somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

  প্রাইভেট কোচিংএর মহামারী রূপ ও শিক্ষাব্যবস্থায় ধ্বস

৩১ শে মে, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




প্রাইভেট কোচিংএর মহামারী রূপ ও শিক্ষাব্যবস্থায় ধ্বস

বাংলাদেশের ১৯৬০ সালের চাকরীবিধি অনুযায়ী স্কুল শিক্ষক, ১৯৭৯ সালের চাকরীবিধি অনুযায়ী উচ্চমাধ্যমিক কলেজশিক্ষক, ১৯৯৪ সালের চাকরীবিধি অনুযায়ী ডিগ্রী অনার্স কলেজের শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়াতে পারবেননা। অন্য চাকরীও করতে পারবেন না। কিন্তু এসব বিধির বাস্তবায়ন নেই। শিক্ষকরাও তা মানছেন না। ফলে শিক্ষকদের অনৈতিক কোচিং ব্যবসা বাংলাদেশের মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিকলাঙ্গ করে দিচ্ছে দিন দিন।

বর্তমানে বাংলাদেশে মূলতঃ শিক্ষকদের সীমাহীন লোভের কারণে কোচিং ব্যবসার লাগামহীন প্রসার ঘটেছে গোটা দেশে। শহর তো বটেই, গ্রামের স্কুলগুলোতেও প্রাইভেট ব্যবসা জমজমাট। শিক্ষকরূপী এসব কোচিং ব্যবসায়ীর হাতে জিম্মি সব শ্রেণী-পেশার শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা।

আগে কোন ছাত্র প্রাইভেট না পড়লে শিক্ষকরা তাকে বাধ্য করত না। এখন শিক্ষকরা প্রাইভেটে ছাত্র আনার জন্য নম্বর কম দেয়া, শিক্ষার্থীদের মারা, ইচ্ছে করে কঠিণ প্রশ্ন করা, যারা পড়ে তাদেরকে পরীক্ষার আগে প্রশ্ন আউট করে দেয়া, তাদেরকে নম্বর বেশী দেয়া, যারা পড়েনা, তাদেরকে কম নম্বর দেয়া, অভিভাবকদেরকে নানাভাবে চাপ দেয়া, ইত্যাদি নানা কূটকৌশল অবলম্বন করেন।

কোচিং বাণিজ্য ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়ায় এসব লোভী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিভাবক ঐক্য ফোরাম আদালতে ২০১১ সালের শেষের দিকে একটি রিট করেন। এর ফলশ্রুতিতে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে ২০১২ সালে "শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ নাতিমালা ২০১২" প্রনয়ণ করেছে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এই নীতিমালা অনুসারে কোন শিক্ষক তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেননা। প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য স্কুলের একসাথে সর্বোচ্চ দশ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। অভিভাবকদের অনুরোধে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলের ভিতরেই অল্প ফিতে প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতিক্রমে অতিরিক্ত ক্লাস করানো যাবে।

এই নীতিমালা না মানলে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বলা আছে। যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিও স্থগিত বা বাতিল, সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে সাময়িক বা স্থায়ী বরখাস্ত, পেশাগত অসদাচরণের কারণে শৃঙ্খলা আপীল বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া,
বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি ও পাঠদান অনুমতি বাতিল
ইত্যাদি।

কিন্তু এসব আইন বা নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকরা ক্লাসে দায়সারাভাবে পড়িয়ে ছুটছেন প্রাইভেট পড়াতে। কখনও নিজ বাসায় বা বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে। শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে বসিয়ে ব্যাচের পর ব্যাচ পড়াচ্ছেন। এমন কি, স্কুলের বা কলেজের ক্লাসে ঠিকমত না পড়িয়ে স্কুল ছুটির পর কোচিং ক্লাসে বেশী টাকা নিয়ে ঠিকই যত্ন করে পড়াচ্ছেন ঐ স্কুলেই বা কলেজেই। শিক্ষার্থীরাও ক্লাসে হাজিরা দিয়েই ছুটতে বাধ্য হচ্ছে এসব শিক্ষকদের কাছে। প্রচুর ভাল নামকরা শিক্ষক আছেন যারা ক্লাসে ভাল না পড়ালেও কোচিং এ খুবই ভাল পড়ান। শিক্ষকরা ক্লাসে ঠিকমত পড়িয়ে দিলেই শিক্ষার্থীদের কোচিং এর পিছনে ছুটতে হতনা। অভিভাবকদেরও অর্থ, সময় ও শ্রমের অপচয়ও হতনা।

কেন অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের প্রাইভেটে পড়তে দেন বা শিক্ষার্থীরা পড়ে :

১। পিএসসি-জেএসসি পরীক্ষা প্রবর্তন : পিএসসি-জেএসসি - এ দুটো পাবলিক পরীক্ষা প্রবর্তনের ফলে এদুটো পরীক্ষার ফলাফলের গুরুত্ব শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে বেড়ে যাওয়ার কারণে ভাল ফলের আশায় বাধ্য হয়ে অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়াচ্ছেন।

২। ক্লাসে শিক্ষকদের ঠিকমত না পড়ানো : এখন ক্লাসের পড়ায় ছেলেমেয়েরা ভাল করতে পারছেনা। কারণ শিক্ষকরা ইচ্ছে করে ক্লাসে ঠিকমত পড়ান না। পড়ালে ছাত্ররা তাদের কাছে প্রাইভেট পড়বেনা। ঠিকমত না পড়ানোর কারণে শিক্ষার্থীরা পড়া বোঝেনা, রেজাল্ট খারাপ করে। তাই তারা বাধ্য হয়ে প্রাইভেট পড়ে।

৩। সৃজনশীল পদ্ধতি চালু : সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়ার কারণে অভিভাবকরা এ পদ্ধতি বোঝেন না। তাই নিজে আর ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারেন না। এই না পারার কারণে অনিচ্ছাসত্ত্বে, বাধ্য হয়ে প্রাইভেট পড়ান।

৪। ভর্তি পরীক্ষা : বাংলাদেশের সব ভাল স্কুলগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা না দিয়ে কোন শিশু ভর্তি হতে পারেনা। অর্থাৎ স্কুলে আসার আগেই শিশুকে অনেক কিছু শিখে আসতে হয় যা তার স্কুলে আসার পরে শেখার কথা। প্রাইভেট পড়ানো শুরু হয় মূলতঃ ভাল স্কুলগুলোতে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করানোর জন্য। কারণ ওসব স্কুলের রেজাল্ট ভাল। তাই ধরেই নেয়া যায় ভর্তি করাতে পারলে ভাল ফল সুনিশ্চিত। তাই ভাল স্কুলে যাতে ভর্তি পরীক্ষায় ভাল করতে পারে, সেজন্য প্রাইভেট পড়ান অভিভাবকরা।

ভাল নম্বর না পোলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগই দেয়া হয়না। এখন তো আবার ভাল নম্বর পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে একবারের বেশী ভর্তি পরীক্ষা দিতে দেয়া হয়না। আগে দ্বিতীয় বিভাগ পাওয়া ছাত্রও বুয়েটে চান্স পেয়েছে যেটা এখন অসম্ভব। তাই যেকোন মূল্যে ভাল নম্বর পাওয়াটা অনিবার্য। আর ভাল ফল বা নম্বরের জন্য প্রাইভেট না পড়ে উপায় নেই।

৬। প্রশ্ন আউট বা ভাল ফলের নিশ্চয়তা: এখন ভাল ফলাফল নির্ধারণ করে টাকা। অর্থাৎ টাকা খরচ করে স্কুলের শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়ালে শিক্ষকরা পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন বলে দেন, বেশী নম্বর দেন। ফলে রেজাল্ট ভাল হয়। প্রাইভেট না পড়লে ভাল নম্বর পাওয়া যায়না। রেজাল্টও ভাল হয় না।

অভিভাকরা কোচিং এ বাচ্চাদের দিচ্ছেন। কারণ তাঁরা তার সুফল পাচ্ছেন। উদাহরণ দেই। আমি ক্লাস ওয়ানে আমার মেয়েকে নামতা পড়িয়েছি। কিন্তু পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে গুণ আকারে। যেমন ৩ এর ঘরের নামতা লিখ - এর পরিবর্তে তিন গুণ চার সমান কত?- এভাবে প্রশ্ন এসেছে। যারা কোচিং করেছে, তাদেরকে এভাবেই শেখানো হয়েছে। ফলে তারা পারবে। যেসব বাচ্চা কোচিং করেনি তারা প্রশ্ন না বোঝার কারণে পারবোনা বা ভুল করতে পারে। ফলে রেজাল্ট খারাপ হবে। আবার ইংরেজি প্রশ্নের উত্তর ওয়ানের বাচ্চার বানিয়ে লিখতে পারার কথা না। তাই কোচিং এ যেসব প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করানো হয়, শিক্ষকরা সেগুলোই পরীক্ষায় দেন। ফলে কোচিং করা শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন কমন পায়, রেজাল্ট ভাল হয়। আবার বিভিন্ন ভাল স্কুলগুলোর শিক্ষকরা ভর্তি পরীক্ষার কোচিংকরান আবার ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নও করেন। তাই প্রশ্ন আগেই বলে দেন। ছাত্ররা প্রশ্ন কমন পায়, ভর্তির সুযোগও পায়। ফলে ওসব শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়ার হিড়িক পড়ে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ( কখনো কখনো স্বামী ও স্ত্রী দু'জন ) তাঁর ক্লাস ওয়ান বা টু এর শিশুকে পড়াতে পারবেন না, এটা হতে পারেনা। কিন্তু বাস্তবতা হল, মেধাবী, শিক্ষিত, পেশাজীবী অভিভাবকরা, এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও তাঁদের স্কুলপড়ুয়া সন্তানদের নিয়ে ধর্ণা দিচ্ছেন স্কুলের শিক্ষক বা কোচিং সেন্টারে উপরোক্ত সুবিধা পাবার জন্য। সময়, শ্রম ও মেধার কি নিদারুণ অপচয়!

ক্লাস সিক্স পর্যন্ত আমার মেয়ের কোন গৃহশিক্ষক ছিলনা। সব বিষয় আমি নিজে পড়াতাম। কোন কোচিংএ ও দেইনি, কারণ আমি চেয়েছি আমার মেয়ে ক্লাসে প্রথম না হোক, তবে ওর বেইজ যেন দূর্বল না হয়। তাতে মেয়ে পিএসসি পরীক্ষায় ভাল কারলেও স্কুলের পরীক্ষায় তার রোল এক থেকে দশের মধ্যে ছিলনা, যদিও আমি জানি সে খারাপ ছাত্রী নয়।

আমাদের সময় সৃজনশীল ছিলনা। তবু কিছু কম শিখেছি বলে মনে হয়না। আমাদের সময়ও সায়েন্সের ছেলেমেয়েরা প্রাইভেট পড়ত। অল্প কিছু বিষয়ে। আমি নিজেও স্কুলে কখনও কোন বিষয়ে প্রাইভেট পড়িনি। কলেজে পরিসংখ্যান প্রাইভেট পড়েছি বিশ দিন। শুধু যেগুলো নিজে পারতামনা, সেগুলো।(স্কুলে থাকতে আব্বা পড়াতেন অংক আর ইংরেজী, তাও শুধু যেগুলো নিজে নিজে পারতামনা, সেগুলো। তাতে আমার রেজাল্ট খারাপ হয়নি। আমি এসএসসি- তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল থেকে রাজশাহী বোর্ডে মানবিক বিভাগ থেকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম ও সম্মিলিত মেধা তালিকায় অষ্টম স্থান এবং এইচএসসি - তে রাজশাহী কলেজ থেকে রাজশাহী বোর্ডের মানবিক বিভাগ থেকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম ও সম্মিলিত মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান অধিকার করি।আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে মনোবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছি)।

আর এখনকার পড়ালেখার ধবণ এমন হয়েছে যে, শিক্ষার্থীদের প্রতিটা বিষয়ের প্রতিটা চ্যাপ্টারের প্রতিটা প্যারা টিউটরের কাছে শিখে নিতে হয় সৃজনশীল পদ্ধতি না বোঝার কারণে বা যেকোন প্যারা থেকে প্রশ্ন হবার সম্ভাবনা আছে বলে। একারণে এখনকার বাচ্চারা সব বিষয়ে প্রাইভেট পড়ে। ধর্ম, সমাজ, এমন কি মাতৃভাষা বাংলাও। ক্লাসের প্রথম যে ছাত্র, সে সবচেয়ে বেশী প্রাইভেট পড়ে। অর্থাৎ রেজাল্টের কৃতিত্ব এখন ছাত্রের নয়, প্রাইভেটের। যেসব অভিভাবকের সাধ্য আছে, তাঁরা প্রাইভেট পড়াচ্ছেন। আর যাঁদের নেই, তাঁরা যে কি কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার বাড়তি খরচ জোগাড় করছেন, তা তাঁরাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।

৭। অভিভাবকদের ধারণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা : প্রাইভেট ছাড়া ভাল ফল করা যায়না, এ ধারণা এখন বদ্ধমূল, বাস্তবতাও তাই। অভিভাবকরা জানেন, শিক্ষকরা ক্লাসে ভাল করে পড়াবেননা, প্রাইভেট না পড়লে শিক্ষার্থীরা ভাল বুঝবেনা, শিক্ষকরা ভাল নম্বরও দেনেননা। তাই এটা মেনে নিয়েই অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের প্রাইভেটে পড়তে দেন।

৮। অভিভাবকদের সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞতা : আগে অভিভাবকরা নিজেরাই নিজেদের সন্তানদের পড়াতেন।সৃজনশীল পদ্ধতি না বোঝার কারণে এখন অভিভাবকরা আর সেটা পারেন না। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা শিক্ষকদের দ্বারস্থ হচ্ছেন।

৯। তীব্র প্রতিযোগিতা : এখন প্রতিযোগীতায় টিকতে হলে ভাল ফল করতেই হবে। যারজন্য প্রাইভেট না পড়ে উপায় নেই। তাই ভাল স্কুলে, ভাল কোচিং এ ভাল টিচারের কাছে পড়ানোটা জরুরী। অনেকের কাছে এটা মানসিক তৃপ্তি ও ভরসার কারণও। তাছাড়া বিত্তবানরা পড়ানোর জন্য টাকা খরচ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। তাই শিক্ষকরাও লোভী হয় বাড়তি আয়ের জন্য। একারণে তুলনামুলকভাবে অস্বচ্ছল অভিভাবকরাও বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষকদের এ লোভের খোরাক জোগাতে।

১০। অভিভাবকদের ব্যস্ততা : এখন বাবামা ব্যস্ততার কারণে সন্তানদের পড়াশোনার পিছনে সময় দিতে পারেননা। এখন প্রশ্নের ধরণ এমন যে, গাইড বই না পড়লে পড়ানো যায়না। অভিভাবকদের অত মোটা মোটা গাইড বই পড়ে সন্তানদের পড়ানোর বিড়ম্বনার চেয়ে কোচিং এ দেয়া বেশী সহজ। তাছাড়া প্রাইভেট না পড়লে ফল খারাপ করবে, অভিভাবকরা এ ঝুঁকি নিতে চাননা।

১১। শিক্ষকদের জবাবদিহিতার অভাব : আমাদের দেশে ছাত্র-ছাত্রী ফেল করলে বা খারাপ করলে শিক্ষকদের কোন জবাবদিহিতা নেই বা শাস্তি ও হয়না। ফলে শিক্ষকরা স্কুলে কম, কোচিং বা প্রাইভেটে বেশী পড়ান। ইচ্ছে করে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ভাল করে পড়ান না বা ফল খারাপ করান যাতে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়তে আসে বা অভিভাবকরা পড়তে পাঠান। ইত্যাদি।

আমাদের শিরক্ষাব্যবস্থার দূরবস্থার কারণ

উন্নত দেশগুলোতে, যেমন ফিনল্যান্ড, এখন পরিবেশ থেকে কোন একটি ঘটনা তুলে এনে সেটার সাথে সম্পৃক্ত সবগুলো বিষয় শেখানো হয়। নানা বিষয় আলাদা আলাদা ভাবে শেখানো হয়না। যেমন কোন একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগ, যেমন বন্যা পড়াতে গিয়ে এর কারণ ( বিজ্ঞান - বৈশ্বয়িক উষ্ণায়ন, ভূগোল- পরিবেশের পরিবর্তনে আবহাওয়ার ও ভৌগোলিক অবস্থানের ভূমিকা, সমাজ- এর সাথে মানুষের জীবনপ্রবাহের নানা সমস্যা, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞান - এর সাথে মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণীর রোগ, গবেষণা- প্রতিকারের উপায় উদ্ভাবন), ইত্যাদি সবকিছুকে সমন্বিতভাবে পড়ানো হয়। ফলে শিক্ষার্থীর শিক্ষা যেমন বাস্তবমুখী হয়, তেমনি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা নিজের, দেশের ও সমাজের কাজে লাগে।

এজন্য উন্নত দেশগুলোতে লেখাপড়ার ধরণ পাল্টে যাচ্ছে। তারা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের একটা কফি শপ দিয়ে বলে, আগামী এক বছর এই দোকানটিৈ চালানো তোমার পরীক্ষা। এই দোকান চালাতে গিয়ে তারা হাতেনাতে অংক শিখেছে, কফি বিক্রি করতে গিয়ে তারা মার্কেটিং শিখেছে, পুরো ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে তারা ম্যানেজমেন্ট শিখেছে, লাভ-লসে পড়ে অর্থনীতি শিখেছে।

যেসব ছেলেমেয়েরা মেকানিকাল কাজ জানে, তাদের দেয়া হয় গ্যারেজ বা কোন খুচরা যন্ত্রাংশের দোকান, কাউকে দেয়া হয় কাপড়ের বা সৌখিন জিনিসের দোকান, কাউকে দেয়া হয় কোন যন্ত্র বানানো বা কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর কাজ। যে যার দক্ষতা দিয়ে দোকান চালাবে বা কাজ করবে। প্রত্যেকের পারদর্শিতার ভিত্তিতে নম্বর দেয়া হবে। এতে তার একাডেমিক শিক্ষার সাথে সাথে তার ভবিষ্যত কর্মজীবনের দিকনির্দেশনা ও পাওয়া হয়ে যায়।

ভারতে একটি স্কুলে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি চ্যাপ্টার বাস্তব প্রয়োগ পদ্ধতিতে শিখতে গিয়ে স্কুলের ছেলেমেয়েরা সে গ্রামের কলেরা, টাইফয়েড, ডায়রিয়া নির্মূল করেছে। আসলে এটাই দরকার। কোন কিছু শেখার সাথে সাথে সেটা কোথায় কাজে লাগবে, সেটা শেখানো বেশী জরুরী।

দূর্বাগ্যজনকভাবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এসবের বালাই নেই।

শিশুদের যাতে স্কুল ও পড়াভীতি তৈরী না হয় সেজন্য প্রথম ছয় বছর খেলাধুলা, ছবি আঁকা, গল্প করা, নাচ, গান এসব করানো হয় উন্নত দেশগুলোতে। পরীক্ষাভীতি শিশুদের শেখার আগ্রহ নষ্ট করে। তাই ফিনল্যান্ডে স্কুলে যাবার পর প্রথম ছয় বছর কোন পরীক্ষা হয়না। ১০ বছর পর শিশুরা প্রথম বড় ধরণের কোন পরীক্ষা দেয়।

মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বিরতিহীন শেখার চেয়ে বিরতিসহ শেখালে শিক্ষার্থীরা ভাল শেখে। তাই জাপানে শেখার মাঝখানে বাধ্যতামূলক বিরতি, এমন কি, কোন কোন স্কুলে ঘুমানোর সুযোগও আছে। শিশুরা বাবা মার সঙ্গ ও ববাবামার সাথে দুপুরের খাবারের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য সেভাবে স্কুলের সময় স্থির করা হয় ফ্রান্স ও মেক্সিকোতে। শিক্ষার কোন স্তরে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে হয়না। বেলজিয়ামে দশ বছর পর্যন্ত কোন হোমওয়ার্ক দেয়া হয়না। পৃথিবীর সব উন্নত দেশে পড়ার চাপ কমাতে সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম চালানো হয় পড়ার সমান গুরুত্ব দিয়ে।

ভার্সিটিতে প্রথম বর্ষে পড়ুয়া এক ছাত্র মাসখানেক আগে আমার কাছে এসে বলল, "ম্যডাম, আমি খুব গরীব ঘরের ছেলে। মেসে থাকার সামর্থ নাই। তাই হলে এক বড় ভায়ের কাছে থাকি। সে নানাভাবে আমাকে তাচ্ছিল্য করে। রান্না করা, তার এঁটো প্লেট ধোয়া, ঘর ঝাড় দেয়া, তার সিগারেট কিনে আনা,... এসব আমাকে দিয়ে করায়। অনেক রাত পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। আমি পড়তে পারিনা।"

আমাদের ছেলেমেয়েরা হলে গাদাগাদি করে থেকে পড়ে, হলে সিট পায়না, সিনিয়রদের চাকর হয়, বিদ্যুৎ থাকেনা ঠিকমত, ডাইনিং এর বাসি, পচা, অখাদ্য খাবার খায়, মাঝে মাঝে শুনি তাদের নাকি শেয়াল কুকুরের মাংসও খাওয়ানো হয়, আছে সেশনজট, বই- কম্পিউটার কেনার টাকা নেই, ইত্যাদি হাজার কষ্ট। আর পাস করে চাকরী নেই, বেকারভাতাও নেই। মামার জোর, ঘুষ, রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর লোক,...এসব না থাকলে চাকরীও জোটেনা। মধ্যবিত্ত ও গরীব অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা নানাভাবে নিষ্পেষিত। আর লাভবান হয় লোভী শিক্ষকরা, কোচিং-গাইড বই ব্যবসায়ীরা।

অথচ আমাদের ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট মেধাবী, পরিশ্রমী। মেধাবী বলেই তারা বিদেশের নামী দামী কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টপ করে। কারণ ওখানে হাতে কলমে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে, দেশে যেটা পারেনা মুখস্থনির্ভর পড়ালেখার কারণে। আমাদের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত প্রবাসী শ্রমিকরা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেই আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে।

জেএসসি, পিএসসি, সৃজনশীল ইত্যাদি নানা নতুন নতুন পধতি চালু, এ প্লাসের ছড়াছড়ি, ভুল লিখলেও শিক্ষকদেরকে নম্বর বেশী দিয়ে এ প্লাস বাড়ানো বা শতভাগ পাস করানোর চাপ, বছরে ৩ টা পরীক্ষা দেয়া, ক্লাস টেস্ট দেয়া, প্রাইভেট পড়ার চাপ, ইত্যাদি নানা সমস্যা তো আছেই।

কেন শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানঃ

বলা হয়, শিক্ষকদের বেতন কম। তাই তাঁরা প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য হন। ক্যান্টনমেন্ট স্কুলগুলোর শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়াতে পারেন না। পড়ালেও নিজের স্কুলের শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারেন না। পড়ালে চাকরী চলে যায়। তাঁদের চলে কিভাবে? শিক্ষকরা চাকরীতে ঢোকার সময় বেতন কত হবে সেটা জেনেই আসেন। যদি মনে করেন, এ বেতনে চলবেনা, তাহলে আসেন কেন?

কোন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রাইভেট পড়ান না। যখন বেতন অনেক কম ছিল, তখনো কেউ পড়াননি। তাহলে তাঁদের চলত কিভাবে? নিশ্চয় কষ্ট করেই চলতেন।  তবু কোনদিন তাঁরা নিজের পেশাকে কলুষিত করেননি।
আমার বাবাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তাই আমি বিষয়টা খুব ভাল জানি।

কিন্তু বর্তমানে স্কুল, কলেজ, এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা টাকার পেছনে ছুটছেন। স্কুল কলেজের শিক্ষকরা প্রাইভেট কোচিংসহ নানা দূর্নীতিতে জড়াচ্ছেন।, নৈশ কোর্স, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলোতে পরীক্ষা নিতে গিয়ে ঘুষ নেয়া, নানা প্রজেক্টে বাড়তি আয়ের জন্য কাজ করা, কলেজের বিভিন্ন শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, ইত্যাদি  নানা অনিয়মের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নাম। কেন এমন হবে? আসলে বিষয়গুলো নিয়ে খুব সিরিয়াস আলোচনা দরকার।


এ নৈরাজ্য থেকে মুক্তি ও শিক্ষার মান বাড়ানোর উপায়ঃ

১। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা তুলে দিতে হবে। লটারীর মাধ্যমে আসনসংখ্যা অনুযায়ী ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করতে হবে।

২। ছাত্র-শিক্ষক  অনুপাত ঠিক রাখতে হবে। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

৩। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়াতে হবে। বিভিন্ন ক্লাসে শিশুদের ফলাফলের ভিত্তিতে ক্রমান্বয়ে উপরের ক্লাসে, এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ভর্তি করতে হবে।

৪। কোচিং, প্রাইভেট, গাইড বই- এসব তুলে দিতে হবে। পিএসসি-জেএসসি পরীক্ষা , সৃজনশীল পদ্ধতি তুলে দিতে হবে।

৫। শিক্ষকদের জবাবদিহিতা ও শাস্তির কঠোর প্রয়োগ বাড়াতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব পর্যায়ে শিক্ষকদের বেতন আরও অনেক বাড়ানো উচিত, যাতে দেশের সবচেয়ে মেধাবী মানুষগুলো অর্থের পেছনে না ছুটে তাঁদের বেতন দিয়েই একটি সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারেন।


সামগ্রিকভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যে ধ্বস নেমেছে সেটা রদ করতে হলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। আমাদের শিরক্ষাব্যবস্থার এ দূরবস্থা খুব দ্রুত বদলানো দরকার।

শিক্ষা বিষয়ক অনলাইন জার্নাল 'বাংলাদেশের শিক্ষা'-য় লেখাটি গতকাল ছাপা হয়েছে।




https://www.bn.bdeduarticle.com/প্রাইভেট-কোচিঙের-মহামারী/














সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৭ বিকাল ৪:৪৭
২৩টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×