খুলনা হতে রাত ন’টায় সীমান্ত এক্সপ্রেস (ট্রেন) ছাড়ার ঠিক ২০ মিনিট আগে দৌড় দিয়ে এসে টিকেট মাস্টারের কাছে টিকেট চাওয়াতে, হতাশ করে দিয়ে তিনি বলে বসলেন বাথ’র(ভিআইপি) কোন টিকেট নেই আর প্রথম শ্রেনীর বগিগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে আজ এক বছর। আর যেটা এভেইলেবেল অর্থ্যাত শোভন চেয়ার, সেটাতেও কোন টিকেট নেই। যেতে হলে স্ট্যান্ড টিকেটে যেতে হবে। মাথা পুরো খারাপ করে টিকেট মাস্টারকে রীতিমত ধমকের সুরে বলে বসলাম- মাথা ঠিক আছে আপনার? খুলনা থেকে সৈয়দপুর মোটামুটি ৬০০ কিলোমিটার! এই পথ দাঁড়িয়ে যাওয়া সম্ভব? টিকেট মাস্টার বেশ প্রফেশনাল লোক, আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ইশারায় লাইন হতে সরে দাঁড়িয়ে, লাইনে দাঁড়ানো পরবর্তী জনকে সুযোগ করে দিতে বললেন। ভাগ্য নেহায়েত ভাল বলতেই হবে, আমার অবস্থা দেখে রেলের একজন কর্মচারী কিভাবে কোথা থেকে ৩২৫ টাকা মূল্যের একটা শোভন শ্রেনীর টিকেট দ্রুত ম্যানেজ করে দিলেন আর বিনিময় হিসেবে নিলেন ৫০ টাকা। ন্যায়-অন্যায়ের কথা না ভেবে অবৈধ পন্থাটিকেই জয়তু জানিয়ে হাটা দিলাম।
গাঁটকি বস্তা নিয়ে প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটায় উঠতে গিয়ে পড়লাম বিকট এক সমস্যায়। স্টেশনের প্ল্যাটফরমটি উচু না হবার কারনে, ট্রেনে উঠার সিঁড়িগুলো অনেক উঁচুতে হয়ে গিয়েছে। উঠতে হলে সিঁড়ির সর্ব নিচের স্টেপটা ধরে ঝুলে উঠতে হবে। ট্রেনের সিঁড়িগুলো হওয়া উচিত ছিল অনেক বেশি ফ্লেক্সিবেল, বিশেষত বৃদ্ধ এবং মহিলাদের কথা বিবেচনা করে। রেল মন্ত্রনালয় বেশ অবিবেচক। পা রেখে উঠার সিঁড়িগুলো হাতে ধরে ঝুলে উঠবার জন্য করে রেখেছে। অবশেষে অন্য আর একজন যাত্রী আমরা উভয়ের সহায়তায় কাংখিত ‘জ’ নাম্বার দেয়া বগিতে উঠে নির্ধারিত সিটে গিয়ে বসলাম। একটু পর-ই মাইকে কোরআন তেলওয়াত শুরু হল। তারপর সুরেলা এক নারী কন্ঠ ভেষে আসল। তিনি জানিয়ে দিলেন যে আর কিছুক্ষনের মধ্যে ট্রেনটি খুলনা স্টেশন ছেড়ে যাবে। একই সাথে তিনি ট্রেনটি স্টেশনে দাঁড়ানো অবস্থায় ট্রেনের বাথরুম ব্যবহার না করতেও অনুরোধ করলেন।
রেল যাত্রা শুরু করার সাথে সাথেই, নিরাপত্তার লক্ষ্যে কিছুক্ষন পরপর কিছু রেল পুলিশের আনাগোনা দেখে বেশ স্বস্তিই বোধ হল। তবে কি উদ্দ্যেশে তাদের এই আনাগোনা, সেটা ক্লিয়ার না। ঝালমুড়ি ওয়ালা, চাবির রিং-রুমাল আর আয়না চিরুনী ওয়ালাদের সাথে সাথে ট্রে হাতে সাদা পোষাক পরিহিত ট্রেনের ক্যাটারিং সার্ভিসওয়ালাদের ও আনাগোনা বেশ বেড়ে গেল। ট্রেনের পুরো একটা বগি জুড়ে হল এই ক্যাটারিং সার্ভিস অর্থ্যাত ট্রেনের ক্যান্টিন। ভিন্ন ভিন্ন নানান নামের কোম্পানি ট্রেনের এই ক্যান্টিন গুলো নিলামে ডেকে নিয়ে যাত্রীদের গলা কাটেন এখানে। চা, স্যান্ডউইচ, পানি এবং ভাত তরকারী বেশ চড়া দামে পাওয়া যায় এই ক্যান্টিনে। ক্যান্টিনে কিছু টেবিল আর বেঞ্চ বসানো থাকলেও এগুলো কখনো খালি পাওয়া যায় না। পুলিশ, চেকার আর ট্রেনের ম্যানেজারেরা এই আসনগুলো টিকেট ছাড়া যাত্রীদের ভাড়ায় দিয়ে দেন।
ট্রেনের একেবারে শেষ বগিটায় রয়েছে নামায ঘর। নামায ঘর হলেও এটি আসলে ব্যবহার করা হয় টিকেট বিহীন যাত্রীদের জন্য। চেকার এবং রেল পুলিশেরা মাথা গুনে গুনে টিকেট বিহীন যাত্রীদের নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে এই ঘরে ঢুকিয়ে দেন।
ট্রেনের টয়লেটগুলো বেশ অপরিচ্ছন্ন এবং নিচে ট্যাংকিহীন। এইবার বিষয়টা পরিস্কার হল, কেন সুকন্ঠী যান্ত্রিক কন্ঠস্বরের আপা বারবার স্টেশনে দাঁড়ানো অবস্থায় ট্রেনের টয়লেট ব্যবহার করতে নিষেধ করে চলেছেন। খোলা ট্যাংক দিয়ে যাত্রীদের ত্যাগকৃত মল-মূত্র রেললাইনেই পতিত হয়। সুকন্ঠী যান্ত্রিক কন্ঠস্বরের আপা শুধু প্ল্যাটফরমের পরিছন্নতার কথা চিন্তা করেছেন কিন্তু রেল লাইন পার্শ্ববর্তী স্থানীয় পরিবেশের কথা একবার ও ভাবলেন না।
রাতের দূরপাল্লার ট্রেনগুলো যে এত দ্রুত ছুটতে পারে তা পূর্বে জানা ছিল না। এটা ঠিক দ্রুত নয়, মোটামুটি ক্ষ্যাপা গতিতে ছুটে চলছে রাতের সীমান্ত এক্সপ্রেস- গন্তব্য খুলনা থেকে সৈয়দপুর। একেকটা বগি যেন ছিড়ে-ফুড়ে আকাশে উড়ে যাবার জোগাড়। রেলগাড়ির এহেন ক্ষিপ্রতায় শুরুর দিকটায় বেশ ভয় ভয় লাগলেও শীত আর দলুনি মিলিয়ে ৩২৫ টাকা মূল্যমানের শোভন শ্রেনীর চেয়ারটা-য় বসে হালকা ঘুমঘুম ভাব চলে আসল। সুকন্ঠী মেয়েটির যান্ত্রিক কন্ঠস্বর শুনছি- ট্রেনটি আর কিছুক্ষনের মধ্যে যশোর স্টেশনে পৌছাবে। ট্রেন প্ল্যাটফরমে দাঁড়ানো অবস্থায় ট্রেনের টয়লেট ব্যাবহার না করতে তিনি আবারো অনুরোধ করলেন। ঘুমঘুম ভাব নিয়ে আবারো শুনছি- ট্রেনটি আর কিছুক্ষনের মধ্যে যশোর স্টেশন ছেড়ে যাবে। ট্রেন ছেড়ে দিল, আবারো সেই ক্ষ্যাপা গতি।
হঠাত-ই ধাপ-ধাপ, দুম-দাম মারামারির শব্দ। মাইর খেয়ে ছিটকে এসে ছোকড়া মতন একটা ছেলে আমার গায়ের উপর এসে পড়ল। চোখ খুলে দেখি তিনজন ‘ভদ্রলোক’ মিলে ছোকরাটাকে লাথি আর কিল ঘুষি মারছেন সমানে আর পুরো বগি ভর্তি মানুষ তামশা দেখছে। দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচারটা ঠিক মেনে নিতে না পেরে উঠে গিয়ে তাদের থামালাম এবং ছোকরাটাকে এভাবে মারার জন্য ষন্ডামার্কা তিনজন ভদ্রলোককে ধমকালাম। ছোকরাটার নাম মুকুল। যশোর স্টেশন থেকে পুরো মদ্যপ অবস্থায় মুকুল স্ট্যান্ড টিকেট নিয়ে ঈশ্বরদী যাবার উদ্দেশ্যে আমাদের বগীটায় উঠেছিল। আসলে এমন ক্ষ্যাপা গতির ট্রেনে অবলম্বন হিসেবে কোন কিছু না ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব আর ধরতে হলে সিটগুলো ছাড়া বিকল্প কোন কিছু নেই। মুকুল ও দাঁড়িয়ে ছিল ‘ভদ্রলোকেদের’ সিটের কোনা ধরে। তার শরীর হতে বের হওয়া মদের তীব্র গন্ধ থেকেই শুরু হয় ঝামেলা এবং ফলাফল মদ্যপ মুকুলের উপর অমানুষিক নির্যাতন। অমানুষেদের নির্যাতন হতে মুকুলকে রক্ষা করে তাকে বগীর গেটে নিয়ে দাড় করাই। ট্রেনের গেট হল ধুমপায়ীদের অভয়ারন্য। ধুমায়া মাইনসেরা বিড়ি খায় এই জায়গায় এসে।
সিগারেট খাইবা মুকুল?
জ্বি ভাইয়া। ধরান আপনি, তারপর আমারে দেন।
মুকুল যখন কথা বলছিল তার মুখ থেকে ভস ভস করে এলকোহলের উৎকট গন্ধ বের হচ্ছিল আর মাঝে মাঝে সে তার জিব বের করছিল। মানুষ বেশি নেশা করলে সাধারনত এমন জিব বের হয়ে আসতে চায়। রক্তে ভেজা নাক-ঠোট আর কান্না ভেজা চোখ মুছতে মুছতে সে বলে চলছিল- ভাইয়া দেখলেন তো, কিভাবে আমাকে মারল তারা। আমি কিছু বলছি? কোন প্রতিবাদ করেছি? এরপর ও মারল। তারা আমাকে তাদের সিট থেকে সরে যেতে বলেছে, আমি সরে যাই নাই- এই আমার দোষ। খুব কষ্ট করে দম চেপে তার কথা শুনলাম আর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। মুকুল একসময় রেলেই চাকুরী করত। কি এক অজানা কারনে ৪/৫ বছর আগে চাকুরীরত অবস্থায় তাদের অনেকের চাকুরী চলে যায় আর চির পরিচিত ট্রেনটা হয়ে ওঠে অচেনা। কোর্টে মামলা চলছে এখন পর্যন্ত কিন্তু কোন অগ্রগতি নেই। চাকুরিটা চলে যাবার পর থেকে হতাশা আর কর্মহীনতা থেকেই এই এলকোহল নেশায় সে আসক্ত হয়ে পরে। মুকুলে বাড়ি যশোরে। যাবে ঈশ্বরদী। আমার সিটে তাকে বসতে বললে সে তা সগৌরবে প্রত্যাখান করে যেন সিটে বসা ভদ্রলোকেদের প্রতি ধিক্কার জানায়। মুকুলকে দরজায় রেখে এসে সিটে বসে যেন শান্তি পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষন পর আবার গেলাম তার কাছে। গিয়ে দেখি, মুকুল তার জায়গা ঠিকই বানিয়ে নিয়েছে। ট্রেনের দরজার সিঁড়িতে বসে সে তার পা ঝুলিয়ে দিয়ে, আপন মনে গান গেয়ে চলছে-
বান্ধব আমার মন বান্ধিয়া, পিঞ্জর বানাইছে…..
তন্ময় হয়ে মুকুলের গানের কথা গুলো শুনছিলাম। মনের কষ্ট দূর করবার খুব ভাল মাধ্যম হয়তোবা কান্না আর গান। গান শেষ হলে গেট হতে আবারো তাকে সরিয়ে বসালাম। এবারো সে সিটে বসতে যেতে নারাজ। অবশেষে নিজের সিটে এসে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে মুকুলের গানের কথা গুলো ভাবতে ভাবতে নিদ্রা গেলাম।
সুকন্ঠী নারীর যান্ত্রিক কন্ঠস্বরে মাথা আর পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে গেলাম। গাড়ি কখন ঈশ্বরদী ছাড়িয়ে জয়পুরহাটে পৌছে গিয়েছে খবর রাখতে পারি নাই। পা-গুলো একটু প্রসারিত করবার জন্য জান বের হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোন উপায় নেই। শোভন শ্রেনীর এই চেয়ার গুলো আরামের চেয়ে বেশি হারাম করে দেয়া। পুরো বগীটিতে এখন অনেক লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। যাদের বেশির ভাগ-ই বিনা টিকেটের যাত্রী। ভোররাতে চেকার আর পুলিশরা ধুমায়া বিনা টিকেটে রেল ভ্রমনের ফায়দা তুলে চলেছেন। একজন মহিলা আমার চেয়ারের নিচে সামান্য ফাকা জায়গাটুকুর ভেতরে ঢুকে গিয়ে একটা চাদর পেতে ঘুমিয়ে পড়েছে। এরা গরীবের ও গরীব। চেকারকে দশটি টাকা দেবার মত সাধ্য নেই তাই সিটের তলে ঢুকে পড়া, আর সাথে ফ্রি আরামের ঘুমটি তো থাকছেই। যেই ভদ্রলোকটি শোভন শ্রেনীতে একটু আরাম করে যাবার জন্য একসাথে দুটো সিট নিয়ে যাচ্ছিলেন শত চেষ্ঠাতেও সে আর তার খালি সিটটি ধরে রাখতে পারেন নাই। একজন লোক সেটায় বসে তৃপ্তির ঘুম দিয়েছেন। মুকুল ঈশ্বরদী নেমে গিয়েছে জানি, কিন্তু তার আর কোন খবর নেয়া হয় নাই। এই জীবনে হয়তোবা আর তার সাথে দেখা হবে না। তবু মুকুলের খোজে ভীর ঠেলে গেটে গিয়ে দাঁড়াই। মুকুল নেই সেখানে। অন্য এক মোটা লোক সেখানে বিড়ি ফুঁকছে, কিন্তু সে আর মুকুলের মত গান করছে না। মুকুলের মত করে পা ঝুলিয়ে তার বসার জায়গাটায় বসে তার মত করে সেই গানটা ধরার চেষ্ঠা করলাম-
বান্ধব আমার মন বান্ধিয়া, পিঞ্জর বানাইছে…..
নাহ! মুকুলের মত হলনা। মুকুলদের মত আমাদের হয় না। কারন আমরা ভদ্দরনোক।
ভোর হয়ে গিয়েছে। হিলিতে ভারত সীমানা ঘেঁসে নো-ম্যানস ল্যান্ডে এসে গাড়ি থেমে গেল। কোন এক বগীর চাকায় কি একটা সমস্যা হয়েছে। কর্তব্যরত লোকজন লাইট মেরে মেরে দেখছেন। দৌর দিয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে বিজিবি সদস্যগন ট্রেন টার্গেট করা চোরাচালিনীদের পেছনে দৌড়াচ্ছেন। ট্রেন লাইনের দেড় হাত দূরে বাংলাদেশ অংশে ভারতীয় বিএসএফ এর একটা দল ও ট্রেন থেমে যেতে দেখে, তাদের কুকুর আর দলবল নিয়ে হাজির হয়েছে। ভারতীয় অংশের ঘর বাড়ি হতে ভারতীয় মানুষেরা কৌতুহলী হয়ে ট্রেনের যাত্রীদের দেখছে আর যাত্রীরা তাদের। যেন পাশাপাশি দুটো চিড়িয়া ঘর। ট্রেন আবারো চালু হল। ফুলবাড়ি স্টেশনে এসে বিজিবি সদস্যরা নেমে গেলেন, সাথে ট্রেনের পানির ট্যাংকি হতে উদ্ধার করলেন দুই বস্তা ফেন্সিডিল। বিজিবি সদস্যরা নেমে যাওয়ার পরপর-ই ট্রেনে ভারতীয় মসলা, ক্রিম, বাম, চকলেট আর বিস্কিট বিক্রি শুরু হয়ে গেল। ভারত সীমানা ঘেঁসে কিছুদূর চলার পর ফুলবাড়ি, বিরামপুর স্টেশন পেড়িয়ে পার্বতীপুর এসে গাড়ি থেমে রইল। শুরু হল প্রতীক্ষা। কখন ঐ পাশ হতে বরেন্দ্র এক্সপ্রেস আসবে আর কখন এই ট্রেন ছাড়বে। দূর্ঘটনা এড়াতে এই ব্যাবস্থা। প্রায় পৌনে এক ঘন্টা অপেক্ষার পর অবশেষে বরেন্দ্র এক্সপ্রেস ট্রেনটি আসল এবং আমাদের গাড়ি ছেড়ে গেল। আধা ঘন্টার মধ্যে প্রচন্ড মাথা, পা আর কোমর ব্যাথা নিয়ে সৈয়দপুর স্টেশনে নেমে পড়লাম। এবার আমার বাস ধরবার পালা। বাসে যেতে হবে আরো পুরো দুই ঘন্টা……….
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১:০৬