somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'অশ্রুপাত শেষ হলে নষ্ট করো আঁখি'

০১ লা অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১১:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খুব কবিতা পড়ার নেশা আমার। সময়ে-অসময়ে, অবসরে-ব্যস্ততায় কবিতা আমাকে আশ্রয় দেয়। মাঝে-মাঝে কোনো-কোনো কবিতা পড়ে এতটাই অভিভূত হই যে, শুধু নিজে পড়ে তৃপ্তি হয় না, মনে হয় আরো অনেকের সঙ্গে এই পাঠ-আনন্দ ভাগ করে নিই। কিন্তু, হায়, কবিতার মতো অলাভজনক (!) বিষয় নিয়ে কথাবার্তা কে-ই বা শুনতে চায়! এই ব্লগে, তাই, এর আগেও কবিতা নিয়ে লেখা দিয়েছি, শুধু ওই আনন্দ ভাগ করে নেয়ার উদ্দেশ্য থেকেই। আজও, অনেকদিন পর, তেমনই আরেকটি কবিতা।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'ও চিরপ্রণম্য অগ্নি' কবিতা এটি- তাঁর একুশতম কাব্যগ্রন্থের, সম্ভবত প্রায় শেষ বয়সের রচনা। শক্তি আমার প্রিয় কবিদের একজন। তাঁর অনেকগুলো কবিতা প্রায় ঠোঁটস্থ হয়ে গেছে, পড়তে পড়তে। এটি তারই একটি।

কবিতাটি, মৃত্যুর পর কবির আকাঙ্ক্ষা ও মিনতি নিয়ে। মৃত্যুর পর না বলে, সৎকারের সময় বলাই ভালো। অর্থাৎ দাহ করবার সময় কবি আগুনের কাছে যে মিনতি জানাচ্ছেন তাই নিয়ে এই কবিতা।

কবিতাটি শুরু হয়েছে এভাবে-

'ও চিরপ্রণম্য অগ্নি
আমাকে পোড়াও।
প্রথমে পোড়াও ঐ পা দুটি যা চলৎশক্তিহীন,
তারপর যে-হাতে আজ প্রেম পরিচ্ছন্নতা কিছু নেই।
এখন বাহুর ফাঁদে ফুলের বরফ,
এখন কাঁধের পরে দায়িত্বহীনতা,
ওদের পুড়িয়ে এসো জীবনের কাছে
দাঁড়াও লহমা, তারপর ধ্বংস করো
সত্যমিথ্যা রঙে-শ্বেতে স্তব্ধ জ্ঞানপীঠ।'

বোঝাই যাচ্ছে - মৃত্যু হয়েছে কবির, দাহ করবার জন্য সমস্ত আয়োজন শেষ, আর কবি আগুনকে 'চিরপ্রণম্য' সম্বোধন করে পোড়াতে বলছেন তাঁর সবকিছু- চলৎশক্তিহীন পা, প্রেম-পরিচ্ছন্নতাহীন হাত, দায়িত্ববিহীন কাঁধ (যে কাঁধে সারাজীবন ধরে আমরা নানারকম দায়িত্ব বয়ে বেড়াই), তারপর 'সত্যমিথ্যা রঙে-শ্বেতে স্তব্ধ জ্ঞানপীঠ'- সবই।

সবই? না, এর পরের পঙক্তিতেই আছে-

'রক্ষা করো দুটি চোখ
হয়তো তাদের
এখনো দেখার কিছু কিছু বাকি আছে।'

অর্থাৎ, চোখ দুটো রক্ষা করতে বলছেন তিনি, কারণ- 'হয়তো' এখনো দেখার কিছু বাকি আছে! কি বাকে আছে? পরের পঙক্তিটি পড়ুন-

'অশ্রুপাত শেষ হলে নষ্ট করো আঁখি'

কার অশ্রুপাত? নিজের? না, বলাইবাহুল্য। তিনি তো মৃত এখন, নিজের অশ্রুপাতের প্রশ্ন নেই তাই। এইঅশ্রুপাত স্বজন-প্রিয়জন এমনকি অপ্রিয়জনদেরও! আমরা তো কখনো-কখনো নিজের অজান্তেই এমনটি ভাবি - আমি মরে গেলে কে-কে কাঁদবে আমার জন্য? কার দুচোখ ভেসে যাবে জলে? কার চোখের কোণ ভিজে উঠবে শুধু? কে-ই বা অবরুদ্ধ কান্নায় নিজেকে কেবল পুড়িয়েই চলবে? কবিও তেমনটি ভেবেছেন নিশ্চয়ই, আর তাই অশ্রুপাতগুলো দেখে যেতে চান। কিন্তু এ-ও জানেন এই অশ্রুপাত একসময় শেষ হবে, তখন- 'নষ্ট করো আঁখি'! কী অভূতপূর্ব একটি পঙক্তি, না?

কবিতার আসল বাঁকটি অবশ্য দেখা যাবে পরের পঙক্তিগুলোতে। নিজের সবকিছুই পোড়াতে বলছেন তিনি 'চিরপ্রণম্য অগ্নি'কে, কিন্তু একটি জিনিস না পোড়াবার জন্য মিনতি জানাচ্ছেন-

'পুড়িয়ো না ফুলমালা স্তবক সুগন্ধে আলুথালু
প্রিয় করস্পর্শ ওর গায়ে লেগে আছে।'

ফুলমালা-স্তবক যাকিছু দেয়া হয়েছে তার শবদেহে, তা যেন না পোড়ানো হয়! কেন? কারণ-

'প্রিয় করস্পর্শ ওর গায়ে লেগে আছে'

এ কি শুধু ফুলমালা? না তো! ওতে যে 'সুগন্ধে আলুথালু' প্রিয়জনের করস্পর্শ লেগে আছে! ওই করস্পর্শ কি পোড়ানো যায়?

কী বিপুল আবেগ, কী ভয়াবহ রোমান্টিকতা!

এবং পরের পঙক্তি-

'গঙ্গাজলে ভেসে যেতে দিও ওকে মুক্ত, স্বেচ্ছাচারি...'

ওকে পুড়িও না, হে অগ্নি, বরং গঙ্গাজলে ওকে ভেসে যেতে দাও- মুক্ত, স্বেচ্চাচারি। শেষের ডটচিহ্নগুলোও লক্ষ্য করবার মতো। এই ভেসে যাওয়ার মুক্ততা ও স্বেচ্ছাচারিতা যেন অনন্ত হয়, যেন অনন্তকাল ধরে 'প্রিয় করস্পর্শ' নিয়ে ওই ফুলমালা ভেসে যেতে পারে...

মাঝে মাঝে ভাবি, শেষ বয়সে এসেও এই কবির মধ্যে এমন তুমুল রোমান্টিকতা আসতো কোত্থেকে?

[উৎসর্গ : প্রিয় নিতির, তোমার সবকিছুর জন্য...]
১২৫টি মন্তব্য ৯১টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিশ্বাসীকে লজিকের কথা বলার দরকার কি?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:১৭




হনুমান দেবতা এবং বোরাকে কি লজিক আছে? ধর্ম প্রচারক বলেছেন, বিশ্বাসী বিশ্বাস করেছেন ঘটনা এ পর্যন্ত। তাহলে সবাই অবিশ্বাসী হচ্ছে না কেন? কারণ অবিশ্বাসী বিশ্বাস করার মত কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের শাহেদ জামাল- ৭১

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:৫৪



শাহেদ জামাল আমার বন্ধু।
খুব ভালো বন্ধু। কাছের বন্ধু। আমরা একসাথেই স্কুল আর কলেজে লেখাপড়া করেছি। ঢাকা শহরে শাহেদের মতো সহজ সরল ভালো ছেলে আর একটা খুজে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভাবছিলাম ২ লক্ষ ব্লগ হিট উপলক্ষে ব্লগে একটু ফান করব আড্ডা দিব, কিন্তু এক কুৎসিত অপব্লগার সেটা হতে দিলোনা।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:০৫



এটি ব্লগে আমার ২৬০ তম পোস্ট। এবং আজকে আমার ব্লগের মোট হিট ২০০০০০ পূর্ণ হয়েছে। আমি আনন্দিত।এই ছোট ছোট বিষয় গুলো সেলিব্রেট করা হয়তো ছেলে মানুষী। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শয়তান বন্দি থাকলে শয়তানি করে কে?

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:২০



রমজানে নাকি শয়তানকে বেধে রাখা হয়,তাহলে শয়তানি করে কে?

বহুদিন পর পর ব্লগে আসি এটা এখন অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। বেশ কিছু বয়স্ক, মুরুব্বি, সম বয়সি,অল্প বয়সি একটিভ কিছু ব্লগার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কট বাঙালি

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৯ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:২৪



কদিন পরপরই আমাদের দেশে বয়কটের ঢল নামে । অবশ্য তাতে খুব একটা কাজ হয় না । বাঙালির জোশ বেশি দিন থাকে না । কোন কিছু নিয়েই বাঙালি কখনই একমত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×