somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হিন্দু ধর্মের বিবর্তনের ইতিহাস

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এই লেখাটা আমার হিন্দু ধর্মের বিবর্তনের ইতিহাসের উপর একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস | কেন এই প্রয়াস ? এর কারণ হলো আমি যখন রামায়ন মহাভারত পুরাণে হিন্দু ধর্ম দেখি তখন তার সাথে আজকের প্রচলিত হিন্দু ধর্মের মিল খুঁজে পাই না | দুটো যেন দুই মেরুর বাসিন্দা বলে মনে হয় | কিন্তু কেন এই অসামঞ্জস্য ? আমার মনে হয় যে মহারাজ পরিক্ষিতের সময় থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন জাতি ভারত শাসন করেছে | বৈদিক ধর্মের সাথে হিন্দু ধর্মের যা কিছু পার্থক্য আমি দেখতে পাই , আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওই জাতিগুলির শাসনকালের মধ্যেই তার রহস্য লুকিয়ে আছে | অন্যভাবে বলতে গেলে ওই শাসনকারী জাতিগুলিই বৈদিক ধর্মে বিবিধ পরিবর্তন করে তাকে আজকের হিন্দু ধর্মে পরিনত করেছে | বলা বাহুল্য যে হিন্দু শব্দটা আমি পুরাণে মহাভারতে বা রামায়নে পাই নি | মনুসংহিতাতেও পাইনি | ইটা সম্পূর্ণ বিদেশী শব্দ | সেই জন্যই আর মূলত “রাজার ধর্মই লোকধর্ম হয়” এই প্রবাদ বাক্য মেনে আমার সন্দেহ ওই শাসনকারী বিদেশী জাতিগুলির উপর রয়েছে | এই লেখায় আমি দেখব এবং দেখাবো যে ওই জাতিগুলি কিভাবে বৈদিক ধর্মকে হিন্দু ধর্ম বানালো |

ভারতে শাসনকারী জাতির টাইম লাইন

বৈদিক যুগ শেষ হয় পরিক্ষিতের রাজ্যকালের শেষে | এই সময় অবধি বৈদিক ধর্ম তার ফুল ফর্মে বিদ্যমান ছিল | প্রথমে এই বৈদিক ধর্মের কিছুটা পরিচয় দেই তাহলে পরিবর্তনটা বুঝতে সুবিধে হবে |

বৈদিক ধর্ম মূলত যজ্ঞ প্রধান | যজ্ঞই ছিল প্রধান কর্ম | মুর্তিপুজা ছিল গৌন | গ্রামে দেবালয় ছিল | দেবালয়ে মূর্তি ছিল | মূর্তিপূজক ব্রাহ্মনদের স্থান নিচে ছিল | যজ্ঞকারী ভ্রাম্যমান ব্রাহ্মন ব্রহ্মস্বরুপ ছিলেন বলে তাঁর স্থান উচ্চে ছিল | অবশ্য বেদে যজ্ঞের চেয়েও শ্রেষ্ঠ কাজ ছিল | অহিংসা, সত্য , অক্রোধ, দান : এই চার ধর্ম ছিল সনাতন ধর্ম | অগস্ত্য মুনি, ভীস্ম পিতামহ , দেবাদিদেব মহাদেব, বেদব্যাস , ভরদ্বাজ, শ্রীকৃষ্ণ ইত্যাদি মহাপুরুষরা এই সনাতন ধর্মকে বেদ ও যজ্ঞের চেয়েও অধিকতর শ্রেষ্ঠ বলেছেন | যজ্ঞের মধ্যে হিংসামূলক ক্ষত্রিয় জ্যোতিস্তম আদি যজ্ঞ আছে | আর অহিংসামূলক অগ্নিহোত্র, চাতুর্মাস্য, আদি যজ্ঞ আছে | এর মধ্যে অহিংসামূলক যজ্ঞ শ্রেষ্ঠ কারণ এতে ব্রহ্মপ্রাপ্তি হয় আর হিংসামূলক যজ্ঞ নিকৃষ্ট কারণ এতে স্বর্গাদী পাওয়া যায় | সংক্ষেপে এই ছিল বৈদিক ধর্ম | কুসংস্কার খুবই কম ছিল এই ধর্মে | বৈদিক যুগে মূলত এই ধর্ম ছিল ও নাস্তিক্যবাদ ছিল যার স্রষ্টা ছিলেন চার্বাক |

ভারতে পরিক্ষিতের পর বৌদ্ধযুগ শুরু হয় | তারপর গ্রিক যবনদের শাসনকাল শুরু হয় | তারপর শ্বেত হুন ও কুষাণ দের রাজত্ব আসে | এর পর রাজপুতদের রাজত্বকাল আসে | তারপর মুঘলদের রাজত্বকাল আসে | এবং সবশেষে ব্রিটিশদের রাজত্বকাল আসে | মোটামুটি এই হলো ভারতে বিদেশী জাতিগুলির শাসনের টাইম লাইন |

এইবার দেখা যাক যে এই বিদেশী জাতিগুলি আমাদের কতগুলি কুসংস্কার দিয়েছে |

১] বৌদ্ধ যুগ

এই যুগে দুটি যুযুধান ধর্ম ভারতবর্ষে ছিল | ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম | তখনও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম (যার আরেক নাম বৈদিক ধর্ম ) যজ্ঞ প্রধান ছিল | বৌদ্ধদের রাজত্বে ব্রাহ্মনদের অতি দুর্দশা এসে উপস্থিত হয় | বিম্বিসার বৌদ্ধ ছিলেন | তাঁর আমলে ব্রাহ্মনদের উপর কিরূপ অত্যাচার হয় এবিষয়ে ইতিহাস নীরব | ব্রাহ্মনেরা অহিংস বৌদ্ধ রাজাদের অত্যাচারের ভয়ে নেপাল তিব্বত ইত্যাদি স্থানে পালাতে বাধ্য হয় | তবু তখনও অব্দি বৈদিক তথা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম যজ্ঞ প্রধান ছিল | তবে জাতপাতের নিয়ম অতি কড়া হয়েছিল বৌদ্ধদের থেকে নিজেদের আলাদা করার জন্য |

বৌদ্ধ ধর্ম চীন তিব্বত অব্দি গিয়েছিল | সেখান থেকে বুদ্ধ ধর্ম ভারতে আমদানি করলো চীনা ও তিব্বতী কুসংস্কার যা পরে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে যুক্ত হয়েছিল তন্ত্রের নামে | চীনা তাও ধর্ম আর তিব্বতী বোন্ ধর্মে ধর্মের নামে যৌনাচার প্রচলিত ছিল | আজও বহু তাও ধর্মিকে যৌনাচার করতে দেখা যায় | এই ধর্মীয় যৌনাচার বৈদিক ধর্মে তন্ত্র হিসেবে যুক্ত হলো | মহা চিনাচার তন্ত্র, কৌল তন্ত্র, লিঙ্গ তন্ত্র , যোনি তন্ত্র, সহজিয়া সাধনা ইত্যাদি সমস্ত কিছুই ধর্মের নামে যৌনাচারের আখড়া যা চীন ও তিব্বত থেকে বৌদ্ধ ধর্মের আমদানি | এইসব তান্ত্রিকরা শিব ও পার্বতীর কথোপকথনের মধ্য দিয়ে বলে যৌনাচার করলেই নাকি মোক্ষ পাওয়া যায় | অথচ বৈদিক ধর্মে মোক্ষ পাওয়ার উপায় হলো জগতের উপর সমস্ত বাসনা ত্যাগ | সুতরাং পূর্বোক্ত যৌনাচারের পথটি বেদসিদ্ধ নয় |

এই যৌনাচারের অনেক মুদ্রা তন্ত্রে পাওয়া যায় | বজ্রলি, অমরলি, সহযোলি ইত্যাদি মূদ্রাতে বীর্যপাত রোধ করে যৌনাচার করা হয় | এতে নাকি মোক্ষ পাওয়া যায় | এই মুদ্রাগুলির সাথে তাও ধর্মীয় রীতিনীতির সাদৃশ্য পাওয়া যায় | তাই একথা মনে করা অনুচিত নয় যে তাও ও বোন্ ধর্ম থেকে এই যৌনাচার বৈদিক ধর্মে তন্ত্র নামে যুক্ত হয়েছে | আরো একটা লক্ষনীয় বিষয় হলো যে এই তন্ত্রগুলোতে রচয়িতার কোনো নামধাম পাওয়া যায় না | কিন্তু সমস্ত বৈদিক সাহিত্যে রচয়িতার নাম আছে যেমন আঠারোটা পুরাণ ও মহাভারত বেদ ব্যাস রচনা করেছেন , রামায়ন বাল্মীকির রচনা , বেদের বিভিন্ন শ্লোকের রচয়িতা ঋষিদের নাম আছে |কিন্ত এই যৌনাচার তন্ত্রের রচয়িতার নামধাম পাওয়া যায় না | এ থেকে অনুমান করা যায় যে এগুলি বৈদিক সাহিত্য নয় | রচয়িতার নাম দেয়া হয় নি : হয়ত কোনো গভীর কারণে | হয়ত রচয়িতার প্রানের ভয় ছিল | হয়ত রচয়িতা জানত যে এইসব বেদবিরোধী কার্যকলাপের সাথে তার নাম এলে তাকে প্রাণে মারা হতে পারে | এইসব কারণে আমি মনে করি যে এই যৌনাচারগুলি কুসংস্কার মাত্র এবং বিদেশী জাতি থেকে আমদানি করা | আজও এই হিন্দু ধর্মে তন্ত্র্রের নামে যৌনাচার দেখা যায় |

এই বিদেশী কুসংস্কারটি বৌদ্ধ ধর্মকেও ছাড়ে নি | শুদ্ধ বৌদ্ধ ধর্ম থেরবাদ বা হীনযান-এ এই যৌনাচার নেই | মহাজানে কিঞ্চিত আছে আর বজ্রজানের সবটাই যৌনাচার | সুতরাং বৌদ্ধ ধর্মের কম ক্ষতি করেনি এটা |

এই আমলে নীলতারা, কালচক্র, কালভৈরব ইত্যাদি বহু কাল্পনিক দেবদেবীর আমদানি হয় | এইগুলি তিব্বতী-চীনা ও হিন্দু ধর্মের মিশ্রণে তৈরী | এইসব দেবদেবীর সামনে ঐসব যৌনাচার হত |

আসলে ভারতের পুরো ইতিহাসটাই ইসলামিক পিরিয়ডের আগে পর্যন্ত হিন্দু আর বৌদ্ধ ধর্মের মারামারির ইতিহাস | যবনরা শুধু উত্তর পশ্চিম ভারত শাসন করেছিল | সমগ্র ভারতে তাদের প্রভাব খুবই কম | বৌদ্ধ রাজা অশোকের শাসনকালে বৌদ্ধ ধর্ম সারা ভারতে ছড়িয়েছিল | শুধু দক্ষিন ভারতের কিয়দংশ যেমন কেরালা ও তামিলনাড়ু হিন্দু ছিল |

অশোকের পর বিম্বিসার ছিলেন বৌদ্ধ আর তার পুত্র অজাতশত্রু ছিলেন হিন্দু | অশোকের রাজত্বকালেই কত বৈদিক পুঁথি যে নষ্ট হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই | এই সময়েই বৈদিক ধর্ম অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় | অশোকা বাদন বলে বিনয় পিটকের অন্তর্ভুক্ত একটি গ্রন্থে লেখা আছে যে এক জৈন একবার একটা ছবি এঁকেছিল | সেটার বিষয়বস্তু হলো বুদ্ধ এক জৈনগুরুর চরণে মাথা নত করেছে | অশোক সেটার খবর পেয়ে জৈনদের হত্যার নির্দেশ দেয় | প্রায় ৫০,৬০ জন জৈন ওই দিনেই মারা যায় | এই গল্প থেকে অশোকের অহিংসার অনেক উদাহরণ পাওয়া যায় | যে অশোক শুধু ছবি আঁকার অপরাধে ৫০,৬০ জন জৈনকে একদিনে মেরে ফেলতে পারে , সে হিন্দুদের সাথে কি করেছে তার অনুমান সহজেই করা যায় | কত হিন্দু মেরেছে, কত পুঁথি পুড়িয়েছে, কত সংস্কৃত পাঠশালা শেষ করেছে, কত মন্দির ধ্বংস করেছে , কত হিন্দুকে বৌদ্ধ বানিয়েছে, তার হিসাব পাওয়া যায় না | এই ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে আজকে যেখানে বৌদ্ধ স্তুপ আছে তার তলায় নিশ্চিত ভাবেই আমরা হিন্দু মন্দিরের ধংসস্তুপ পাব | খুঁজে দেখতে হবে |

অশোকের সময় হিন্দু ধর্ম প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছিল | যেভাবে অশোক বৌদ্ধ ধর্ম স্থাপন করেছিল , সেইভাবে বৌদ্ধ ধর্ম তিব্বতে চালু হয়েছিল | স্থানীয় বোন্ ধর্মকে শেষ করে দিয়ে, বোন্ ধর্মের উপাসক তিব্বতের শেষ বোন্ রাজা ল্যাং দার্মাকে হত্যা করে বৌদ্ধ ধর্ম চালু হয় তিব্বতে | এইসব কথা অতীশ দীপঙ্করের উপর লেখা একটি নাটকে পাওয়া যায় |

অনেকে বলতে পারেন যে অশোক তো তার শিলালিপিতে লিখে গেছিলেন যে সমস্ত ধর্মের প্রতিই তিনি সহিষ্ণু | তা সেরকম কথা তো আজকের নরেন্দ্র মোদির সরকারও বলছে | কিন্তু কাজে করছে কি ? ওই রকম কথা শিলালিপিতে না বললে রাজ্যে লোক আসা বিশেষ করে বনিকদের আসা বন্ধ হয়ে যাবে | তাতে রাজ্যের রাজস্বের ক্ষতি হবে | তাই অমন বলা |

২] যবনদের শাসনকাল

যবন বলতে শুধু গ্রিকদের বোঝায় না , পার্সি, শক, কুষাণ এদের বুঝায় | আমি ছোট করে যবন বলছি | যবনরা উত্তর পশ্চিম ভারত শাসন করত | এই জায়গায় তক্ষশিলা বিদ্যালয় ছিল যা সেই সময়ে খুবই বিখ্যাত শিক্ষাপীঠ ছিল | এই স্থান যবনদের অধিকারে যায় এবং এই বিদ্যালয়েই বৈদিক ধর্মে যবন কুসংস্কার ঢোকে | পরে তা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে |

আজকে ভারতের উত্তর পশ্চিমে যে হিংস্র জাতির অস্তিত্ব আছে তারা ওই যবনদের বংশধর, দো আশলা মাত্র | এ থেকেই ওই যবনরা কেমন ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় |

৩] রাজপূত ও হিন্দু রাজাদের শাসনকাল

এই সময়ে হিন্দু রাজাদের উত্থান শুরু হয় | মৌর্য সাম্রাজ্যের শেষ রাজাকে মেরে তার মন্ত্রী পুষ্যমিত্র শুঙ্গ শুঙ্গ বংশের শাসন চালু করেন | তিনি হিন্দু ছিলেন | দিব্যবাদন নামক বৌদ্ধ গ্রন্থ যা বিনয় পিটকের অন্তর্ভুক্ত তাতে লিখা আছে কিভাবে শুঙ্গ রাজারা বৌদ্ধদের হত্যা করেন | লক্ষ লক্ষ বুদ্ধের শিরচ্ছেদ করেন | অসংখ্য বৌদ্ধ স্তুপ ধ্বংস করেন | আজ যতগুলো হিন্দু মন্দির আছে মধ্য ও পূর্ব ভারতে , বাজি রেখে বলতে পারি তাদের ভিতের তলায় বৌদ্ধ স্তুপের অবশেষ পাওয়া যাবে | খুঁজে দেখতে হবে |

একই কাজ করেছিল সাতবাহন বংশের রাজারা | তারা পশ্চিম ভারতে একই সময়ে রাজত্ব করত | এটা অনুমান করাই যায় | এই সময় পুনরায় বৌদ্ধরা প্রাণে বাঁচতে হয় পালিয়ে যায়, নয়তো হিন্দু হয়ে যায় | কিন্তু আগেই বলেছি যে অশোকের সময় হিন্দু ধর্ম প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছিল | শুধু পুরানগুলো আর মোক্ষ শাস্ত্র বাকি ছিল | তো সেইগুলি আবার সামনে এলো | আজকে বৈদিক সাহিত্যের অনেক কিছু পাওয়া যায় না , তার একটা কারণ এই যে বৌদ্ধ অশোক সেগুলি ধ্বংস করেছিল | এই সময় পুরোহিতেরা পুরোপুরি রাজশক্তির ওপর নির্ভরশীল ছিল | রাজারা যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল পুরোহিতেরা তাতে রাজার মনপসন্দ উপাসনা পদ্ধতি চালু করেছিল |
এইভাবে একটু একটু করে বৈদিক সাহিত্য শেষ হয়ে যাচ্ছিল আর সেই জায়গায় ভুইফোর হিন্দু রাজাদের তৈরী কুসংস্কার স্থান করে নিচ্ছিল | মন্দিরে দেবতার সামনে বলি খুব সম্ভব এইসব রাজারাই চালু করেছিলেন | দরকার কিছু প্রমানের |

আরেকটি কুসংস্কার হলো দেবীপুজা | বেদে কোথাও দেবীপুজা প্রাধান্য পায় নি | সেখানে ৩৩ জন দেবতার পুজো হত | তাহলে এই দেবীপুজা কোথা থেকে এলো যা ভারতের সর্বত্র দেখা যায় ? রানী রাসমনি দেবী দক্ষিনেশ্বর মন্দির করে কালী পূজা চালু করেছিলেন | এই উদাহরণ ধরে বলা যায় যে বিভিন্ন সামন্ত রাজারা বিভিন্ন সময় দেবীপুজা চালু করেছিলেন | তাদের খুশি করতে ব্রাহ্মনেরা কাল্পনিক পূজার ব্যবস্থাদি দিয়েছিল | বিদ্যাসাগরের রচনাবলীর মধ্যে “অতি অল্প হইলো”, “আবার অতি অল্প হইলো” আর “ব্রজবিলাস” ইত্যাদি রচনায় দেখা যায় যে কিভাবে স্মার্ত ব্রাহ্মনেরা ধনী লোকেদের খুশি করতে উল্টোপাল্টা বিধান দিচ্ছেন | এই একই পরম্পরা গোটা ভারতে চলছিল | যেহেতু এইগুলি বেদের বিকৃতি অথবা বিশুদ্ধ কল্পনা , সেহেতু এগুলোকে আমি কুসংস্কার বলব | দেবীর সামনে বলিও এরাই চালু করেছিল |

কিছু কাল্পনিক দেবদেবীর উদাহরণ দেয়া যাক | একজন দেবী হলেন আশাপুরা মাতা | তিনি গুজরাটের রাজপুতদের কুলদেবী | বেদে তাঁর কোনো উল্লেখ নাই |

আরেকজন হলেন আম্মাভারু | ইনি হলেন সেই মাতা যিনি ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশকে সৃষ্টি করেছেন | আম্মা মানে হলো মা | ইনি দক্ষিন ভারতে , বিশেষ করে কর্নাটকে পূজা পান | বেদ কিন্তু এইজাতীয় নারীর সমর্থন করে না | আমার মনে হয় সমর্থন করা যুক্তিযুক্ত নয় | কারণ ব্রহ্মাই বিষ্ণু আর মহেশকে সৃষ্টি করেছেন এইরকম বেদে বলা আছে | দ্বিতীয়ত : যিনি ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করবেন তাঁর কোনো আকার থাকার কথা নয় কারণ ব্রহ্মাই হলেন সৃষ্টির প্রথম আকারবান জীব | বেদ সৃষ্টির পূর্বে যে নারায়নের উল্লেখ করেন তিনি নিরাকার | তাহলে আম্মাভারুকেও নিরাকার হতে হবে | কিন্তু তিনি সাকার | এই বঙ্গের কালীরও একই দুর্দশা | রামপ্রসাদ তাঁকে বলেছেন ব্রহ্মান্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথা পেলি | এতেই বুঝা যায় যে কালী নিরাকার নন | সাকার | অতএব তিনি আদিভুতা সনাতনী হতে পারেন না | রামপ্রসাদের গানের মধ্যে স্ববিরোধ আছে | তিনি কালীকে একবার শুন্যরুপা বলেছেন আবার শশিভালি বলেছেন | তিনি যদি শুন্যই হবেন তাহলে তার কপালে চাঁদ কি করে হবে ? এছাড়াও কালী সাকার দেবী , তিনি নিরাকার নন | এইগুলি আমার মনে হয় অবৈদিক ব্যাপার স্যাপার | আরো দেখুন কালীপুজায় ছাগবলী হয় | যিনি আদিভুতা ও সনাতনী তিনি যদি ছাগের রক্ত ও মাংসতে খুশি হন , তাহলে মহাপ্রলয়ের পর তার মনোরঞ্জন করবে কোন ছাগ ? বেদে আদিপুরুষ সনাতন নারায়নের একমাত্র পূজা হলো ধ্যান | কোনো বলির গল্প নেই | সুতরাং এইসব পূজাকে কষ্টকল্পনা বললে মনে হয় না যুক্তিহীন কথা হবে | আম্মাভারুর পূজা চালু করেছিলেন ভিজিয়ানাগারাম রাজ্যের রাজা পুষ্পাতি পেডা বিজয় রাম রাজু ১৭৬০ সালে | এই দেবীকে নিয়ে অনেক গপ্প আছে কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট ইতিহাস নেই | কোনো গল্পে দেবী হলেন রানীর বোন, কোনো গল্পে তিনি হলেন গ্রামদেবতা | আরেকটা কুসংস্কার |

আরেকজন দেব হলেন আয়াপ্পান | দক্ষিন ভারতে পূজিত | ইনি নাকি হরিহরের সন্তান | হরি আর হর এক দেহে যুক্ত হয়ে এনাকে উত্পন্ন করেছেন | এটি বাস্তবিকই অসম্ভব ব্যাপার | দুজন পুরুষ তৃতীয় আরেক পুরুষকে জন্ম দিতে পারেন না | বেদে বা পুরাণে কোথাও এই দৃষ্টান্ত নেই | সুতরাং এটা বিশুদ্ধ কল্পনা |

তিরুপতি আরেক কাল্পনিক দেবতা | তিনি চোখ বেঁধে বসে আছেন এই ভয়ে যে চোখ খুললেই প্রলয় হবে | তিনি নাকি নারায়নের রূপ | বেদে কোথাও এমন রূপের বর্ণনা নেই | বেদের চতুর্ভুজ নারায়ণ চোখ বন্ধ করে নেই আর তিনি চোখ খুললে প্রলয়ও হয় না | আর যদি আদিপুরুষ নারায়নের কথা বলা যায় তো তিনি নিরাকার , তাঁর চোখও নেই , বাঁধার প্রশ্নই ওঠে না | অথচ এই কাল্পনিক দেবতার মন্দিরেই কোটি কোটি টাকার ভেট চড়ে | গরিবরা না খেয়ে মরে | বলা বাহুল্য এই তিরুপতির পূজা চোল , চালুক্য ও বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজারা চালু করেছিলেন | তাছাড়া এই দেবতার উত্পত্তির গপ্পও বড় অদ্ভুত | মহর্ষি ভৃগু নাকি বৈকুন্ঠলোকে নারায়নের দর্শনে যান আর তাঁর পায়ে নাকি একটা চোখ ছিল , সেটা তাঁর অহংকার ছিল | বিষ্ণু নাকি সেই চোখ খুবলে নেন | তখন তাঁর ঈশ্বর দর্শন হয় | সেই ঈশ্বরই নাকি তিরুপতি | এইরকম নানা হাবিজাবি কাহিনী | পুরাণে বা বেদে এসব দেখা যায় না |

আরেক কাল্পনিক দেবী হলেন বহুচারা মাতা | ইনি হিজরেদের দেবী | ইনি নাকি মানুষ ছিলেন, মরে দেবী হয়েছেন | ভুত যে হন নি এই যথেষ্ট | এঁর পূজা না করলে নাকি ইনি হিজড়ে বানিয়ে দেন | সত্য মিথ্যা জানি না | বেদে এইরকম দেবীর উল্লেখ কোথাও পাই না | এঁর মন্দিরে অসংখ্য পশুবলি হয় |

শাকম্ভরী দেবীর পূজা পুন্দির রাজপুতেরা শুরু করেছিল | এঁর দুটি মন্দির আছে : উত্তর প্রদেশে একটি আর রাজস্থানের জয়পুরে একটি | বলা বাহুল্য ইনিও কাল্পনিক | এই হিন্দু পর্বেই ভারতের বহু কাল্পনিক দেবদেবীর জন্ম যারা আজও পূজা পেয়ে থাকেন |
এইসব কাল্পনিক দেবদেবীদের উপস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে যে হিন্দু ধর্মে কুসংস্কারের মূলটা কতটা গভীর | আর বৌদ্ধদের সময় হিন্দু ধর্ম সত্যি সত্যই শেষ হয়ে গেছিল |

এছাড়া ম্লেচ্ছ রাজারাও হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস করেছিল | কলহনের রাজতরঙ্গিনীতে আমরা হর্ষরাজা বলে এক ম্লেচ্ছ রাজার নাম পাই যিনি কাশ্মীরের হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরগুলি লুটপাট ও ধ্বংস করেছিলেন | এনার মত ম্লেচ্ছ রাজারাও হিন্দু ধর্মের প্রভূত ক্ষতি সাধন করেন | ইনি দেবত্পাটন নায়ক নামের এক রাজকর্মচারীর সৃষ্টি করেছিলেন | নামেই বোঝা যায় তাঁদের কাজ কি ছিল |

বর্তমানে নেপালে এক প্রসিদ্ধ দেবী আছেন | নাম গাধিমাই | এনার কথা না বললে অন্যায় হয় | প্রতি ৫ বছর অন্তর এনার মন্দিরে অসংখ্য নিরীহ পশু বলি হয় | আজকের সুসভ্য দেশের পক্ষে এটা একটা কলঙ্ক | তাই এনার ইতিহাস একটু শোনা যাক | আজ থেকে ২৬০ বছর আগে ভগবান চৌধুরী নাম এক সামন্ত রাজা মাক্বানপুর জেলে বন্দী ছিল | সে একরাতে স্বপ্ন দেখল যে যদি সে গাধিমাই মন্দিরে বলি দেয় তাহলে তার সব সমস্যার সমাধান হবে | জেল থেকে বেরিয়ে সে এক গ্রামের ওঝার পরামর্শ নেয় আর পশুবলি চালু করে | এইসব কুসংস্কার বৈদিক ধর্মকে হিন্দু ধর্ম বানিয়েছে |

আরেকজন দেবী হলো সন্তোষী মা | ৫০ এর দশকে এনার সিনেমা হয় | তারপরে এনার পুজো চালু হয় | আগে এনার পুজো ছিল না | ইনিই ছিলেন না |

আরেক নামজাদা দেবী হলেন বৈষ্ণ দেবী | ইনি আসলে মহালক্ষীর রূপ | এনার সাথে মন্দিরে ৩৩ কোটি দেবতা থাকেন | সত্য মিথ্যা জানি না | প্রতি বছর ১০ কোটিরও বেশি ভক্ত এনার দর্শনে যায় | অনেক মুখরোচক গপ্প জড়িয়ে আছে | এক গপ্প বলে রামচন্দ্র নাকি দেবী বৈষ্ণবিকে ত্রিকুট পর্বতে থাকতে বলেছিলেন | গোটা রামায়নে এরকম কোনো গপ্প নেই | আরেক গপ্পের মতে পান্ডবরা এই মন্দির তৈরী করেন | মহাভারতেও এমন কোনো গপ্প নেই | পপুলার গপ্পটা হলো শ্রীধর পন্ডিতের | ইনি একজন শাক্ত ছিলেন | ত্রিকুট পাহাড়ের তলায় আজকের কাটরা শহরে বাস করতেন | বৈষ্ণ দেবী তার স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাকে এক ভান্ডার আয়োজন করতে বলেন | সেই ভান্দারায় খাওয়ানোর দায়িত্বটা বৈষ্ণ দেবীই নিজেই নেন | এর পরে এটাকে কুসংস্কার ছাড়া কি বলব | শাক্তরা বৈদিক ধর্মের বারোটা বাজিয়েছিল |
বাকি সমস্ত কাল্পনিক দেবদেবীর পূজা কোনো না কোনো রাজা গজা চালু করেছিল | স্থানাভাবে বলতে পারলাম না | যেহেতু এগুলো কাল্পনিক ছিল সেহেতু এগুলির কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই | এইসব কাল্পনিক পূজা আর অজস্র কুসংস্কার বৈদিক ধর্মের বারোটা বাজিয়েছিল | এতে আরো ইন্ধন যুগিয়েছিল মুসলিমেরা |

৪] ইসলামিক যুগ

এই সময় মুঘল-পাঠানরা ভারতে আধিপত্য বিস্তার করে | এরা নিজেদের রাজকার্যের জন্য দেশীয় হিন্দু ধর্মকে গুরুত্ব দিয়েছিল | কিন্তু হিন্দু ধর্মের ক্ষতিও কম করেনি | মন্দির ভাঙ্গা, মূর্তি ভাঙ্গা, লুটপাট ইত্যাদি তো আছেই এর সাথে জোর করে ধর্মান্তরকরণ যুক্ত হয়েছিল |
এই প্রসঙ্গে আকবর বনাম ঔরঙ্গজেব বিবাদ বলা উচিত | আকবর হিন্দু ধর্মকে সহ্য করেছিল | দ্বীন ই ইলাহী চালু করেছিলেন | ঔরঙ্গজেবের সময় সামন্ত রাজাদের বিদ্রোহে মুঘলদের প্রানান্তকর অবস্থা | তাই তিনি হিন্দু মন্দির ভেঙ্গেছিলেন ও জিজিয়া কর বসিয়েছিলেন শুধু যুদ্ধের খরচ তোলার জন্য | অতএব মুঘলরা হিন্দুদের প্রতি ধর্মের জন্য অত্যাচার করেননি | সুন্দর বামপন্থী যুক্তি | কিন্তু যুক্তির মধ্যে ফাঁক আছে | প্রথমত মাত্র দুইজন মুঘল বাদশার কাজ দিয়ে সমগ্র মুঘল যুগের মূল্যায়ন করা যায় না | দ্বিতীয়ত ঔরঙ্গজেবের যুদ্ধের খরচের জন্য সমস্ত প্রজার উপর সমান হারে কর বসানোটাই কি উচিত ছিল না ? তিনি ধর্মের ভিত্তিতে একই বিশেষ ধর্মের প্রজার উপর কেন কর বসালেন ? হিন্দুদের উপরি কেন জিজিয়া বসলেন? মুসলমানরা কেন বাদ গেল ? তৃতীয়ত আকবর রাজ্যরক্ষার জন্য ধর্মসহিশ্নুতার পরিচয় দিয়েছিলেন : এ কথার অর্থ হলো তিনি ধর্মের প্রতি ভালবাসার জন্য ওই ধর্মসহিষ্ণু হন নি | তিনি মনে প্রাণে অমুসলমান ধর্মগুলোকে ঘৃনা করতেন কিন্তু রাজ্য রক্ষার জন্য শুধু সহিষ্ণুতার অভিনয় করতেন | তিনি তাঁর শত্রু হিন্দু রাজা হিমুকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিলেন |

মুঘল যুগে হিন্দু ধর্মে বহু ক্ষতি হয় | ক্ষতি পূরণ করে কুসংস্কার | মুসলমানের ভয়ে মেয়েদের বাল্যকালে বিয়ে দিয়ে দেয়া হত | গোটা বেদে কোথাও বাল্য বিবাহের দৃষ্টান্ত নেই | সুতরাং এটা একেবারেই নতুন আবিষ্কার | বিধবাদের বিয়ে করত না কেউ | এটাও মুঘলদের দান | মুসলমানেরা সর্বদা অক্ষতযোনি কুমারী পছন্দ করে | তাই মুসলমানদের প্রভাবে হিন্দু সমাজও অক্ষতযোনি কুমারিই পছন্দ করত | হিন্দুসমাজ এটা ভুলে গেল যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে ১৬ হাজার রানী নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বানাসুরের বিধবা | অর্থাৎ অক্ষতযোনি নয় |এছাড়াও তিনি যে রাধার সঙ্গে লীলা করেছিলেন, সেই রাধা অন্যের স্ত্রী ছিলেন | অর্থাৎ এটাও অক্ষতযোনির কেস নয় | অর্জুন যে নাগকন্যা উলুপির পানিগ্রহণ করেছিলেন তিনিও বিধবা ছিলেন | সুতরাং বেদে বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত ছিল | আমাদের সমাজে তা বন্ধ হয়ে গেল কারণ মুসলমানদের প্রভাব |

এছাড়া আছে সতীদাহ | মুসলমানদের অত্যাচারের ভয়ে সতীদাহ বাধ্যতামূলক হয়ে গেছিল | শাস্ত্রে সতীদাহ বাধ্যতামূলক ছিল না | মুসলমানদের ভয়ে স্ত্রীশিক্ষা বন্ধ হয়ে গেছিল অথচ বেদে স্ত্রীশিক্ষা শাস্ত্রসম্মত ছিল | তার প্রমান অপালা, ঘোষা বিশ্ববারা, গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রভৃতি নারী ঋষিরা | উপাধ্যায়া বা ঋষিকা প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার শুধু নারী ঋষি আর শিক্ষিকার প্রতি ব্যবহৃত হত | আর্যে শব্দটিও স্ত্রী শিক্ষকের অস্তিত্বের প্রমান | কিন্তু মুসলিমদের মধ্যে স্ত্রীশিক্ষা একদম নিষিদ্ধ | আজও তার পরিচয় পাওয়া যায় | পাকিস্তানে স্ত্রীশিক্ষার দাবিতে তাই মালালাকে গুলি খেতে হয় |

এইসমস্ত কুসংস্কার বৈদিক ধর্ম থেকে হিন্দু ধর্মকে আরও বিছিন্ন করে দিল | এছাড়া মুসলিম আর হিন্দু ধর্মের হাইব্রিড পূজার বিধান এলো : সত্যপীর, মানিকপীর ইত্যাদির পূজা | এগুলো সুফি পীর আর হিন্দু ধর্মের মিশ্রণে তৈরী একটি হাইব্রিড কুসংস্কার | হিন্দুরা বিভিন্ন পীরের দরগাতে যেতে থাকে মানত করে বা চাদর চড়ায় এই মুঘল যুগ থেকেই | এগুলোও হিন্দুদের কুসংস্কার |

এছাড়া সেই সময়ে অর্থলোভী ব্রাহ্মনদের আবির্ভাব হয় | এরা অর্থলোভে উল্টোপাল্টা শাস্ত্রবহির্ভুত ব্যবস্থা দেয় | বিদ্যাসাগর তাঁর রচনা ব্রজবিলাসে এদের ভন্ডামির স্বরূপ উন্মোচন করেছেন | এছাড়া নারায়ণ সান্যাল তাঁর রূপমঞ্জরী উপন্যাসেও এদের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন | এরা নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য পারতনা হেন নীচ কাজ নেই | অনেক বামপন্থী বলেন যে সতীদাহ, বাল্যবিবাহ ও বিধবাবিবাহ সংক্রান্ত কুপ্রথাগুলি এরাই চালু করেছিল | কিন্তু আট বছরের শিশুকে কে কেন বিয়ে করতে চাইবে ? বিধবাদেরই বা কেন পুড়িয়ে মারা হবে ? এসমস্ত প্রশ্নের সদুত্তর মেলে না | একটাই ব্যাখ্যা ঠিক বলে মনে হয় আর তা হলো মুসলমানে চালু করেছিল | সিরাজুদ্দৌলা এই বঙ্গের হিন্দু নারীদেরকে চানের ঘাট থেকে তুলে নিয়ে যেত অনেক দেশী বিদেশী ঐতিহাসিক বলেছে | সেটা থেকে বাঁচাতেই মেয়েদের ঘরে বন্দী করে রাখা চালু হলো কারণ এভাবেই শুধু তাদের বাঁচানো যেত |

এছাড়া হিন্দু ধর্মে ঘোমটা প্রথা মুসলমানদের পর্দা প্রথার এক অনুকরনমাত্র | এইভাবে মুঘল আমলে হিন্দু ধর্মের আরো অবনতি ঘটে | সেটা অলমোস্ট নরকযন্ত্রণার তুল্য হয় | তারপর ব্রিটিশরা এসে হিন্দু ধর্মের কুপ্রথার অবসান করে |
হিন্দু ধর্মে বহুবিবাহ বাধ্যতামূলক ছিল না | মুসলমানদের মন রাখতে বহুবিবাহ বাধ্যতামূলক হয় |

৫] ব্রিটিশ যুগ

এই যুগেও বহু খ্রিস্টান কুসংস্কার হিন্দু ধর্মে প্রবেশ করে | এক বিবাহ বাধ্যতামূলক হয় | সেই এক বিবাহ শাস্ত্রসম্মত করার জন্য রামকে আদর্শ পুরুষ করা হয় | আরেকটা খ্রিস্টান কুসংস্কার ঢুকলো তা হলো অবৈধ সন্তানের অধিকার কেড়ে নেয়া | বেদে এই ধরনের সন্তানের স্বীকৃতি আছে | কর্ণ সূর্যদেব আর কুন্তির অবৈধ সন্তান | স্বয়ং বেদব্যাস পরাশর ঋষি আর মত্সগন্ধার অবৈধ সন্তান | এদের বেদে স্বীকৃতি আছে | এদেরকে সমাজ ত্যাগ করেনি বরং মর্যাদা দিয়েছে | উপনিষদে সত্যকাম জাবালি অবৈধ সন্তান হলেও হারিদ্রুমত গৌতম তাকে ব্রহ্মবিদ্যা দিয়েছিলেন |

এইভাবে ধীরে ধীরে বৈদিক ধর্মের সাথে হিন্দু ধর্মের পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটে | এই যুগে ইংরেজদের প্রভাবে লোকে হিন্দুধর্মের বহু আচার ত্যাগ করে | ডিরোজিওর শিষ্যরা এবং ইয়ং বেঙ্গল তার উদাহরণ | ব্রাহ্ম সমাজও এর উদাহরণ | তবে এইযুগেই স্ত্রীশিক্ষা আবার চালু হয় |বাল্য বিবাহ ও সতীদাহ বন্ধ হয় | এটাই এই যুগের একটা ভালো জিনিস |

এই যুগেই স্বামী দয়ানন্দ স্বরস্বতী নামে আরেক অবৈদিক সন্ন্যাসী আর্য সমাজ নামে আরেকটি ধর্ম চালু করেন | এটাও হিন্দু ধর্মের আওতায় আসে | এইভাবে হিন্দু ধর্ম আরো জটিল হয়ে ওঠে |

৬] আধুনিক যুগ

এই যুগে হিন্দু ধর্ম খুল্লমখুল্লা ব্যবসায়িক হয়ে উঠেছে | এখন তো যে যা খুশি তাই হিন্দু ধর্ম বলে চালাচ্ছে | বহু সাধু এখন ধর্মের নামে যৌন ব্যবসা চালাচ্ছে | উদাহরণ আসারাম বাপু, স্বামী নিত্যানন্দ ইত্যাদি | এই সব বদমায়েশ সাধু (!) গুলি বড় বড় আখড়ার অখন্ড মণ্ডলেশ্বর হয়ে বসেছে | ধর্মের সাথে রাজনীতির যে গাঁটছড়া অশোকের সময় থেকে চালু হয়েছিল তা এখন পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান | হিন্দু ধর্ম এখন ব্যাবসাপ্রধান একটি বুজরুকি মাত্র | বৈদিক ধর্মের কোনো গুনই এখন বিদ্যমান নেই |

এই গবেষনার সীমাবদ্ধতা

হিন্দু ধর্ম অনেক বিরাট আর ব্যাপক | সমস্ত কুসংস্কার বলা সম্ভব হলো না | প্রধান প্রধান আর জনপ্রিয় কুসংস্কার গুলি বললাম | ইতিহাসের সীমাবদ্ধতার কারণে সমস্ত ঘটনা বলা সম্ভব হলো না |

তথ্যসূত্র :

বিনয়পিটক (দিব্যবাদন আর অশোক বাদন )
বিদ্যাসাগর রচনাবলী
নারায়ণ সান্যালের রূপমঞ্জরী
উইকিপিডিয়া :
ক] হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া
খ] হিস্ট্রি অফ হিন্দুইজম
গ] হিস্ট্রি অফ টেম্পলস
বৈদিক ধর্মশাস্ত্র : মহাভারতের শান্তিপর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৪৬
১২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×