somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ পচা পাগলার পালা

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৫:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আপনারা কী কোন পাগলকে কখনো মদ খেতে দেখেছেন? আমি আজ এক পাগলের কথা বলবো, যে মদ খেত।
তার নাম পচা পাগলা। বদ্ধ পাগলদের মতো সে কিন্তু দিগম্বর হয়ে ঘুরতো না। বরং ঠিক তার উল্টো। ফুলপ্যান্টের ওপর গিঁট বেঁধে পরা ছেঁড়া ফাটা লুঙ্গি আর নোংরা পাঞ্জাবির ওপর বিবর্ণ ফুলহাতা শার্ট। এই ছিল তার শীত গ্রীষ্ম সারা বছরের পোশাক। অবশ্য তাকে স্যান্ডেল বা জুতা পরতে কেউ দেখেনি। খালি পায়ে হাতে একটা ছড়ি নিয়ে বাজারের কশাইপট্টিতে সে কুকুর তাড়িয়ে বেড়ায়।

সূর্য উঠার আগে থেকে কশাইপট্টির ভেতর গরু ছাগল জবাই করা শুরু হয়ে যায়। পচা পাগলার ডিউটিও তখন থেকে শুরু। সে রাতের বেলা তাড়ি খেয়ে কশাইপট্টির ভেতর শুয়ে থাকে। তাড়ি হলো খেজুর বা তালের রস পচিয়ে তৈরি করা এক ধরণের মদ। এই মদ খেয়ে পচা পাগলা রাতে ঘুমিয়ে থাকে। ডোজ একটু বেশি হলে সে উল্টোপাল্টা বকতে বকতে ঘুমিয়ে যায়। ডোজ কম হলে সারা রাত না ঘুমিয়ে সে ঝিম মেরে বসে থাকে। ভোরে গরু ছাগলের গলায় ছুরি চালানোর সাথে সাথে নেড়ি কুত্তাগুলো রক্তের গন্ধ পেয়ে ছুটে আসে। তখন পচা পাগলার ডাক পড়ে। ‘এই পচা’, ‘এই পচা’, ‘আয় রে’-কশাইদের হাঁক ডাক শুনে পচা পাগলা সাঁই সাঁই করে ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে এসে হাজির। কিন্তু যারা শুধু ‘পচা’ বলে ডাকে, তাদের ডিউটি সে করতে চায় না। তার টাইটেল সহ তাকে ডাকতে হবে। অর্থাৎ, ‘পচা পাগলা’। কশাইদের কেউ কেউ যখন দেখে যে, কুত্তা মুখ লাগিয়ে রক্ত চাটছে অথবা পশুর নাড়িভুঁড়ি নিয়ে টানাটানি করছে অথচ পচা পাগলা ছড়ি হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, তখন তারা বুঝতে পারে যে পচাকে তার টাইটেল সহ ডাকা হয়নি। তারা তখন চিৎকার করে বলে, ‘আবে ওই পচা পাগলা, কুত্তাগুলা তাড়া ভাই, তাড়া!’
ব্যস্, পচা পাগলার প্লে বাটনে চাপ পড়ে যায়। সে মুহূর্তের মধ্যে সাঁই সাঁই করে ছড়ি ঘুরিয়ে ধমক দিয়ে কুত্তা গুলো তাড়িয়ে দেয়। একটু পরে কুত্তা গুলো একটা একটা করে আবার এসে জড়ো হয়। পচা আবার তাড়া করে ওদের। এভাবে মাংস বিক্রি শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেলা বারোটা একটা অব্দি সে ডিউটি করে। কশাইরা তাকে সকালের চা-নাস্তা খাওয়ায়। দুপুরে হোটেলে খাওয়ার জন্য টাকা দেয়। তাড়ি ও বিড়ি–সিগ্রেট খাওয়ার জন্যও কিছু দেয়। পাগলের মাথা ঠাণ্ডা না থাকলে সে ডিউটি করবে কেন?

দুপুরে খাওয়ার পর ছড়ির মাথায় বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে ঘাড়ে নিয়ে পচা পাগলা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত তার দৃপ্ত পদচারনা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু মুখে তার কোন শ্লোগান বা সংলাপ নেই। ফাজিল ছেলেদের ছোঁড়া ইট পাটকেলকে সে ভ্রুক্ষেপ করে না। কঠিন মুখ করে পতাকা হাতে খালি পায়ে সে শহরের রাস্তা দাপিয়ে বেড়ায়। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে শহর ছাড়িয়ে সে চলে যায় তাড়ির ভাটির দিকে। সেখানে সে কখনো মাগনা তাড়ি খায় না। মজিদ ভাটিওয়ালাকে রোজ দশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে সে মাটির খোলা ভর্তি এক খোলা তাড়ি নিয়ে বসে যায়। অন্যান্য তাড়িখোররা নেশার ঘোরে পচা পাগলার গান শোনার জন্য তাকে এক আধ গ্লাস তাড়ি অফার করে। পচা সসম্মানে অফার গ্রহন করলেও একটা গানের প্রথম দুটো কলি ছাড়া সে অন্য গান জানে না। “ঝুম বারাবার ঝুম শরাবি, ঝুম বারাবার ঝুম!” গানের এই একই পংক্তি বার বার শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে তাড়িখোররা পচা পাগলাকে তাড়িয়ে দেয়। একে তো পাগল, তার ওপর আবার তাড়ি খেয়ে মাতাল। পচা পাগলা টলতে টলতে রওনা দেয় তার আশ্রমে। আশ্রম বলতে সেই কশাইপট্টি। পাগল হোক আর মাতাল হোক, দুটো জিনিষের কথা সে কখনো ভোলে না। হাতের ছড়ি আর কশাইপট্টির ঠিকানা।

অন্য পাগলদের মতো পচা পাগলা বক বক করে না। একমাত্র কুকুর তাড়ানো ছাড়া তার কোন হিংস্র আচরণও নেই। শোনা যায়, এক সময় নাকি তার বাড়ি ঘর সবই ছিল। একাত্তর সালে যুদ্ধের সময় বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে নৌপথে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবি হয়ে পদ্মার খরস্রোতা জলে সবাই ডুবে যায়। পচা পাগলা সাঁতরে কূলে উঠে নিজের প্রাণ বাঁচায়। কিন্তু পরিবারের সবাইকে হারিয়ে তখন থেকে তার মাথা সামান্য টাল হয়ে যায়। জনশ্রুতি আছে, যুদ্ধের শেষের দিকে রাজাকাররা তার মাথায় রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে তাকে আরও টাল বানিয়ে দেয়।
তার সম্পর্কে সত্য মিথ্যা অনেক কিছুই জানা যায় না। কেউ বলে, পচা পাগলা হিন্দু, কেউ বলে মুসলমান। মাঝে মাঝে সে দু’একদিনের জন্য কশাইপট্টি থেকে উধাও হয়ে যায়। কোথায় যায়, কে জানে? জিজ্ঞেস করলে সে কোন জবাব দেয় না। কেউ তার সাথে কথা বলতে চাইলে সে বিরক্ত বোধ করে।

তাড়ি খেলে পচা পাগলা দিলদরিয়া হয়ে যায়। হাতের মুঠোয় যা দু’একটাকা থাকে, তা’ সে ভিক্ষুককে দিয়ে দেয়। একবার এক ভিক্ষুকের সাথে এ নিয়ে তার ভীষণ ধ্বস্তাধস্তি হলো। ভিক্ষুক পাগলের ভিক্ষা নেবে না, আর পাগল ভিক্ষা না দিয়ে ছাড়বে না। পচা যতবার দু’টাকার কয়েন ভিক্ষুকের থালায় রাখে, ভিক্ষুক ততবার সেটা তুলে ফেলে দেয়। কয়েন কুড়িয়ে এনে আবার দিতে গেলে ভিক্ষুক পচা পাগলাকে তাড়া করে। পচা দৌড়ে পালিয়ে যায়। দূরে দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে বলে, ‘শালা ফকির না পাগল?’

একবার পচা পাগলাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। কশাইপট্টিতে মাংস কিনতে আসা সিভিল ড্রেসের এক পুলিশ অফিসার তার মানিব্যাগ হারিয়ে ফেলে পচা পাগলাকে পকেটমার ভেবে ধরে ফেললো। কশাইরা যতই বলে, ‘ও পকেটমার না স্যার, পাগল’, অফিসার ততই ক্ষেপে যায়। পচাকে চড় থাপড় দিয়ে পায়ের কাছে বসিয়ে রেখে অফিসার ওয়াকি টকিতে থানায় খবর দিল। থানা থেকে পুলিশ এসে তাকে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে ধরে নিয়ে গেল। কশাইরা সবাই একযোগে প্রতিবাদ করলেও কোন ফল হলো না।

বিকেল বেলা সব কশাই এক হয়ে বাজারের আরো লোকজন নিয়ে থানায় গেল পচাকে ছাড়িয়ে আনতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে পচা পাগলার অবস্থা দেখে সবার মন খারাপ। পচাকে মার ধোর করে হাত পা বেঁধে থানার হাজত ঘরের মেঝেতে উপুড় করে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার নোংরা পোশাক আশাক ছিঁড়ে ফালি ফালি। কিন্তু এত কিছু করেও তার কাছ থেকে কোন মানিব্যাগ পাওয়া যায়নি। পচা পাগলা কশাইদের দেখে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললো। কশাইরা পুলিশের সাথে অনেক কথা কাটাকাটি করে কিছু টাকা পয়সা ভেট দিয়ে পচাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলো।

কিন্তু পরদিন থেকে পচা পাগলার ভিন্নরূপ। কশাইরা তাকে নতুন কাপড় চোপড় কিনে দিলেও সে সেসব গা থেকে খুলে ফেলে দিগম্বর হয়ে বাজারের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। বহু চেষ্টা করেও তাকে কাপড় পরানো গেল না। বাজারের দোকানদাররা মহা বিব্রত। তারা হাই হুই করে পাগলাকে তাড়া করলে সে দৌড়ে বাজারের এক গলি থেকে আর এক গলিতে চলে যায়। সেখানে তাড়া খেয়ে সে আবার অন্যদিকে পালায়। কিন্তু বাজার থেকে সে বেরোয় না। মহা মুশকিল!
বাজার করতে আসা লোকজন লজ্জায় চোখ ঢেকে দোকানদারদের বকাঝকা করে। বাজারে নারী পুরুষ অসংখ্য কাস্টোমার। তাদের মধ্যে এক ন্যাংটো পাগল ছোটাছুটি করছে। এমন হলে তো এ বাজারে আর আসা যাবে না! দোকানদাররা এ পাগলকে তাড়িয়ে দিচ্ছে না কেন?

অবশ্য দোকানদাররা না পারলেও পচা পাগলা এতদিন যাদের ছড়ি ঘুরিয়ে তাড়িয়ে বেড়াতো, সেই কুকুর গুলোই তাকে বাজার থেকে তাড়িয়ে দিল। পোশাকধারী পুলিশ আর পোশাকবিহীন পাগলকে তাড়া করা কুকুরের সহজাত স্বভাব। রহস্যজনক কারণে তারা এই দুই শ্রেণীর লোককে পছন্দ করে না। পচা পাগলার উদোম দেহ দেখে প্রথমে ভড়কে গেলেও পরে কুকুর গুলো ঘেউ ঘেউ করে তাড়া করলো তাকে। সম্ভবতঃ এতদিন পচাকে পোশাক পরা অবস্থায় দেখে তারা বুঝতে পারেনি যে, সে পাগল। দিগম্বর পচা পাগলাকে তারা কামড়ে হাঁচড়ে রক্তাক্ত করে ফেললো। কুকুরের কবল থেকে বাঁচার জন্য পচা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালিয়ে গেল বাজার থেকে।
এরপর আর দেখা যায়নি তাকে। কেউ কেউ বলে, শহর থেকে দূরে ময়লা ফেলার এক ভাগাড়ে পচা পাগলা নাকি উদোম শরীরে মরে পড়ে ছিল। হতেও পারে। কে খোঁজ রাখে এসব পাগল ছাগলের?
********************************************************************************************************************
রি-পোস্ট।
ছবিঃ গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৫:২৫
৩৮টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×