১.
মুন্না, কেমন আছিস, কোথায় আছিস জানি না। মাঝে মাঝে তোর কথা মনে পড়ে, যদিও সত্যি যে এখন অনেকটাই মনের আড়াল হয়ে গেছিস। বুকে কোথাও যেন তবু বাজে, খুব করে বাজে, কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। বন্ধু আসে যায়, সময়ের সাথে পাল্টায়, তবু তোর জায়গাটা আজো ভীষণ খালি, ঠিক তেমনি বিশটি বছর আগের মতোই। জুন মাসটাই বড্ড বেশি কাঁদায়। ১৯৯৬ সালের ৩রা জুনের সে দিনটি স্পষ্ট চোখের সামনে ভাসে। আর তিনটা দিন পরেই সাধারণ নির্বাচন, চারিদিকে সাজ সাজ রব আর আনন্দ। এর মাঝেই পায়ে হেঁটে বাদুরতলা হতে রওনা দিলাম চেরাগি পাহাড়ের উদ্দেশে বিকেলের চড়া রোদটা একটু কমে আসতেই। কথা ছিল, আজ মিলব আমরা সবাই, দেখা হবে, আড্ডা হবে, চলবে গান-গল্প আর আবৃত্তি, তোদের বাড়ির সামনের সেই দুর্বাঘাসে ঢাকা খোলা মাঠটিতে। ঠিক সেখানটাতেই দেখা হলো সবার। কথা হলো কিন্তু আড্ডা-গান-গল্প কোনোটাই নয়। তোর সাথেও দেখা হলো তবে সেই মাঠটিতে নয়, দেখা হলো তোদের টিনের চালাঘরের সেই সরু বারান্দাটায়, কোণে রাখা সেই কাঠের বিছানাটায় যেখানটায় দিনের পর দিন, রাতের পর রাত শুয়ে-বসে একসাথে কাটিয়েছি আমরা। হ্যাঁ, দেখাই তো হল, শুধু আমরাই দেখলাম। দেখলাম – তোর নিঃসাড় দেহ, তোর মায়ের বুক চাপড়ে চাপড়ে মাটিতে গড়াগড়ি, তোর আদরের সেই ছোট্ট বোনটির চোখে অবিরল জলের ধারা। সবশেষে যথারীতি সবাই মিলে অভয়মিত্র মহাশ্মশানের পথে সেই অন্তিম যাত্রা।
আমার বারবার মনে পড়ছিল পহেলা বৈশাখের সেই দিনটির কথা। ডিসি হিলে দেখা হয়েছিল আমাদের, উত্তাল তরঙ্গ তখন চট্টগ্রামের সকল সংস্কৃতি কর্মীদের মধ্যে, ‘এই ডিসি হিল আমাদের’ শিরোনামে। উপর থেকে নেমে আসছিলি তুই, চোখে তোর সেই প্রিয় সানগ্লাস, ছোট ছোট চুলের হেয়ার কাট; দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছিলি আমাকে, ‘দোস্ত, আজকে টাকা চাইবি না, আজকে বৎসরের প্রথম দিন টাকা চাইলে সারা বৎসর টাকা চাইবি’। তোর কথা শুনে হেসে উঠেছিলাম আমি আর মনে পড়ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরের সেই সন্ধ্যাটা। ‘এক বল বাকি থাকতেই ক্রিকেট খেলাটা শেষ হয়ে গেল’ মহিউদ্দীন চৌধুরির গ্রেপ্তারের কারণে উত্তপ্ত চট্টগ্রাম; একদিন আগেই বইমেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মন্তব্য করছিল সবাই। তোর খুব মন খারাপ; স্টলে অনেকের কাছে টাকা বকেয়া রয়ে গেছে তাই, আর এদিকে আমি ঝগড়া করছি আমার বইযের টাকার জন্য। আজ আফসোস হচ্ছে খুব কেন সেদিন টাকাটা চাইলাম না, তাহলে তোর কাছে সারাটি বৎসর টাকা চাইতে পারতাম, তোর সাথে নির্বাক দর্শন হতো না এমনটি।
২.
রাত ৯ টায় শ্মশানে রওয়ানা হবার কথা ছিল আমাদের সবার। আটটা বাজতেই কেমন যেন ভীড়টা হালকা হয়ে গেল খুব, লোকজন কমে গেল নিমিষেই। বুঝলাম, টিভি দেখতে বসে গেছে সবাই কোথাও না কোথাও, সামনেই নির্বাচন। আটটার সংবাদের পর প্রধান নির্বাচনী দলগুলোর সাথে সরাসরি আলোচনা অনুষ্ঠান আসরটাকে জমিয়ে দিয়েছে আরো, সঞ্চালনা করছেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আনিসুল হক। মুন্না, তোর সেই প্রিয় মানুষটা, আজ তিনি নগরপিতা রাজধানী শহরের। সময়ের সাথে সাথে কত কিছুই পাল্টায়, সেই প্রশ্নকর্তা মানুষটি আজ উত্তরদাতার ভূমিকায় এক মিডিয়া হাউজ থেকে অন্য মিডিয়া হাউজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষ পাল্টায়, ভুমিকা পাল্টায়, কিন্তু প্রক্রিয়া পাল্টায় না। কিছু ঐতিহ্য আজো বর্তমান সেই বিশ বছর আগের মতোই। কতো নাটক, হাসির খোরাক এখনো সেই একই। নগরপিতা হবার দৌড়ে প্রার্থীদের ঝাড়ু দেবার প্রতিযোগিতার কিছু তথ্য জোগাড় করে রেখেছি, ছবির তো কোন অভাব নেই, এখন সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন। কিছু ছবি নিয়ে একটা কোলাজ করব ভেবেছি, আর ক্যাপশন হিসেবে ধার নেব তোর সেই প্রিয় ডায়ালগটি ‘ভন্ডামি দেখবেন, পাঁচটি বৎসর অপেক্ষা করুন’।
কতবার এ রাস্তা ধরে একসাথে হেঁটেছি আমরা, চেরাগি পাহাড় মোড় থেকে আন্দরকিল্লা, টেরিবাজার মোড় হয়ে বলুয়ার দীঘির পাড় আর অভয়মিত্র মহাশ্মশানের পথে। কখনো ভাবিনি তোকে ছাড়া হাঁটব কোনদিন, ঠিক তোকে ছাড়া নয়, তুইতো আছিস, সাথেই আছিস, কাঁধেই চড়ে আছিস। ভাবিনি এটাই যে তোকে কাঁধে নিয়ে হেঁটে যাব কখনো। ‘হরি হরি বোল’ শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে পা ফেলে আমার শরীরটা এগোচ্ছে ঠিকই কিন্তু আমার মনটা এখনো চেরাগি পাহাড়ের মোড়ের সেই মাঝবৃত্তটায় ঘুরপাক খাচ্ছে, গিটার হাতে ঝড় তুলছিস তুই ‘চলো না ঘুরে আসি অজানাতে. . .’। একাই সে অজানায় পা বাড়ালি তুই; ঘুরে আসবি তো?
৩.
টেরিবাজার মোড় পার হতেই আমার পায়ের পাতা যেন আর চলছিল না। খালি পায়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। কতো না একে অন্যের কাঁধে চড়েছি আমরা, অসংখ্যবার; মনে পড়ে না কখনো ছেড়ে দিয়েছি একে অন্যের ভার সইতে না পেরে। আজ চারটা মানুষ মিলেও কেমন যেন হাঁফিয়ে উঠছি। লাশের ওজন কি জীবিত মানুষের চাইতে বেশি হয়? আমি কাঁধ সরিয়ে নিলাম, মুন্না; শেষবারের মতোই। আমার চোখের সামনে ভাসছিল কর্ণফুলী’র পাড়ের সেই নতুন খোঁড়া পুকুরটি যেখানে ডুবে গেলি তুই। আবাসিক এ প্রকল্পটি আজ দালানে দালানে ভরা, মানুষে মানুষে জমজমাট। কেউ কি মনে রেখেছে তোকে? কেন চলে গেলি তুই?
অভয়মিত্র মহাশ্মশানের যতই কাছাকাছি আসছিলাম, ততই কেমন যেন অস্বস্তি ভর করছিল আমার মাঝে, একটু পরই ছেড়ে যেতে হবে তোকে। তোর কোন সাড়া নেই আজ, অথচ সব বন্ধুরা আজ তোর সাথে.....নয়ন, শ্যামল, রাজিব, মুনতাসির, কাইয়ুম, তাপস। আশপাশের দোকানপাট থেকে লোকজন শবযাত্রাটা উঁকি দিয়ে দেখে, কেউ জেনে নেয়ার চেষ্টা করে লাশের পরিচয়, ‘হরি হরি বোল’ শব্দ শুনে কেউ বুঝে নেয় লাশটা স্বজাতি না অন্য কারোর। আমার চোখে ভেসে আসে শ্মশানের সেই ইলেকট্রিক প্লেটের উপর সাজানো ছাই, কী নিমেষেই আধ ঘন্টার মধ্যে একটা মানুষের পুরো শরীরটা ছাইয়ে রুপান্তরিত হয়! এতো সুন্দর থরে থরে সাজানো ছাই কি কোথাও দেখি আমরা!
‘কে মারা গেছে, ভাই?’
‘আমাদের বন্ধু, চেরাগি পাহাড় মোড়ে বাসা’ উত্তর দেয় একজন।
‘এতো কম বয়সে’, আফসোস করে একজন।
‘ওহ্ হিন্দু! যাক বাবা, নৌকার ভোট একটা কমলো’ বলুয়ার দীঘির পূর্ব পাড়টায় চায়ের দোকানটার সামনে সটান থমকে যাই আমি, মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে।
পলকেই দৌড়ে চায়ের দোকানটার ভেতরে ঢুকে পড়ে মুনতাসির, শার্টের কলার ধরে হেঁচকা টানে লুঙ্গি পরা লোকটাকে তুলে ধরে। ‘কী বললি শালা’ বলে সজোরে একটা চড় কষায় লোকটার বাম গালে। লোকটা চড় খেয়ে কেমন যেন ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে যায়, কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। চরম উত্তেজনায় আমরা আরো এগিয়ে যেতে থাকলে মাঝখানে এসে দাঁড়ায় কাইয়ুম। ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে তর্ক জুড়ে দেয়। আমরা একটু অবাক হই তার লোকটার পক্ষ নেয়া দেখে। সে চোটপাট করতে থাকে তার গায়ে হাত তোলায়। আমরা কেমন যেন হিসাব মেলাতে পারি না, তার এলাকার মানুষ এতো বাজে একটা মন্তব্য করল বন্ধুর লাশ নিয়ে। সে কোথায় আমাদের হয়ে কথা বলবে তা না, ঠিক তার উল্টোটা!
তোর সেই প্রিয় বন্ধুটা, কাইয়ুম, এবারের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছে, মুন্না। কোন মার্কার ভোটারদের ভোটের জোরে জানি না; কারণ, সেদিনের পর থেকে খুব একটা ভালো যোগাযোগ নেই আমাদের আর।
৪.
চলে গিয়ে ভালোই করেছিস মুন্না, বেঁচে গেছিস তুই। আমাদের এই সময়ে তুই এমনিই টিকে থাকতে পারতিস না বন্ধু। তুই তো ইম্যাচিউরড, আমাদের ভাষায়। মনে পড়ে, সেবার বাদুরতলায় সব বন্ধুরা মিলে ফিল্ম দেখতে বসেছিলাম। অনেক আয়োজনের সেই অ্যাডাল্ট ফিল্ম দেখা। কয়েক মিনিট যেতেই লাফিয়ে উঠেছিলি তুই, ‘এই বন্ধ কর্ এসব, এ ছি!’ আমাদের ধমক খেয়ে বসে পড়েছিলি দু’হাতে দু’চোখ ঢেকে। ‘আমার কেমন যেন লাগছে, তোরা এসব বন্ধ কর দোস্ত, প্লিজ!’ আমরা কয়েকজন মুখ থেকে তোর দু’হাত সরিয়ে দিয়ে জোর করে ফিল্ম দেখানোর চেষ্টা করছিলাম। কেউ কেউ ঠাট্টা করছিল, ‘বেইবি, তুমি বাসায় যাও। সাবু খাবে? বার্লি খাবে?’ এর মধ্যেই গল্গল করে বমি করে দিয়েছিলি তুই। তুইতো আসলে ম্যাচিউরড না, তুই এমনিতেই টিকে থাকতে পারতিস না আজকের এই দিনে। আজকাল আর ভিডিও ভাড়া করতে হয় না, সবার হাতে হাতে স্মার্ট ফোন, ঘরে ঘরে কম্পিউটার। ডিজিটাল মায়ায় আমরা একে অন্যের খুব কাছে। অ্যাডাল্ট ফিল্মও এখন আর মন ভরে না। আমরা এখন দল বেঁধে শিশু পেটাই, যুবক পেটাই, বৃদ্ধ পেটাই; নামের পর নাম যোগ হয় – বিশ্বজিৎ, অভিজিৎ, সামিউল রাজন। মোবাইলে সে দৃশ্য ধারণ করি, রেকর্ডিং থামে না শেষ নিঃশ্বাস না ফেলা পর্যন্ত। কখনো লাশ গুম করে দেই। সে রেকর্ড ছড়িয়ে দিই সামাজিক নেটওয়ার্কে সবাই যাতে দেখতে পায়। আমরা সবাই মিলে বাসায়, অফিসে, টিভিতে সে দৃশ্য দেখি। দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হই, শেয়ার করি, মজা পাই, বিনোদিত হয়, সময় কেটে যায় আমাদের। আমরা এসব দেখা শুরু করতে না করতেই কেউ বমি করি না তোর মতো। ফিল্ম দেখার মাঝামাঝি বা শেষ করে তখন আমরা হস্তমৈথুন করতাম; আর আজকাল এসব দেখে কোন বিকার হয় না, তেমন কিছু করতে হয় না, খুব ভাল বা খুব খারাপ লাগলে বড়জোর একটা স্ট্যাটাস দিয়ে বা একটা মন্তব্য লিখেই সব উগড়ে দিই; গুনতে থাকি ‘লাইক’-এর সংখ্যা, প্রতীক্ষায় থাকি অন্যদের মন্তব্যের। চলে গিয়ে ভালোই করেছিস, তুই আমাদের এ সময়ের উপযুক্ত না, মুন্না!
আশীষ বড়ুয়া
১৫.০৭.২০১৫
ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১:৩৯