শীত মানেই হিমহিম কনকনে ঠাণ্ডার অনুভূতি। ইউরোপ-আমেরিকা বা অন্যান্য শীতপ্রধান দেশগুলোতে শীতকালে বরফ পড়ে। তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের অনেক নিচে; জীবনযাত্রা হয়ে পড়ে স্থবির— অনেক মানুষ মারাও যায়। জানা যায়, শুধু ইউরোপ-আমেরিকা বা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেই নয়, আমাদের এই এশিয়ার অনেক দেশেই চলে হাড়-কাঁপানো শীতের দাপট। ১৯৬৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি চীনের মোহে কাউন্টিতে সে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি শীত পড়ে। তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের নিচে ৫২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (—৫২.৩ ডিগ্রি)।
জাপানের হোক্কাইডোর আশহিকাওয়ায় ১৯০২ সালের ২৫ জানুয়ারি সে দেশের এ যাবতকালের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়— হিমাঙ্কের নিচে ৪১ (—৪১) ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৯৯ সালের ১৫ মে নেপালের হিমালয়-সংলগ্ন সাগরমাথা অঞ্চলে (Sagarmatha Zone) সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় হিমাঙ্কের নিচে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ইরানের সাক্কেজে ১৯৬৯ সালের শীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ যাবতকালের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড হলো আলাস্কার প্রোসপেক্ট ক্রিকে—১৯৭১ সালের ২৩ জানুয়ারি, হিমাঙ্কের নিচে ৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কানাডার ইয়োকোনে দেশটির এ যাবতকালের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো ১৯৪৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি—হিমাঙ্কের নিচে ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেই তুলনায় আমাদের শীতকাল অনেকটা সহনীয়। শীতকালে এখানে বরফ পড়ে না। ভয়াবহ তুষার-ঝড় প্রকৃতিকে লণ্ডভণ্ড করে দেয় না। তাপমাত্রাও হিমাঙ্কের ওপরেই থাকে; তবে কোনো কোনো বছর উত্তরাঞ্চলসহ দেশের কোনো কোনো এলাকায় তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার রেকর্ডও আছে— হিমাঙ্ক ছুঁই-ছুঁই অবস্থা প্রায়। ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলে তাপমাত্রা নেমে যায় ২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা আমাদের দেশে এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশি শীতের রেকর্ড। শীতকালে, বিশেষ করে মাঘের কনকনে শীতে আমাদের দেশের অনেক গরিব মানুষ কষ্ট পায়। এমনকি শীতের প্রকোপে কোনো কোনো বছর দু-একজন মানুষ মারা যাওয়ার খবরও পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে ছয়টি ঋতু। এর মধ্যে পৌষ ও মাঘ মাস হলো শীত ঋতু। কথায় বলে—'মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে'। শুধু বাঘ নয়, পৌষ-মাঘে যখন কনকনে শীত পড়ে তখন অনেক মানুষও কাঁপে শীতে— বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের গরিব মানুষেরা। কিন্তু শীত শুধু হাড়ই কাঁপায় না; নানান বৈচিত্র্য আর মজাদার উপহারের ডালি নিয়েও আসে আমাদের জন্য। শহরে লাখ লাখ মানুষের বসতি। অগণিত বিজলী বাতি। অনেক দোকানপাট আর কলকারখানা। তাই গ্রামের তুলনায় আমাদের দেশে শহরাঞ্চলে শীতের তীব্রতা কম। শীতের আসল চেহারা আর রূপ পুরোপুরি দেখতে পাওয়া যায় গ্রামে। পৌষ-মাঘ এই দুই মাস শীতকাল হলেও অগ্রহায়ণ মাস থেকেই শুরু হয়ে যায় শীতের আনাগোনা। তবে হাড়কাঁপানো শীত বলতে যা বোঝায় তার দেখা পাওয়া যায় পৌষ-মাঘ মাসে। এমনকি ফাল্গুনের শেষাবধিও তার রেশ থেকে যায়, তবে দাপট অনেক কম।
শীতে বাংলাদেশের গ্রাম-প্রকৃতি সন্ধ্যার আগে থেকেই শিশির আর কুয়াশার চাদর মুড়ি দিতে শুরু করে। মানুষজন বেশ সকাল-সকালই ঘরে ফেরে। গবাদি-পশুরও আশ্রয় হয় গোয়ালে বা নির্দিষ্ট স্থানে। শীতের হিমশীতল গ্রাম-বাংলায় খুশি আর
আনন্দের আয়োজনও রয়েছে প্রচুর। চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন এলাকায় খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও গুড়-পাটালি তৈরি হয়। এ উপলড়্গে রীতিমতো উত্সব শুরু হয়ে যায় যেন। বিশেষ করে দেশের দড়্গিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশকিছু জেলায় খেজুর রস থেকে চমত্কার গুড় ও পাটালি তৈরি হয়। তবে সব এলাকায় অতি উন্নত মানের চমত্কার নান্দনিক পাটালি তৈরি হয় না। অনেক ধৈর্য, শ্রম আর যত্নসহকারে এই বিশেষ সুস্বাদু আর শৈল্পিক পাটালি তৈরি করেন পাটালির কারিগর তথা শিল্পীরা। শুধু গুড়-পাটালি-পিঠেপুলি-ড়্গির-পায়েস আর মোয়া নয়, হরেক রকম তরিতরকারি, শাকসবজি বাড়িতে বাড়িতে; ক্ষেতে-পালানে। শীতকালের এসব দৃশ্য দেখলে মনে হয়, শাক-সবজির এই অফুরন্ত্ম সম্ভারই যেন ঋতুর বিশেষ উপহার; এ সৌন্দর্য আর ঐশ্বর্যের মহিমা যেন অন্য ঋতুতে তেমন মানানসই হতো না। লাউ-কুমড়ো-ফুলকপি-বাঁধাকপি, মূলো, পালংশাক, শালগম, বেগুন, টমেটো, মেটে-আলু, পেঁয়াজের কলি এসব তরকারি রাশি রাশি। কী তরতাজা আর কী স্বাদ সেগুলোর!
বিল-বাওড় আর নদী-খালের মিঠেপানির হরেক রকমের মাছ আমাদের শীতকালের আরেকটি উপহার। শুধু গ্রামে নয়, শহর-গঞ্জের বিভিন্ন বাজারেও শীতের নদী-খাল, বিল-বাওড় থেকে ধরা টাটকা ও 'লাফানো-মাছ' দেখা যায়, কিনতে পারা যায়। বড় বড় শৈল-বোয়াল-গজার-টাকি, শিং-মাগুর-কৈ-মেনি, খয়রা-পুটি-সরপুটি-বাইন-পাবদা-ট্যাংরা ইত্যাদি মাছের স্বাদ যেন শীতকালে অনেক বেড়ে যায়। বিশেষ করে, গ্রামের গেরস্থ বাড়িতে রাতে রান্না করে-রাখা বড় বড় তারাবাইন, শৈল, কই, পাবদা কিংবা সরপুটি-মেনি সকাল বেলায় ঠা্লা কড়কড়ে ভাত দিয়ে খাওয়ার যে কী মজা তা যে খেয়েছে সে ছাড়া অন্য কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।
অগ্রহায়ণ মাসে সীমিত আকারে আমন ধান কাটা শুরু হলেও পৌষের শুরুতে ধান কাটা পুরোদমে শুরু হয়ে যায় গাঁয়ের মাঠে মাঠে। মাঠভরা থোকা থোকা আমন ধানের সারি সারি গাছগুলো হাওয়ায় দোলে। মাথাভরা যেন ছোট ছোট সোনার টুকরো— সোনার ধান। চাষীদের স্বপ্নের প্রতীক। খুশি আর আনন্দের বার্তাবহ। সোনালি ধানের সোনালি আভা লক্ষ লক্ষ চাষীর মুখে হাসি ছড়ায়। বুকে আশা জাগায়। তাইতো মাঠজুড়ে ধান কাটার ব্যস্ততা— যেন আগামী দিনের নতুন স্বপ্নপূরণের মহোত্সব। সেই ধানে ভরে ওঠে কৃষকের গোলা, আউড়ি, ডোল। চাল তৈরির কল এখন গ্রামে পৌঁছে যাওয়ায় ঘরে ঘরে ঢেঁকিতে আর আগের মতো ধান ভানার দৃশ্য দেখা যায় না। তার পরও শীতকালে এখনও গ্রামবাংলার গেরস্থ বাড়িতে ঢেঁকিতে চিঁড়ে কোটার ধুম লাগে। বানানো হয় চাউলের গুঁড়ি— পিঠেপুলির জন্য। ঢেঁকির একটানা ঢুকুর ঢুকুর শব্দ শুনতে বেশ লাগে। উঠোনের কোনায় বড় চুলোয় নতুন চালের মুড়ি ভাজার ব্যস্ততাও চোখে পড়বে। সকালের মিষ্টি রোদে বসে খেজুরের রসে ভেজানো মুড়ি, গুড়-মাখানো মুড়ির মোয়া কিংবা নোলেন পাটালি দিয়ে মচমচে মুড়ি খাওয়ার কথা মনে হলেই জিবে পানি এসে যায়।
সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আলো-আঁধার এসব নিয়েই আমাদের জীবন। আমাদের এগিয়ে চলা। তাই শীত যেমন কষ্টের তেমনি অনেককিছু পাওয়ারও ঋতু। আমরা যদি গরিবদের প্রতি সাহায্য ও মমতার হাত বাড়িয়ে দিই, তাহলে তারাও শীতের কষ্ট কাটিয়ে উঠতে পারবে। আমরা সবাই তখন শীতের আনন্দ-উপহারগুলো ভাগ করে নিতে পারব।