আজকাল কথায় কথায় ইসলামের নামে অনৈসলামিক বিষয়াবলি জায়েজ করে ফেলা হয়। হারাম বিষয় করে ফেলা হয় হালাল। ঈমানের দুর্বলতা, শিক্ষার অসম্পূর্ণতা এবং হারাম-হালালের ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে ইসলামের বহু বিষয়ে জনসাধারণের মাঝে সত্য-মিথ্যার ব্যাপারে নানারকম ধূম্রজাল সৃষ্টি হচ্ছে। উদাহরণ অনেক। সবচেয়ে বড় উদাহরণ চতুর্থ খলিফা হজরত আলী ( রা: ) এর বিরুদ্ধে সমবেত কিছু বিদ্রোহী মুসলমানের সাথে স্বয়ং হজরত আয়েশা সিদ্দিকা ( রা: ) এর বসরার যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে কিছু কল্পকাহিনীর প্রবর্তন। ওই যুদ্ধের ময়দানে উম্মুল মুমিনিন ( রা: ) উটের পিঠে রক্ষিত হাওদায় অবস্থান করার কারণে কিছু ঐতিহাসিক যুদ্ধটিকে উটের যুদ্ধ বা জামাল যুদ্ধ নামে চালিয়ে দিয়েছেন এবং পাশ্চাত্যের কিছু লেখক কর্তৃক প্রচার করা হয়েছে যে, তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। জামাল যুদ্ধে স্বয়ং নবী পত্নীর অংশগ্রহণের নজির টেনে ইসলামের পর্দার বিধানের ব্যাপারে ইদানীং কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে।
বলা হচ্ছে যে, স্বয়ং হজরত আয়েশা রা: যদি হাজার হাজার পুরুষের মাঝে যুদ্ধের ময়দানে উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করে থাকেন তাহলে মেয়েদের আর ঘোমটা দেয়া বা পর্দা করার দরকারটা কী? বক্তারা ভুলে যান যে, দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর রা:-এর সময়ে মেয়েদের অপর্যাপ্ত পোশাকে মসজিদে গমনের ব্যাপারে হজরত আয়েশা সিদ্দিকা ( রা: ) কর্তৃক বিরক্তি প্রকাশের কারণেই মেয়েদের মসজিদে জামাতে গমনের রেওয়াজ বাতিল হয়ে যায় (দ্র: বুখারি, মুসলিম ও অন্যান্য)। তিনি নিজে তো পর্দা মেনে চলতেনই, কেউ পর্দার নির্দেশ অমান্য করলে তার ব্যাপারেও তিনি এ রকম কঠোর ছিলেন। তার পরও এ যুগে তাঁর বিরুদ্ধে পর্দার বিধান অমান্য করে যুদ্ধে গমনের অজুহাত তুলে বা অভিযোগ এনে অন্যদেরও পর্দা ভঙ্গের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিষয়টা বাস্তাবিক দুঃখজনক।
উম্মুল মুমিনিন ( রা: ) নিজে যে কাজটির জন্য অনুতপ্ত ছিলেন, যে কাজটির বিপরীতে স্বয়ং নবী করিম ( সা: ) এর সাবধান বাণী ছিল এবং যে ধরনের কাজের বিপক্ষে আল-কুরআনের স্পষ্ট আয়াত রয়েছে (সূরা আহজাব : ২৮-৩৩ দ্র.), যা পাঠ করে পরবর্তীকালে উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা ( রা: ) জার জার হয়ে অশ্রু বিসর্জন করতেন (দ্র. শব্দার্থে কুরআন, সূরা আহজাবের ওই আয়াতগুলোর টীকা) সেই কাজটির নজির টেনে হারাম বিষয়াদি হালাল করার চেষ্টা হচ্ছে। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা ( রা: ) জামাল যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন কিছু বিপথগামী লোকের মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে। তাঁকে উটের পিঠে হাওদায় বসিয়ে তাঁরা বসরার দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় ‘হাওয়াব’ নামক কুয়ার কাছে পৌঁছলে কতগুলো কুকুর হাওদা ঘিরে কাঁদতে শুরু করে। তখন তাঁর নবীজী (সা: )এর ভবিষ্যদ্বাণীর কথা মনে পড়ে যে, তাঁর এক স্ত্রীর জন্য হাওয়াব নামক কুয়ার কাছে কতগুলো কুকুর কাঁদতে থাকবে। উম্মুল মোমেনিনের ওই বাণীর কথা মনে পড়তেই তিনি উট থামাতে বলেন এবং জায়গাটার নাম জিজ্ঞেস করেন। সঙ্গীরা হাওয়াব নামটি বলার সাথে সাথে তিনি ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়েন এবং উটের গতি উল্টো দিকে ঘোরাতে বলেন। সঙ্গীদের কাছে তিনি কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন,
‘আমি রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি : ‘হায় আমি যদি জানতাম তোমাদের মধ্যে কারো জন্য হাওয়াবের কুকুর কাঁদবে।’ তারপর তিনি আয়েশা (রা: ) উটের বাহুতে আঘাত করে ওটাকে বসান এবং সঙ্গীদেরকে বলেন : ‘আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলো, আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলো, আল্লাহর কসম। আমিই তো হলাম হাওয়াব কুয়োর অধিবাসিনী।’ তিনি বসরার দিকে আর অগ্রসর হতে অস্বীকার করেন। তখন সঙ্গীদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের ( রা: ) বলেন, ‘ যে আপনাকে বলেছে যে, এটা হাওয়াব কুয়ো সে মিথ্যা বলেছে।’ তিনি আরো ৫০ জন লোক হাজির করেন যারা হজরত আয়েশা সিদ্দিকা ( রা: ) এর কাছে বলেন যে, জায়গাটা হাওয়াব কুয়া নয়। ইসলামের ইতিহাসে এটাই ছিল সর্বপ্রথম মিথ্যা সাক্ষ্য এবং এই মিথ্যা সাক্ষ্যই শেষ পর্যন্ত তাকে নমনীয় করে ফেলে এবং বিদ্রোহীরা তাকে বসরার দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় (দ্র. ইবনে কাসিরের আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইফা), সপ্তম খণ্ড, জামাল যুদ্ধ অধ্যায়)।
মজার ব্যাপার হলো, যুদ্ধের ময়দানে তিনি উটের পিঠে হাওদার মধ্যেই বসা ছিলেন, বাইরে বেরোননি এবং তাঁর উটের রশি যার হাতে ছিল তাকেও তিনি কোনো মুসলমান হত্যার অনুমতি দেননি, বরং হজরত আদম আ:-এর ছেলে কাবিলের সামনে তাঁর ভাই হাবিলের পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ ঠিক হাবিলের মতো অসহায়ভাবে প্রতিপক্ষ মুসলমানের হাতে মরতে বলেছিলেন এবং একের পর এক করে সত্তর জন মুসলমান একাদিক্রমে উটের রশি ধরে নিহত হওয়ার পর হজরত আলী রা: নিরুপায় হয়ে হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা:-এর উটের পা কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়ে হাওদা ভূপাতিত করে অসম যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটান এবং হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা:কে সসম্মানে তাঁর ভাই আবদুর রহমানকে সাথে দিয়ে মদিনায় পাঠিয়ে দেন। এই পুরা কাহিনীর মধ্যে উম্মুল মুমিনিন রা: একবারো হাওদার বাইরে বেরোননি। পর্দার ব্যাঘাত ঘটাননি। তার পরও তিনি বাকি জীবন ওই ঘটনার জন্য আফসোস করেছেন, ভুল পদক্ষেপটির জন্য চোখের পানি ফেলেছেন। এই ঘটনা কোনোক্রমেই কোনো মুসলমান নারীর বেপর্দা হওয়ার জন্য সার্টিফিকেট হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। কিন্তু হচ্ছে। কারণ ঘটনাটার আদি-অন্ত অনেকেরই জানা নেই।
সত্য জানার পক্ষে এ দেশের সিলেবাস ও পাঠ্যতালিকা সবচেয়ে বড় বাধা। ব্রিটিশ আমল থেকে ইসলামের যে ইতিহাস এ দেশের স্কুল-কলেজে পড়ানো হচ্ছে, তা অসম্পূর্ণ, বিকৃত ও বিভ্রান্তিকর। বিজাতীয় লেখকদের ইতিহাস তো মুসলমানদের ব্যাপারে সত্য বলে না। আসলে হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা: কখনো কোনো যুদ্ধ পরিচালনা করেননি, বরং হজরত আলী রা:-এর প্রতিপক্ষ বিদ্রোহীরা তাঁর উটটিকে পরিচালনা করে তাঁর হাওদাসহ যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে উটটিকে দাঁড় করে রেখেছিলেন হজরত আলী রা:-এর বিরুদ্ধে মুসলমানদের সমর্থন লাভের আশায়। বলা বাহুল্য যে, দুই দল মুসলমানের যুদ্ধ ভ্রাতৃঘাতী ফিতনা ছাড়া আর কিছুই নয় এবং সে ফিতনার বিরুদ্ধে নবী করিম সা: অনেক আগে থেকেই মুসলমানদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, এমনকি ওই ফিতনা দেখা দিলে যুদ্ধ না করে বরং নিজ নিজ তরবারি ভেঙে ফেলার নির্দেশও দিয়েছিলেন (দ্র: বুখারি, মুসলিম ও অন্যান্য)।
তা ছাড়া হজরত আলী রা:-এর মতো পরহেজগার ও ন্যায়পরায়ণ খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বা যুদ্ধ করা ইসলামে জায়েজ নয়। কাজেই কোনো মুসলমানের পক্ষে ওই যুদ্ধে হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা:-এর ভূমিকার ব্যাপারে কোনো বেফাঁস কথা না বলাই উত্তম। তিনি নিজেও তাঁর সেই দিনের ভূমিকায় লজ্জিত ছিলেন বলে তাঁর পরবর্তীকালের কথায়-কাজে প্রমাণ হয়েছে (দ্র: আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া)। হজরত আলী রা: নিজেও তাঁর যথাযোগ্য সম্মান দিতে ভোলেননি।
যুদ্ধ যার সাথেই হোক, হজরত নবী করিম সা:-এর জীবদ্দশায় কোনো মুসলমান নারী যুদ্ধে গমনের অনুমতি পাননি। ওহুদের যুদ্ধে কিছু সঙ্গিনীসহ হজরত ফাহিমা রা: বিনা অনুমতিতে মুসলিম শিবিরে উপস্থিত হলে তাঁর প্রতিও তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, ক্রোধান্বিত হয়ে বলেছেন, ‘কে তোমাদের যুদ্ধের ময়দানে আসতে বলেছে?’ এবং পরে যেহেতু এসেই পড়েছেন সেহেতু বিপদের মধ্যে আর ফেরত না পাঠিয়ে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেননি। তবে ওই যুদ্ধে নারীগণ তীর কুড়িয়ে দেয়া এবং আহত মুজাহিদদের শুশ্রƒষার দায়িত্ব পালন করার অনুমতি পেয়েছিলেন। ইসলামি বিধানমতে যুদ্ধ সম্পূর্ণরূপে পুরুষের দায়। মুসলিম নারী, শিশু ও অক্ষম পুরুষ ভোগ করবে আরক্ষা ও নিরাপত্তা, এটাই ইসলামের স্বাভাবিক বিধান। কোনো মুসলমান নারী যুদ্ধবন্দিনী হয়ে শত্রুর হাতে পড়তে পারে কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতির কারণে শত্রুপক্ষ আক্রমণের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত উৎসাহ বোধ করতে পারে এ রকম অবস্থা সৃষ্টি করতে অনুমতি নেই, যেমন অনুমতি নেই কুরআন শরিফ নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার (তাঁবুতে থাকতে পারে), যেহেতু বিপর্যয় ঘটলে শত্রু কর্তৃক আল কুরআনের অবমাননা হতে পারে। একটা কথা ভুললে চলবে না যে, ইসলামের বিধিবিধান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সা: কর্তৃক নির্ধারিত। অন্য কারো বিধিব্যবস্থা ইসলামে অবশ্যই অচল ও বাতিল।
হজরত খাদিজা রা:-এর ব্যবসায়ের কথা বলেও ইদানীং নারীসমাজকে পর্দা ত্যাগ করতে উৎসাহিত করা হয়। বড় দুর্ভাগ্য তার, যে জানেন না যে, উম্মুল সুমিনিন রা: ব্যবসায় করেছেন মুসলমান হওয়ার আগে এবং নিজে ব্যবসায় করেননি, লোক দিয়ে করিয়েছেন। তিনি মুসলিম অবস্থায় তো বটেই, অমুসলিম অবস্থায়ও ঘরেই থাকতেন। প্রত্যেক মুসলমানেরই জানা থাকা উচিত যে, নবীত্নীদের ঘরে থাকার জন্য সূরা আহজাবে (আ-২৮-৩৩) স্পষ্ট নির্দেশ আছে এবং অমান্য করলে দ্বিগুণ শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এ আদেশ শুধু নবী পত্নীদের জন্যই। অন্যান্য মুসলিম নারীর জন্য সাধারণ পর্দার নির্দেশ আছে সূরা নূরের ৩০-৩২ নম্বর আয়াতে। প্রয়োজনবোধে বা জীবিকার অন্বেষণে নারীরা অবশ্যই ঘরের বাইরে যেতে পারে, তবে পর্দার বিধান মান্য করেই সেটা করতে বলা হয়েছে এবং তা করাও সম্ভব। সব যুগেই মুসলমান নারীরা প্রয়োজনের তাগিদে যথাযথ পর্দার ব্যবস্থা করে ঘরের বাইরে যেতেন। এতেই বরং তারা ভালো ও নিরাপদ থাকতেন। কাজেই পর্দার ব্যবস্থাকে যারা অত্যাচার বা অসম্ভব বলে মনে করেন তাদের ঈমানে ত্রুটি আছে, অন্তরে নিফাকের ব্যাধি আছে; আর যারা বলে থাকেন যে, ইসলাম নারীকে ঘরে বন্দী করেছে, তারা ইসলামের শত্রুশিবিরের লোক। এ উভয় শ্রেণীর লোক থেকেই মুসলমানদের সাবধান থাকতে হবে; অন্যথায় দুনিয়া ও আখিরাত দুটাই বরবাদ হয়ে যাবে।
আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু, সন্দেহ নেই; কিন্তু তিন শাস্তিদানেও অত্যন্ত কঠোর। সময় থাকতে তাই সাবধান হওয়াই উত্তম পন্থা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১২:৪১