এসএসএফ- এর ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন যে, ‘বিশ্বে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কৌশল পরিবর্তন হচ্ছে দিন দিন। নানা ধরনের সংঘাত বাড়ছে। বাংলাদেশকে আমরা এই সংঘাত থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। বিষয়টি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।’ তার ঠিক পরের সপ্তাহেই সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির যুগ্মকমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে প্রকারান্তরে সমর্থন করেই বললেন, গত দুই বছরে ইরাক, সিরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জঙ্গি তৎপরতার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনদের নানা কার্যক্রমে এ দেশেও জঙ্গি তৎপরতায় অনেকে উৎসাহিত হচ্ছে। আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি তিনি বলেছেন তা হলো, জঙ্গিবাদ এ দেশ থেকে একেবারে নির্মল করা সম্ভব নয়। তবে আমাদের (আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর) অভিযানের কারণে তা নিয়ন্ত্রণে আছে। (প্রথম আলো অনলাইন, ২৮.০৭.২০১৫)।
আমরা মনে করি- বর্তমানের বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বিধানের স্বার্থে উপরোক্ত মন্তব্যগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়- আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ ইস্যুতে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিভিন্ন কারণে সম্পর্কিত এবং বিষয়টি বাংলাদেশের মৌলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই আশঙ্কা প্রকাশ পেয়েছে গোয়েন্দা কর্মকর্তার মন্তব্য থেকেও। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন তার মোকাবেলা তিনি কীভাবে করবেন তার অস্বচ্ছতা যেমন ভাবনার বিষয়, তেমনই আশঙ্কার বিষয় গোয়েন্দা কর্মকর্তার মন্তব্যটি যেখানে তিনি বক্রতার আশ্রয় না নিয়ে খুব সোজাভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ (Control) করা গেলেও নির্মূল (Destroyed) করা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় প্রশ্ন হলো- নিরাপত্তা বিধানে বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ যদি থেকেই থাকে, এবং প্রচলিত পন্থায় সেটা এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত করা গেলেও নির্মূল যদি সম্ভব না-ই হয়, তাহলে সেই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার নতুন কী পদ্ধতি অবলম্বন করবে?
আজ পৃথিবীর বিশাল ভূ-খণ্ড জঙ্গিবাদ নামক ভয়াবহ মহামারিতে আক্রান্ত। এ মহামারি যেন থামার নয়। পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্রপ্রধানদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে জঙ্গিবাদ। মুসলিম নামধারী জাতিটির প্রত্যেকটি রাষ্ট্রনায়ক চিন্তিত ও শঙ্কিত। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে, নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, জঙ্গিদেরকে জেলে দেয়া হচ্ছে, সাজা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছে; অর্থবল, অস্ত্রবল ও মিডিয়া- তিন শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আপাতদৃষ্টে এক অসম লড়াই চলছে পৃথিবীব্যাপী, কিন্তু ফলাফল- শুন্য। একজন জঙ্গি মরলে দশজন তৈরি হচ্ছে। ১৮ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে বিবিসিতে প্রকাশিত ‘বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ সূচক- ২০১৪’ রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ২০১২ ও ২০১৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতের হার শতকরা ৬১ ভাগ বেড়ে গেছে। সেখানে আরও বলা হয়, বিশ্বে কেবল সন্ত্রাসের (জঙ্গিবাদের) তিব্রতাই বাড়ে নি, এর প্রসারও বেড়েছে। এদিকে চলতি বছরে জঙ্গিবাদের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- আগের বছরের তুলনায় ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা এক তৃতীয়াংশ বেড়েছে। আর চলতি বছরের ঘটনাপ্রবাহ থেকে এখনই নিশ্চিত হওয়া যায় যে, বৈশ্বিক জঙ্গিবাদের ঊর্ধ্বমুখী সূচকে এ বছরটিও নতুন মাত্রা লাভ করবে।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ: বাংলাদেশ পরিস্থিতি কীভাবে সম্পর্কিত?
ষোল কোটি মানুষের মাতৃভূমি বাংলাদেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। তারা আল্লাহ, আল্লাহর রসুল ও ইসলামকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। এ অঞ্চলের মানুষের ধর্মের প্রতি টান হাজার বছর পুরানো। এটা তাদের রক্ত-মাংসের সাথে মিশে আছে। একে জীবন থেকে কোনোভাবেই আলাদা করা সম্ভব নয়। এই শুভ চেতনাই আজ বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের দেশের জন্য। আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সাথে এ দেশের বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠনের আদর্শ ও কর্মপদ্ধতিগত সমন্বয় রয়েছে- এ অভিযোগ বহু পুরনো। মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখলকারী আইএস যোদ্ধারা এখন কার্যত সারা বিশ্বের জঙ্গি ও জঙ্গিসমর্থকদের আদর্শিক ‘হিরো’তে পরিণত হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ কথিত জেহাদের নেশায় ছুটে যাচ্ছে ইরাক-সিরিয়ায়। ‘জেহাদী তামান্না’ বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও আছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে আইএসে যোগদানের উদ্দেশ্যে ইরাক যাবার পথে বিমানবন্দর থেকে কয়েকজনকে আটক করার ঘটনা ঘটেছে। আবার সম্প্রতি ব্রিটেনে বসবাসকারী বাংলাদেশি বংশদ্ভূত ১৩ সদস্যের একটি পরিবার আইএসে পাড়ি জমিয়েছে। চিন্তা বিষয় হলো- সরাসরি ব্রিটেন থেকে না গিয়ে তারা আইএস’এ গেছে বাংলাদেশ থেকে, এবং কিছুদিন পরে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে পরিবারটি দাবি করে যে, সেখানে তারা খুব শান্তিতে বসবাস করছে, নিরাপদে আছে। এতটা শান্তি ও নিরাপত্তা নাকি তারা কোথাও পায় নি।
আমরা জানি গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিষ্পেষণ থেকে মানুষের মুক্তির জন্য যখন সমাজতন্ত্রের আবিষ্কার হলো, তখন সমাজতন্ত্রের মধ্যে মুক্তি আছে মনে করে পঙ্গপালের মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ সমাজতন্ত্রের শিখায় ঝাঁপ দিল। কিন্তু কিছুদিন পরেই তাদের স্বপ্নভঙ্গ হলো, তারা বুঝতে পারল যে তারা কড়াই থেকে লাফিয়ে চুলায় পড়েছে। এখন বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের গণতান্ত্রিক হানাহানির বীভৎসতা থেকে মানুষ মুক্তি চাচ্ছে। এটাও চাচ্ছে কয়েক যুগ থেকে। সম্প্রতি আইএস মহানবীর ভবিষ্যদ্বাণীকৃত হাদিস (যদিও অনেক হাদিসের বিশুদ্ধতা নিয়ে খোদ হাদিসবেত্তাদেরই প্রচুর মতভেদ রয়েছে, হাদীসের নামে বহু দয়ীফ, জাল বা ভুয়া হাদীস প্রচলিত আছে) মিলিয়ে মিলিয়ে ইসলামী খেলাফতের নামে এমন একটি কৃত্রিম কাঠামো দাঁড় করিয়ে ফেলছে যে, ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের মধ্যে একটি বড় অংশ মনে করছে আইএস এর মাধ্যমেই বিশ্বে শান্তি আসবে, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে এবং পাশ্চাত্যের দুঃশাসন থেকে মানুষ চূড়ান্তভাবে মুক্তিলাভ করবে। সুতরাং এর দ্বারা এতে তারা একদিকে যেমন শান্তি পাবে, অন্যদিকে তারা উম্মতে মোহাম্মদী হতে পারবে, অর্থাৎ এটি তাদের ধর্মীয় কর্তব্য। ইতোমধ্যেই হাজার হাজার যুবক এই ধ্যানধারণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে কথিত জেহাদ করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ ছুটছে ইরাক-সিরিয়ার পথে। আধুনিক পৃথিবীতে ধনে-সম্পদে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিল্প-সাহিত্যে, সামরিক শক্তিতে অর্থাৎ পার্থিব উন্নতির আইডল হিসেবে বিবেচিত হয় ইউরোপ। সেই ইউরোপ থেকে যখন দলে দলে ধর্মপ্রাণ মানুষ সমস্ত বাধার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে, প্রাণের মায়া ত্যাগ করে সিরিয়া-ইরাকে ছুটছে তখন আমাদের দেশের দারিদ্র-কষ্টে জর্জরিত সরলপ্রাণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা যেতেই পারে। এ কথা ভুললে চলবে না যে, এমনই এক ধরনের প্রেক্ষাপট অর্থাৎ আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে কথিত জেহাদ থেকেই এক সময় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছিল। জঙ্গিদের এই পথ যে ভুল, এই কোরবানি ও প্রচেষ্টার বিনিময়ে তারা যে আল্লাহর কাছ থেকে কিছুই লাভ করবে না, বরং তাদের দ্বারা ইসলামের শত্র“রাই লাভবান হচ্ছে এ কথা তাদেরকে কে বোঝাবে, সাধারণ মানুষকেই বা কে বোঝাবে?
এমনিতেই বিভিন্ন সময়ে উন্মাদনা সৃষ্টি করে কথিত জেহাদী তামান্না সৃষ্টি করা হয় বাংলাদেশে যা বার বার আমরা দেখেছি। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার ঘটনা এ দেশে অহরহ ঘটে। এছাড়াও রয়েছে মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত অর্থোপার্জনের দৃষ্টান্ত। এক কথায় আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের ঈমানকে হাইজ্যাক করে থাকে এক শ্রেণির স্বার্থবাদী। তার উপর এই জঙ্গিবাদের অশুভ ছায়া। সরকার শক্তি প্রয়োগ করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে তাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। অতি শক্তি সম্পন্ন গ্যাস বোতলের ঢুকিয়ে দিয়ে যেমন ছিপি দিয়ে আটকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়, ঠিক সেরকম করা হয়েছে। ফলে যতটুকু উপশম হওয়ার হয়েছে, কিন্তু নির্মূল হয়ে যায় নি। ঝুঁকি থেকেই গেছে। ধর্মের বিবিধ অপব্যবহারের এই সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এ কথা বলায় দোষের কিছু থাকে না যে, বাংলাদেশ ভয়াবহ বিপদের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। সাবধান! মাথার উপর কিন্তু চক্কর দিচ্ছে চিল!
শক্তি প্রয়োগের প্রচলিত পন্থায় জঙ্গিবাদ দমন সম্ভব নয় কেন?
জঙ্গি বা জঙ্গি মনোভাবাপন্ন গোষ্ঠী আন্তরিকভাবে চায় যে তাদের জীবনে আল্লাহর আইন-বিধান প্রতিষ্ঠিত হোক। কোর’আনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তারা এমনভাবে অনুপ্রাণিত (Inspired) ও সংকল্পবদ্ধ (Determined) যে তারা আল্লাহর রাস্তায় নিজেদেরকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করে দিয়েছে। তারা কোনো পার্থিব স্বার্থে এ পথ বেছে নেয় নি। তারা আল্লাহকে, আল্লাহর রসুলকে ভালোবাসে ও পরকালে বিশ্বাস করেন। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পারলেই তারা চূড়ান্ত সফল, এর বিনিময়ে আখেরাতে জান্নাতে যেতে পারবে। এজন্য শরীরে বাঁধা বোমা ফাটিয়ে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে প্রাণ বিসর্জন দিতেও তারা কুণ্ঠিত হচ্ছে না, এবং এমন লোকের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে তাদের ধারণা (আকিদা) ভুল ও বিকৃত হওয়ার কারণে এরা বুঝতে পারছে না যে, তারা যে সন্ত্রাসের পথ গ্রহণ করেছে সেই পথে চললে তারা দুনিয়াও পাবে না, আখেরাতও পাবে না অর্থাৎ দুই কূলই হারাবে। যতদিন তারা তাদের এই ভুল না বুঝতে পারবে ততদিন শক্তি প্রয়োগ করে বড়জোর তাদের কার্যক্রমকে কিছু সময়ের জন্য স্তিমিত করা যেতে পারে, বন্ধ করা যাবে না। এ কথা যিনি বুঝবেন জঙ্গিবাদের সমাধান তার দৃষ্টিতে খুব কঠিন মনে হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি তালেবান-আল কায়েদার মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে আফগানিস্তান থেকে ফিরে গেছে এবং নিজেদের অসফলতার কথা পুনঃ পুনঃ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন তাদের কর্তাব্যক্তিরা। বারাক ওবামা নিজে বলেছেন, “বুলেট-বোমা দিয়ে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করা যাবে না, বিকল্প পন্থা খুঁজতে হবে।” তালেবান ও আল কায়েদার বিরুদ্ধে প্রায় এক যুগ লড়াই করার পর ঈঙ্গ-মার্কিন শক্তি অসহায়ের মতো এসব স্বীকারোক্তি করেছে। এর মাঝে তারা কী পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করেছে, কী অঢেল অর্থব্যয় করেছে তা বিজ্ঞ মানুষমাত্রই জানেন। বছর কয়েক আগের ইউরোপ-আমেরিকায় সংঘটিত বিরাট অর্থনীতিক মন্দার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল এই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অকল্পনীয় অর্থব্যয়। অথচ এত এত অর্থব্যয়ের পর, সামরিক শক্তিতে অপ্রতিরোধ্য বলে কথিত পরাশক্তিগুলো ব্যর্থতার গ্লানি বরণ করছে। সামরিক শক্তি, অর্থবল ও মিডিয়ায় সমৃদ্ধ বিশ্বের পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোই যদি শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগ করে জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে ব্যর্থ হয় তাহলে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশের সরকার যে ব্যর্থ হবে তা বোঝাই যায়। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বিকল্প পন্থা খোঁজার ঘোষণা দিয়েছেন ২০০৯ সালে ( 03-00-2009), কিন্তু বিকল্প কোনো পন্থা না পাওয়ায় তারা আজও প্রচলিত শক্তি প্রয়োগের পন্থার উপরই নির্ভর করছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও পূর্বোল্লিখিত ভাষণে স্বীকার করেছেন যে, জঙ্গিরা নতুন নতুন কৌশল ধারণ করছে, সে ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগের পন্থাতেই কি সরকার সীমাবদ্ধ থাকবে? নাকি শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি নতুন কোনো সমাধানের খোঁজ করবে? শুধু শক্তি ও অর্থব্যয়ের ব্যর্থতার আরেক প্রমাণ হলো- খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান সরকার ও আফগান সরকার এখন তালেবানদের সাথে আলোচনা-পরামর্শের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করছে, যা আগে খুব কমই ঘটেছে।
সুতরাং বোঝা গেল, শক্তি প্রয়োগের প্রচলিত পন্থায় সম্পূর্ণভাবে জঙ্গিবাদ নির্মূল সম্ভব নয়। অথচ জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ সরকার বরাবরই কেবল শক্তি প্রয়োগের নীতি অবলম্বন করে এসেছে। শক্তি প্রয়োগেরও দরকার আছে, একেবারে শক্তি ছাড়াও হবে না। শক্তি প্রয়োগ কখন ও কীভাবে করতে হবে এই বিষয়ে প্রবন্ধের শেষে আলোকপাত করা হবে। কিন্তু জঙ্গিবাদ মোকাবেলার মূল পন্থা ওটা নয়, সন্ত্রাসীদেরকে যদি কোর’আন হাদিস ও ইতিহাস থেকে যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে তাদের ভুল কোথায় এবং কেন তারা জীবন উৎসর্গ করলেও আল্লাহ-রসুলের সন্তুষ্টি লাভ করবে না, জান্নাত লাভ করবে না, কেবল তাহলেই তারা জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড ত্যাগ করতে পারে। সেই সাথে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যেও ইসলামের প্রকৃত ব্যাখ্যা প্রদান করে ব্যাপক গণজাগরণ তৈরি করতে হবে। সাধারণ মানুষের ঈমান বা ধর্মবিশ্বাস যতদিন না কল্যাণের পথে ব্যবহার করা যাচ্ছে, ধর্মব্যবসায়ী ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী ততদিন তাকে অকল্যাণের পথে ব্যবহার করতেই থাকবে। ঈমান আছে মানেই, ধর্মবিশ্বাস আছে মানেই তা ব্যবহৃত হবেই। তাই চেষ্টা চালাতে হবে অকল্যাণের পথে ব্যবহৃত না হয়ে মানুষের ঈমানী শক্তিকে জাতির কল্যাণের পথে ব্যয় করার। জঙ্গিরা যে ভুল পথে আছে তা তাদেরকে বোঝানোর জন্য ও সাধারণ মানুষকে ধর্মব্যবসা, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সচেতন করার জন্য কোর’আন ও হাদিসভিত্তিক যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য, প্রমাণ ও যুক্তি আমাদের অর্থাৎ হেযবুত তওহীদের হাতে আছে। এটা যে নিছক আশ্বাসবাণী নয়, প্রকৃতপক্ষেই জঙ্গিদেরকে ভুল প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট যুক্তি, প্রমাণ ও তথ্য-উপাত্ত আমাদের কাছে আছে, সেটা অতি স্বল্প পরিসরে আলোকপাত করা হলো।
জঙ্গিবাদের টেকসই সমাধান
সাম্রাজ্যবাদের পাতানো ফাঁদ: জঙ্গিবাদ
পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোই এক ঢিলে দুই পাখি মারার উদ্দেশ্যে জঙ্গিবাদ ইস্যুটির জন্ম দিয়েছে। তারপর তা বিশ্বময় রপ্তানি করে নিজেরাই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এ যুদ্ধের স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্য হলো পররাজ্য দখল করা, পরসম্পদ লুট করা, আর দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য হলো একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ‘ইসলাম’-কে ধ্বংস করে দেওয়া। এর স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্যটি নিয়ে আলোচনার তেমন প্রয়োজন নেই, এ বিষয়ে বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি উক্তিই যথেষ্ট হবে আশা করি। তিনি ২৩ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, “তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ সূচনা করে মুসলিম বিশ্বকে পদানত রাখার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছে। দেশটি আফগানিস্তানে যুদ্ধের সূচনা করে, তা এখন সম্প্রসারিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে।” আর দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য হলো কম্যুনিজমের পতনের পর তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ‘ইসলাম’-কে ধ্বংস করে দেওয়া। এটা এখন পশ্চিমা আগ্রাসনকারীদের আত্মস্বীকৃত বিষয়। অনেকেই স্বীকার করেছেন, অনেকে এ নিয়ে দম্ভোক্তিও করেছেন।
জঙ্গিবাদের উদ্গাতা কারা? কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করেছে এবং জঙ্গিবাদ থেকে লাভবান হচ্ছে মূলত কারা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন বলেন, “আজকে আমরা যে আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি কুড়ি বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমরাই তাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তাদেরকে অর্থ যুগিয়েছি।’ [১ জুন ২০১৪, ফক্স নিউজ, সি.এন.এন]। অন্যদিকে পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মোশারফকে বলতে শোনা গেছে- তালেবান আমেরিকার সৃষ্টি, (ডন, ০৫.১২.১৪)। আর বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া আইএস- এর জন্মের প্রেক্ষাপট যারা জানেন তাদেরকে বলে দিতে হবে না যে, কীভাবে পশ্চিমা জোট আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুৎ করার প্রচেষ্টায় আইএসকেই একদা সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করে শক্তিশালী করেছে। এমনকি ইরাকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করার পরও কুর্দীদের অস্ত্র দেবার নাম করে আকাশ থেকে আইএসকে অস্ত্র প্রদান করেছে যুক্তরাষ্ট্রই। অবশ্য জঙ্গিরাও অকৃতজ্ঞ নয়; তালেবান, আল কায়েদা বা আইএসের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদকে পৃথিবীব্যাপী শোষণ অব্যাহত রাখতে যতখানি সুযোগ করে দিয়েছে তা অতীতে কেউ পেরেছে বলে মনে হয় না।
আমরা সবাই জানি, আশির দশকে সংঘটিত রুশ-আফগান যুদ্ধটিই হচ্ছে জঙ্গিবাদের সূতিকাগার। এ সময়টিতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস.আই. আফগানদেরকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯৪ এই সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানে একটি সশস্ত্র বাহিনী তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৫৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে লাখ লাখ যুবক আফগানিস্তানে ছুটে গিয়েছিল আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করার জন্য। তারা কি বুঝেছিলেন যে, এটা জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহ নয়, এটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাথের্র যুদ্ধ, এ যুদ্ধে আল্লাহ-রসুলের কিছু আসে যায় না? বুঝতে পারেন নি, কারণ এই যুবকদেরকে প্রাণদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য পশ্চিমারা মুসলমান দেশগুলোতে হাজার হাজার ধর্মব্যবসায়ীকে ভাড়া করছিল যারা তাদের যার যার দেশের যুবকদেরকে ওয়াজ-নসিহত করে যুদ্ধে যোগদানের জন্য উত্তেজিত, অনুপ্রাণিত (Inspired) করে সংঘটিত করেছিল। তারা বলত যে এটা সাধারণ যুদ্ধ নয়, জেহাদ ও কেতাল ফি-সাবিলিল্লাহ। এখানে মরলে শহীদ বাঁচলে গাজি। শুধু তাই নয়, পরবর্তী প্রজন্মকে জঙ্গি হিসাবে গড়ে তোলার জন্য পশ্চিমারা ওই প্রকল্পের আওতায় আফগানিস্তানের বাচ্চাদের পাঠ্যপুস্তকে সন্ত্রাস ও মারণাস্ত্র সম্পর্কিত অনেক প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করেছিল। সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কোন কোন অস্ত্র ব্যবহার করলে ভালো হবে এমন তথ্য সেগুলোতে অনায়াসে দেওয়া হয়েছিল। তখন ইংরেজি বর্ণমালা পরিচয়ে ‘জে’-তে জেহাদ শেখানো হতো। এমনকি গণনা শেখানোর সময় ৫ বন্দুক + ৫ বন্দুক = ১০ বন্দুক শেখানো হতো। এভাবে হাতে কলমে জঙ্গিবাদের শিক্ষা প্রচার করেছে যারা সেই পশ্চিমারাই আজ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে চেচিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছেন।
এই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ যে আসলে পশ্চিমাদের রাজনীতির খেলা, অর্থাৎ Political game, সেটাও প্রমাণিত। এতে তাদের লাভ হচ্ছে তারা খনিজ ও তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো দখল করতে পারছে, পাশাপাশি অস্ত্রব্যবসা করে নিজেদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। আমাদের দেশের অর্থনীতিকে যেমন বলা হয় কৃষি অর্থনীতি, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বলা হচ্ছে যুদ্ধ অর্থনীতি (War Economy)। যুদ্ধ না থাকলে তাদের অর্থনীতিতে মন্দা হবে। তাদের প্রয়োজন বিশ্বজোড়া অস্ত্রের বাজার। কিন্তু তারা নিজেরা আর স্বশরীরে যুদ্ধ করতে আগ্রহী নয়। তাদের সৈন্যরা যুদ্ধবিমুখ ও ভোগবাদী। তাই দরকার পড়েছে মুসলমানদের একটি দলকে আরেকটি দলের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেওয়া। সুতরাং জঙ্গিরা পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে অতি প্রয়োজনীয় শত্র (Essential Enemy)। তারা যেমন জঙ্গিদেরকে জিইয়ে রাখতে চায় চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত তেমনি, অনেক দেশের সরকারও জঙ্গিবাদ নির্মূল হোক এটা চায় না। জঙ্গিরা থাকলে তাদের বহুমুখী স্বার্থোদ্ধারের পথ খোলা থাকে। (এ বিষয়ে হেযবুত তওহীদের এমামের লেখা বই- ‘ধর্মব্যবসায়ী ও পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রের যোগফল: জঙ্গিবাদ’ বইতে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে)
সুতরাং জঙ্গি ও জঙ্গি মনোভাবাপন্ন মুসলমানদেরকে যদি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের এই খেলা সম্পর্কে সচেতন করা যায় এবং তারা যদি বুঝতে পারে যে, জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড থেকে ইসলামের কোনো উপকার তো হয়-ই না, বরং ইসলামের শত্ররাই লাভবান হয় তাহলে ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো আর পশ্চিমা ক্রীড়নকে পরিণত হবে না।
বিকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম: ভস্মে ঘৃতাহুতি দেয়া
জঙ্গিরা যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে, জেলে যাচ্ছে, ফাঁসিতে ঝুলছে, শত্র“র গোলা-বারুদে ঝাঁঝরা হচ্ছে সেই ইসলাম আর আল্লাহর রসুলের ইসলাম এক নয়। বর্তমানে ইসলামের নাম করে যে দ্বীনটি প্রচলিত আছে তা বাহ্যিক দৃষ্টিতে প্রকৃত ইসলামের মতো মনে হলেও, আত্মায় ও চরিত্রে আল্লাহর রসুলের ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত। যেটাকে আইএস, বোকো হারাম, আল কায়েদা, ইখওয়ান, তালেবানরা ইসলাম মনে করছে এবং ভাবছে সেটাকে প্রতিষ্ঠা করে স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনবে সেটা বিগত ১৩০০ বছরের ধারাবাহিক বিকৃতির ফল, প্রকৃত ইসলামের ছিটে ফোটাও এর মধ্যে নেই। দীন নিয়ে অতি বিশ্লেষণকারী আলেম, মুফতি, মোফাস্সের, মোহাদ্দেস, সুফি, দরবেশ ও পীর-মাশায়েখদের অপ্রয়োজনীয় তর্ক-বিতর্ক, বাহাস, মতভেদ ও চুলচেরা বিশ্লেষণের পরিণামে দীনের ভারসাম্য হারিয়ে গেছে অনেক আগেই, সেই ভারসাম্যহীন দীনের ভিন্ন ভিন্ন ভাগকে আঁকড়ে ধরে ছিল ভিন্ন ভিন্ন ফেরকা-মাজহাব, দল-উপদল। এর মধ্যে ইসলাম পারস্যে প্রবেশ করলে সেখানকার পূর্ব থেকে বিরাজিত বিকৃত আধ্যাত্মবাদ ইসলামে প্রবেশ করল। বিকৃত সুফীবাদী ধ্যান-ধারণার প্রভাবে এক সময়ের প্রগতিশীল, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী, বহির্মুখী, প্রগতিশীল, উদার, যুক্তিপূর্ণ ইসলাম অন্তর্মুখী, গতিহীন, অযৌক্তিক, পলায়নপর সাধু-সন্ন্যাসের ধর্মে পরিণত হলো। তারপর আসল ব্রিটিশরা। তারা এই জাতির কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকল। আগের শিক্ষাব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলে নিজেরা মাদ্রাসা তৈরি করে সেই মাদ্রাসায় ব্রিটিশরা তাদের নিজেদের তৈরি সিলেবাস ও কারিকুলাম অনুযায়ী তাদের সুবিধামতো একটি বিকৃত ইসলাম এই জাতিকে শিক্ষা দিল। ফলাফল- মানবজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগ করে রসুলাল্লাহর রেখে যাওয়া ঐক্যবদ্ধ জাতি এখন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, তেহাত্তর ফেরকায় বিভক্ত হয়ে একে অপরের রক্তে হোলি খেলছে। ব্রিটিশদের শেখানো এই বিকৃত ইসলাম পৃথিবীর এক ইঞ্চি মাটিতেও শান্তি আনয়ন করতে ব্যর্থ। সুতরাং একে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যারা জীবন দেবে, সম্পদ দেবে তারা যে ভস্মে ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন তাতে সন্দেহ নেই।
তারা আল্লাহর সাহায্য পাচ্ছেন না কেন?
আল্লাহর দেওয়া দীন প্রতিষ্ঠা করতে হলে আল্লাহর সাহায্য (Favour, নসর) অবশ্যই লাগবে। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তারা যেটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে সেটা আল্লাহর ইসলাম নয়। সেটা প্রকৃত ইসলাম হলে তারা অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য পেত। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, মিশরসহ কোথাও তো দেখছি না তাদের সাথে আল্লাহর সাহায্য আছে। আল্লাহ যাদের সাহায্য করবেন তাদের পরাজয় অসম্ভব এটা পবিত্র কোরানে আল্লাহ বার বার বলেছেন। কাজেই এতেই প্রমাণিত হয় তারা যেটা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন সেটা আল্লাহর ইসলাম নয়।
ইসলামের প্রকৃত আকীদা হারিয়ে গেছে
প্রকৃত আকীদার অনুপস্থিতির কারণে জঙ্গিবাদের পথ আরও প্রশস্ত হচ্ছে। ইসলামে আকীদার গুরুত্ব অতুলনীয়। এই দীনের আলেমদের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাপারে মতভেদ থাকলেও এ ব্যাপারে তারা সকলেই একমত যে, আকীদা সঠিক না হলে ঈমানের মূল্য থাকে না। জঙ্গিদের ঈমান আছে, শুধু আছে বললে ভুল বলা হয়, তাদের ঈমান অন্য আর দশজন সাধারণ মুসলিমের চেয়ে অনেক বেশি। দৃঢ় ঈমান না থাকলে কেউ জান দিতে যায় না। কিন্তু এত প্রবল ঈমানের কী দাম থাকে যদি আকীদা ঠিক না হয়? আকীদা হচ্ছে Comprehensive Concept, সম্যক, সামগ্রীক ধারণা, অর্থাৎ একটি কাজ কেন করা হবে, কীভাবে করা হবে, কখন করা হবে, কোন কাজ আগে কোনটা পরে, কোনটা এখন কোনটা তখন, কোনটা খুব প্রয়োজনীয় কোনটা কম প্রয়োজনীয়, কোনটা না হলেই নয় কোনটা না হলেও চলবে, কোনটার পূর্বশর্ত (Prereqisite) কোনটা, কোন কাজ দ্বারা মানবতার কী উপকার হবে বা কী ক্ষতি হবে ইত্যাদি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা। অথচ এই দীনের নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাতসহ যে জেহাদের কথা বলে জঙ্গিবাদ ছড়ানো হচ্ছে সেই জেহাদ সম্পর্কেও জঙ্গিদের আকীদা সঠিক নয়। উপরন্তু আকীদাকে অনেকে ঈমানের সাথেই গুলিয়ে ফেলছেন, অথচ আকীদা ও ঈমান যে পৃথক বিষয় তা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়। ইসলামের জেহাদ কী জন্য, রসুল কখন কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে জেহাদ করেছেন, কখন কিতাল করেছেন সে সম্পর্কে সঠিক আকীদা না থাকায় জঙ্গিরা সন্ত্রাসকেই জেহাদ বলে মনে করছে। কাজেই ইসলামের প্রকৃত আকীদা জানতে পারলে অনেক বিপথগামী জঙ্গিই সন্ত্রাস ত্যাগ করবে তাতে সন্দেহ নেই।
জাতিকে আগে তওহীদের জ্ঞান প্রদান করতে হবে
জঙ্গি মনোভাবসম্পন্ন মানুষদেরকে তওহীদের প্রকৃত অর্থ বোঝাতে হবে। দীনের ভিত্তি বা প্রাণ হলো তওহীদ। জীবনের সকল অঙ্গনে যেখানে আল্লাহ ও আল্লাহর রসুলের কোনো কথা আছে, সেখানে অন্য কারোটা না মানাই তওহীদের একমাত্র দাবি। সেই তওহীদ কি আজকের মুসলিম নামধারী জাতির মধ্যে আছে? নেই। আজ এই জাতি জাতীয় জীবন থেকে আল্লাহর হুকুম, বিধি-বিধানকে প্রত্যাখ্যান করে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সিস্টেম গ্রহণ করেছে। ইসলাম বলতেই এরা বোঝে নামাজ, রোজা, এবাদত-উপাসনা এবং জিকির-আজগার, তসবীহ-তাহলীল, ওযু, গোসল, মেসওয়াক বা লেবাসের মতো তুচ্ছ ব্যক্তিগত জিনিস। অথচ আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, দীনের ব্যক্তিগত ভাগ মেনে ও জাতীয় ও সামষ্টিক ভাগ প্রত্যাখ্যান করে এরা যে তওহীদ থেকেই বিচ্যুত হয়ে গেছে, আল্লাহর চোখে এরা আর যে মো’মেন নেই, মুসলিম নেই, বরং মোশরেকে পরিণত হয়েছে সে জ্ঞান তাদের নেই। কাজেই যারা পুনরায় ইসলামের স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে চায় তাদেরকে একদিকে যেমন নিজেদের অবস্থান বুঝতে হবে, সেই সাথে বুঝতে হবে জাতি বর্তমানে কোন অবস্থানে আছে। যে জাতিতে তওহীদই নেই, যারা জাতীয় জীবনে আল্লাহর হুকুম, ন্যায় ও সত্যকে অস্বীকার করেছে তাদেরকে তওহীদের আহ্বান না জানিয়ে, তওহীদের মর্মার্থ না বুঝিয়ে অর্থাৎ মানসিকভাবে জাতিকে আল্লাহর বিধান গ্রহণ করার উপযোগী না করে আগেই জেহাদের জিগির তোলা সুবিবেচনার কাজ হতে পারে না। জাতিকে আগে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বোঝাতে হবে। ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমাজ থেকে অশান্তি দূর করার জন্য সংগ্রাম করাই যে একজন মু’মিনের প্রধান কর্তব্য, এবাদত সেটা সকলকে বোঝাতে হবে। তাদেরকে আরও বোঝাতে হবে যে, ধর্মের কোনো বিনিময় চলে না, ব্যবসা চলে না। ধর্মের কাজ হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। এভাবে জাতিকে আগে ধর্ম-অধর্মের পার্থক্য, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য, তওহীদ, শিরক, কুফর ইত্যাদি সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে হবে। যুগ যুগ ধরে এদের বিশ্বাসে, আচারে, প্রথায় যে অজ্ঞতা বাসা বেধেছে তা দূরীভূত করতে হবে। তা না করে যাদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম, সেই সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধরা চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় প্রদান করে। এভাবে যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ শান্তি আনয়ন সম্ভব নয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ গত দুই-এক দশকের ভেতরেই পাওয়া যাবে।
ইতিহাসের শিক্ষা
ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইরত তথাকথিত জেহাদী গোষ্ঠীগুলো তাদের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য রসুলাল্লাহর জীবনী থেকে বিভিন্ন ঘটনার অবতারণা করে থাকেন। তারা তাদের কর্মকাণ্ডের সমর্থনে কোর’আন হাদীসের রেফারেন্সও দিতে পারে। কারণ রসুলাল্লাহ তাঁর নবী জীবনের অধিকাংশ সময়ই বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রসুলের পদাঙ্ক অনুসরণ করাই প্রতিটি মু’মিনের কর্তব্য। কিন্তু আরেকটু গভীরে গেলেই প্রকৃত ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জঙ্গিরা প্রধানত যে ভুলটি করে তাহলো- আল্লাহর রসুলের জীবনের দুইটি ভাগ, অর্থাৎ মক্কা জীবন ও মদীনা জীবনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়া; অথচ মক্কা ও মদীনায় রসুলাল্লাহর কর্মপদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। মক্কায় তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে তওহীদের বালাগ দিয়ে গেছেন। শত অন্যায়, অবিচার সহ্য করেছেন। মুশরিকদের নির্দয় আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন। সঙ্গি-সাথীরা ঘর-বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছে। অবরুদ্ধ ও একঘরে জীবনযাপন করেছে। কয়েকজনকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। রসুলের সামনে দিয়ে সাহাবীদের টেনে-হিঁচরে নির্যাতন করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, রসুলাল্লাহ বাধা পর্যন্ত দিতে পারেন নি। এত নির্যাতনের মাঝেও মক্কা জীবনে যুদ্ধের অনুমতি ছিল না। সেখানে একটাই কাজ- সমস্ত নির্যাতন, নিপীড়ন, ঠাট্টা, বিদ্রƒপ উপেক্ষা করে যথাসম্ভব তওহীদের বালাগ চালিয়ে যাওয়া, ঘুমন্ত মানুষগুলোর অন্তরাত্মাকে জাগ্রত করে তোলা, তাদেরকে যাবতীয় অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করা। অতঃপর যখন মদীনায় একটি জনগোষ্ঠী রসুলাল্লাহর আহ্বান গ্রহণ করল, রসুল হেযরত করলেন এবং মদীনার মুসলিম-অমুসলিম সকলকে নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছা (Instinctive desire) এবং সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতে (On the basis of common interest) চুক্তির মাধ্যমে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করলেন, রসুল (স.) তখন নবগঠিত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান। আর স্বাভাবিকভাবেই নবগঠিত ওই রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী ও অস্ত্র-শস্ত্র দরকার পড়েছিল। সেখান থেকেই রাজনীতিক কারণে রসুলাল্লাহ ও তাঁর সাহাবাদের যোদ্ধা জীবন শুরু। সেই যুদ্ধ প্রচলিত রাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধনীতি ও ধর্মীয় বিধান কোনো দৃষ্টিতেই অবৈধ ছিল না।
অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, ব্যক্তি বা দলগতভাবে কেউ অস্ত্র হাতে নিলে সেটা ইসলাম হবে না, কারণ রসুল তা নেন নি। অস্ত্রের ব্যবহার, সেনাবাহিনীর ব্যবহার করতে পারে একমাত্র সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই মুলনীতিকে অগ্রাহ্য করার অর্থ রসুলাল্লাহর কর্মপদ্ধতিকে ভুল মনে করা।
যারা জঙ্গি হচ্ছে এবং যারা জঙ্গিবাদের সমর্থক তাদের মূল প্রেরণা হচ্ছে কোর’আন-হাদীস, রসুলের ইতিহাস ইত্যাদি। তাদের ইসলামের অপব্যাখ্যা দ্বারা উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এই অপব্যাখ্যা বজায় রেখে, শুধু শক্তি প্রয়োগ করে সফলতার আশা করা যায় না। কারণ, পূর্বেই বলেছি- যারা জঙ্গি হয় তারা জেনে বুঝেই হয়, মৃত্যুকে ভয় পাওয়া তো পরের কথা, মৃত্যুই তাদের আকুল কামনা। এমতাবস্থায় ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা ও শিক্ষা প্রদান করে মানুষকে সচেতন করে তোলা ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ নেই। শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা আমরা যে একেবারে অস্বীকার করছি না তা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সেটা কখন? আদর্শিক লড়াই চালানোর পরও যে স্বল্প সংখ্যক স্বার্থবাদী চরিত্রের মানুষ এই গর্হিত কাজে লিপ্ত হবে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজন হবে শক্তি প্রয়োগের। জঙ্গিবাদ দমনে সেটা হবে অতি কার্যকরী মাধ্যম। বস্তুত সরকারের হাতে আছে আইন, শক্তি, অস্ত্র এবং আমাদের হাতে আছে আদর্শ; এই দুইয়ের যৌথ ব্যবহার করা গেলে বাংলাদেশ একদিকে ধর্ম সম্বন্ধীয় যে কোনো ঝুঁকি থেকে মুক্ত হবে, আরেকদিকে মানুষের ধর্মবিশ্বাস দেশ ও জাতির কল্যাণের পথে কাজে লাগায় জাতি অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করবে। ব্যক্তি যেমন উপকৃত হবে, সমাজ ও জাতিও উপকৃত হবে। মানুষের ইহকাল এবং পরকাল উভয়ই সার্থক হবে। হেযবুত তওহীদ যথাসাধ্য সে প্রচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে।
জঙ্গিদের উদ্দেশে দু’টি কথা
যারা জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত বা আদর্শগত কারণে জঙ্গিবাদ সমর্থন করেন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রচার-প্রচারণায় তারা আহত ও ক্ষুব্ধ হতে পারেন। ভাবতে পারেন যে- ‘আমরা ইসলামের জন্য জীবন বাজি রেখে তাবৎ দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করছি, আল্লাহর দ্বীনকে সম্মুন্নত করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি অথচ হেযবুত তওহীদ আমাদের কুরবানীকে অবজ্ঞা করছে, আমাদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে । প্রকৃতপক্ষে আমাদের পরিষ্কার বক্তব্য হলো, যাদের উদ্দেশ্য সৎ, যারা ইসলামের জন্য অতুলনীয় ত্যাগ স্বীকার করে এবং আল্লাহ-আল্লাহর রসুলের জন্য যাদের হৃদয়ে অপরিমেয় ভালোবাসা রয়েছে তাদেরকে আমরা কিছুতেই অবজ্ঞা করতে পারি না; কিন্তু যখন দেখি এই জাতির মূল্যবান প্রাণগুলো বিপথে পরিচালিত হয়ে অকালে ঝরে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির নোংরা খেলায় এই জাতির দৃঢ় ঈমানের মানুষগুলো ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তাদের জীবন-সম্পদ আল্লাহ-রসুলের উপকারে না লেগে ইসলাম ধ্বংসের উদ্দেশ্যে যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তাদের অভিসন্ধি পূরণের রসদ যোগাচ্ছে তখন আমরা কষ্ট পাই, ব্যথিত হই। দুঃখে বুক ভেঙ্গে যায়। আমাদের সন্তানদের দিয়ে আমাদেরকেই হত্যা করাচ্ছে। আমাদের স্থাপনা, পর্যটনকেন্দ্র, মসজিদ, রাস্তাঘাটগুলো ধ্বংস করাচ্ছে। বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে আমাদেরই শরীর। আফগানিস্তানের মাটিতে সোভিয়েত-রাশিয়ার স্বার্থের দ্বন্দ্বে এই জাতির অকুতোভয় সন্তানদের জেহাদের নামে বলি হতে দেখে আমরা ব্যথিত হই। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের শোষণের পথ প্রশস্ত করার জন্য মুসলমানদের বুকে টেনে নেয়, আবার স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে ঘৃণাভরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যখন জঙ্গি, চরমপন্থী, মৌলবাদী অপবাদ দেয় তখন আমাদেরও অন্তর্জ্বালা কম হয় না। বাস্তবতা হচ্ছে, যারা বর্তমানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবে বলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, তাদের বহু ত্যাগ-স্বপ্ন-সাধনা ও প্রাণক্ষয় কার্যত জাতিকে এতটুকু লাভবান করে নি। বরং ইসলামের ক্ষতিই হয়েছে। উপকার হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের, উপকার হয়েছে ইসলামের শত্র“দের।
সুতরাং আপনারা যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে লড়াই করছেন, সেই ইসলামের স্বার্থেই ওপথ থেকে ফিরে আসুন। এতে আপনারা নিজেরা যেমন উপকৃত হবেন, জাতিও উপকৃত হবে। আমাদের এই দেশের মাটিতে থেকে, দেশের মানুষের কল্যাণে অবদান রাখা যায়। মু’মিন হবার জন্য জান-মাল নিয়ে ইরাক-সিরিয়া যাবার দরকার নেই; সেই জান-মাল আপনারা এই দেশের নিপীড়িত, নির্যাতিত, অন্যায়-অবিচারে ক্লিষ্ট, দরিদ্র-বুভুক্ষ, অশিক্ষা-কুশিক্ষায় জর্জরিত সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজে লাগান; হানাহানি, রক্তারক্তিতে লিপ্ত ও দল-মত, ফেরকা-মাজহাবে বিভক্ত জাতির মধ্যে ঐক্য, শৃঙ্খলা, মানবতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করুন। এতে আপনাদের দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই সাফল্যমণ্ডিত হবে।
[লেখাটি দৈনিক বজ্রশক্তি পত্রিকার আগস্ট মাসের সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে]
আমার ফেসবুক ইউআরএল
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪০