হোটেলে চেক-ইন করার সময় কাউন্টারে দুইজন ছিলেন। দু’জনই তরুণ।
তাদের একজন দেখতে আমার দেশের নায়ক ফেরদৌসের গড়নের। আরেকজন ঢাকা এটাকের হিরো শুভর গড়নের। কিন্তু শুভর মতন রংটা ফর্সা না। আর অতো লম্বাও না। তবে লম্বাটে, ছিপছিপে, হ্যান্ডসাম, শ্যামাঙ্গ তরুণ।
শ্যামাঙ্গ তরুণটিই আমার ভাগ্যে পড়লেন। মানে তার সাথেই হলো আমার যাবতীয় আলাপ-সালাপ।
দরকারী কথা-বার্তার এক ফাঁকে শ্যামাঙ্গ জানতে চাইলেন, সি-সাইড রুম এভেইলেবল আছে। আপনি কি একটা সাগরমুখো কক্ষ নিতে চান?
আমি জানালাম, আমাকে যে রেঞ্জের মধ্যে রুম দেয়া হয়েছে যদি সেই রেঞ্জের মধ্যে কুলায় তাহলে একটা দিতে পারেন।
কম্পিউটারে কিছু একটা চেক-টেক করে তরুণ জানালেন, সাগরমুখো রুম নিতে গেলে রাত প্রতি আরো ৭০ ডলার করে বাড়তি ভাড়া যোগ হবে।
তাহলে আমার এই রুম লাগবে না বলে জানিয়ে দিলাম।
শ্যামাঙ্গের বুকের উপর নেমপ্লেট। আরাফাত। আরাফাত কম্পিউটারে খুঁট-খুঁট করে কিছু একটা টাইপ করলেন। আরো যেনো কী কী কাগজ প্রিন্ট নিলেন।
তার কাছ থেকে কিছু ডলার পাল্টে লংকান রুপি নিলাম। সুন্দর করে সব হিসেব-পত্তর বুঝিয়ে দিয়ে একটা খামে ভরে রুপিগুলো গুছিয়ে দিলেন।
সবশেষে রুমকার্ড বুঝিয়ে দেয়ার পালা। রুমকার্ড দেয়ার সময় শ্যামাঙ্গ বললেন, আমার জন্য যে রুমের রিজার্ভেশান ছিল সেটির বদলে তিনি আমাকে অন্য আরেকটা ফ্লোরে রুম দিয়েছেন। নিজে থেকেই ফ্লোর ও রুম পাল্টানোর কারণ ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, তিনি নিজ এখতিয়ারে আমার রুম আপডেট করে দিয়েছেন।
মানে বাড়তি কোনো ভাড়া গোনা ছাড়াই আমার জন্য সাগরমুখো রুম বরাদ্দ হলো। কেন তা হলো? কেন দিলেন এই শ্যামাঙ্গ তরুণ আমাকে সাগরমুখো রুম? আমি তা জানি না।
এর আগেও একবার এমন হয়েছিল। তবে তা রুমের ক্ষেত্রে না। প্লেনের টিকিটের ক্ষেত্রে। জীবনের প্রথম লং ডিসটেন্স বিমান ভ্রমণ ছিল সেটা।
বাংলাদেশ থেকে জার্মানীতে যাচ্ছিলাম। এয়ারপোর্টে লাগেজ দিতে গিয়ে দেখি সেখানে বসে আছেন আমার ইউনিভার্সিটি লাইফের হলের এক বড় আপু। পরম বদান্যতায় তিনি সেদিন আমার ইকনোমিক ক্লাসের টিকিটকে বিজনেস ক্লাসে আপ করে দিয়েছিলেন নিজের এখতিয়ারে। আমার কানেক্টিং ফ্লাইট ছিল বাহরাইনে। বাহরাইন পর্যন্ত পর্যন্ত আমি, বলতে গেলে, রাজার হালে ছিলাম।
আপুর এই বদান্যতার একটা ব্যাখা ছিল। তিনি আমাকে চিনতেন। আমার হলের বড় বোন। কিন্তু এই শ্যামাঙ্গ তরুণ কেন আমাকে দিল সাগরমুখো রুম?
আমার মুখে অবশ্য মিসকিন মার্কা একটা ছাপ মারা আছে। তারউপরে দেখতে কৃশকায়, কৃষ্ণকায়, বেঁটে আর বানরের চেহারার সাথে আমার মুখের আদলের একটা মিল আছে। এই মিসকিন মার্কা মুখ দেখেই কি শ্যামাঙ্গের মায়া হলো ভারী?
নাকি আমার মুখে এমন একটা ছাপ মারা আছে যে, আমি আসক্ত? নেশা করতে কারো লাগে শুকনা পাতা, কারো খুলতে হয় ছিপি, কারো লাগে বদি-বাবা। কিন্তু আমার সেসব কিস্সু লাগে না। একটা খোলা সাগর হলেই তার ঢেউয়ের কল্লোল আর বাতাসের জাদুতে আমি মাতাল হয়ে যাই। ভোর থেকে গভীর রাত অব্দি চুম্বকের সাথে লেগে থাকা লোহার মতন সাগরের সাথে আটকে থাকি। এই কথা কি লেখা ছিল আমার মিসকিন-মার্কা মুখে?
কী জানি! জানি না। সব উত্তর পেতেও হয় না বুঝি।
তবে, শ্যামাঙ্গ সে তরুণকে ধন্যবাদ দিয়ে রুমকার্ড হাতে লিফটের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে মনে হতে থাকে, আহা! রাবণের দেশ! তুমি মায়ায় বেঁধেছো বটে!
জুলাই ২৮। ২০১৮।