somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চাঁদ নিভে গেলে বসে থাকি হাসনাহেনার বনে

১৮ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অভিলিপি: চাঁদ নিভে গেলে বসে থাকি হাসনাহেনার বনে

==================================
রোদ, তুমি স্বাস্থ্যবতী হয়ে রও এই সহজলভ্য দুপুরে।
পাড়ার রকে, বারান্দার গ্রীলে, আর ময়দানের কিশোর গাছটার কাছে। মানুষের কাছে রোদের মূল্য কম, নেই বললেই চলে। দেখ, ভুলে গেছি কতো রোদের করস্পর্শ- আমার ঘাড়ের উঠোনে, আঙুলের ব্যবহারে।

ভুলে গেছি থানা রোডের কাছে কৃষ্ণচূড়ার বিস্তার।

এখানে এখন শরৎ। বাঙালি রুটিনে।
আমরা মেঘের আত্মীয়তা ভুলে মর্মর মাড়াই। লালহলুদ ম্যাপলে ছেয়ে গেছে সড়কপাতা। ওহ্, দ্ব্যর্থহীন রোদ, উত্তাপ নিয়ে আমার শরীরে ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকো। এখানে শীত এলে শুকনো পাতা, খড় দিয়ে আগুন পোহানোর প্রচলন নেই।
আগুন পোহানোর রেওয়াজ এখনো হয়ত অটুট চরকাঁকড়ায়। সেই খড়ের অক্ষর পুড়িয়ে তাপপোহানো শীতের স্লেটে। ঈদে গ্রামে গেলে। সামাজিক আড়ম্বর। চিরকাল।
দাদী বয়েসী আঙুল দিয়ে আমার দূরন্তপনাকে বাস্তবিক করে দেন। খেলাচ্ছলে, গল্পের ফাঁকে আমরা শিখে নিই জীবনের নামতা। তারপর পাঠ করতেই থাকি, পাঠ করতেই থাকি......ক্রমশ।
তাঁর রান্না করা হাঁসের মাংশের স্বাদ লেগে আছে জিহবায়। লালার অহং এ সতেজ রাখি তাকে পরবর্তী ভোজনের।
অসংখ্য হাঁস যখন উঠোন ছেড়ে জলে নেমে যায় আমরা তখন স্থলের হাঁস হয়ে রোদ পোহাই। রোদের শাঁসে পুষ্টিপূর্ণ হয়ে উঠে আমাদের দেহ।
আমরা বেড়ে উঠি। আমাদের হাত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। আমরা পেয়ারা গাছের নাগাল পাই। পেয়ারা গাছটা জাতে অদ্ভুত। ছেলেবেলার চোখে। পেয়ারাগুলো ভিতরে আশ্চর্য লাল, আমার ঘুমহীন রাতুল চক্ষু।
আগে কখনো এমন খাই নি। অমৃত লাগে।
'আমাকে এই গাছটা কলব করে দিবে?'
'এই গাছ দিয়া তুই কী করবি! মাটি হাইবি কন্দায়?'
'বারে, বাসার ছাদে লাগাব। দোতলার ছাদে মাটি উঠানো নিশ্চয় কঠিন না।'
'যা ভাগ। মৌসুমে আঁই পেয়ারা খাইজাস দাদীর কাছে।'
আমরা সেই শপথ ভুলে গিয়েছি। আমরা পেয়ারা খাই না। ডাসাডাসা। আমরা লাল হয়ে কাঁদি। শহরের বিলবোর্ডে ঝুলে থাকে মৃতআমি ও সবাকরোদ।

গল্প করতে হয় আবছা অন্ধকারে, মিহি সুর/শব্দ থাকবে আশপাশে। দাদী বলে। তাঁর সব গল্প বলা হয় ঝিঁঝিঁসাঁঝে, বৈদ্যুতিক বাতিটাকে বিশ্রামে পাঠিয়ে চেরাগ জ্বালানো হয়- তার-ও আগে ছিল রেডীর তৈলের কুপি। ছোট কাকা নিয়ে বিক্রি করে ফেলেছিল কুপিটা! এখন বড়ই দুস্প্রাপ্য জিনিস। আমি মনে রেখেছি। তাই কোন গল্প লেখার আগে কাগজে দাদীর উপস্থিতি মনে করি। আমি আবছায়াঅন্ধকার তৈরী করতে চাই গল্পে, কুপি জ্বালানোর চেষ্টা করি- বারবার। পারি, কখনো পারি না।
অদ্ভুত সব গল্প। সুকুমার বাবুর আমার দাদীর সাথে পরিচিতি থাকলে আমরা আরো কিছু কালজয়ী পুস্তক পেতাম- আমাদের শিশুরা।
'হুনছত নি, ঘাডাগের পুকুরে একটা ছলি আছে।'
'"ছলি" কী জিনিস?'
'ছলি হইল জলের রাক্ষস। একলা জলে নামলে পায়ে রশি বান্ধি পাতালে লই যায়।'
আমাদের ভ্রাতা, ভগ্নিরা ভয়ে হাত পা.....আমি তখন বিজ্ঞানের কৌতূহলী ছাত্র ছিলাম। পুকুরের জলে মিথেন গ্যাসের জন্য আলেয়া হয়, কবরে মৃত মানুষের ফসফরাস বাতাসের সংস্পর্শে এসে গায়েবী আগুন হয়ে যায়- আমি এই পাঠ জানি। তবু-ও আমি নিশ্চুপ থাকতিম। পেয়েছি.....রবিদা- যিনি গতকাল আমাকে মোটে একটা ডাবের পানি পান করতে দিয়েছিলেন তাকে একদিন জলে নামিয়ে দিব- একলা। ছলি এসে নিয়ে যাক ওই ব্যাটাকে।
আমি ডাবের পানির শাঁস খাব, জুমজুমের জল সবার ভাগে জুটে না!

চাঁদে একটা বুড়ি চরকা কাটে- আমি এই ব্যাপারটা জানতাম না। বইয়ে পড়ে জানি। আমার জীবনই! দাদী আকাশ দেখতো না, দেখে না; তাঁর কেবল বৈশাখি-ঝড়ের ভয়। আমার জন্ম বৈশাখে। তাঁর ঘরে ঘনিষ্ঠবৈশাখঘুমকাতুরে।

'কী করো বুড়ি?'
'পোলা, নাক টিপলে দুধ বাইর অইব; আমারে বুড়ি কস্!'
'হিহিহিহিহি।'
'শহীদ আঁইঅক। তারপর হিহি বাইর অইব।'
জ্যাঠামশাইকে ভয় পেতাম, চুপ হয়ে শরৎ হয়ে যাই- কাশঝাঁড়। ইঁদুর আসে।

পাকিস্তানি আমলের কিছু টাকা ছিল তাঁর। সিন্দুকে। সিন্দুকে কীসের জানি একটা কাপড়-ও ছিল। আগে ভাবতাম বিয়ের শাড়ি! কিন্তু অতো সৌখিন তিনি নন। পরে জানি মহাপিতামহের দেয়া রুমাল।
বড় ভাইকে দুইটাকার নোট দিল কয়েকটি। আপু কতগুলো রূপালি, সোনালি কয়েন পেল। আমি আমের মুকুল নিয়ে বাগিচায় দাঁড়িয়ে থাকি। আমার রোদ দেখতে ভাল্লাগে। স্পষ্ট রোদ।
অবশ্য বদ্দার মানিব্যাগ থেকে একটাকার একটা নোট চুরি করে নিয়েছিলাম! পরে অবশ্য বলে দিয়েছি।
আমাকে একটা আংটি দিয়েছিল। উৎসবে। উপহার। হারিয়ে ফেলেছিলিম বাসার পিছনের কলাবাগানে। আমি তখন ইঁদুর। কলাবাগানে ইঁদুরের সওদাগরী কাজে লাগে না, কলাবাগানে বাদুড় হতে হয়। আমার শ্রবণশক্তি কম।

মা দেশে ফোন করে। আমি শুনি। আমি কাউকে ফোন করি, যোগাযোগ নেই। কেবল কান পেতে শুনি, তথ্য পেয়ে যাই।
দাদী কথা বলতে চায়। কেউ অনুরোধ করলে রাখার চেষ্টা করি। আমি সরিষাক্ষেতের হলুদ।
'ভালা আছো নি গো।'
'ভালো আছি দাদু, আপনি কেমন আছেন? শরীর ভালো? ডাক্তার দেখান তো নিয়মিত?' আমি হড়বড় করে কথা বলি। আমি শব্দের তোপ।
'ডাক্তার দেখাই লাভ নাই রে। এই বয়সে কত কিছু....।'
সত্তুর হয়ত অনেক বছর। হয়ত অনেক কম। আমার অংক করতে ভালো লাগে না। হঠাৎ।
গ্রামের গিয়ে একবার দাদীর সাথে আকাশ দেখতে হবে। রাতের। সেখানে চাঁদ থাকবে- অলস চাঁদে আমরা লিখে দিব রোজনামচা, তারার পেন্সিলে।

মাকে কখনো ফুল পরতে দেখি নি। দিদি পরে।
ফুলের জন্য আগ্রহ দেখেছি অনেক। বাসায় একটা হাসনাহেনার গাছ ছিল। তীব্র গন্ধ। আর অন্ধকারে-ও সাদা সাদা যেন। আমার সন্ধ্যার কাফন।
সেখানে বদ্দা একটা সাপ পেল একদিন। যথারীতি হাসনাহেনার বন সাবাড়। দা'র মুখ ধারালো।
আশা ছিল হাসনাহেনার মালা দিব মাকে।
দিই না। লজ্জা লাগে। মাকে সালাম করতে লজ্জা লাগে! ভিতরে ভিতরে ইচ্ছে মতন সাজিয়ে দিই মাকে। সালাম করি, পূজো করি। বলি না। বাতাসের কান প্রখর।

দাদী কী চলে যাবে...।
আমি তো সাইকেল চালাতে পারি না।
আমি বসে থাকব।

চাঁদ নিভে গেলে বসে থাকি হাসনাহেনার বনে।

১২/১০/২০০৯
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ৮:০৯
৩৪টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আরো একটি সফলতা যুক্ত হোলো আধা নোবেল জয়ীর একাউন্টে‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪০



সেদিন প্রথম আলো-র সম্পাদক বলেছিলেন—
“আজ শেখ হাসিনা পালিয়েছে, প্রথম আলো এখনো আছে।”

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আজ আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখতে চাই—
প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেব, আপনারা কি সত্যিই আছেন?

যেদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১১

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

ছবি এআই জেনারেটেড

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ প্রতিবাদের ভাষা নয় কখনোই
আমরা এসব আর দেখতে চাই না কোনভাবেই

আততায়ীর বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমাদের হাদিকে
হাদিকে ফিরে পাব না... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×