somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আস্তিক-নাস্তিক-সংশয়ী এবং তাদের ঈশ্বর

২৭ শে জুন, ২০০৮ রাত ৯:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[আস্তিকতা-নাস্তিকতা নিয়ে বিতর্ক অনেক দিনের পুরনো হলেও এর কোনো মীমাংসা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিতর্ক চলছেই। আমার এই লেখাটিও সেই বিষয় নিয়েই। বলা দরকার যে, লেখাটি আমার 'সংশয়ীদের ঈশ্বর' প্রবন্ধের অংশবিশেষ। ব্লগে বড় লেখা দেয়া সমস্যা, তারই সঙ্গত কারণেই কাটছাঁট করে দেয়া হলো।]

আমাদের সমাজে আস্তিকদের কণ্ঠ অনেক উঁচুস্বরে শোনা গেলেও, সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে কোনো 'আস্তিক' স্বীকার করতে লজ্জা পান যে, তিনি আস্তিক- কারণ সেক্ষেত্রে তাকে প্রতিক্রিয়াশীল অভিধা পেতে হতে পারে। অন্যদিকে 'নাস্তিক'রা প্রকাশ্যে বলতে কিঞ্চিৎ 'ভয়' পেলেও আড্ডায় বা ঘরোয়া পরিবেশে বেশ গর্ব করেই বলেন যে, তিনি নাস্তিক। অর্থাৎ নাস্তিকতা গৌরবের আর আস্তিকতা লজ্জার! কিন্তু অদ্ভুত শোনালেও সত্যি যে, এর একটি যদি নেতিবাচক হয় তবে একইভাবে অন্যটিও নেতিবাচক শব্দ। আমাদের এখানে একটি ধারণা প্রচলিত আছে- এই দুটো শব্দ পরস্পরের বিপরীত অর্থ বহন করে। কিন্তু সত্য হচ্ছে এই যে, আস্তিকতার বিপরীত শব্দ নাস্তিকতা নয়, এই দুটো শব্দ দুটো বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে। একটি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস, অন্যটি ঈশ্বরের অনস্তিত্বে বিশ্বাস। যিনি অনস্তিত্বে বিশ্বাস করেন তিনি আবার ঈশ্বরের পরিবর্তে প্রকৃতি বা এই ধরনের অন্য কোনোকিছুতে বিশ্বাস করেন। এই শব্দ দুটোর বিপরীত শব্দ হচ্ছে সংশয়। একজন সংশয়ীকে কি এর যে-কোনো একটি বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বা পক্ষে দাঁড় করানো যাবে? যে-কোনো এক পক্ষে দাঁড় করালে তার অন্য পক্ষে চলে যাবার সম্ভাবনাটিও পুরোমাত্রায় রয়ে যাবে।

সংশয়ীদের নিয়ে না হয় একটু পরে বলি, তার আগে বরং আস্তিক-নাস্তিকদের নিয়েই কিছু চিন্তাভাবনা করা যাক।

প্রথম কথা হচ্ছে- আমাদের দেশে আস্তিকতা-নাস্তিকতার ধারণাটি খুবই অদ্ভুত। বিষয়টি আর ঈশ্বরের অস্তিত্ব-অনস্তিত্বে বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে নেই; দাঁড়িয়ে গেছে ধর্মে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ওপর। অর্থাৎ যিনি ধর্মে বিশ্বাস করেন তিনি আস্তিক, যিনি করেন না তিনি নাস্তিক। এই কনসেপ্টটিকে পরিপূর্ণ বলা যায় না। ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ঈশ্বরের প্রতি যার বিশ্বাস নেই অথচ অন্য কোনো মহামহিম ক্ষমতাবান অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস আছে, আমাদের দেশে তাকে নিশ্চয়ই কেউ আস্তিক বলতে চাইবেন না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি তো আস্তিকই। ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাস আছে কি নেই সেটা তো কোনো প্রশ্নই নয়। অন্যদিকে ঈশ্বর সম্বন্ধে একেবারেই কোনো ভাবনা-চিন্তা নেই অথচ ধর্ম-প্রণীত আচার-আচরণ মহা সাড়ম্বরে পালন করেন এমন সব ব্যক্তিকে সবাই আস্তিক বলবেন, যদিও তার আস্তিক্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট কারণ আছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে- ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ঈশ্বরে আস্থা নেই এমন লোককে আস্তিক বলা যায় কীভাবে? প্রচলিত দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁকে আস্তিক বলা যায় না বটে, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে- ধর্ম মেনে চলা বা ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত মোটামুটি নিষ্ঠুর এবং ভয়ংকর একজন ঈশ্বরে বিশ্বাস করার পরিবর্তে একজন মানুষ তার নিজের মতো করে একজন ঈশ্বরের কল্পনা করতে পারেন এবং সেক্ষেত্রে তাঁকে আস্তিক বললে খুব বেশি ভুল করা হবে না। এ প্রসঙ্গে আমরা লালনের একটি গানের উদাহরণ দিতে পারি। 'পারে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়'- এই গানটির কয়েকটি পংক্তি এরকম

নবী না মানে যারা
মওয়া ছেদ কাফের তারা
আখেরে হয়


এই পংক্তি শুনে যে কেউ মনে করবেন, লালন ইসলাম ধর্মে প্রচারিত মতেরই প্রতিধ্বনি করছেন। কিন্তু এর পরের বাক্যগুলো এরকম-

যে মুর্শিদ সেই তো রাসুল ইহাতে নাই কোনো ভুল খোদাও সে হয়

এই পংক্তি অবশ্যই ইসলামের মূল তত্ত্ব বিরোধী। কারণ এখানে মুর্শিদ অর্থাৎ একজন সাধারণ মানুষকে (হতে পারেন তিনি সাধক পুরুষ) প্রথমত রসুলের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে (রসুল নিজে কোনো সাধারণ পুরুষ নন, ইসলাম ধর্মমতে তিনি আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ- মহামানব)। তবু শরীয়তপন্থী লোকেরা হয়তো এ কথাটি মেনে নিতে আপত্তি করবেন না, কারণ রসুলই বলেছেন- আমি তোমাদেরই মতো সাধারণ মানুষ, পার্থক্য শুধু এই যে, আমার কাছে আল্লাহর অহি আসে তোমাদের কাছে আসে না (এটাকে অবশ্য তাঁর অপূর্ব বিনয়ের প্রকাশ বলেই মনে হয় আমার। কারণ যাঁর কাছে আল্লাহর অহি আসে তিনি সাধারণ মানুষ হন কীভাবে?)। কিন্তু লালন যখন বলেন- 'খোদাও সে হয়'- তখন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের প্রতিবাদ স্বরূপ একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠার কথা। কারণ রসুল উপরোক্ত কথাটি বলেছিলেন যেন তার অনুসারীরা আল্লাহর সঙ্গে তাঁকে মিলিয়ে না ফেলেন এবং তাঁকেই আল্লাহ বলে ভাবার মতো ভুল না করেন। কিন্তু এখানে লালন তাই করেছেন। মুর্শিদ (সাধারণ মানুষ), রসুল (মহাপুরুষ) ও খোদা (সৃষ্টিকর্তা) কে তিনি মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে ফেলেছেন- এবং পংক্তিটি পরিষ্কারভাবে এ কথাটিই বলতে চায় যে, মানুষ এবং খোদা একই রূপের দ্বিবিধ প্রকাশ অথবা মানুষের মধ্যেই খোদা বিরাজমান- তাঁর আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। এই মত মূল ইসলাম সমর্থন করে না (যদিও এর সঙ্গে সুফিবাদ কথিত মতের বেশ মিল পাওয়া যায়)। প্রশ্ন হলো লালনের খোদা তাহলে কে, এই ধারণাই-বা তিনি কীভাবে এবং কোত্থেকে পেলেন?

এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথাও বলা যায়। মানব-ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালে যতগুলো প্রতিভা প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ তাদের অন্যতম, আর রবীন্দ্রনাথের বহুমাত্রিক প্রতিভার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছে তাঁর গানে। কী কথায়, কী সুরে তিনি এক অতুলনীয় সংগীত-ব্যক্তিত্ব। পৃথিবীতে এমন 'সংগীত প্রতিভা' আর দেখা যায় না। মানুষের জীবনের এমন কোনো অনুভূতি নেই যা তাঁর গানে ধরা পড়ে নি। আমার তো মনে হয় মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে মানিয়ে যাবার মতো একটা না একটা গান রবীন্দ্রনাথের আছে। কিন্তু তাঁর এই বহুবিচিত্র গানগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ প্রতিভার ছোঁয়া পেয়েছে তাঁর প্রার্থনা সংগীতগুলো। মানুষের সমর্পণ ও আত্ননিবেদনের এমন অসামান্য আকুতি ও আর্তি অন্তত আমার জানামতে অন্য কোনোকিছুতে ধরা পড়ে নি। তো, তাঁর একটি প্রার্থনা সংগীতের উদাহরণ দেই-

যদি এ আমার হৃদয় দুয়ার বন্ধ রহে গো কভু
দ্বার ভেঙে তুমি এসো মোর স্বামী ফিরিয়া যেওনা প্রভু।


রবীন্দ্রনাথের আস্তিকতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবেন না, জানি, কিন্তু এই গানের প্রভু কোন ধর্মগ্রন্থের? বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত কোনো ঈশ্বর তো তার অনুরাগীর এমন অন্যায় আব্দার রাখবেন বলে মনে হয় না, এমন প্রেমময় আহ্বানে তাকে পটানো যাবে না, উল্টো দ্বার বন্ধ দেখে তিনি রেগে যেতে পারেন। প্রভুর এমন কী দায় পড়েছে যে, বন্ধ দ্বার ভেঙে অনুরাগীর হৃদয়ে প্রবেশ করবেন?

লালনের দয়াল/খোদা কিংবা রবীন্দ্রনাথের প্রভু কোনো ধর্মগ্রুন্থের ঈশ্বর নন, অথচ এঁরা প্রত্যেকে ঈশ্বরের মতো কোনো একজনকে কল্পনা করেছেন। এঁদেরকে কি আমরা আস্তিক বলবো? আস্তিক বলতে তো আমরা কোনো ধর্মাবলম্বীকে বোঝাই, অথচ প্রচলিত কোনো ধর্মে এঁদের আস্থা ছিলো না। সেক্ষেত্রে তাঁরা তো আস্তিকই থাকেন না, আবার নাস্তিকও তো বলা যাচ্ছে না, তাঁরা যে বিশ্বাস করেন! আমি এতক্ষণ ধরে তাঁদেরকে আস্তিকই বলেছি, কিন্তু এখন সম্ভবত বলা যায়- এঁরা প্রত্যেকেই সংশয়ী। প্রচলিত ঈশ্বর ধারণার প্রতি এঁদের সকলেরই সংশয় ছিলো বলে তাঁরা নতুন এমন একজন ঈশ্বরের প্রকল্প দাঁড় করিয়েছেন যেটা তাঁদের দার্শনিক প্রতীতির সঙ্গে মেলে।

এই ঈশ্বরের স্বরূপটা কিরকম? এঁরা এই ঈশ্বরের ধারণাই-বা পান কোত্থেকে? কেউ হয়তো লালনের ওপর সুফিবাদের প্রভাব খুঁজে পাবেন, অথবা ভারতবর্ষের প্রেম-ভক্তিবাদের এবং বৌদ্ধ সহজিয়াবাদের প্রভাবও খুঁজে দেখতে চাইবেন। রবীন্দ্রনাথের ওপর তো লালন, কবীর প্রমুখ মরমীদের প্রভাব প্রায় স্পষ্ট। কিন্তু যে প্রভাবই থাকুক না কেন, ধর্মগ্রন্থের ঈশ্বরের সঙ্গে যে তাঁদের ঈশ্বরের মিল প্রায় নেই- একথা সবাই বোঝেন। এমনকি ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে সম্পর্কিত সুফিবাদের ঈশ্বরও ইসলামী ঈশ্বর নন! সুফিরা মনে করেন- মানুষ হচ্ছে ঈশ্বরেরই একটি প্রকাশ মাত্র এবং মানুষ সাধনার মাধ্যমে নিজেকে এমন এক স্তরে উন্নীত করতে পারে যখন মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না, তাঁরা একই সত্ত্বায় পরিণত হন। সুফিবাদের এই আল্লাহর সঙ্গে মূল ইসলামের আল্লাহর ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। মূল ইসলামেরর কনসেপ্ট অনুযায়ী আল্লাহ একটি ইউনিক (একক/অদ্বিতীয়) সত্ত্বা, অন্য সবকিছু তাঁর সৃষ্টি। অর্থাৎ সম্পর্কটা এখানে স্রষ্টা ও সৃষ্টির। আর সুফিবাদ বলছে আল্লাহ এবং তাঁর সৃষ্টজগতের মধ্যে মূলত কোনো পার্থক্য নেই, কারণ আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছেন মাত্র। এই ধারণা এখন আর আমাদের কাছে বৈপ্লবিক বলে মনে হয় না, কিন্তু সুফিবাদের জন্মকালে এসব কথাবার্তা কী ভয়ানক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিলো ভেবে দেখুন! ইসলামের পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে, ইসলাম সৃষ্ট আল্লাহকে মেনে নিয়ে এবং নবীকে এবং ঈমানের অন্যান্য অনুষঙ্গগুলোকে স্বীকার করে নিয়েই তাঁরা আল্লাহর ভিন্নতর একটি রূপ দাঁড় করিয়েছিলেন।

এই যে প্রচলিত ধর্মমতসমূহের বাইরে গিয়ে ঈশ্বর সম্বন্ধে একটি নতুন ধারণা সৃষ্টি বা নিজের জন্যই ঈশ্বরের একটি রূপ তৈরি করেন মনীষীরা, তার কারণ কি? সঠিক কারণটি নির্ণয় করাটা খুবই দুরূহ; সম্ভাব্য কারণটি হয়তো এই যে, তারা অনুভব করেন- নিজেকে সমর্পণের জন্য, নিবেদনের জন্য এমন একজনের অস্তিত্ব থাকা প্রয়োজন। কেমন একজন? প্রেমময়, দয়াময়, ক্ষমাশীল একজন। এমন একজন যিনি কথায় কথায় নরকের ভয় দেখান না, স্বর্গের লোভও দেখান না, শাস্তি দেবার জন্য উদ্যত হস্তে যিনি দাঁড়িয়ে থাকেন না, অনুরাগীর অপরাধকে যিনি দেখেন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে, যাঁর কাছে দাবি করা যায়, যাঁর ওপর অভিমান করা যায়, রাগ করা যায়, এমনকি তাঁর কোনো নিষ্ঠুরতার জন্য তাঁকে অভিযুক্তও করা যায়। প্রেম নিবেদনে যিনি আনন্দিত হন, অনুরাগীর সমর্পণ যাঁকে খুশি করে তোলে। প্রেমের মাত্রাটা বেশি হয়ে গেলে যিনি নিজের বিরাটত্ব ভুলে গিয়ে অনুরাগীর বন্ধ দুয়ার খুলে ঢুকে পড়েন, নিজেকে প্রকাশ করেন অনুরাগীর প্রেমের মধ্যে দিয়ে, প্রমাণ করেন- তিনি ভয়ংকর নন, বীভৎস নন, বিদ্বেষপরায়ণ নন, শাস্তিদাতা নন, ভীতিকর নন- তিনি প্রেমময় এবং সুন্দরের পুজারী, সমর্পণ আর নিবেদনই তাঁর কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- আর কিছু নয়। এই ঈশ্বর তাঁদের নিজস্ব ঈশ্বর যিনি তাঁদেরকে সৃষ্টিকর্ম উপহার দেন। তাঁর সঙ্গে তাই সম্পর্কটি ভয়ের নয়, প্রেমের ও কৃতজ্ঞতার। আর এই প্রেম ও কৃতজ্ঞতা থেকেই জন্ম নেয় সমর্পণ।

বিশ্বাসীরাই শুধু তাদের ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত হন- কথাটি ঠিক নয়, অবিশ্বাসী এবং সংশয়ীরাও জীবনের কোনো-না-কোনো সময়ে সমর্পিত হন কারো-না-কারো কাছে। হয়তো কোনো সুনির্দিষ্ট ঈশ্বরের কাছে নয়, তবু তিনি কোনো-না-কোনো অর্থে সমর্পিত ব্যক্তিটির চেয়ে অনেক বড়, মহান এবং দয়াময়। প্রকৃতপক্ষে নাস্তিক বা সংশয়ীদের এই সমর্পণ অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ তাদের কোনো সংজ্ঞায়িত ঈশ্বর নেই। আমার তো মনে হয়- বিশ্বাসীরা কোনোদিনই আপাদমস্তক সমর্পিত হতে পারেন না, তাদের ঈশ্বর ধারণা সুনির্দিষ্ট এবং সংজ্ঞায়িত বলেই ঈশ্বর সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার সময় তাদের নেই, তারা তাই ধর্মের কতগুলো আচার মেনেই সন্তুষ্ট থাকেন। ফলে তাদের নিয়মিত ধর্মচর্চা নিছক আচারসর্বস্বতায় পরিণত হয়।

পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই জীবন ও পৃথিবীর সবকিছুকে ব্যাখ্যা করার জন্য একটি ফ্রেম তৈরি করেন- আর ওই ফ্রেমকেই তিনি স্ট্যান্ডার্ড বলে মনে করেন। পৃথিবীর সবকিছুকেই ওই ফ্রেমে বন্দী করে ফেলাটা তার একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায়, একান্তই কোনো বিষয় যদি সেই ফ্রেমের মধ্যে না পড়ে তাহলে সেটাকে তীব্রকণ্ঠে অস্বীকার করেন। আস্তিকদের জন্য নাস্তিকতা আর নাস্তিকদের জন্য আস্তিকতা হচ্ছে ফ্রেমের বাইরের ব্যাপার- ফ্রেমে ফেলে বিষয়টিকে তারা ব্যাখ্যা করতে পারেন না বলেই অস্বীকার করেন।

অন্যদিকে সংশয়ীদের এমন কোনো সুনির্দিষ্ট ফ্রেম থাকে না, ফলে তারা যে-কোনো বিষয়কেই স্বীকার বা অস্বীকার না করে বিবেচনায় নেন, সংশয় প্রকাশ করেন, বিষয়টির ভালো-মন্দ, ইতি ও নেতি খতিয়ে দেখেন। আর এইদিক থেকে বিচার করলে মনে হয়- সংশয়ীরা দার্শনিকভাবে অন্যান্যদের চেয়ে এগিয়ে আছেন। তাদের বিবেচনার আকাশটি অনেক বড়, তাদের ভাবনা-চিন্তার জগৎটি ফ্রেমবন্দী নয়, আর তাছাড়া কে না জানে আকাশকে কখনো ফ্রেমবন্দী করা যায় না!

সংশয়ীদের কৌতূহলের শেষ নেই, প্রশ্নেরও শেষ নেই- আর তাই অনুসন্ধানেরও শেষ নেই। শেষ নেই বলেই সংশয়ীরা কোথাও দাঁড়ান না, অবিশ্রান্তভাবে এগিয়ে চলেন। ঈশ্বরবিহীন পৃথিবীতে তাঁরা নতুন ঈশ্বরের জন্ম দিতে পারেন- হয়তো এভাবেই কোনো এক সুদূর অতীতে কোনো এক সংশয়ী মানব-সমাজে ঈশ্বর ধারণার সূচনা করেছিলেন। একইভাবে ঈশ্বরময় পৃথিবীতে তাঁরা সংশয়ী প্রশ্ন করে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পারেন। অর্থাৎ কোনো অবস্থাই তাঁদের জন্য শেষ অবস্থা নয়। অন্য সব দর্শন যেখানে হেরে যায়, থেমে যায়- সংশয়ীরা তখনও থাকেন চলমান। এই একটি জায়গায় সংশয়ীরা অন্য সবার থেকে শ্রেষ্ঠ।
৭৪টি মন্তব্য ৪৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×