--বাবা তুমি কি আমার সাথে বিয়ে বাড়িতে যাবে?
--হ্যাঁ, মা যাব। বিয়ে বাড়িতে কি থাকে?
--বিয়ে বাড়িতে বর আর বউ থাকে।
--ওখানে আমরা কি করবো?
--আমরা বর দেখব, বউ দেখব, ঘুরবো গল্প করবো বিয়ে দেখব আর মজার মজার খাবার খাব।
-- ওখানে অনেক মজা হবে তাই না মা ? আমরা কখন যাব?
--এই এক্ষুনি যাব। চল সবাই রেডি হয়ে নেই।
সবাই মিলে রেডি হয়ে ডিজিটাল সময় নয়টায় বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলাম। আধা ঘন্টার মধ্যেই কমিনিউটি সেন্টারে পৌছে গেলাম। কমিনিউটি সেন্টারের ভিতরে ঢুকেই মনে হলো আরে এ কোথায় এলাম। এত মনে হছে পহেলা বৈশাখের বট তলায় এসে পরেছি। এটাকে বড় কোন রাজনৈতিকদলের মহাসমাবেশ ও বলা যেতে পারে।পহেলা বৈশাখের বটতলা বললাম কারন চারিদিকে সুসজ্জিত নারী-পুরুষ। আর সবার মাঝে উৎসব উৎসব ভাব। চারিদিকে মানুষ আর মানুষ। বসবার জায়গাতো নেই দাঁড়াবার জায়গা পর্যন্ত নেই। পরিচিত মুখ খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম ছেলের বাবাকে। উনি সম্পর্কে আমার দুলাভাই হন। দুলাভাই বললেন --খাবারের ব্যাবস্থা দোতলায়। চল, দোতলায় যাই।
দোতলার সিঁড়ি কোন দিকে? সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না মানুষ ছাড়া। জানুকে বললাম-- সিঁড়ি কোন দিকে?
জানু বলল --দুলাভাইয়ের পিছন পিছন চলো তাহলেই সিড়ি পাবে। এক হাত দিয়ে জানুর শার্ট ও অন্য হাত দিয়ে মেয়ের হাত ধরে অন্ধের মত হাঁটতে লাগলাম। একটা জায়গায় এসে দেখি মানুষের উচ্চতা বাড়ছে, বুঝলাম যে এখনেই সিঁড়ি।
সর্বনাশ!!!! এই সিঁড়ি দিয়ে উঠব কি ভাবে। সিঁড়ির দোরগোড়ায় এসে মনে হচ্ছে রমনার বট মূলের আড্ডা শেষে রমনার গেটে এসে পরেছি। এক হাতে শাড়ি ও অন্য হাতে মেয়েকে ধরে আস্তে আস্তে উঠছি। মনে হছে মানুষের চাপে সিঁড়িটা না ভেঙ্গে পরে। মেয়েটা ভিড়ে ঠিক মত হাঁটতে পারছে না। একপাশে দাঁড়িয়ে শাড়ি কোমরে গুঁজে মেয়েকে কোলে তুলে নিলাম। উপরের দিকে তাকিয়ে জানুকে খোঁজার চেস্টা করলাম। কারন ছয় বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে শাড়ি পরে সিঁড়ি ভেঙ্গে ভিড় সামলিয়ে উঠা আমার জন্য বেশ কষ্ট সাধ্য। জানু কে তো খুঁজে পেলাম না, পেলাম ছেলেকে । কারন সে তার বাবার ঘাড়ের উপরে । এত কষ্টের মধ্যেও হেসে ফেললাম। যাক এক সময় দেখি আমি দোতালার ডাইনিং হলে এসে পরেছি।
ওখানে তো দেখি মহাযজ্ঞ। লোকে লোকারন্য। প্রতিটি টেবিল ভর্তি এবং প্রতিটি চেয়ার ধরে লোক দাঁড়িয়ে আছে। আর্থাৎ খাওয়া শেষ হলেই চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তি ঐ চেয়ারে বসবে। সিট দখল আর কি?
জানি না কিভাবে যে দুলাভাই একটা টেবিলে আমাদের বসার ব্যাবস্থা করে দিলেন। কিন্তু আমাদের চার জনের জন্য তিনটি চেয়ার। ছেলেকে কোলে নিয়ে বসলাম। ছেলে দেখলো তার আপু চেয়ারে বসেছে তাই এবার তার চেয়ার লাগবে। বাচ্চার জেদ শুরু হল সে চেয়ারে বসবেই। কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। বুঝলাম এত লোকের গ্যাঞ্জামে ও অস্থির হয়ে গেছে। দুটো চেয়ার একত্রিত করে দুজনের মাঝে ছেলেকে বসিয়ে খেতে বসলাম। এবার প্লেট সমস্যা। টেবিলে একটা প্লেট বেশী দরকার। সেই প্লেট আর আসে না এবং শেষ পর্যন্ত আসেওনি। বাচ্চার প্লেট থেকেই আমি খাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে যেই এক লোকমা মুখে তুলেছি সাথে সাথে ছেলে বলল -- মা আমি হিসু করবো। কি বিপদ?? এর চেয়ে বড় বিপদে মনে হয় আমি আমার জীবনে পড়ি নাই।!!
বললাম-- বাবা একটু পরে যাব। এখন খাও। এই দেখ মুরগির রান। খাও।
ও বলে --আমি হিসু করবো। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক অসহায়ের মত তাকালাম। এখান থেকে উঠলে আর জায়গা পাব না আর এই ভিড়ে কোথায় খুঁজবো টয়লেট আর কোথায় নিয়ে যাব ওকে হিসু করাতে? ছেলে কাঁদ কাঁদ হয়ে বলছে --আমি হিসু করব।!!
মুসকিল আসান এর মত এই সময় এসে হাজির হলো ছেলের মা ও বড় বোন। ছেলের বোনকে বললাম --উদ্ধার কর মা শেলী। শেলী আমার ছেলেকে নিয়ে কাকে যেন দিয়ে আসল। আমি আরাম করে খেলাম। খাওয়া শেষ হয়ে গেল ছেলে তো ফেরে না।
---শেলী আমার ছেলেকে যার কোলে দিয়েছ তাকে ফোন কর। ছেলেকে নিয়ে আসুক।
শেলী বলল --আমি তো তার ফোন নাম্বার জানি না।
মানে???? কি বলে শেলী ?? এই শেলী তুমি যার কোলে ছেলেকে দিয়েছ তাকে চেনো তো? শেলী বলে-- মুখ চিনি নামটা ঠিক মনে নেই। তবে আমাদের আত্মিয়। আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। আমার এখন চিৎকার করে কাঁদা শুধু বাকি। জানু উঠে গেল ছেলেকে খুঁজতে। এই সময় ছেলে আমার সহাস্য বদনে ফিরে এল। যাক, অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে তাকে বিদায় করলাম।
ছেলেকে খেতে বসালাম। ছেলে একটা টিকিয়া আর মুরগির রোস্টটা খেল। আর খেল এক প্লেট জর্দা। যাক ছেলের আমার খাওয়া হয়ে গেছে । নিশ্চিন্ত মনে ওখানে যে দুই একজনের সাথে দেখা হল তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে এলাম। বর বউ আর দেখা হলো না ।
শুতে শুতে রাত বারটা বেজে গেল। বিছানায় শুয়ে বুকের উপর ছেলেকে নিয়ে ঘুম পারাচ্ছি। পাশে মেয়েটা কি সুন্দর ঘুমিয়ে পরেছে। হঠাৎ ছেলে আমার বুকের উপর উঠে বসে বলল --মা আমিতো আজ ভাত খাইনি।
--আব্বু আজ ভাত খেতে হবে না । তোমার পেটতো ভরে গেছে। আমরা যে বিয়ে বাড়ি থেকে খেয়ে এলাম।।
--না আমি ভাত খাইনি তো। বাবাকে বলি, আমি ভাত খাইনিতো।
ছেলে বিছানা ছেড়ে ওর বাবার কাছে চলে গেল।
--বাবা আমি ভাত খাইনি তো।
---তুমি ভাত খাবে ??
---হ্যাঁ খাব।
জানু ফ্রিজ খুলে খুঁজে দেখল ভাত নেই। আমরা দু জনে মিলে যত বোঝাই ছেলে ততই বলে আমি শুধু ভাত খাব। বিস্কিট , কলা, ডিম,পাউরুটি, মাছ, দুধ খাও ?? না আমি ভাত খাব??? আমি ভাত খাব? আমি রাতে ভাত খাইনি তো আমি ভাত খাব!!
ভাব দেখে মনে হচ্ছে উনি কত খান ?? খাওয়া নিয়ে তার কোন ঝামেলা নেই?? মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। ওর বাবা না থাকলে দিতাম দুইটা মার লাগায়, মার খেলে ঠিকই শুয়ে ঘুমাতো?? কি আর করা আবার ভাত রান্না করা হল। আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম ও কোন ঝামেলা না করেই এক প্লেট ভাত মাছ দিয়ে খেয়ে ফেলল। আর কত গল্প তার। একসময় জিজ্ঞাসাও করলো --মা বিয়ে বাড়িতে বর বউ কোথায়? তুমি যে বলেছ বিয়ে বাড়িতে বর বউ থাকে। আর বিয়ে তো দেখলাম না।?? মজাতো নাই খালি লোক আর লোক।
ছেলের কথার আর কি উত্তর দেব??? এত মানুষ কিন্ত তাদের জায়গাদেবার মত স্থান নেই!!??
ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী??!!
বিয়ে বাড়িতে স্বপরিবারে যেয়ে খাবার সাধ আমার ষোল আনা উসুল হল।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:১৯