০১.
ক্লাশ সেভেনে পড়ি তখন। কত আর বয়স। সেই বয়সেই বই পড়ার ভীষণ নেশা।
বিস্তারিত এই পোস্টে।
মনিরার প্রেমে পড়িয়া পাগল
সেই সময়ে মাঝে মাঝে মাসুদরানা বা কুয়াশাও পড়ি। কারণ ওই একই লাইব্রেরীতে এই সব বইও পাওয়া যায়। সেবা প্রকাশনী থেকে তখন আত্মউন্নয়নমূলক কিছু বই বের হয়েছিল। তার মধ্যে একটা বই আমার জীবনকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। বইটির নাম - ধূমপান ত্যাগে আত্মসম্মোহন। এর আগেই সম্মোহন সম্পর্কে একটা বই পড়েছিলাম। কিন্তু এই বইটি সেই রকম না। এই বইয়ে বিস্তারিত লেখা ছিল যে ধূমপান মানুষের জন্য কত ভয়াবহ। সেই কিশোর বয়সে ওই বইটা আমার মধ্যে ব্যাপক প্রভাব তৈরি করল। পণ করলাম, কোন দিনও একটি শলাকা সিগারেটও খাব না, কৌতূহল নিবারণের জন্য হলেও না। ২৭ বছর কেটে গেছে , সেই পণটি আজও ভাঙ্গিনি। জীবনের মধ্যগগনে এসে পড়লেও জীবনে এক শালাকা সিগারেটও কোনদিন টান দিয়ে দেখিনি।
মানুষ ইচ্ছে করলে অনেক কিছু্ করতে পারে।
০২.
তবে একবার একটা কঠিন বিপদে পড়েছিলাম। তখন সবে ক্লাশ টেনে উঠেছি। আমাদের এলাকায় বেশ কিছু গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির গড়ে উঠছে তখন। সেই রকম একটা বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির নির্মাণাধীন দালানের পাশে আমরা সহপাঠীরা আড্ডা দিচ্ছিলাম।
হঠাৎ বন্ধুদের একজন বলল, চল, এই দালানের ভেতরে যাই। আমরা সবাই গেলাম। ওই দালানের আন্ডারগ্রাউন্ড অংশ ছিল। আমরা সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে গেলাম নিচে। আন্ডারগ্রাউন্ড অংশে নামার পর ৩ বন্ধু আমাকে তিন দিক থেকে ধরে ফেললাম। আমি অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকালাম। একজন একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার মুখের কাছে নিয়ে এল। বলল, খা।
আমি বললাম, খাব না।
ওরা বলল, এটা বিদেশী সিগারেট। খাইলে ঠাণ্ডা লাগে। খেয়ে দেখ কী মজা।
আমার তখন একটাই চিন্তা, সেই পণটা ভাংব না। ওরা অনেক জোরাজুরি করল। আমি হঠাৎ করে ঝাটকা দিয়ে ছুটে পালালাম। পেছন থেকে শুনতে পেলাম, কেউ একজন বলছে, শালা মাইগ্গা।
০৩.
আমাদের দেশে সিগারেট সম্পর্কে একটা হিরোইজম প্রচলিত আছে। এক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হয় রজনীকান্ত সবার সেরা। সিগারেট ধরানোটা যে একটা ভীষণ নায়কোচিত ব্যাপার, সেটা তার অদ্ভুত ভঙ্গিমার সিগারেট ধরানো থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়।
সিনেমার ভিলেনরা নায়ককে সাইজ করার আগে সিগারেটের ধোঁয়া নায়কের মুখে ছুঁড়ে না মারলে ঠিক যেন জমে না। প্রকৃত ভিলেন লাগে না। অন্য দিকে নায়কও সিগারেটের ধোঁয়া নিয়ে খেলা না করলে পুরুষালি মনে হয় না।
সিনেমা নাটকে সিগারেটের যাচ্ছেতাই ব্যবহারের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সিগারেট সম্পর্কে এই রকম একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে। সিগারেট না খেলে যে পুরুষত্ব থাকে না। কিন্তু আসল খবর হল, সিগারেট অধিক পরিমাণে খেলে পুরুষত্বও কমে যায়।
এই ধারণা থেকেই এক সময় অনেক মেয়েও প্রেমিককে সিগারেট খেতে না দেখলে তাকে মাইগ্গা ভাবত। অধূনা তামাক ব্যবহারের কুফল জানার ফলে এই সব ভুল ধারণা থেকে মানুষ বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
০৪.
আমার এক পরিচিত সংস্কৃতিকর্মী অনেক বড় বড় কথা বলেন। কথায় কথায় সমাজ বদলে ফেলতে চান ওই বড় ভাই। তার বড় বড় কথা শুনে বিরক্ত লাগে।
এক দিন ধরেই বসলাম তাকে। ভাই, আপনি তো সমাজ বদলাতে চান ?
তিনি তার প্রিয় বিষয় পেয়ে গেলেন। বললেন, সমাজের যত অনিয়ম ও অসঙ্গতি দূর না করতে পারলে আমরা সাংস্কৃতিক আন্দোলন করছি কেন ?
আমি বললাম, সবার আগে দরকার নিজেকে বদলানো। যদি নিজেকে বদলাতে না পারি, তবে সমাজকে বদলাব কিভাবে ? নিজের যত দোষ আছে সেগুলো আগে দূর করতে হবে, তারপর সমাজ পরিবর্তনের কথা বলা উচিত।
তিনি থমকে গেলেন। বললেন, কী বলতে চাস তুই ?
আমি বললাম, কিছু মনে করবেন না। আমরা সমাজের অনেক অসঙ্গতি দূর করার কথা বলি, কিন্তু আমার নিজের মধ্যেই যে অসঙ্গতি রয়ে গেছে সেটা দূর করার ব্যাপারে উদাসীন থাকি।
তিনি এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন যেন বুঝতে পারছেন না আমি কোন বিষয়ে কথা বলছি। আমি বললাম, এই যে আপনি এত এত সিগারেট খান, তার জন্য আপনার স্বাস্থ্যের ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে। নিজের এই অসঙ্গতি দূর না করে সমাজের অসঙ্গতি দূর করার কথা বলা ঠিক ?
তিনি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হা করে তাকিয়ে রইলেন।
০৫.
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আমার এক সাংবাদিক বন্ধু ফোন করে বললেন, একটা ওয়ার্কশপ আছে, যাবেন নাকি ?
আমি সাধারণত ওয়ার্কশপ মিস করি না। কারণ, অনেক কিছু জানা যায় এবং অনেক নতুন নতুন লোকের সাথে পরিচিত হওয়া যায়।
আমি যথারীতি রাজি হলাম। মিডিয়া ফর ট্যোবাকো কন্ট্রোল ইন বাংলাদেশ নামে দু'দিনের ওয়ার্কশপ। সাংবাদিকদের জন্য বেসরকারী সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) ও প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ যৌথভাবে এই ওয়ার্কশপ আয়োজন করেছে। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা নাটাব (বাংলাদেশ জাতীয় যক্ষ্মা নিরোধ সমিতি) ও ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এই ওয়ার্কশপ আয়োজনে সহযোগিতা করে আসছে।
১৬ ও ১৭ ফেব্রুয়ারি দু'দিন কাটালাম এই ওয়ার্কশপে। সাভারের বাড়ইপাড়ার হোপ ফাউন্ডেশনের কনফারেন্স রুমে অনুষ্ঠিত এই ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করলেন ঢাকা বিভাগের তৃণমূল পর্যায়ের ৪১ জন সাংবাদিক।
জানলাম, তামাক এমন একটি পণ্য সেটা যেভাবেই আমাদের শরীরে ঢুকুক না কেন, ক্ষতি করবেই। এমনকি প্রত্যেক্ষ ধূমপানে যেমন ক্ষতি তেমন ক্ষতি পরোক্ষ ধূমপানেও - মানে অন্য কেউ ধূমপান করছে সেই ধোঁয়া আশেপাশের যার দেহেই যাবে, তারও ক্ষতি করবে।
সিগারেট, বিড়ি, হুক্কা ছাড়াও জর্দা, সাদাপাতা ও গুল হিসেবে আমরা তামাক ব্যবহার করি। ধূমপানের কারণে গলায় ও ফুসফুসে ক্যান্সার হয়, স্ট্রোক হয়, হৃদরোগ হয়। প্রত্যেক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপানে শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা হয়। ধূমপান ছাড়াও তামাকজাত অন্যান্য দ্রব্য ব্যবহারে মুখে ক্যান্সার হয়। সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লাইট বা লো বলে যতই আশ্বাসবাণী থাকুক না কেন, তামাক ক্ষতি করবেই।
এই ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করে সেই ক্লাশ সেভেনে করা ধনুর্ভঙ্গ পণটি যে সঠিক ছিল সেটা ভালো করে অনুধাবন করলাম। যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন এই পণটি কখনও ভাংব না।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৫:৪২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




