somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: অদ্ভুত মৃত্যুর ডাক

১০ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৩:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অলংকরণ: জসীম অসীম।

[নোট: আমি এই গল্পটি লিখেছিলাম ১৯৯০ সালে। তখনও ছোটগল্প বিষয়ে আমার কোনো ধারনাই তৈরি হয়নি। তবু এ গল্পটি আমি একসময় কুমিল্লার `দৈনিক রূপসী বাংলা' পত্রিকার সাহিত্য পাতা'য় ছাপাতে দিয়েছিলাম। এই গল্পটিও ওই পত্রিকায় বেশ গুরুত্বসহ ছাপা হয়। `রূপসী বাংলা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল ওহাব ওই পত্রিকার সাহিত্য পাতায় আমার অনেক গল্পই ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। সেটা ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে। সময়ের আবর্তনে এবং আমার জীবনের একাধিক দুর্ঘটনায় প্রকাশিত তারিখসহ সেসব লেখার অধিকাংশই হারিয়েছি। আজ অনেক বছর পর আমার স্ত্রী সাদিয়া অসীম পলি আমারই পুরনো কাগজপত্রের সঙ্গে এ লেখাটি পেয়ে তাৎক্ষণিক কম্পোজ করে দেয়।]
==============================
ভোর রাতের আরও অনেকটা সময় বাকী। চারদিক স্তব্ধতায় বন্দী। আমি মোহন। ব্রিগেডিয়ার মোহন। ঊনিশশ' একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের একজন দেশপতির হত্যা মামলায় আমিও জড়িয়ে গেছি কিংবা আমাকে জড়ানো হয়েছে। ওই হত্যার জন্য আমি কোনোভাবেই দায়ী কিনা, সে আলোচনা জটিল। তাই অন্তিম মুহূর্তে আর সে দিকে যাচ্ছিনা আমি। শুধু বলে রাখছি যে, একটু পরই আমার ফাঁসি হবে। ফাঁসি। মৃতু্যদন্ড কার্যকর করা হবে। জীবনের এই শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমি এখন ইচ্ছে করেই আমার মৃত্যুকে ভুলে আছি। মরতে যখন হবেই, তখন মৃত্যুকে আর ভয় করে কী লাভ। বরং একটু সুখে শান্তিতেই মরণ হোক আমার। তাই এখন আপনাদের আমার জীবনের স্মরণীয় এক সন্ধ্যামাখা বিকেলের কথা বলি।
তখন আমি কিশোর। সেদিন সঙ্গীদের সঙ্গে খেলাধুলো ভুলে গিয়ে বসেছিলাম কুমিল্লার গোমতি নদীর তীরে, যে গোমতি মিশে গেছে আমার রক্তের সঙ্গে। তখন ছিলো শরৎকাল। নদীর পাড় সবুজ সবুজ ঘাসে ঢেকে ছিলো। ঘাসের চাদরে হেঁটে হেঁটে কৃষকদের গরু-ছাগলগুলো তখন ঘাস খাচ্ছিলো। গরু-ছাগল কোনো কোনোটির পিঠে আবার ফিঙে পাখি বসে বসে ডাকছিলো। নানান রকমের ডাক। নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলো নানা রকমের কচুরিপানা। তাঁর কোনো কোনোটির মধ্যে আবার ছিলো বেগুনি রঙের ফুলও। আশেপাশের কৃষকেরা তখন বর্ষার উজানের জল নেমে যাওয়া চরগুলোতে চাষাবাদও করছিলো। দূরে এক চরে আমার বয়সী অনেক ছেলেদের ফুটবল খেলতেও দেখলাম। অন্যদিন হলে দৌড়ে যেতাম আমি। কিন্তু সেদিন খেলতেও ভালো লাগেনি আমার। ভালো লেগেছিল শুধু বসে বসে গোমতি নদীর এপার-ওপার দেখতে। খুব দূরে অবস্থিত একটা বাড়ীর ঘন গাছপালাকে বনের মতো মনে হচ্ছিল আমার। সবুজ সবুজ গাঢ় সবুজ। শুধু সবুজের সমারোহ। সেই সবুজের কথা কখনোই আমি ভুলে যেতে পারবো না। নদীর একপাশে মাছ ধরছিলো কয়েকজন জেলে। এক সময় একটি বড় মাছ পেয়ে তারা আনন্দে হৈ-হল্লা শুরু করলো। অন্যদিন হলে তাদের কাছে দৌড়ে যেতাম আমি। মাছের চোখ দেখতাম, লেজ দেখতাম। কেন ঠিক জানি না, সেদিন আমার দৌড়াদৌড়িতে একেবারেই মন ছিল না। আর গোমতি নদী বয়ে যাচ্ছিল ঠিক ওই আশ্বিনের নদীর মতোই। বুঝাই যাচ্ছিল না এ নদী আষাঢ়ে এতো ভীষণ উত্তেজিত হয়। নদী দিয়ে দু'পাড়ের যাত্রী নিয়ে এপার-ওপার করছিলো মাঝি। যাত্রীদের অধিকাংশেরই পরনে ছিল লুঙ্গি। অনেকের গায়ে আবার পাঞ্জাবী বা গেঞ্জিও ছিলো। কেউবা ছিল আবার খালি গায়েই। টুপি ছিল আরো অনেকের মাথায়। একই মাঝি সব বয়সী, সব ধর্মীয়, সব চেতনার, সব পেশার মানুষকে পাড় করে দিচ্ছিল। আমি সেদিনই প্রথম এতো গভীর করে এই ব্যাপারটি দেখেছিলাম। নদীর ওপারে ছিলো বাজার। বাজার থেকে সন্ধ্যামাখা বিকেলে খরচের ব্যাগ-পোটলা নিয়ে বাড়ি ফিরছিলো লোকজন। কেউবা ধীরে, কেউ বা দ্রুত লয়ে। কিন্তু বাড়ি ফিরছিলো সব্বাই-ই। ওপারে যে বাজার ছিল, তারই নীচে ছিল একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সে বিদ্যালয়েই পড়তাম আমরা। স্কুল প্রাঙ্গণে শীতকালে বছরে একবার মেলা হতো। মেলার সময় মাঝি খেয়া নৌকো খুব খুব যাত্রী বোঝাই করেই এপার-ওপার করতো। একবার এই মেলার সময়েই নৌকোডুবিতে আমার চাচাত ভাই রবিন মারা গিয়েছিলো। সে দুঃখের স্মৃতি আমি কোনোদিনই ভুলবোনা। ভুলে যেতে পারবো না। নদীর পাড় দিয়ে সেদিনই যাচ্ছিল এক ফেরিওয়ালা। স্বাস্থ্য বেশি ভালো ছিল না তাঁর। পরনে ছিল নীল রঙের লুঙ্গি। ঠিক শরতের আকাশটারই মতো। তাঁর এ দ্রুত বাড়ির দিকে হাঁটার মধ্যে এক ধরনের সুখ দেখেছিলাম আমি। ঠিক তখনই হঠাৎ রেলগাড়ির ডাক শুনলাম আমি। রেলগাড়িটা আসলো এবং গেলো।পশ্চিমের নদীর ওপরের লাল ব্রীজটা দিয়েই। শব্দ করলো নানা রকমের শব্দ। ওর দৌড়ের দাপটে মাটি এবং নদীর পানিও কেঁপেছিলো সেদিন। দেখেছিলাম খুব কাছ থেকেই। কিশোর একজন রাখাল বাড়ি ফিরছিলো বিড়ি খেতে খেতে। তারই পেছন দিক থেকে আমাদের ওসমান স্যার আসছিলেন কালো সাইকেল চেপে। বোধ হয় শ্বশুরবাড়ী থেকেই। কারণ সেদিন ছিল রবিবার, স্কুল ছুটির দিন। ছুটির দিনে কতো খেলা খেলতাম আমরা। কিন্তু কেন যে সেদিন সব খেলা বাদ দিয়ে শুধু দেখার খেলাই খেলছিলাম আমি। দেখা-দেখা শুধুই দেখা। এ দেখার যেন আর শেষই ছিল না। হঠাৎ একজন মহিলাকে একটি শিশু কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখেছিলাম। শিশুটির হাত পা ও পেট দেখে বুঝেছিলাম শিশুটি ভীষণই অপুষ্টির শিকার। মহিলার পরনের শাড়িতে অনেকগুলো তালিও দেখেছিলাম। শাড়ির একদিকের ছিঁড়ে জায়গা দিয়ে মহিলাটির হাঁটু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিলো। এতোই দরিদ্র ছিলো সেই মহিলা। রাগে- ঘৃণায়- দুঃখে আমার কান্না এসেছিলো। জানিনা এ কিসের রাগ... কিসের ঘৃণা কিংবা কিসের দুঃখ। হয়তো মহিলার কষ্ট দেখেই এমন হয়েছিলো। হঠাৎ সামনে দেখেছিলাম মশার ঝাঁক। ততক্ষণে নিজ বাড়ির দিকে ফিরবো বলে ওঠে দাঁড়ালাম আমি। আকাশে তখন অনেক অনেক ঘুরন্ত উড়ন্ত বাদুর। মেঘগুলোও আর নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা ছিল না তখন। অস্ত যাওয়া সূর্যের রঙে রক্তের মতো লাগছিলো। আর তখনই আমার ভয় লেগে গেলো। সাদা সাদা মেঘগুলো এভাবে রক্তে ছেয়ে গেলো কেনো। রক্ত মেঘে ভেসে ভেসে আমি বাড়ি ফিরতে লাগলাম।

শেষ কথা: আমি মোহন। ব্রিগেডিয়ার মোহন। ঊনিশশ' একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের একজন দেশপতির হত্যা মামলায় আমিও জড়িয়ে গেছি কিংবা আমাকে জড়ানো হয়েছে। ওই হত্যার জন্য আমি কোনোভাবেই দায়ী কিনা, সে আলোচনা জটিল। এবার আমিও উঠি বন্ধু। ডাক এসেছে। ফাঁসির ডাক। অস্ত যাওয়া রক্তবর্ণের সূর্যের মতো করুন রঙা ডাক। এ ডাক অদ্ভুত এক মৃত্যুর ডাক। এ ডাক ছেলেবেলার সেই নদীতে দেখা কচুরিপানার শোনা ডাক। কেবলই ভেসে চলা। উজানের দিকে আর ফেরার উপায় নেই কিংবা যেন রবিনের মতো নৌকাডুবিতে মরার ডাক: যে ডাক থেকে ফেরার উপায় কক্ষনোই থাকে না। কোনোদিন না। মানুষকে কেন এমন মৃত্যু এসে ডাকে? কেনো?
[নোট: আমি এই গল্পটি লিখেছিলাম ১৯৯০ সালে। তখনও ছোটগল্প বিষয়ে আমার কোনো ধারনাই তৈরি হয়নি। তবু এ গল্পটি আমি একসময় কুমিল্লার `দৈনিক রূপসী বাংলা' পত্রিকার সাহিত্য পাতা'য় ছাপাতে দিয়েছিলাম। এই গল্পটিও ওই পত্রিকায় বেশ গুরুত্বসহ ছাপা হয়। `রূপসী বাংলা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল ওহাব ওই পত্রিকার সাহিত্য পাতায় আমার অনেক গল্পই ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। সেটা ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে। সময়ের আবর্তনে এবং আমার জীবনের একাধিক দুর্ঘটনায় প্রকাশিত তারিখসহ সেসব লেখার অধিকাংশই হারিয়েছি। আজ অনেক বছর পর আমার স্ত্রী সাদিয়া অসীম পলি আমারই পুরনো কাগজপত্রের সঙ্গে এ লেখাটি পেয়ে তাৎক্ষণিক কম্পোজ করে দেয়।]
==============================
ভোর রাতের আরও অনেকটা সময় বাকী। চারদিক স্তব্ধতায় বন্দী। আমি মোহন। ব্রিগেডিয়ার মোহন। ঊনিশশ' একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের একজন দেশপতির হত্যা মামলায় আমিও জড়িয়ে গেছি কিংবা আমাকে জড়ানো হয়েছে। ওই হত্যার জন্য আমি কোনোভাবেই দায়ী কিনা, সে আলোচনা জটিল। তাই অন্তিম মুহূর্তে আর সে দিকে যাচ্ছিনা আমি। শুধু বলে রাখছি যে, একটু পরই আমার ফাঁসি হবে। ফাঁসি। মৃতু্যদন্ড কার্যকর করা হবে। জীবনের এই শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমি এখন ইচ্ছে করেই আমার মৃত্যুকে ভুলে আছি। মরতে যখন হবেই, তখন মৃত্যুকে আর ভয় করে কী লাভ। বরং একটু সুখে শান্তিতেই মরণ হোক আমার। তাই এখন আপনাদের আমার জীবনের স্মরণীয় এক সন্ধ্যামাখা বিকেলের কথা বলি।
তখন আমি কিশোর। সেদিন সঙ্গীদের সঙ্গে খেলাধুলো ভুলে গিয়ে বসেছিলাম কুমিল্লার গোমতি নদীর তীরে, যে গোমতি মিশে গেছে আমার রক্তের সঙ্গে। তখন ছিলো শরৎকাল। নদীর পাড় সবুজ সবুজ ঘাসে ঢেকে ছিলো। ঘাসের চাদরে হেঁটে হেঁটে কৃষকদের গরু-ছাগলগুলো তখন ঘাস খাচ্ছিলো। গরু-ছাগল কোনো কোনোটির পিঠে আবার ফিঙে পাখি বসে বসে ডাকছিলো। নানান রকমের ডাক। নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলো নানা রকমের কচুরিপানা। তাঁর কোনো কোনোটির মধ্যে আবার ছিলো বেগুনি রঙের ফুলও। আশেপাশের কৃষকেরা তখন বর্ষার উজানের জল নেমে যাওয়া চরগুলোতে চাষাবাদও করছিলো। দূরে এক চরে আমার বয়সী অনেক ছেলেদের ফুটবল খেলতেও দেখলাম। অন্যদিন হলে দৌড়ে যেতাম আমি। কিন্তু সেদিন খেলতেও ভালো লাগেনি আমার। ভালো লেগেছিল শুধু বসে বসে গোমতি নদীর এপার-ওপার দেখতে। খুব দূরে অবস্থিত একটা বাড়ীর ঘন গাছপালাকে বনের মতো মনে হচ্ছিল আমার। সবুজ সবুজ গাঢ় সবুজ। শুধু সবুজের সমারোহ। সেই সবুজের কথা কখনোই আমি ভুলে যেতে পারবো না। নদীর একপাশে মাছ ধরছিলো কয়েকজন জেলে। এক সময় একটি বড় মাছ পেয়ে তারা আনন্দে হৈ-হল্লা শুরু করলো। অন্যদিন হলে তাদের কাছে দৌড়ে যেতাম আমি। মাছের চোখ দেখতাম, লেজ দেখতাম। কেন ঠিক জানি না, সেদিন আমার দৌড়াদৌড়িতে একেবারেই মন ছিল না। আর গোমতি নদী বয়ে যাচ্ছিল ঠিক ওই আশ্বিনের নদীর মতোই। বুঝাই যাচ্ছিল না এ নদী আষাঢ়ে এতো ভীষণ উত্তেজিত হয়। নদী দিয়ে দু'পাড়ের যাত্রী নিয়ে এপার-ওপার করছিলো মাঝি। যাত্রীদের অধিকাংশেরই পরনে ছিল লুঙ্গি। অনেকের গায়ে আবার পাঞ্জাবী বা গেঞ্জিও ছিলো। কেউবা ছিল আবার খালি গায়েই। টুপি ছিল আরো অনেকের মাথায়। একই মাঝি সব বয়সী, সব ধর্মীয়, সব চেতনার, সব পেশার মানুষকে পাড় করে দিচ্ছিল। আমি সেদিনই প্রথম এতো গভীর করে এই ব্যাপারটি দেখেছিলাম। নদীর ওপারে ছিলো বাজার। বাজার থেকে সন্ধ্যামাখা বিকেলে খরচের ব্যাগ-পোটলা নিয়ে বাড়ি ফিরছিলো লোকজন। কেউবা ধীরে, কেউ বা দ্রুত লয়ে। কিন্তু বাড়ি ফিরছিলো সব্বাই-ই। ওপারে যে বাজার ছিল, তারই নীচে ছিল একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সে বিদ্যালয়েই পড়তাম আমরা। স্কুল প্রাঙ্গণে শীতকালে বছরে একবার মেলা হতো। মেলার সময় মাঝি খেয়া নৌকো খুব খুব যাত্রী বোঝাই করেই এপার-ওপার করতো। একবার এই মেলার সময়েই নৌকোডুবিতে আমার চাচাত ভাই রবিন মারা গিয়েছিলো। সে দুঃখের স্মৃতি আমি কোনোদিনই ভুলবোনা। ভুলে যেতে পারবো না। নদীর পাড় দিয়ে সেদিনই যাচ্ছিল এক ফেরিওয়ালা। স্বাস্থ্য বেশি ভালো ছিল না তাঁর। পরনে ছিল নীল রঙের লুঙ্গি। ঠিক শরতের আকাশটারই মতো। তাঁর এ দ্রুত বাড়ির দিকে হাঁটার মধ্যে এক ধরনের সুখ দেখেছিলাম আমি। ঠিক তখনই হঠাৎ রেলগাড়ির ডাক শুনলাম আমি। রেলগাড়িটা আসলো এবং গেলো।পশ্চিমের নদীর ওপরের লাল ব্রীজটা দিয়েই। শব্দ করলো নানা রকমের শব্দ। ওর দৌড়ের দাপটে মাটি এবং নদীর পানিও কেঁপেছিলো সেদিন। দেখেছিলাম খুব কাছ থেকেই। কিশোর একজন রাখাল বাড়ি ফিরছিলো বিড়ি খেতে খেতে। তারই পেছন দিক থেকে আমাদের ওসমান স্যার আসছিলেন কালো সাইকেল চেপে। বোধ হয় শ্বশুরবাড়ী থেকেই। কারণ সেদিন ছিল রবিবার, স্কুল ছুটির দিন। ছুটির দিনে কতো খেলা খেলতাম আমরা। কিন্তু কেন যে সেদিন সব খেলা বাদ দিয়ে শুধু দেখার খেলাই খেলছিলাম আমি। দেখা-দেখা শুধুই দেখা। এ দেখার যেন আর শেষই ছিল না। হঠাৎ একজন মহিলাকে একটি শিশু কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখেছিলাম। শিশুটির হাত পা ও পেট দেখে বুঝেছিলাম শিশুটি ভীষণই অপুষ্টির শিকার। মহিলার পরনের শাড়িতে অনেকগুলো তালিও দেখেছিলাম। শাড়ির একদিকের ছিঁড়ে জায়গা দিয়ে মহিলাটির হাঁটু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিলো। এতোই দরিদ্র ছিলো সেই মহিলা। রাগে- ঘৃণায়- দুঃখে আমার কান্না এসেছিলো। জানিনা এ কিসের রাগ... কিসের ঘৃণা কিংবা কিসের দুঃখ। হয়তো মহিলার কষ্ট দেখেই এমন হয়েছিলো। হঠাৎ সামনে দেখেছিলাম মশার ঝাঁক। ততক্ষণে নিজ বাড়ির দিকে ফিরবো বলে ওঠে দাঁড়ালাম আমি। আকাশে তখন অনেক অনেক ঘুরন্ত উড়ন্ত বাদুর। মেঘগুলোও আর নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা ছিল না তখন। অস্ত যাওয়া সূর্যের রঙে রক্তের মতো লাগছিলো। আর তখনই আমার ভয় লেগে গেলো। সাদা সাদা মেঘগুলো এভাবে রক্তে ছেয়ে গেলো কেনো। রক্ত মেঘে ভেসে ভেসে আমি বাড়ি ফিরতে লাগলাম।

শেষ কথা: আমি মোহন। ব্রিগেডিয়ার মোহন। ঊনিশশ' একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের একজন দেশপতির হত্যা মামলায় আমিও জড়িয়ে গেছি কিংবা আমাকে জড়ানো হয়েছে। ওই হত্যার জন্য আমি কোনোভাবেই দায়ী কিনা, সে আলোচনা জটিল। এবার আমিও উঠি বন্ধু। ডাক এসেছে। ফাঁসির ডাক। অস্ত যাওয়া রক্তবর্ণের সূর্যের মতো করুন রঙা ডাক। এ ডাক অদ্ভুত এক মৃত্যুর ডাক। এ ডাক ছেলেবেলার সেই নদীতে দেখা কচুরিপানার শোনা ডাক। কেবলই ভেসে চলা। উজানের দিকে আর ফেরার উপায় নেই কিংবা যেন রবিনের মতো নৌকাডুবিতে মরার ডাক: যে ডাক থেকে ফেরার উপায় কক্ষনোই থাকে না। কোনোদিন না। মানুষকে কেন এমন মৃত্যু এসে ডাকে? কেনো?

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:১০
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×