somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপরাধ মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ- ২

২১ শে জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্ব এখানে পাবেন

আগের পর্বে 'হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট'-এর ক্ষেত্রে মায়ের গর্ভে থাকাকালীন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এ ব্যাপারেই লিখতে গেলে অনেক কিছু লেখা যায়। সচেতন পাঠক আশা করি আরও পড়াশুনা বা খোঁজ করবেন ইন্টারনেট-এ। এখন আমি আলোচনা করার চেষ্টা করবো শিশুর জন্মের পরের কয়েক বছর পারিপার্শ্বিকতা কি ভূমিকা রাখে তা নিয়ে। B:-/

ডিসকভারি চ্যানেল-এর চমৎকার একটি ওয়েবসাইট পেলাম যা এ ধরণের লেখার জন্য বেশ কাজে দেবে মনে হয়ঃ

Click This Link

এছাড়া 'জাইটগাইস্ট' ডকুমেন্টারির লিংক আমার আগের ব্লগটায় আছে।

প্রথমেই যে কথাটা বলা প্রয়োজন, তা হচ্ছে, মানুষের 'আর্লি চাইল্ডহুড এক্সপেরিএন্স' মানুষকে একটি পথ বা 'ডেভেলপমেন্টাল ট্র্যাক'-এ নিয়ে যায়। তাই কারো আচরণে পরিবর্তন আনতে হলে তার শিশুকালের বিভিন্ন ঘটনাবলী জানা এবং বোঝা খুবই জরুরী। বহু রিসার্চেই এর সত্যতা মিলেছে।

রিচার্ড উইল্কিন্সন (Richard Wilkinson) ইউনিভার্সিটি অফ নটিংহ্যাম-এর প্রফেসর।

তিনি বলেন, 'বাবা-মার জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে তাদের শিশুদের মাঝে স্থানান্তরিত হয়। জীবন কতটা সোজা বা কতটা কঠিন, তা শিশুদের ভিতরে তাদের বাবা-মার বিভিন্ন আচরণের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়। এটা হতে পারে মায়ের বিষণ্ণতা (Maternal Depression), বাবা-মার বদরাগী আচরণ, অথবা দিন শেষে তাদের লম্বা পরিশ্রমী দিনের ক্লান্তি--- এগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা রাখে শিশুর বেড়ে ওঠার ''প্রোগ্রামিং'' -এর উপর।' উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, একটি গাছের ছাড়া যেভাবে কোনও এক পরিবেশে বড় হয় এবং কোনও নির্দিষ্ট পরিবেশই যেমন তার বেড়ে ওঠা নির্ধারণ করে, মানুষের ক্ষেত্রেও তা খুবই সত্যি। তবে মানুষের ক্ষেত্রে পরিবেশ বলতে যা বোঝায় তা হচ্ছে "The Quality of SOCIAL RELATIONS"। দেখা যাক তার মানে কি। B:-)

প্রারম্ভিক জীবনে কতটা সযত্নে লালিত হচ্ছি, কতটা বিবাদ বা Conflict আমরা দেখছি এবং অবশ্যই কতটা অ্যাটেনশন বা মনোযোগ আমরা পাচ্ছি আমাদের পারিপার্শ্বিকতা থেকে, তা আমাদের ভবিষ্যতের পৃথিবী সম্বন্ধে একটা 'আভাস' দেয়। এভাবে আমাদের ব্রেইন সেই মেমরি স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখে। তাই ভবিষ্যতে আমাদের আচরণও অনেকটা নির্ধারিত হয়ে যায় এখানেই। কি ধরণের পৃথিবীতে আমি বড় হচ্ছি? এখানে কি আমাকে সারাক্ষণ যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হবে? নাকি আমি এমন পরিবেশে বড় হচ্ছি যেখানে মানুষ পারস্পরিক নির্ভরতার ও সহমর্মিতার মাঝে বেঁচে থাকে? এটাই আমাদের ভবিষ্যৎ আচরণ নির্ধারণ করে দেয়। তাই শিশু পরিবার ও সমাজে যা দেখে, যেভাবে বড় হয়, সেরকম একটা পৃথিবীর জন্যই নিজেকে তৈরি করে, যদিও সম্পূর্ণ অবচেতনভাবে। :-*

উল্লেখ্য, বাবা-মার এবং অভিভাবক-স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকে আমরা কতটুকু মনোযোগ পাচ্ছি, তা আমাদের ভবিষ্যৎ আচরণ অনেকটাই নির্ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ, গবেষণায় দেখা যায়, যারা অভিনয়, মডেলিং ইত্যাদি বিভিন্ন 'পারফরমিং আর্টস'-এর দিকে ঝোঁক দেখায়, তাদের প্রায় অনেকের ক্ষেত্রেই মূল কারণ হচ্ছে শিশু বয়সে বাবা-মার কাছ থেকে যথেষ্ট 'emotional support' বা অখণ্ড মনোযোগ না পাওয়া। তাই তারা অনেকটাই 'emotional insecurity'-তে ভোগে, তবে সেটা কিন্তু অবচেতনভাবে। তাই তারা প্রায় পুরো জীবনই অন্যদের কাছ থেকে 'recognition' বা 'approval' পাওয়ার চেষ্টা করে। এ বিষয়ে 'বিগ ব্যাং থিওরি'-র একটি মজার ক্লিপ দেখলে বোধয় আরও ভালো হয়ঃ ;)



এই কারণেই দেখা যায় সারা পৃথিবীর সেলিব্রেটিরা অনেক 'উগ্র আচরণ' করে। সেটা হলিউড, বলিউড বা ঢালিউড যাই হোক না কেন, সব জায়গায়ই কিছু কমন প্যাটার্ন দেখা যায়। সেলিব্রিটিদের সম্পর্ক দুদিনও টেকে না, অনেকেই ড্রাগস, অ্যালকোহল ইত্যাদি বিভিন্ন নেশায় জড়িয়ে যায়, নিজেদের চেহারা এবং সাজসজ্জা বা গ্লামার-এর পেছনে তারা তাদের সারা জীবন ব্যয় করে (মায় প্লাস্টিক সার্জারি পর্যন্ত!)। কারণ তারা বুঝতে পারে না ঠিকই, কিন্তু আসলে শিশু বয়সের সেই 'Lack of Attention' তাদের আচরণ তৈরি করে দিয়েছে, নারীপুরুষ নির্বিশেষে। এখনো তারা তাই চেষ্টা করে যাচ্ছে সেই 'Emotional Need' পূরণ করার। :|

একই সাথে অজস্র টাকা এবং খ্যাতি ও ভালবাসা পাওয়া সত্ত্বেও তারা প্রচণ্ড বিষণ্ণতায় ভোগে। (আমার এক নিকট আত্মীয় মনঃচিকিৎসক। তার কাছে দেশের প্রথম সারির অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়মিত চিকিৎসা নেন। তবে কখনই তিনি তাদের পরিচয় প্রকাশ করেন নি অবশ্যই।) এই কারণেই তারকাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও কিন্তু কম নয়। /:)

যেহেতু বায়োলজিক্যাল জিনিসগুলি নিয়েই আলোচনা করছি, তাই অনুরোধ করবো স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজিকাল সায়েন্সের অধ্যাপক রবার্ট সাপলস্কি (Robert Sapolsky)-এর এই লেকচারটি দেখার জন্যঃ

http://www.youtube.com/watch?v=hrCVu25wQ5s

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনি এই লেকচারটি আগে না দেখে থাকলে তা আপনার জীবনের চিন্তাধারাই পাল্টে দেবে। :)

তবে আবার ফিরে আসা যাক শিশুর বেড়ে ওঠা নিয়ে। ব্রিটিশ চাইল্ড সাইকাইয়াট্রিস্ট ডি, ডাব্লিউ, উইন্নিকট (D. W. Winnicott) বলেন, একটি শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে দুটি ব্যাপার ঘটতে পারে। যা হওয়া উচিত না তা হয়, আবার যা হওয়া উচিত তা হয় না। প্রথম ক্ষেত্রে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের শিশু নির্যাতন বা ট্রমাটিক ঘটনা (যৌন, শারীরিক বা মানসিক)। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রয়েছে বাবা-মার অখণ্ড মনোযোগ না পাওয়া ইত্যাদি। দুটোই সমানভাবে ক্ষতিকর। :-/

সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে 'Proximal Abandonment'। এর মানে হচ্ছে, বাবা-মা বা অভিভাবক শিশুর আশেপাশেই আছেন, কিন্তু শারীরিকভাবে থাকলেও, তারা মানসিকভাবে অনুপস্থিত। এসব শিশুর 'Emotional Need' তাই পূরণ হয় না। /:)

একইসাথে ভালোবাসার স্পর্শ যেকোনো শিশুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক নিউরোবায়োলজিস্টরা সবাই দেখেছেন, শিশু বয়সে আবিউজ বা নির্যাতনের শিকার শিশুদের ব্রেইনের সুস্থ ক্রমবিকাশ হয় না। আবার জন্মের পর থেকে স্নেহময় স্পর্শ আমাদের ব্রেইনের ডেভেলপমেন্ট-এ বিশাল ভূমিকা রাখে। Click This Link

তাহলে দেখা যাচ্ছে, সোশ্যাল, বায়োলজিক্যাল আর সাইকোলজিক্যাল ব্যাপারগুলি সবই প্রায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেটাই স্বাভাবিক। আমরা একটি জৈবিক প্রাণী, আমাদের মন আছে এবং আমরা সমাজে বেড়ে উঠি। তাই সবকটিই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। :-B

তবে সাইকোলজিক্যাল ব্যাপারগুলি নিয়ে পরের পোস্টে আরও লিখব। আপাতত শেষ করি হার্ভার্ডের ডঃ জেমস গিল্লিগান-এর কিছু কথা দিয়েঃ

"আমি আমার জীবনের গত ৪০ বছর ব্যয় করেছি হিংস্রতা নিয়ে গবেষণা করে, বোঝার চেষ্টা করেছি কোনও মানুষ ভায়লেন্ট বা হিংস্র আচরণ (খুন, ধর্ষন ইত্যাদি) করে কেন। আমি আবিষ্কার করলাম, সবচেয়ে হিংস্র অপরাধীরা নিজেরাই এত ভয়াবহ শিশু নির্যাতন (Child Abuse)-এর শিকার, যা আমি কল্পনাও করতে পারিনি! এইসব নির্যাতন ছিল যেকোনো 'শিশু নির্যাতন মাপকাঠি'-এর অনেক বাইরে। সবচেয়ে ভায়লেন্ট লোকগুলি দেখেছি, নিজেরাই তাদের অভিভাবক বা অন্য কারো হাতে হত্যা প্রচেষ্টার হাত থেকে বেঁচে গেছে! অথবা এমন ছিল যে, তারা নিজেদের চোখে খুন হতে দেখেছে তাদের পরিবারের অন্য কাউকে কিন্তু নিজে বেঁচে গেছে! আমার কোনও ধারনাই ছিল না কতটা নির্মমতার সাথে প্রায়ই আমাদের সমাজে শিশুদের নির্যাতন করা হয়!" :|

ডঃ গিল্লিগান সম্বন্ধে পড়তে পারেন এখানেঃ http://en.wikipedia.org/wiki/James_Gilligan

পোস্ট আবারও বড় হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তী পর্বগুলিতে আরও আলোচনা করবো। পড়ার জন্য ধন্যবাদ! :)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:২৪
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×