপনি একটু বসুন আমি স্টেশনের কাছাকাছি চলে এসেছি।
-আচ্ছা তাড়াতাড়ি এস।
-ওকে মিস্টার কাতুপুতু, জাস্ট ওয়েট ফর মি। বাই..
.
ফোনটা কেটে গেল। আমি ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আছি। এখনো নিহিনের হাসি মুখটা স্ক্রীনে ভেসে আছে। আমি শেষবারের মত চোখের পানিটুকু মুছে নিলাম। কিন্তু নিহিন! ও যখন সামনে আসবে তখন কি করব? এই মেয়েটার সামনে আমি কখনোই মিথ্যে বলতে পারি না। যতবার মিথ্যা বলতে চেষ্টা করেছি ততবারই ও ধরে ফেলেছে। তাই আজ মেস থেকে বের হবার আগে ওর কাছে কিভাবে কথাগুলো বলব সেটা অনেকবার রিয়্যারসেল করে এসেছি। জানি না কতটুকু বলত পারব তবে আমাকে যে বলতেই হবে। এছাড়া যে আর কোন পথ নেই। আমি খুব ভাল করেই জানি ওর চোখের দিকে তাকালে সবকিছু আবারও এলোমেলো করে ফেলব। আজই ওর সাথে শেষ দেখা। ভেবেছিলাম ওকে না জানিয়েই চলে যাব। কিন্তু কেন যে সেটা করতে পারলাম না। ওকে শেষবারের মত দেখতে ইচ্ছে হল তাই বের হবার আগে ফোন করে আসতে বললাম। নিহিনকে বলেছি আমি দু দিনের জন্য বাড়ি যাচ্ছি। কিন্তু একেবারেই যে চলে যাচ্ছি সেটা বলি নি। যদি বলি তাহলে এই মেয়ে আমাকে কখনই যেতে দিবে না কিছুতেই না!
.
নিহিনকে পড়াচ্ছি প্রায় দু'বছর। স্কুল এবং কলেজ লাইফ থেকেই আমি কেমিস্ট্রিতে খুব ভাল ছিলাম। আমি নিজেও বুঝতে পারি না কেন এই বিষয়টাতে আমি এতটা ইন্টারেস্টিং ছিলাম। অন্যদের দেখতাম এই বিষয়ের স্যার ক্লাসে অাসলেই হাত-পায়ে কাপুনি ধরে যেত কিন্তু আমার ক্ষেত্রে হত তার একদমই বিপরিত। তখন থেকেই আমার ইচ্ছে ছিল কেমিস্ট্রিতে অনার্স করার কিন্তু সেটা বোধহয় আমার কপালে ছিল না তাই ইংরেজীতেই করতে হচ্ছে। তবে নিহিনকে আমি কেমিস্ট্রিতে পড়াচ্ছি। সবকিছু ভালই চলছিল কিন্তু একটা সময় লক্ষ্য করলাম নিহিনের আচরন দিন দিন অন্যদিকে মুভ নিচ্ছে। আস্তে আস্তে সে আমার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে। কিস্তু আমি সবসময় এসব ধনীর দুলালীদের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতাম। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলেদের এসবে জড়াতে নেই কখনো। কারণ এসব প্রেম ভালবাসা তাদের ক্ষেত্রে মানায় না। তার কিছুদিন পরই ওকে পড়ানোটা ছেড়ে দিলাম। সপ্তাহ দু'য়েক ভালই কাটল। কিন্তু হঠাৎ একদিন নিহিনের বাবার ফোন আসল। তিনি আমাকে বাসায় ডাকলেন। আমি ওদের বাসায় গিয়ে দেখলাম নিহিন এই কদিনে কেমন শুকিয়ে গেছে চেহারাতে ভিষন্ন ভাব। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। এটা যে নিহিন হঠাৎ দেখলে কেউ চিনতেই পারবে না।
নিহিনের এই অবস্থা দেখে ওর প্রতি আমার কেমন মায়া অনুভব হল। এর জন্য যে আমি দায়ী সেটা বুঝতে বাকি রইল না। নিজেকে তখন বড় অপরাধী মনে হচ্ছিল। কি করলাম আমি এটা! পরে আংকেলের অনুরোধে ওকে আবার পড়াতে শুরু করলাম।
.
-কি রাফাত সাহেব আপনি কি এখানে আছেন নাকি চাঁদের দেশে বিচরণ করছেন বলুন ত?
.
আমি পাশে ফিরে তাকালাম আর দেখলাম নিহিন অামার পাশেই বসে আছে। মুখে একটু জিজ্ঞাসু ভাব নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আশ্চর্য্য! ও কখন আসল আমি টেরই পাই নি। আমি অবাক হয়ে বললাম।
-কখন এলে তুমি?
-সেই কখন এসে বসে আছি! আপনার কোন খেয়ালই নেই। তা কি ভাবছিলেন এত শুনি?
-না তেমন কিছু না।
-আচ্ছা হয়েছে, এখন বাড়ি যাচ্ছেন কেন? গত সপ্তাহে না বাড়ি গেলেন? আবার বাড়ি যেতে হবে কি জন্য? বাড়িতে কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?
.
গত কয়েকমাস থেকে বাবার শরীর ভাল ছিল না। আগে থেকেই বলত পেটে ব্যাথা করে। একদিন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ল। সেদিনই তাড়াহুড়ো করে বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করলাম। পরীক্ষা করে ধরা পড়ল অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে বাবার দু'টা কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। কর্তব্যরত ডাক্তাররা জানাল জরুরি ভিত্তিতে কিডনি ব্যবস্থা করতে পারলে কিছু একটা করা সম্ভব। সেদিন ডাক্তারের মুখ থেকে এমন কথা শুনে আমার পুরো পৃথিবী যেন হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছিল। চারদিকে অন্ধকার দেখছিলাম।
আমাদের পরিবারের বাবাই আয় করার মাধ্যম ছিলেন। বাবা যা রোজগার করত তা দিয়ে কোনরকম চলতে পারতেন। আমি পাশাপাশি টিউশনি করে নিজের লেখাপড়া আর হাত খরচটা চালাতে পারতাম। এত টাকা এই অল্প সময়ের মধ্যে জোগাড় করে কিডনির ব্যবস্থা করা কোন ভাবেই সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে দিনদিন বাবার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল। চোখের সামনে বাবার মৃত্যুর যন্ত্রনা দেখা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলাম না।
যখন সবকিছু ম্যানেজ করে কিডনি ব্যবস্থা করলাম ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ডাক্তাররা যখন বললেন আর কোন হোপ নেই সেদিন বাবাকে জড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। সেদিন রাতেই বাবা চলে গেলেন পৃথিবীর ছেড়ে। আমি যেন নির্বাক হয়ে গেছিলাম একেবারেই। প্রিয়জন হারানো ব্যাথাটা সেদিন খুব বুঝতে পারছিলাম।
.
পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় সব দায়িত্ব আমার উপর এসে পরে। কিন্তু আমার এখন লেখাপড়াই শেষ হয় নি চাকরির চিন্তা অনেক দূর। টিউশনি করে নাহয় নিজের একটা উপায় করতে পারলাম কিন্তু আর সবার কি হবে? এমন পরিস্থিতিতে না পারছি লেখাপড়া কন্টিনিউ করতে না পারছি ছাড়তে। তাই আজ সবকিছুই ছেড়ে চলে যাচ্ছি অজানার উদ্দেশ্যে।
-কি হয়েছে আপনার বলবেন কি? আজকে এত চুপচাপ কেন? বাড়িতে কোন সমস্যা হয়েছে নিশ্চই?
-নিহিন তোমাকে বলেছিলাম না কিছুদিন যাবত বাবার শরীর খারাপ।
-হুম বলেছিলেন।
-গতকাল রাতে বাবাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। বাবার অবস্থা খুব একটা ভাল না। সেজন্য আমাকে আজকে যেতে হচ্ছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে মিথ্যেটা বলে দিলাম। তবে নিহিনের দিকে তাকিয়ে নয়। ওকে লুকিয়ে চোখের পানিটুকু মুছে নিলাম। আমার কথা শুনার পর নিহিনকে একটু আহতই মনে হল। নিহিন বলল
-দেখুন বিপদের সময় ভেঙে পড়বেন না। আপনি যদি ভেঙ্গে পড়েন তাহলে পরিবারের সবাই আরো চিন্তিত হয়ে পড়বে। তখন তাদের সান্তনা দেবার কেউ থাকবে না। বুকে সাহস রাখুন সব ঠিক হয়ে যাবে।
-আমি ঠিক আছি। তবে বাবা মনে হয় বেশিদিন বাঁচবে না।
-আচ্ছা আমি কি আপনার সাথে আসব? মানে আপনার বাবাকে দেখতে?
.
নিহিনের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। এই মেয়েটা এত বেশি বুঝে ফেলে কেন? সব বানিয়ে বললাম আবার যেতে চাচ্ছে। এখন কি বলি।
.
-না তোমাকে এখন যেতে হবে না। আমি আগে গিয়ে পরিস্থিতি দেখি তারপর তোমাকে যেতে বলব।
-আচ্ছা ঠিক আছে, পৌছে আমাকে জানাবেন।
.
ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল, একটু পরই ছেড়ে দিবে। আমি নিহিনের দিকে তাকালাম। হঠাৎ কররেই ওর প্রতি মায়া হতে লাগল। মুখে এখনো চিন্তার ছাপ আর সেটা যে আমার জন্য বুঝতে বাকি নেই। একটা বিষয় ভাবলে আমার খুব অবাক লাগে আমাকে এত ভালবাসে কেন এই মেয়েটা? কি আছে আমার যেটা দেখে আমার পিছে পরে আছে। আজ নিহিন আমাকে ভালবাসে একটা সময় আবার সেই আমাকে ঘ্রীনা করবে প্রতারক ভাববে। কোনদিন হয়ত সত্যিটা জানবে হয়ত না। আচ্ছা জীবনে চলার পথে কখনো যদি নিহিনের সাথে আবারো দেখা হয় তাহলে সেদিন কি বলব আমি। কি বলার আছে আমার? সেদিন কি ও আমার সাথে কথা বলবে? নাকি দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে।
.
ট্রেন আস্তে আস্তে চলছে। নিহিন আমাকে আরো অনেক কিছু বলেই উপদেশ দিতে লাগল। আমি যখন ওর দিকে তাকালাম দেখলাম ওর চোখ থেকে টুপ করে কয়েকফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। আমি নিজের কাছেই প্রশ্ন করলাম ওর প্রতি কোন অন্যায় করছি না ত? না এত ভাবলে চলবে না। আমাকে যে জীবনের অনেক খানি পথ পারি দিতে হবে। কিছু মুখ আমার প্রতিক্ষায় বসে আছে। আমাকে ওদের পাশে দাড়াতে হবে। বাস্তবতা কঠিন। আবেগ খুব খারাপ। বাস্তব পরিস্থিতির কাছে এর তিল পরিমান মূল্য নেই। অামি শেষবারের মত নিহিনকে হাত নেরে বিদায় জানালাম। আস্তে আস্তে ট্রেন এগুতে লাগল আর বাড়তে থাকল আমাদের মাঝে দূরত্ব। নিহিন এখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি শেষবারের মত নিহিনের অশ্রুভেজা চোখ দেখলাম। সেখানে ছিল আমাকে ফিরে পাবার তীব্র আকাংক্ষা আর কিছু ভালবাসা।
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×