এই কমিশন গঠনের বিষয়টি এখন প্রায় অজানা। এ নিয়ে তেমন আলোচনাও নেই। সদস্যদের মধ্যে বেশিরভাগই বেঁচে নেই। বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি লেখালেখিও হয় না।
কয়েকদিন আগে পিয়াল ফোন করেছিল এই বইয়ের খোঁজে। তখনই সে জানায় বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে অনেক আগে প্রথম আলোতে একটা ভাল রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল, করেছিল শামীমা বিনতে রহমান। (শামীমা এখন প্রথম আলোতে নেই, সম্ভবত সমহোয়ারে সে একটা বা দু’টা পোস্টও দিয়েছিল।) খোঁজ লাগাই রিপোর্টটার। তেমন কষ্ট করতে হলো না। রিপোর্টটা পড়ে মনে হলো এর অনেকগুলো বিষয় এখনো অনেক প্রাসঙ্গিক। কিছু বিষয় আবার নতুন করে আলোচনারও দাবী রাখে। কেননা, আমরা আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাচ্ছি, এবং সরকারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ কারনেই সেই রিপোর্টটি সামনে রেখে এই পোস্টটা লেখা।
বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধিজীবী হন্তারকদের চিহ্নিত করা, কী প্রক্রিয়ায় বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কতজনকে হত্যার জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, এই অপকর্মের পরিকল্পনাকারী, সহযোগী কারা ছিল- এরকম সব তথ্য খুঁজে বের করা। কমিশনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ ও সাপ্তাহিক হলিডের সাবেক সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান। তিনি এখন আর বেঁচে নেই। গঠনের চার দিন পর কমিশনে সদস্য হিসেবে কলকাতা থেকে এসে যোগ দেন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। এরপর জহির রায়হান এর আহ্বায়ক এবং আবুল বাশার ছিলেন এর মহাসচিব। সদস্য ছিলেন এনায়েতুল্লাহ খান, শহীদ বুদ্ধিজীবী মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছোট ভাই এহতেশামুল হায়দার চৌধুরী, আলী আশরাফ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। কমিশনের কাজ ছিল বুদ্ধিজীবী পরিবারগুলোর সাক্ষ্য নেওয়া, ঘাতক আল বদর, আল শামসদের চিহ্নিত করা, আল বদরের ক্যাম্প খুঁজে বের করা ইত্যাদি।
এখন যেটি প্রেসক্লাব, এই ভবন সেসময় ছিল না। ব্রিটিশ রীতিতে তৈরি একটি লাল ভবন ছিল তখনকার প্রেসক্লাব। সেই প্রেসক্লাবের পুরনো অফিসটির দোতলায় টেবিল টেনিসের একটি কক্ষে গঠন করা হয়েছিল বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন।
কমিশন কাজের মধ্য দিয়ে আল বদরের প্রধান চারটি ক্যাম্প তারা পেয়েছিলেন। এর মধ্যে একটা মোহাম্মদপুরে ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজ, এটি ছিল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। আর ধানমন্ডিতে ছিল হেড কোয়ার্টার। সেখান থেকে আল বদর বাহিনীর বুদ্ধিজীবীদের হত্যার একটি তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। এর মধ্যে কয়েকটি ছিল সংক্ষিপ্ত তালিকা। আবার কিছু ছিল বিশাল তালিকা। ক্যাম্পগুলো তল্লাশি করে শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী, সাংবাদিকেরও তালিকা পাওয়া যায়।
তদন্ত কমিশন আল বদর, আল শামস প্রস্তুতকৃত ২০ হাজার শিক্ষিত, পদস্থ পেশাজীবীদের হত্যার তালিকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের তৈরি ৩০ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে বাংলাদেশ সমর্থনের দায়ে হত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়ার তালিকাও উদ্ধার করেছিল।
শামীমা তখন এনায়েতুল্লাহ খানের সঙ্গে কথাও বলেছিল। তিনি জানান, কমিশনের কাছে ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. গোলাম মূর্তজা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আলিম চৌধুরীরসহ বেশ কয়েকটি পরিবার সাক্ষ্য দেয়। তাদের সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে অভিযুক্তদের প্রথমে একটা বড় তালিকা তৈরি করা হয়। এরপর সেখান থেকে প্রতিটি পরিবারের অভিযুক্ত অপরাধী হিসেবে তিনজনের ছোট তালিকা করা হয়। এরপর এই দলিলপত্র নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জহির রায়হান ২৮ ডিসেম্বর মঙ্গলবার প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে জহির রায়হান আল বদর বাহিনী দ্বারা অপহৃতদের সন্ধানের জন্য অবিলম্বে তদন্ত কমিশন গঠন করতে সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে জহির রায়হান বলেন, যেসব দলিলপত্র পাওয়া গেছে, তাতে এই ষড়যন্ত্রেও সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মচারীদের নামও পাওয়া গেছে। আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এরা আবার ভোল পাল্টে সাধারণ্যে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করবে। পরদিন ২৯ ডিসেম্বর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে এ খবর প্রকাশিত হয়। এনায়েতুল্লাহ খান জানান, এরপর কমিশন ওই স্যাক্ষপ্রমাণের একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে এবং ৮ জানুয়ারি সেটা মুজিবনগর সরকারের প্রধান রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে এবং বাংলাদেশের প্রথম স্বরাষ্ট্র সচিব এবং একই সঙ্গে আইজি এ. খালেকের কাছে একটি কপি দেয়।
বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন সম্পর্কে তথ্য জানার পর শামীমা যোগাযোগ করে সে সময়ের স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইজি এ. খালেকের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৯৭৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইজি ছিলেন, তখন পর্যন্ত কমিশনের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে ছিল। দায়িত্ব ছাড়ার পর এ সম্পর্কে আর কোনো খবর তিনি জানেন না। বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন প্রতিবেদনের পরিণতি সম্পর্কে তখন আর কোনো তথ্য জানাতে পারেননি এনায়েতুল্লাহ খান এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। এর কোনো অনুলিপিও তাদের কাছে নেই জানিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম জানিয়েছিলেন, ‘জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পর তদন্ত প্রতিবেদনগুলোও অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে।’
বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৮ ফেব্রুয়ারি একটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন বলেও জানা যায়। তিন সপ্তাহের মধ্যেই কমিশনকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এটি সরকারি নির্দেশনা আকারে জারি হওয়ার কোনো প্রমান পাওয়া যায়নি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৪:৪২