নাটক! নাটক! আর নাটক!
বিখ্যাত ইংরেজী কবি, শেক্সপিয়ার বলেছিলেন পৃথিবীটা একটা নাট্যশালা এবং নারী ও পুরুষরা এর অভিনেতা-অভিনেত্রী। বিরাট পৃথিবীর নাট্যকলা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার অত বড় মাথা বা বুদ্ধিশুদ্ধি আমার নেই। ছোট বাংলাদেশের নাটক দেখতেই তো মাঝেমাঝে খেই হারিয়ে ফেলি। কত রকমের নাটক যে এখানে হচ্ছে। নাটকের রকমসকমও আলাদা আলাদা। সবচেয়ে জৌলুসপূর্ণ, দর্শনীয় আর লক্ষ্যণীয় নাটক অনুষ্ঠিত হয় আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে। বলতে পারেন, আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনুষ্ঠিত নাটকগুলো বিশ্বের যে কোন দেশের রাজনৈতিক নাটককে টেক্কা দিয়ে বিশ্বজয়ী পুরস্কার প্রাপ্তিতে সক্ষম। আর এরূপ নাটক একটার পর একটা চলছেই। একটা শেষ হলতো, আরেকটা শুরু হয়। যেমন-ধরুন, জিয়া পরিবারে ধারাবাহিক নাটকের একটি পর্ব বেশ চলছিল। নাটকের টাইটেল ছিল ‘জিয়া পরিবার তথা বেগম খালেদা জিয়া আর্থিক অনটনের জন্য বাড়ি ভাড়া দিতে পারছেন না’। হায়রে সততা, হায়রে আর্থিক অবস্থা? যিনি জিয়ার মৃত্যুর পর তৎকালীন এরশাদ সরকার কর্তৃক সরকারের স্বার্থ উপেক্ষা করে ঢাকার গুলশানে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার মূল্যমানের জমিসহ বাড়ি উপঢৌকন পেয়েছেন এবং বর্তমানে যে বাড়ি থেকে মাসে ৩ লক্ষ টাকা ভাড়া পাচ্ছেন, যিনি প্রতিমাসে ব্যাংক থেকে আড়াই লক্ষ টাকা ব্যক্তিগত খরচের জন্য উত্তোলন করার অধিকার রাখে, যিনি বডি ফিটনেস, রুপচর্চা ও পোশাক আশাকের (এক পোশাক সাধারণত দ্বিতীয়বার পরিধান করেন না) পিছনে মাসে লক্ষাধিক টাকা খরচ করে থাকেন। তিনিই অর্থের অভাবে বাড়ি ভাড়া দিতে পারছেন না! কি সেলুকাস? কি হাইথটের নাটক? অবশ্য বিভিন্ন কারণ ও বিচার বিশ্লেষণে নাটকটির নেপথ্য রহস্য দেশবাসী সঠিক সময়েই অনুধাবন করতে পেরেছে।
যাক, সেসব কথা। জিয়ার পরিবারের ধারাবাহিক নাটকটির রেশ না কাটতেই হঠাৎ করে শুরু হয়ে গেল আরেক নাটক। বৈশাখের কাল বৈশাখীর মতই আর্বিভূত হল রিজওয়ানা পরিচালিত ""বকর অপহরণ নাটক"। টাইটেল হলো ‘‘রেজওয়ানা পরিচালিত বকর অপহরণ নাটক এবং বেলা শেষে বিএনপির হুংকার”। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি তথা বেলা এর প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এর স্বামী আবু বকর সিদ্দিক (এবি সিদ্দিক) লাল টকটকে কারে করে নারায়নগঞ্জের কর্মস্থল থেকে ঢাকায় বাসভবনে ফিরছিলেন। পথে তাদের সাথে অন্য কাউকে নেয়া হয়নি। কারণ নাটকের রহস্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে। পথে নারায়নগঞ্জে ফতুল্লা ভূঁইগড় থেকে এবি সিদ্দিক দিনে দুপুরে অপহরণ হয়ে যায়। অপহরণের খবর পেয়ে প্রকট যানজট পেরিয়ে সিনেমার নায়িকার ন্যায় রিজওয়ানা তড়িৎ গতিতে ঘটনাস্থলে গিয়ে গাড়ীর চালক রিপনকে নিজের জিম্মায় নিয়ে নেন। ভাবটা এরকম যেন, তিনি আগে থেকেই এরূপ দুর্ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। রিপনকে নিজের জিম্মায় নেয়ার কারণ একটাই, অপহরণ নাটকের আসল রহস্য যেন কারো কাছে প্রকাশ না হয়ে যায় রিপনের মাধ্যমে।
নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখা গেল নাটক নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বক্তৃতা বিবৃতি। অন্যরা রহস্যের ভেতরে না গেলেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন সরকার বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের হত্যা, গুম, অপহরণ ও নির্যাতনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করার ফলেই আবু বকর সিদ্দিকীকে অপহরণের মতো ঘটনা ঘটেছে। যাক, এরই মধ্যে ৩৫ ঘন্টার নাটকীয়তা, থ্রিল, সাসপেন্স আর উৎকন্ঠার পর এবি সিদ্দিককে মিরপুর আনসার ক্যাম্পের সামনে স্বাভাবিক অবস্থায় পাওয়া যায়।
নাট্য বিষয়ে বিশ্লেষক আমার এক বন্ধুর মতে রিজওয়ানা পরিচালিত “বকর অপহরণ” নাটক এবং ‘বেলা’র স্বামীকে নিয়ে বেলা শেষে বিএনপির হুংকার নাটকটি পুরো মাত্রায় ফ্লপ। আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম কেন পুরো মাত্রায় ফ্লপ? ও বলেছিল, নাটকটির রচনা, পরিচালনা, নায়কের অসংগতিপূর্ণ এবং অসংলগ্ন ডায়ালগ, প্রভাবশালীদের প্রচারণা ও সমর্থন সবকিছু মিলেই নাটকটি ফ্লপ হয়েছে। ও আর বলেছিল, বকর অপহরণ কালে কি কোন প্রকার বোমাবাজি, গোলাগুলি বা আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছিল? আমি বললাম না। বাংলাদেশে অনেক পরিবেশবাদী সংগঠন পরিবেশ নিয়ে কাজ করার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি গোষ্ঠীর আক্রোশের শিকার, তাদের উপর কি কোন পক্ষের আক্রোশের জের হিসেবে আজ পর্যন্ত হামলা/অপহরণের ঘটনা ঘটেছে বা আছে? না। যে কোন অপহরণের পর অপহরণকৃত ব্যক্তির উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কি তা হয়েছে? না। অপহরণের পর অপহরণকৃত ব্যক্তিকে ফেরতদানের বিনিময়ে মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবী করা হয়, এক্ষেত্রে কি তা করা হয়েছে। না। বরং, ফেরতদানের সময় আবু বকর সিদ্দিককে যাতায়াত বা অন্য কিছুর জন্য অপহরণকারীরা তাকে তিনশত টাকা দিয়ে দিয়েছে। মারহাবা। কি সুন্দর অপহরণ। শুধু কি তাই নাটকের মূল চরিত্র বা নায়ক অপহরণ থেকে ফেরত আসার পর জানালেন, তাকে অপহরণ করে দুটি ফেরি পার হয়ে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যেতে সময় লেগেছে দুই ঘন্টা। অথচ সেখান থেকে তাকে ফেরত আনতে সময় লেগেছে মাত্র এক ঘন্টা এবং কোন ফেরি পার হতে হয়নি। আরো জানালেন, তাকে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা হয়েছিল। অথচ আবার পরোক্ষনেই তার নিকট পাওয়া গামছার কথা উল্লেখ করে বলেন সেটা দিয়েই তার চোখ বাঁধা হয়েছিল। এছাড়াও কথিত অপহরণ থেকে মুক্ত হওয়ার পর তার স্ত্রী রিজওয়ানার মোবাইল নাম্বার তার মুখস্ত ছিল না বলে তিনি তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি বলেও অবহিত করেন। কি আশ্চর্য, স্ত্রীর মোবাইল নাম্বার মুখস্ত নেই, এমন কথাও নায়কের মুখ থেকে শুনতে হল। নাটকটি ফ্লপ হওয়ার আরো কারণ আছে। নাটকটি শুরু থেকেই একে রাজনৈতিকায়ন করার প্রচেষ্টা চলছিল। রাজনৈতিক দলীয় নেতা ছাড়া অন্য কোন অপহরণের ক্ষেত্রে দলের শীর্ষ পর্যায় তো দূরের কথা মাঠ পর্যায়ের নেতারাও কোন বক্তৃতা বিবৃতি প্রদান করেন না। কিন্তু আবু বকর অপহরণের পরপরই দলীয় কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি খোদ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া আবু বকর সিদ্দিক অপহরণ অবস্থা থেকে সহি সালামতে ফেরত আসার পর কি বললেন? অবৈধ সরকার পতনের ভয়ে এবি সিদ্দিককে ছেড়ে দিয়েছে। তাকে ছেড়ে না দিলে এখান থেকেই সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করা হতো।
সর্বশেষ বিশ্লেষণ - আবু বকর অপহরণ নয়। এটা ছিল একটি নাটক, তাও আবার পুরো মাত্রায় ফ্লপ নাটক। তবে কেন এটা মঞ্চস্থ করার প্রচেষ্টা ? হয়তো ‘বেলা’ ও এর নায়ক-নায়িকাদের লাইমলাইটে এসে অধিক ফান্ড পাওয়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা, না কি এর মাধ্যমে বিশেষ মহলের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা করা ?
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৩:০৪