সিঙ্গাপুর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছোট্ট একটি দ্বীপ। আয়তন মাত্র ৭১৬ বর্গ কিলোমিটার। এটাকে কোন রাষ্ট্র না বলে নগরই বলা চলে। তবুও এই দ্বীপটিই আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। অথচ আজ থেকে মাত্র ৫০ বছর পেছনে তাকালে দেখা যাবে ভিন্ন এক দৃশ্য। কী ছিল সিঙ্গাপুর? ১৯৫৯ সালের সেই নগর রাষ্ট্রটিকে অপরাধ ও দরিদ্রে জর্জরিত একটা বাণিজ্যকেন্দ্র বলা যায়।
আরো জানতে...
খুবই ছোট এই নগর রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা উল্লেখ করার মতো। প্রকৃত অর্থে কিছুই ছিল না তাদের। তখন তাদের পেশা-নেশা, বেঁচে থাকা সব কিছুর সঙ্গেই জড়িত ছিল ফিশিং। আর সেটি পরিচিত ছিল মাছ ধরার একটা কেন্দ্র হিসেবেই।
সিঙ্গাপুরের সেই ফিশিংম্যানরাই মাত্র ৫০ বছরে নিজেদেরকে নিয়ে গেছেন আধুনিকতার চরম শিখরে। হয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন, গণতান্ত্রিক ও বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ মাথপিছু আয়ের দেশে। সেই সাথে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্রের খ্যাতিতো রয়েছেই।
ফিরে দেখা সিঙ্গাপুর: ১৯৬৫ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে সিঙ্গাপুর স্বাধীনতা লাভ করে। লি কুয়ানকে বলা হয়ে থাকে আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক। তার নেতৃত্বেই স্বাধীনতা লাভ করে দেশটি। শুরুর দিকে সিঙ্গাপুরও ছিল তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ। সে সময়কার সিঙ্গাপুরের চেহারা ছিল আজকের বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। ভাঙ্গাচোরা রাস্তা ঘাট, নিয়ন্ত্রনহীন যানবাহন, রুগ্ন, দরিদ্র মানুষে ভর্তি রাস্তা-ঘাট। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দ্বীপনগরে সংখ্যাগরিষ্ঠ চীনাদের সঙ্গে সংখ্যালঘু মালয় ও ভারতীয়দের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভেদ ছিল চরমে। অপরাধ আর খুন-খারাবির কোনো বালাই ছিল না। একক সিঙ্গাপুরীয় পরিচয়ের চিন্তাও তখনো ছিল না। দুর্নীতি, অশিক্ষা আর ঘিঞ্জি ছিল চারপাশ। কিন্তু সেদিন পাল্টে গেছে।
একজন লি কুয়ান: মাত্র ৫০ বছরের পথপরিক্রমায় সিঙ্গাপুর পরিণত হয়েছে এশিয়ার সবচেয়ে বাসযোগ্য ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ। আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন একজন মানুষ। দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি থেকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ মাথপিছু আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে ৫৫ লাখ মানুষের দেশ সিঙ্গাপুর। এ কারণে তাকে বলা হয় আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক।
১৯৬৫ সালে প্রতিবেশি মালয়েশিয়া থেকে আলাদা হওয়ার পর থেকেই মূলত এ দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে একটু একটু করে নিজ হাতে প্রতিষ্ঠা করেন লি কুয়ান। ৯ আগস্ট ১৯৬৫, লি কুয়ান ইউ জনগণের পক্ষ থেকে রিপাবলিক অব সিঙ্গাপুরের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার সময়েই ঘোষণা করা হয় সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রের মূল নীতি হবে— স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, জনকল্যাণ, সমৃদ্ধি ও সাম্য।’
সদ্য স্বাধীন দেশের ক্ষমতায় গিয়ে লি কুয়ান সবচেয়ে প্রথমে বাছাই করেছেন কিছু মেধাবি মানুষ, প্রনয়ন করেছেন দীর্ঘমেয়াদী কিছু পরিকল্পনা। প্রাথমিক দিকের এই মানুষগুলোর নিরলস পরিশ্রমে দেশটি ধীরে ধীরে তৃতীয় বিশ্বের কাতার হতে পৌছায় প্রথম বিশ্বে। লি কুয়ান মানুষের যে গুনটাকে সবচেয়ে প্রাধান্য দেন তা হচ্ছে ''সততা''। শিক্ষা দীক্ষা , মেধার, ওপরেও স্থান হচ্ছে সততার। সিঙ্গাপুরের প্রতিটা মানুষের মাঝে তিনি এই সততার ভিতটা গভীরভাবে গেথে দিয়েছেন। আসলে দেশের জন্য সকল শিক্ষা ও মেধাই ব্যর্থ যদি মানুষ অসৎ হয়। অপরাধ দমনে সেখানে রয়েছে কঠোর আইন শৃংখলা। নিñিদ্র নিরাপত্তার চাদরে দেশকে ঢেকে রাখতে ২৪ ঘন্টাই সাদা পোষাকে ঘুরে বেড়ায় পুলিশ।
সিঙ্গপুরে সবচেয়ে যে জিনিষটা মুগ্ধ করে তা হচ্ছে নারীদের নিরাপদ অবাধ চলাচল। মধ্যরাতেও একজন নারী ফাকা রাস্তায় পুরোপুরি নিরাপদ। কিছু মজার কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর আইনও এখানে সেখানে। কোন নারীর দিকে যদি কোন পুরুষ অশোভন দৃষ্টিতে তাকায়, তবে সেই নারী পুলিশে রিপোর্ট করতে পারে। পুলিশ নিয়ে এমন করকানি দেয় যাতে সেই পুরুষ আর দ্বিতীয়বার কোন নারীর দিকে তাকাতেও ভয় পায়। আরেকেটি মজাদার আইন হচ্ছে লিটারিং বা ময়লা ফেলা বিষয়ক আইন। যেখানে সেখানে থুথু ফেলা, বা ময়লা ফেলা এখানে একটি অপরাধ। কাজেই লিটারিং করলে শাস্তি হচ্ছে একদিন একটি দ্র্ঘী পরিবেশ সচেতনতা বিষয়ক বোরিং সেমিনারে অংশ নিতে হবে ও তারপর পুরো একটি দিন একটি নির্দিষ্ট এলাকার ঝাড়ুদারের দ্বায়িত্ব নিতে হবে।
নাগরিক সুযোগ সুবিধার কথা বলতে গেলে বলতে হবে ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ পানি, উন্নত ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা ব্যবস্থা যা কিনা স্কুল ও কলেজ লেভেল পর্যন্ত ফ্রি, সাবসিডাইসড উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, সবার জন্য আবাসন সুব্যবস্থা, উন্নত জব মার্কেট ইত্যাদি।
সিঙ্গাপুরের রাজনীতি: সিঙ্গাপুরের রাজনীতি একটি সংসদীয় প্রজাতন্ত্রের কাঠামোয় সংঘঠিত হয়। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকারের প্রধান। দেশটিতে মূলত একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাব বেশি। দেশের নির্বাহী ক্ষমতা সরকারের হাতে ন্যস্ত। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সরকার ও আইনসভার দায়িতে। আইনসভার সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান হলেও তার ভূমিকা মূলত আলংকারিক। তবে ইদানিং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার পরিসর কিছু বাড়ানো হয়েছে।
১৯৫৯ সালের নির্বাচন থেকে সিঙ্গাপুরের রাজনীতিকে পিপল্স অ্যাকশন পার্টি নামের রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। একাধিক বিরোধী দল উপস্থিত থাকলেও ক্ষমতায় তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। তাই অনেক বিদেশী পর্যবেক্ষক সিঙ্গাপুরকে কার্যত একটি এক-দলীয় শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করে থাকেন। তবে সিঙ্গাপুরের সরকার সবসময়ই একটি স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত সরকার হিসেবে বহির্বিশ্বে পরিচিত। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে সিঙ্গাপুর বহুদিন ধরেই এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিমুক্ত দেশ।
(তথ্য কৃতজ্ঞতা: নাগরিক ব্লগ, উইকিপিডিয়া ও সংবাদ পত্র)- আকতারের ক্যানভাস
একজন লি কুয়ান যেভাবে বদলে দিলো দারিদ্রে জর্জরিত সিঙ্গাপুরকে
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
মা
মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।
অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।
একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প
তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে
ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।
সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন