somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দার্জিলিংয়ের ডায়রী: ১ম পর্ব (মিরিক পর্ব)

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দার্জিলিং ভ্রমণ ২য় পর্ব

দার্জিলিং ভ্রমণ: ৩য় পর্ব

(পুরো ভ্রমণ কাহিনীটি লিখা হয়েছে ব্লগ ষ্টাইলে। এ লিখাটি পড়লে দার্জিলিং ও তার আসে পাশের জায়গা সম্পর্কে স্বচ্ছ একটি ধারনা হবে আমি আশাকরি।)

দার্জিলিং ভ্রমণে ইদানিং মানুষের আগ্রহ কম। বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে যাদের কিঞ্চিৎ টাকা পয়সা হয়েছে তারা এখন নেপাল, থাইল্যান্ড, মালোয়েশিয়া, বালি (ইন্দোনেশিয়ার বালিতেই মুলত মানুষ বাংলাদেশ থেকে যায়), শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, দুবাই ইত্যাদি যায়গায় ঘোরাফেরা করে। যাদের টাকা পয়সা আরেকটু বেশী, তারা লন্ডন (ইউ.কে.) আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া কানাডা করে। আমেরিকা ইউরোপ, কানাডা অস্ট্রেলিয়াতে অনেকের আত্মীয়-স্বজন থাকাতে এসব জায়গায় যাওয়াটা অনেক সহজ হয়ে গেছে অনেকের জন্য। আড্ডা বা পার্টিতে এখন দু’ধরনের মানুষ দেখতে পাওয়া যায়, এক শ্রেনীর মানুষ ইউরোপ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা জাপান সহ উন্নত দেশ ভ্রমণ করেছে। আরেক শ্রেনী যারা এসব দেশের কোন দেশই ভ্রমণ করেননি। উন্নত দেশ ভ্রমণকারী অথবা চাকুরী বা পড়াশোনাকারী শ্রেনী নিজেদেরকে অপেক্ষাকৃত জ্ঞানী ভাবেন। পার্টিতে এসব জ্ঞানী মানুষের উচ্চস্বরে সেসব দেশের আদব লেহাজ বা উন্নত জীবন নিয়ে নানা প্রকার গল্প করতে থাকেন। একজন আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করেন আপনি কবে গিয়েছিলেন (জি ৭ দেশ গুলোর কোন একটিতে হয়তো)? অন্য জনের উত্তর শুনে হয়তো মহা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠেন, আরে বলেন কি? আমিও তো তখন আমেরিকায়, আগে জানলে একসাথে যাওয়া যেত/দেখা করতাম, উহ্ খুব মিস করলাম ভাই, ইত্যাদি। অপরদিকে অপেক্ষাকৃত নি¤œ শ্রেনীর, যারা নিজদেশ বা প্রতিবেশী দেশগুলোর বাহিরে কোথায়ও যায়নি তারা গ্লানিযুক্ত চেহারা করে এদিক ওদিক তাকানো আর চোরা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়েন। এসব আলোচনায় তারা বিশেষ সুবিধা করতে পারেন না। ঘটনা বা দুর্ঘটনাক্রমে আমিও দ্বিতীয় দলটির অন্তর্গত। ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করি তাই ভ্রমণ বিষয়ে আলোচনায় আমার আগ্রহও খুব বেশী, কিন্তু উন্নত দেশ ভ্রমন সংক্রান্ত কোন অভিজ্ঞতা না থাকার দরুন (যদিও বেশীরভাগ উন্নত দেশ ও তাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমার ধারনা বেশ পরিস্কার) অনেক আড্ডাতেই ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও দাঁত বসাতে পারিনা।

দ্বিতীয় শ্রেনীভূক্ত নির্যাতিত শ্রেনীদের বলতে চাই, বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু ইউরোপে অনেকবার গিয়েছেন, থেকেছেন, মানুষের সাথে মিশেছেন। কিন্তু তার লেখাতে নিজ দেশের গুনগানই উঠে এসেছে সবচেয়ে বেশী করে। দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়ায় মতো অসাধারন অথচ সহজ ছড়াটি আমরা নিজেদের মনি কোঠায় জায়গা দিতে পারিনি বোধহয়। নতুবা দূরদেশ ভ্রমণে আমাদের ভিতরে অহংবোধ জন্ম নেয়ার কথা না। আমি ও আমার বড় ভাই (আমরা দু’জনই ভূগোলে ¯œাতোকোত্তর ডিগ্রিধারী) নিজেদের ভিতরে প্রায়ই আলাপ করি, আমরা যদি পেরু বা কলাম্বিয়ায় বেড়াতে যাই তবে যেরকম অনুভূতি হবে ঠিক সেরকম অনুভূতি হয় পেরুবাসীদের, যখন তারা নেপাল, ভারত বা বাংলাদেশে বেড়াতে আসে। বিমান ভাড়া দিয়ে ভ্রমণ আনন্দ বিচার না করে আমাদের উচিৎ আমাদের উপমহাদেশের অসাধারন সুন্দর যায়গাগুলো বেড়িয়ে আসা।
ঠিক এমন একটি যায়গা - দার্জিলিং। পশ্চিম বঙ্গে না হয়ে ইউরোপে হলে এমন যায়গা বেড়িয়ে আসা মানুষের উহু-আহা শুনতে শুনতে আশপাশের মানুষের বিরক্তির চরম হয়ে পরতো। কিন্তু কক্সবাজারের খরচে বেড়িয়ে আসা যায় বলে আমাদের ভ্রমণ তালিকায় কদাচিৎ যায়গা পায় এই অসাধারন যায়গাটি। তবে আজ থেকে বিশ-পঁিচশ বছর আগে অনেকেই শখকরে বেড়াতো যেত এখানে। কারন বোধহয় তখন কোলকাতার সিনেমার নায়ক নায়িকা, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদাদের প্রিয় জায়গা ছিলো এই শৈলশহরটি। দার্জিলিং ভ্রমণ নিয়ে লিখতে বসে অনেক অবান্তর বিষয় লিখে ফেল্লাম। এখন আসল ঘটনায় আসি।

আমাদের দার্জিলিং সফরের পরিকল্পনাঃ
আমার ঘনিষ্ঠ সহপাঠি ও বন্ধু আমান সিলং যাবার ব্যাপারে ভয়াবহ রকমের আগ্রহী ছিলো। ওরা ২০০৬ সালে সিলং এবং চেরাপুঞ্জি ভ্রমণ করেছিলো। আমার ভ্রমণপ্রিয়তার কারনে আমান প্রায়ই বলতো, খোকন চল সিলংয়ে একটা ট্যুর দেই ! গত দু’বছর থেকেই সেই ট্যুর আর আলোর মুখ দেখছিলো না। কিন্তু গত ২০১২র ডিসেম্বরে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিলং ট্যুরটি দার্জিলিংয়ে ট্রান্সফার করে নিয়ে আসা হলো। কারন মেঘালয়ের সিলং শহর অনেক সুন্দর হলেও দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনঙ্ঘা দেখার অভিজ্ঞতা সবকিছুকে পেছনে ফেলে বলে নিশ্চিত হয়েছি আমরা। ডিসেম্বর থেকে অপেক্ষায় ছিলাম চার বন্ধু। ঠিক হলো ভ্রমণটি হলে ব্যাচেলর ট্যুর। পরিবার নিয়ে ভ্রমণ করা অনেক আনন্দের হলেও সব জায়গায় যাওয়া যায়না। এছাড়াও আমরাদের মনের গোপন ইচ্ছা দার্জিলিংয়ের অদূরে পশ্চিম বাংলার সবচেয়ে উচু শৃঙ্গ সান্দাকফূর কাছা কাছি ঘুরে আসা। সান্দাক্ফু ভ্রমণ স¤পূর্ন ট্রেকিংয়ের মাধ্যমে করতে হয়। অথবা ভয়ংকর রাস্তায় ল্যান্ডরোভার জিপ নিয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে ঘুরে আসা যায় তবে সেটা মোটেও আনন্দদায়ক কছু নয়। এসব রাস্তায় জিপের ভিতরে বসে থাকলে মুড়ি মাখানোর সময় মুড়িদের কিরকম কষ্ট হয় সেটা টের পাওয়া যায়। সেধরনের অভিজ্ঞতাও আমাদের হয়েছে, সেকথায় পরে আসছি। যাহোক, গত তিনমাস ধরে আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম দার্জিলিং ভ্রমণের জন্য। ইন্টারনেট ঘেটে আর মানুষের সাথে আলাপ করে সবাই দার্জিলিং ও সন্দাক্ফু ট্রেকপথ বিষয়ে পি.এইচ.ডি. করার পথে ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম। দু’মাসে দার্জিলিং বিষয়ে একটা মোটামুটি ধারনা হয়ে গেল আমাদের চার বন্ধুর মধ্যে তিন জনের। শুধু গোলাম মুকিত জুয়েল ছাড়া। ধীরে ধীরে ভিসা হলো, বাসের টিকেট হলো। ব্যাগ বোচ্কা, জ্যাকেট, প্যান্ট গেঞ্জি কেনা হলো। যথারীতি ২৯শে মার্চ রাত ৮.৩০ শে সবাই চলে আসলাম কল্যাণপুরের শ্যামলী এস.আর. বাস কাউন্টারে। এখান থেকে বি.আর.টি.সির সাথে জয়েন্ট ভেন্চারে শ্যামলী এস.আর. তাদের বাস সরাসরি লালমনিরহাটের বুড়িমারি চেংড়াবান্ধা বর্ডার হয়ে পশ্চিম বঙ্গের শিলিগুরিতে চলাচল করে।


ম্যাপ দিয়ে দেখিয়ে দিলে আপনারা ভালো বুঝবেন। মোটা দাগ দিয়ে দেখানো হয়েছে আমাদের যাত্রাপথ।



চলুন ঘুরে আসা যাক দার্জিলিং ও আশপাশের তিনটি যায়গায় ঃ
২৯.০৩.২০১৩
রাত ৮.৩০, কল্যাণপুরঃ
সময় ছিলো আরো কিছুক্ষণ বাসায় থাকার। শুনলাম বাহিরে প্রচন্ড জ্যাম। আমার বাসা কলাবাগানে। কলাবাগান থেকেও ছোট বাস যাবে কল্যাণপুরে, তারপর মূল বাস ছাড়বে ৯.০০টায় বুড়িমারির উদ্যেশ্যে। বাসায় মন টিকছিলো না। রাত আটটায় রওনা হয়ে গেলাম কল্যাণপুরের দিকে। শ্যামলীতে আমানকে ফোন দিলাম ও কতোদূর জানার জন্য, কো-ইন্সিডেন্ট্লি ও তখন আমার গাড়ির পাশে থাকায় ওকে উঠিয়ে বাস কাউন্টারে পৌছাই ৮.৩০শে।

শ্যামলী বাসের ওয়েটিং রুমে তখন প্রচুর মানুষ। সবাই নাইটকোচের বিভিন্ন রুটের যাত্রি। বাস কাউন্টারে পাসপোর্ট দিয়ে টিকেটে পাসপোর্ট নাম্বার উঠিয়ে নিলাম। নয়টার ভিতরে লিটন ও জুয়েল চলে আসলো। আমাদের ব্যাগগুলো ওয়েটিং রুমে রেখে সবাই বাহিরে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করলাম, পানি কেনা হলো একটা। কিছু ছবি তোলার চেষ্টা হলো, মোবাইল দিয়ে, ফেসবুকে পোষ্ট করার জন্য। আলোর স্বল্পতায় ছবিগুলো ঝাপসা আসছিলো। এতো দাম দিয়ে কেনা মোবাইল কিন্তু ফ্লাস না থাকায় কেঁপে যাচ্ছিলো।

জুয়েল ছাড়া আমাদের মধ্যে সবার একাধিকবার ইন্ডিয়ায় যাবার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলো। বাস ছাড়ার সময় তাই জুয়েলের মধ্যে উত্তেজনাটাও বেশী। এছাড়া আমরা বাকি তিনজন মোটামুটি জানি কোথায় যাচ্ছি, কোথায় থাকবো, কি খাবো আর কোন ধরনের অভিজ্ঞতা হতে পারে। কিন্তু জুয়েল এগুলো নিয়ে আগে মাথা ঘামায়নি এবং হজ্ করতে যাওয়া ছাড়া বিদেশ যাবার প্রথম অভিজ্ঞতা বলা যায়। জায়গাগুলোর নামও ও ঠিক মাথায় নিতে পারছিলো না। অবলিলায় মিরিক কে রিমিক, গোর্খাকে গোখরা বলে যাচ্ছিলো আর আমরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম।

অবশেষে বাস ছাড়লো ৯.৩০ মিনিটে। বাসা থেকে আনা চিকেন নাগেট ও বাস থেকে সাপ্লাই দেয়া কেক মিষ্টি দিয়ে ডিনার সারলাম। সারারাত বিচ্ছিন্ন গল্প, কোথায় কিভাবে যাবো ইত্যাদি নিয়ে পরিকল্পনা করতে করতে মাঝরাত্রে ফুড ভিলেজ রেস্টুরেন্টে পৌছালাম। গরম পরটা আর সব্জি দিয়ে খাওয়া দাওয়া করলাম, সাথে দারুণ চা। আমানের কাছে কমন হিসাব নিকাশের দায়িত্ব দেয়া হলো। সকাল ৭টায় পৌছালাম বুড়িমারি। বুড়িমারি জায়গাটি ছোটখাটো, কিন্তু ছিমছাম। অল্প কয়েকটি দোকান, একটি আবাসিক হোটেল দুটি বাস কাউন্টার এবং বুড়ির হোটেল বলে একটি খাবার দোকান নিয়ে গড়ে উঠা ছোট্ট জনপদ।

বলে নেয়া ভালো বুড়িমারি পৌছানোর আগেই শ্যামলী কর্তৃপক্ষ আমাদের সবার পাসপোর্ট ও সাথে ট্রাভেল ট্যাক্স হিসাবে ৩৬০ টাকা জমা নিয়ে রেখেছিলো। বাস বুড়িমারি পোছানোর পর যাত্রীদের লাগেজ টোকেনের বিপরীতে জমা নিয়ে নেয়া হয়। বাস কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ গাইডলাইনের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন ও কাষ্টমস্ পার হয়ে ভারতের মাটিতে পা দিতে দিতে তিন চার ঘন্টা লেগে যায়। বর্ডার ওপেন হয় সকাল ৯টায়।

সকাল ১১.০০, ৩০.০৪.২০১৩: চেংড়াবান্ধা সীমান্ত।
চেংড়াবান্ধা সীমান্তের ইমিগ্রেশন ও কাষ্টমস্ শেষে শ্যামলী বাসের লোক আমাদেরকে একটি দোকানে নিয়ে গেলো যেখান থেকে আমরা ডলার ও বাংলাদেশী টাকা ভাঙ্গিয়ে ইন্ডিয়ান রুপি করে নিলাম। চেংড়াবান্ধা টু শিলিগুড়ির বাসে উঠতে উঠতে সকাল ১১টা বেজে গেলো আমাদের। বাসের অবস্থা মহা দুর্বল। এসি আছে তবে সিটগুলো খুব নড়বড়ে। সিট নাম্বারের বালাই নেই। যে যেখানে পারে বসে পরেছে। অবস্থা দেখে আমরা পেছন থেকে শেষ দুটি সিটে বসে পড়লাম। জুয়েল ওর সিটের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে পেছনে ঢেলান দেয়ার পর ওর ওজন না রাখতে পেরে সিট মশাই ক্যাচঁ শব্দ করে পুরোপুরি পেছনে হেলে পরলো। সিটের আর কি দোষ, ৯২ কেজি ওজন বেচারার জন্য একটু বেশীই হয়ে গেছিলো বোধ হয়। চেংড়াবান্ধা থেকে শিলিগুড়ি আসতে ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট থেকে ৩ ঘন্ট লাগে। রাস্তার দুপাশের দৃশ্য মোটামুটি বাংলাদেশের মতোই। টিনের চালের বাড়িঘরই বেশী দেখতে পেলাম।


দুপুর ১.৩০, শিলিগুড়ি।
শ্যামলী বাসের কাউন্টারটি যেখানে থামে সেই বিল্ডিংটির নাম সেন্ট্রাল প্লাজা। সেন্ট্রল প্লাজা ভবনটির ঠিকানা হচ্ছে বাসা-৭৬৫, প্রধান নগর, হিল কার্ট রোড, শিলিগুড়ি। দুপুর ১.৩০শে বাস থামার পর প্রথমেই আমরা শ্যামলী বাসের লোকদের সাথে ফিরতি পথের টিকেট বুকিং দিয়ে নেই। তারপর সেন্ট্রাল প্লাজা হোটেলের রেস্টুরেন্টে হাতমুখ ধুয়ে লাঞ্চ সারি। প্লেন রাইসের সাথে মটর পনির, সব্জি, আর ডাল ভাজি (ঘন ডাল) দিয়ে খাওয়াটা ভালোই হলো। দাম একটু বেশী গেল কিন্তু খেয়ে ভালো লাগলো। জুয়েল খাওয়ার সময় কম কথা বলে। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে আধবোজা চোখে তাকিয়ে বললো ভালো খাইলামরে- ধন্যবাদ।


শ্যামলী বাসের কাউন্টার থেকেই সব যাত্রী জিপ ভাড়া করে দার্জিলিংয়ের দিকে রওয়ানা দিচ্ছিলো। বেশ কয়েকজন এজেন্ট/দালাল শ্যামলী কাউন্টারে যাত্রীদের গাড়ী ভাড়া বিষয়ক সেবা দিয়ে থাকে। তবে ওদের কাছ থেকে গাড়ী ভাড়া করলে ভাড়ার পরিমান কিঞ্চিৎ চড়া হয়ে থাকে। এজেন্টদেল মধ্যে দু’একজন আমাদেরও জিজ্ঞেস করছিলো আমরা কোথায় যাব। আমরা সরাসরি দার্জিলিং যাবোনা। আমরা যাবো মিরিক (মিরিক হচ্ছে দার্জিলিংয়ের পশ্চিমে অবস্থিত ছোট্ট একটি শহর)। শুরুতেই পরিকল্পনা অধ্যায়ে বলেছিলাম দার্জিলিং ভ্রমণের আগের দুমাস আমরা এ এলাকার ভ্রমণ নিয়ে মোটামুটি পি.এইচ.ডি মার্কা গবেষনা করেছি। তাই গাড়ির দালালরা যখন মিরিকের ভাড়া ১৬০০ রুপী চাইলো আমরা ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে পিঠে ব্যগ ঝুলিয়ে রাস্তায় নেমে শেয়ারড্ বা পাবলিক জিপ স্ট্যান্ড খুজতে বেড়িয়ে গেলাম। রাস্তায় জিজ্ঞাসা করতে করতে ২০ মিনিটের মধ্যে মিরিক যাবার জন্য নির্ধারিত জিপ স্ট্যান্ডে পৌছে গেলাম। জায়গাটির নাম দার্জিলিং মোড়। সুন্দর একটি মাহিন্দ্রা জিপের সামনে জিপের হেল্পার মিরিক মিরিক করে ডাকাডাকি করছিলো। জিপের পাশের কাউন্টার থেকে আমাদের চার জনের জন্য টিকেট কেটে নিলাম আমরা। ভাড়া প্রতিজন ৯০ রুপি। চারজন ৩৬০ রুপি। রিজার্ভ গাড়ী না নেয়ায় বেচে গেলো ১২০০ রুপী।


আমরা জিপের পিছনের চারটি সিটে ভাগাভাগি করে বসেছিলাম। মাঝের সিটে চারজন এবং সামনের সিটে ড্রাইভারসহ তিনজন। মোট এগারজন একটি জিপে। মালসামানা সব ছাদে বেঁধে দেয়া হলো। শিলিগুড়ি থেকে মিরিক যাবার পথে রাস্তাটি খুব সুন্দর, গাছপালা শোভিত। বেশ কিছুটা পথ সেনানিবাস টাইপের প্রতিরক্ষা এলাকার ভিতর দিয়ে যেতে হয়। ঘন্টাখানেকের মধ্যে রাস্তাটি ধীরে ধীরে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে শুরু করে। জিপের জালানা দিয়ে রুদ্ধশ্বাস দৃশ্যের একের পর এক ছবি তুলতে থাকি আমরা। যদিও জানি আগামি ৫-৬টি দিন অনেক সুন্দর সুন্দর যায়গার ছবি তোলার সুযোগ পাব। তারপরও শিলিগুড়ি থেকে মিরিকের যাত্রাটি আমাদের মনে দাগ কেটে যায়। খাঁদের কিনারাতেও ড্রাইভার যেভাবে জোরের উপর গাড়ি চালাচ্ছিল, আর পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশের প্রথম দিন হওয়াতে আমাদের সবার ভিতরেই বেশ একটি আতঙ্ক কাজ করছিলো।
আমরা মিরিক পৌছাই ৩০/০৪/২০১৩ তারিখ বিকাল ৫ টায়। তখনও দিনের আলো ভালোভাবেই ছিলো। বিখ্যাত মিরিক লেকের কাছাকাছি হোটেলগুলোতে খোঁজাখুজি করে হোটেল রতœাগিরী নামের একটি ছিমছাম হোটেলে চারজনের জন্য বড় একটি রুম ঠিক করা হলো। ভাড়া ১২০০ রুপি। হোটেলের জানালা থেকে মিরিক লেকের দৃশ্য দেখে চারজন মিলে আনন্দে বেশ হইচই করলাম। হোটেলে গিজারের মাধ্যমে গরম পানির ব্যবস্থা ছিলো। এমনিতে ট্যাপের পানি ভয়ানক ঠান্ডা। গিজার দিয়ে পানি গরম করে সবাই গোসল সেরে নিলাম আমরা। বিশ ঘন্টার বিশাল জার্নির পর গোসল করতে ভালোই লাগলো। আমাদের হোটেল থেকে মিরিক লেকের দূরত্ব ছিলো ১০০-১৫০ গজের মতো। অন্ধকার নামার আগে আগে লেকের পাড়ে পৌছে আমরা চারজন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের মতো স্ট্যান্ড লাগিয়ে নিজেদের ছবি সহ লেকের প্রচুর ছবি তুলতে থাকি। বাংলাদেশের চৈত্রের গরম থেকে এসে হঠাৎ শীতকালের মতো ঠান্ডা আবহাওয়ায় আমাদের চারজন ভয়ানক ভালোলাগায় বিহবল হয়ে যাচ্ছিলাম। শুধু মনে পড়ে যাচ্ছিলো এইতো তিন চার ঘন্টা আগেই শিলিগুড়িতে গরমে কি ভিষন কষ্ট পাচ্ছিলাম!!


মিরিক লেকের পিছনে বিশাল পাইন বন । পাইন বনের পিছনে উচু পাহাড়ে হেলান দিয়ে মেঘেদের বিশ্রাম নেয়া দেখাটার অভিজ্ঞতা অসাধারন । লেকের পশ্চিম দিকে পাহাড়ের উপরে সুইস কটেজ নামে একটি রিসোর্ট আছে, সাথে হেলিপ্যাড। পাহাড়টির উচ্চতা লেকের পাড় থকে ৩০০-৪০০ ফিট হবে। মিরিকের অন্য দ্রষ্টব্য বিষয়ের মধ্যে আছে মিরিক মনাস্টারী বা গুম্ফা। মিরিক লেক থেকে দেখা যায়।
ফটোসেশন শেষ হলে লেকের পারের ভ্রাম্যমান খাবারের ছোট দোকান থেকে ভেজিটেবল ম ম (ভাপে সিদ্ধকরা পিঠা জাতিয় খাবার) আর মাসালা চা দিয়ে বিকালের নাস্তা সারলাম। খরচ খুবই সামান্য। ১০০ রুপির মতো খরচ হলো। নাস্তা শেষে হোটেলের দিকে ফিরে সাইবার ক্যাফে খুজতে থাকলাম আমরা। মেইন রোড থেকে একটু ভিতরে একটি সাইবার ক্যাফে পাওয়া গেল। বাসার ড্রইংরুমটিকে সাইবার ক্যাফে হিসেবে তৈরী করে নেয়া হয়েছে। টেলিফোন করার ব্যবস্থা আছে। ফেসবুকে লগইন করে চটকরে যে যার মতো ষ্ট্যাটাস দিয়ে নেই সবাই, এরপর বাসায় ফোন করার চেষ্টা করতে থাকি। একঘন্টা সময় কেটে যায় ফেসবুক ও ফোনালাপে। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে ভারতের মোবাইল কম্পানীর সিম পাওয়া খুবই কঠিন এবং বেশীরভাগ ফোন এ্যাক্টিভেট করতে বেশ কিছুদিন সময় লাগে। ফলে পুরো ভ্রমণে আমাদের পরিবার থেকে আমরা মোটামুটি বিচ্ছিন্ন ছিলাম। ফোনে পরিবারের সাথে কথাবার্তা সেরে সবাই মধ্যে কিছুটা হালকা বোধ হলো সাথে কিঞ্চিৎ মন খারাপও লাগলো। এতো সুন্দর জায়গা অথচ প্রিয় মানুষগুলো কতো দূরে !! তবে পরবর্তী ৪-৫ দিনের পরিকল্পনা মাফিক এডভেঞ্চারের কথা মনে করে মনকে প্রবধ দেই যে বউ বাচ্চা নিয়ে পাহাড় ডেঙানো সম্ভব নয়, তাই মন খারাপ করার কিছু নাই। আগে নিজে দেখে নেই, পরে সবাইকে নিয়ে আবার আসা যাবে। সাইবার ক্যাফে মালিক আলাপ প্রসঙ্গে বলে দিলো রাতে খেতে চাইলে বাঙ্গালী রেস্টুরেন্ট আছে একটা নাম কোলকাতা হোটেল, ওখানে খেতে পারেন। যদিও বিকেলেও মমর স্বাদ মুখে লেগেছিলো তারপরও বাংগালী খাবারের কথা শুনে কেন যেন আমরা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। হোটেলটি (রেষ্টুরেন্ট) খুজে পেতে সমস্যা হলোনা। রাত ৮টা মিরিকের জন্য বেশ অনেক রাত। দোকানপাট রাত ৮টাতেই বন্ধ হয়ে যায়। কোলকাতা হোটেলে তখন কাষ্টমার বলতে কেউ নেই। মালিক মালকিন দুজন টাকা পয়সার হিসেব করছিলো কি নিজেদের মধ্যে টুকটাক আলাপ করছিলো। আমাদের দেখে যাকে বলে মহা উষ্ণ অভ্যর্থনা করে বসালো। আমাদের অবাক করেই বললেন আপনারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেনতো, সেই বিকেল থেকে দেখছি লেকের পাড়ে ঘোরাফেরা করছেন। আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, জানেন? বাংলাদেশ থেকে কেউ আসলে আমার এখানেই খায়। তাই আপনারাও যে আসবেন সেটা আমি ধরেই নিয়েছি। হাঃহাঃ। ভদ্রলোককে আমাদের বেশ আন্তরীক মনে হলো, যদিও একটু বেশী বকেন বলেও মনে হচ্ছিলো। উনি কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন সেটা বললেন, বাংলাদেশী মানুষের আন্তরীকতার প্রশংসা করলেন অনেকবার। আরও বল্লেন আপনাদের মতো আপ্যায়নতো আমরা করতে পারবোনা, আমরা অতো ভালোও নই, জানেন। আমরা বেশ মজা পেলাম ওনার কথার উচ্চারণে। আমাদের মধ্যে লিটনের আসল বাড়ি মুর্শিদাবাদে। ওকে ঘটি বলে সব সময় পঁচানো হয়। কোলকাতা হোটেলের মালিককেও ওর ঘটিভাই হিসেবে চিহিৃত করে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি চালাচ্ছিলাম। খাবার তৈরী করতে ২০-২৫ মিনিট লাগলো, এর মধ্যে হোটেলের মালিক আমাদের দাদা হয়ে গেছেন। আমরা সবাই গদ গদ ভঙ্গিতে দাদা দাদা করছিলাম। খাবার মেনু খুব সাধারন, কাতল মাছ, সাদা ভাত, ডাল, পোস্তের তরকারী আর পাপড়। বড় স্টেইনলেস্ ষ্টিলের প্লেটের মধ্যে তিনটি বাটিতে তরকারী সাজিয়ে খাবার দেয়া হয়েছিলো। খাবার সময় আমান আর জুয়েলকে বেশ বিব্রত মনে হলো, এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো। আমি সব্জির তরকারীটি ভাতে ঢেলে টিবিলে রাখতেই দুজনকে আবার স¦াভাবিক মনে হলো। চট করে তরকারী গুলো ঢেলে ছোট বাটি গুলো টেবিলে রেখে দিলো দুজন। রাতে শোবার সময় ওরা রহস্য উন্মোচিত করলো যে এই প্রথম সাজানো থালিতে ছোট ছোট বাটিতে কেউ ওদের খেতে দিলো, তাই বুঝতে পারছিলোনা যে বাটিগুলো টেবিলে রাখা ঠিক হবে কিনা। যদি এটা আবার এখানকার নিয়মের সাথে না যায়, দাদা আবার কি মনে করবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আর লিটন খুব হাসলাম। না জানলে কতো হাস্যকর বিষয়েও আমরা ভয় পাই। আমান বললো আরে দাদা যে বকবকানি শুরু করছে আমার মাথাই খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। ভাত চাবানো বাদ দিয়ে উনার কথায় উহু আহা করতে করতে আমাদের অনেক দেরী হয়ে গেছিলো। জুয়েলতো খিদে থাকা স্বত্বেও লজ্জায় আর ভাতই চায়নি। দাদা আবার কি মনে করে। বাংলাদেশীরা সব খাদক শ্রেনীর এমন না আবার ভেবে বসে। সব মিলিয়ে চরম ননসেন্স ব্যাপার। রাতে খুব হাসলাম নিজেদের বোকামির জন্য। তবে কোলকাতার দাদা একটা বড় উপকার করেছিলো, তিনি মিরিকের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা সুইস কটেজে কিভাবে উঠতে হয় সেই রাস্তাটা চিনিয়ে দিলেন। আমরা ঠিক করলাম পরদিন সকালে কোলকাতা হোটেলে নাস্তা করে সুইস কটেজের পাহাড়ে উঠবো। দুপুর ১২টায় নেমে এসে মানেভঞ্জনের গাড়ী ধরবো। অর্থাৎ মিরিক ভ্রমনের ইতি টানবো।
এখানে কথার কথায় বলে নেই দার্জিলিং ভ্রমণের সময় সাধারনত পর্যটকরা মিরিকে রাতে অবস্থান করেনা। দার্জিলিং থেকে ফেরার সময় বা দার্জিলিং যাবার সময় দু’তিন ঘন্টার জন্য মিরিকে থামেন। মিরিকের উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ফিট। এটা মুলত উপত্যকা বা ভ্যালি, তাই উচুনিচু কম। আবহাওয়া খুবই আরামদায়ক। পর্যটক সংখ্যা দার্জিলিং থেকে অনেক কম। অনেক নিরিবিলি।

সকাল ৯.০০, ৩১.০৪.২০১৩, মিরিক।


রাতে সবার ঘুমই খুব ভালো হলো। দু’রাতের ঘুম একরাতে সারতে হলো বলেই হয়তো। সকালে উঠে টের পেলাম গলায় ব্যথা। আলজিব ফুলে বেলুনের মতো হয়ে গেছে। ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছিলো বেশ। আমি বেশ ভয় পেলাম কিন্তু সবাই বললো তেমন কিছু না, দুপুরের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। নাস্তা খেয়ে ডাক্তার দেখালেই হবে। আগের রাতের পরিকল্পনা অনুযায়ী কোলকাতা হোটেলে নাস্তা খেতে গেলাম। যেয়ে দেখি দাদা বৌদি তখনও বাসা থেকে নামেননি (উনারা রেষ্টুরেন্টের উপরেই থাকেন)। হোটেলে তখন একটি ক্রেতাও ছিলোনা। আগের রাতে দাদা গল্পে গল্প বলেছিলেন যে তার হোটেলে মানুষ জায়গা দিতে পারেন না মাঝে মাঝে। মানুষ তখন বাহিরে দাড়িয়ে অপেক্ষা করে। কোন মানুষ নাই দেখে আমাদের একটু খটকা লাগলো। তাছাড়া লুচি সব্জির দামও অনেক বেশী লাগছিলো। এখানেই খাবো নাকি খাবোনা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ করার সময় লিটন দেখলাম বেশ লজ্জা পাচ্ছে যে, কাল রাতে বলে গেলাম, না খেলে দাদা আবার কি মনে করবে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত এখানে খাওয়া হলোনা। কারন লুচি ভাজতে ৩০ মিনিট সময় চাইলো রেষ্টুরেন্টের লোকটি। আমরাও এখান থেকে কেটে পরার ছুঁতো খুজছিলাম, পেয়ে যেতেই পগার পার। কোলকাতা হোটেল থেকে বেড়িয়ে লোহিত সাগর নামে স্থানীয় একটি রেষ্টুরেন্টে ঢুকলাম। স্থানীয় বলছি কারন এটির মালিক বা যারা কাজ করছিলো সবাই স্থানীয় গোর্খা সম্প্রদায়ের মানুষ। রেষ্টুরেন্টের ভিতরে প্রায় ৩০-৪০ জন মানুষের বসার জায়গা, কিন্তু মাত্র একজন ৩৫-৩৬ বছরের মহিলা কাজ করছিলো। আমরা আলু পরটা, সব্জি আর আচারের অর্ডার দিলাম। আলু পরটার দাম কোলকাতা হোটেলের চেয়ে কম ছিলো এবং খেতেও খুব ভালো। ৪ জন মিলে ৮টা বিগ সাইজ আলু পরটা সাইজ(!) করে ফেললাম। মোটামুটি ধরনের চা দিয়ে নাস্তার ফিনিসিং দেয়া হলো।


নাস্তা শেষে আমি জুয়েল আর লিটন মিরিক সরকারী হাসপাতালে আমার গলা দেখাতে গেলাম। ভাগ্যক্রমে হাসাপাতালটি আমাদের হোটেলের একদম কাছেই ছিলো। ভাগ্য আরও সহায়তা করলো যখন ওখানের ডিউটি ডাক্তারটি বাঙালী পেলাম বলে। কারন হোটেল থেকেই আমি প্রমাদ গুনছি আলজিবের ইংরেজী বা হিন্দি কি হবে আল্লাহ্ই জানে। আমার সাথে আবার যাচ্ছে দুই বদমাস। ডাক্তারের সাথে আমার আলজিব বিষয়ক আলাপ নিয়ে হাসা হাসি করে বাকি ট্যুরের বারোটা বাজিয়ে ফেলার চান্স ছিলো। যাক বাঙালী ডাক্তার পাওয়ায় আরাম করে পরিস্কার বাংলায় আমার সমস্যাটা বুঝিয়ে বললাম। উনি অভয় দিয়ে বললেন এটা একধরনের কোল্ড এলার্জি, ওষুুধ খেলে সেরে যাবে। তিন ধরনের ওষুধ দিয়ে একটি প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন। হোটেলে আসার পথে ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ গুলো কিনে নিলাম। এবং হোটেলে ফিরে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ খেয়েও নিলাম।
সকাল ১০.৪৫, মিরিক।
নাস্তা খাওয়া দাওয়া শেষে কোলকাতার হোটেলের দাদার দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী মিরিক লেকের পশ্চিম পাশ দিয়ে সুইস কটেজের পাহাড়ে উঠা শুরু করি আমরা। পাহাড়টির উচ্চতা ৩০০/৪০০ ফিট হলে কি হবে শুরু থেকেই এতো খাড়া রাস্তা যে আমাদের বেশ কষ্ট করেই উঠতে হচ্ছিলো। পাহাড়ের গায়ে ঘন পাইন বন। ফাঁকা জায়গাগুলো ছোট ছোট ঝোঁপ এবং পাহাড়ী ফুলে ভরা। নিচে মিরিক লেক আর অপর দিকের পাহাড়ে মিরিক শহরের একাংশ দেখতে ভালো লাগছিলো বেশ। ছবি তুলতে তুলতে আর ভিডিও করতে করতে যখন আমরা কটেজের কাছে পৌছালাম তখন দেখি সেটা পেছনের গেট এবং ভিতর থেকে তালা মারা। পুরো কমপ্লেক্সটিতে কোন মানুষ দেখতে পেলাম না। কটেজগুলোতে বাঁশ লাগানো দেখে বুঝলাম বিল্ডিংগুলো মেরামত করা হচ্ছে। চারজন এক হয়ে দেয়ালের পাশ দিয়ে হেটে প্রধান দরজার কাছে এসে দেখি অপূর্ব সুন্দর মিরিক লেক ও চারিদিকে ছড়ানো পাইন গাছের সাড়ি। যদিও বেশ কড়া রোদ ছিলো কিন্তু পাহাড়ের উপরে ঠান্ডা বাতাসে আরাম লাগছিলো। স্ট্যান্ড লাগিয়ে সবাই ক্যামেরা বের করে আমাদের ফটোগ্রাফি চর্চা শুরু করে দিলাম।


ক্যামেরার অটো অপসন দিয়ে নিজেদের পোজ দেয়া গ্রুপ ছবিও তোলা হলে বেশ কটি। সুইস কটেজের থেকে আরেকটু উপরে মিরিক হেলিপ্যাড। সম্ভবত সুইস কটেজের জন্য এই হেলিপ্যাড ব্যবহৃত হতো এক সময়। নামতে ইচ্ছা না করলেও দুপুর ১২.৩০ মিনিটে পাহাড় থেকে নেমে আমি আমরা। হোটেলে ফিরে চেক্ আউট করে আবার সকালের রেষ্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে নেই। ভাতের সাথে ভেন্ডিভাজি, মটর পনির আর ঘন ডাল। জুয়েলের তৃপ্তিভরা মুখ প্রতিবার খাবার পর পরই দেখতে পাচ্ছিলাম। বলতে ভুলে গেছি, সকালের নাস্তাটি ওর এতো পছন্দ হয়েছিলো যে ও সবাইকে থ্রেট দিলো - বিদেশে আসছি, বিদেশী রেষ্টুরেন্টের বিদেশী খাবার খাবো। বাঙালী খাবারের নাম করলে তোদের খবর আছে। এবং যথারীতি আলহামদুলিল্লাহ ভালো খাইলাম-ধন্যবাদ, ইত্যাদি। পাহাড় থেকে নেমে আসার সময় কোলকাতা হোটেলের দাদার সাথে দেখা করে আসলাম। দাদা একটু খোঁচাও দিলেন ওনার লোক বলেছে আমরা নাকি লুচি ভাজির দাম শুনে পালিয়ে গেছি। ভুল ভাঙ্গিয়ে ওনার সাথে গ্রুপ ছবি তুলে বিদায় জানিয়ে আসি আমরা।
লাঞ্চ শেষে মিরিক যাত্রার সমাপ্তি। এবারের গন্তব্য দুর্গম পাহাড়ী গ্রাম মানেভঞ্জন। মিরিক থেকে মানেভঞ্জন যেতে হলে গাড়ি রিজার্ভ করতে হয়। ভাড়াও অনেক বেশী, কারন আসার সময় গাড়িটি খালি আসবে। দেখলাম অন্য আরেকটি অপশন আছে। মিরিক থেকে দার্জিলিং বাসে উঠে সুখিয়াপোখরি নামে একটি জায়গায় নেমে পরতে হবে আমাদের। সুখিয়াপোখরি থেকে মানেভঞ্জন ৭-৮ কিলোমিটার পথ। গাড়ি না পাওয়া গেলে হেটেই চলে যাব বলে ঠিক করলাম আমরা। আমাদের দার্জিলিং ভ্রমণের শুরুটি মিরিক দিয়ে, তাই মিরিক আমাদের স্মৃতির মনিকোঠায় স্থান পাবে সব সময়ই। তবে মিরিক ছাড়ার একদিন পড়েই বুঝলাম মিরিক ছিলো হেভী ডিনারের এ্যপেটাইজারের মতো। আসল এডভেঞ্চার সামনের দিনগুলোতেই বেশী হলো, এমনকি বাংলাদেশে মধ্যে দিয়ে ফেরার সময়।
আগামী চারটি পর্বে আমার ভ্রমণ কাহীনিটির বিস্তারিত দেয়া হবে।

Click This Link

সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৩:৫৫
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×