somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমরা একটা নদীর নাম দিয়েছিলিম

২৩ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ক্রমশ সংস্কৃতিবিচ্ছিন্নতা অস্বীকার করে আমরা বিক্রি করে চলি বাংলাদেশের ঠোঙা, পাঠ করি ধর্মের পুঁথি। মানুষের গেঞ্জির ঘামশহর দেখে ভুলে যাই বানরের নগর পত্তন।

================================


মাড়াই করা ধান নৌকায় নিয়ে এপার-ওপার করে সবুজ মাঝি - কাঁধে মেলে রাখা লাল গামছায় রোদের শাঁস। কয়েকটা হলদে মাছ রোদের লোভে ডিগবাজি খায় জলের 'পরে; ঝুপ করে আবার জলে নামার আগে দেখে নেয় মাঝির মুখের পুরাণ।

দাগনভূঁইয়া থেকে বাংলাবাজার পর্যন্ত যত মানুষ থাকে তাঁদের অশ্রু জমে কালিডাঙায় উপচে যেতে পারে, সে বিষয়ে চক্ষুপাত নেই আমাদের।


হাঁটুবয়েসের বন্ধু রফিকের বয়ান মনে পড়ে সহসা, "শালার, ডান্ডিগুলা দেবীর নামে নাম রাখি নদীটারে দূষিত করি হালাইছে!" শুনে আমরা চুপ করে থাকি, দূরে বাজচিলের পালক উড়ে। তার উক্তির এক চিলতে ভিত্তি আছে। পূর্বে নদীর ভ্রুণস্থানে শশ্মান আর কালিমন্দির ছিল; যদি-ও এখন আশপাশ ছেঁয়ে গেছে মুসলমানি লিঙ্গে- বাতাসে কেবল ছেঁড়া পালকের কবর!
আমরা শক্তি ও উৎসাহ পাই ইমামের ওয়াজে; তিনি হিন্দুনদীর পাশে নবনির্মিত মসজিদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন- তিনি হয় মসজিদ সরানো নতুবা নদীর নামের নতুন আকিকা করার উপদেশ দিয়েছেন। নতুন নামকরণই সহজ- আমাদের শরীরে বল আসে; আমরা নামের তালাশ করতে লাগি।


সাবেতাদের লিচু গাছে এবারে বেবাক ফলন। বসতবাড়িতে লিচুগাছ থাকলে বংশনাশ হয় এমন প্রবাদের মুখে ছাইভাত দিয়ে মহলমিয়া সংসার পেতেছেন সুখেই। সাবেতাদের বাগিচায় গাছপালা আছে নানা কিছিমের, ছায়াশস্য হরেক। আমরা অমাবস্যার রাতে নারিকেল, সুপারি চুরি করে আনি- গঞ্জে বিক্রি করে সিনেমার টাকা উঠাই- ফলের বিকিকিনিতে লাভ বেশি; তাই সাবেতা এবং তার সখীরা আমাদের কাছে পয়গম্বরের মতো জানান দেয়।
সাবেতার গালে আশ্বিনা মেঘ-রোদ মাখামাখি হয়ে হলদে সাদা- ছাপছাপ; বিকেল এলে মেঘনাগরের টানে সে হাঁটতে বের হয় নয়না, সেতারা প্রমুখকে নিয়ে। তাদের দেখে আমরা পথের মাপঝাঁপ বাড়িয়ে দিই। পশ্চিমের পুকুরপাড় ঘুরে এলে এক মুঠো বিকেল, দক্ষিণে সূর্যমুখী কিংবা সরিষার ক্ষেত মাড়ালে এক চিমটি সন্ধ্যা- আমরা এভাবে পথ ও সময়ের হিসেব রাখি। নয়না বিংশ বয়েসী- সখীদের মাঝে সে প্রাচীন; তার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য শান্তিবাদী মনোভাব। যখন-তখন লুঙ্গির কোঁচ মেরে উরুতে বাতাস লাগানো রফিকের নজর নয়নার চক্ষুদ্বয়ে নয়- সে বরং নয়নার শাড়ির প্রস্থ মাপতে আগ্রহী। আমি যেমন সাবেতার তিলের অভিমান খুঁড়তে খুঁড়তে আধ-জাগরণে রাত কাটাই; কেবল বালিশের বয়েস বাড়তে থাকে।


রফিকের বিশেষ পরিচয় আছে- সে মমিন সাহেবের ছেলে। মমিন সাহেব ভাতঘুম না দিয়ে বাজারের পর্দ লিখেন, আড়তের হিসেব করেন, বাঁ হাতের আঙুলে টাকার ঝাঁঝ নিয়ে বসে থাকেন; সে তুলনায় রফিক আলাভোলা ছেলে, কেবল মুখের লাগাম নাই। সে গান বাঁধে, নিজে গায়। সে বাঙলা সিনেমার গান অনুকরণে গান বাঁধে। আমরা স্মরণে রেখেছি:
'চল না ঘুরে আসি সাবেতাদের বাগিচায়
যেখানে মেঘ এসে সময় কাটিয়েছে
আবার এল যে নয়নার ফুল, শুধু
সেতারার কপালে চাঁদ টিপ হয়েছে।'
এসব শুনে আমরা বিনোদিত হই, কেবল সেতারার খোঁপার জবা আরো লাল হয়।
রফিকের গানগুলো যেভাবে শুরু হোক না কেন অবধারিতভাবে শেষ হবে নয়নার গুণকীর্তন করে! যেমন-
উত্তরের নদীতে নামালে মাটির নাও
জলে ভাসি নগ্ন বেশে
স্থানে এলে গামছাখানি সোহাগে দাও
আমার কাঁধের পাশে
বিনিময়ে বকুল দিব আজলা ভরে
নয়না, আমার মন উচাটন করে


আমার ঘরে একটা মাত্র জানালা- উত্তরের দেয়ালে, সেখানে শায়লা ফুফুর পায়রাগুলো সন্ধ্যের আগেআগে হাজির হয়, খুঁদ খায়। গৃহপালিত পশুপাখির দেখাশুনা, কলের জল আনা এসব ছোটছোট কাজ দেখভাল করে সুখী। সুখী আঁচলে চাল রেখে ছড়িয়ে দেয় সারা উঠোন, এই কাজটা সে উৎসাহের সাথে করে- সে জাতে হিন্দু! পায়রাগুলো এসে সমাবেশ করে; আমি পায়রা হয়ে জন্ম দিব পরের জন্মে। আমি পায়রা দেখি- না সুখীকে দেখি তা ঠাহর করতে পারি না!
না, সাবেতাই সই। ইচ্ছে করে সাবেতাদের বাগানের শেষ তেঁতুল গাছটার তেঁতুল মেখে খেতে একগাল, সেই তেঁতুলের শরীরে বৈকালিন রোদের ক্লান্তি লেগে থাকে।

সাবেতাদের উঠোনে একটু-ও মিথ্যে নেই। সে তুলনায় সাবেতার মায়ের গলা বাজখাঁই; আমরা তাই শার্টের খুঁট ধরে ধানক্ষেতের আইলে দাঁড়িয়ে থাকি- তেঁতুল পাকতে থাকে একলা। নিশিথবেলা তেঁতুল গাছ অনেকাংশেই বিপদজনক বিধায় আম-সুপারী নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
সাবেতা সারাদেহ নিয়ে লেপ্টে থাকুক আমার অঙ্গে, বুকের মাঠে; এতেই বেহেশত-কিছিমের সুখ। ছোটবেলায় একবার বুকের উপর দিয়ে সাইকেল চলে গিয়েছিল, আমি মরি নি; আজিব ব্যাপার হলো আমার ব্যথাই লাগে নি! সেদিন সাইকেলের চাপে আমার বুকের মাঠ সাবেতার জন্য বিশাল হয়ে গিয়েছিল, আমি জানি।


শশ্মান লাগোয়া মেঠোপথ ধরে মাইল দুয়েক কেবল নারিকেল গাছের সারি। এসব ফেরিয়ে একটি পুরানো দোতলা দালান আছে। সবুজ মাঝি আর নসু সন্ন্যাসী সেখানে থাকে। নসুকে সন্ন্যাস বলা যায় কিনা তা বিতর্কের বিষয়; সন্ন্যাসীদের সংসার উদাস থাকে; বুকের খাঁচার লোহা-সম্প্রদায় নিরীক্ষায় তারা সময় খরচ করে। কিন্তু এই সমস্তের বিপরীতে নসুর বউ আছে, তবে সন্তান নেই- হয় না। তার বউের গায়ের রঙ তার পরম শক্র হতে পারত বিধায় নসু পাখির পালক হয়েছে। সংসার পড়ে থাকে, সে চল্লিশোর্ধ শরীর নিয়ে বাতাসে উড়ে। তার বউের গায়ের রঙ আঁখের ভিতরের মতো হলুদাভ-সাদা। এই প্রকারের বহু ললনা আমাদের অঞ্চলের বাতাস টানে, আমরা জানি; তবে বিশেষ আগ্রহের ব্যাপার হলো যে নসুর বউের গায়ে একটা প্রাকৃতিক ছাপ বিদ্যমান। অনেকক্ষণ জমাট জলে স্নান করলে ত্বক যেমন আবেগীরঙা হয়ে যায়- তেমন! সবুজ মাঝি বউহারা, বয়েসী শরীরে নদী বাহে; খায়-দায় নসুদের সাথেই। গভীর রাতে এসে ঘুম পাড়ে, বিহানে আবার নদীর সহোদর।

নসু আমাদের পথের জোঁক হয়ে আছে। সে কখনো মসজিদের সিঁড়িতে ঘুমায়, কখনো মন্দিরের মেঝেতে গড়াগড়ি দেয়; এসবে আমাদের বিবাদ নাই- কিন্তু নচ্চারটা নদীর নাম বিষয়ক ইমাম সাহেবের ওয়াজকালে মসজিদের সিঁড়িতে প্রস্রাব করে দিয়েছে! হারামজাদা আবার দাঁড়ি রাখে, খালি গায়ে পৈতা পরে শহর বিষ করে।


সাবেতার লোমঘাসের রঙ লালচে কালো, চিরহরিৎ ওমের যোগান; আমার কোন কোন বিহানে শীত লাগলে তাদের পুকুরপাড়ে চলে যাই। সেখানে সাবেতা দাঁত মাজে। আমার সাথে সাবেতার চোখাচোখি হলে জবালাল।
'সু, ঘুম কেরকুম অইছে?'
'ভালা, সক্কালবেলার দিকে একটু ঠান্ডা পরে।'
'আমার বাড়িতে তুলা গাছ আছে, কম্বল আছে।'
সাবেতা চোখ তুলে তাকায়, গাঢ় ।
'তুঁই এসব ভেজালেতে যাইও না।'
'কিসের ভেজাল?' আমি সর্তক হই।
'নদীর নাম হিন্দু, মুসলমান অয় নিকি? নদী অইল নদী; বর্ষার সম্পত্তি; আমনেরা এত হাল দেন ক্যান নাম নিয়া?'
'হুন, সু। গোপন কথা কই। তুঁই তো জানোই মণ্ডল মিয়া ইলিকশনে খাঁড়াইবো সামনের মাসে। এবার আমার বাপের দৌড়ানি কম। তারউরপে মণ্ডল মিয়ারে সাপোর্ট করের জলিল মাস্টার। বাপজান চায় একটু মাঠ গরম করার জন্য। নামটাম এসব কিছু না। সব ধুঁয়া।'
'তুঁই তো আগে এরকুম আছিলা না। শহরে চাকরী পাও নাই তো কি অইছে। গাঁয়ে কিছু কামকাজ কর। বাপ চেয়ারম্যান অইছে বইল্লা মানষের বাড়া ভাতে ছাই দিবা এমন তো না।'
আমার গলা দিয়ে কথা উঠে আসে না, তরঙ্গ-জ্যাম শরীরে। জবা ফুল রঙ বদলায়, লাল থেকে কালো- অতপর রঙশূন্য।


জামশেদ একটা কাণ্ড করে বসল।

রাতের ডিগা যখন বয়েসী হয় তখন আমরা মাঝে মাঝে উত্তরের সরিষাক্ষেতে যাই। রস আর আতপচালের সিন্নি বানানো হয়- সাথে আটার রুটি। এসব আমরাই পাকাই। রস চুরি করা হয় যেমন খুশি। গাছগাছালি গোস্বা করে। আমাদের ঠোঁটে মিছরিছুরিহাসি।
শীতের ওষ্ঠ যখন চুষতে থাকে কালিডাঙার পাড়, আমরা তখন রাজ্য কাঁপাই। ঘরের মুরগি, হাঁস জবাই করা করা হয়, কবজি ডুবিয়ে খাই। আর কচি ডাবের পানি। পুরা মহুয়া!
জামশেদ একটা ছাগল পাকড়াও করেছে। বিশাল কারবার। কিন্তু আমাদের কারো ছাগলের মাংশ রান্না করার অভিজ্ঞতা নেই। আমরা সাবেতা, নয়না, সেতারা এদের-ও ডাকলাম। লোক বেশি হলে কাজ দ্রুত হবে, ধরা পড়লে-ও কেলেংকারি কম হবে।
"সাবাশ, জাইম্মা।" রফিক দাঁত কেলিয়ে হাসে। "কামের কাম কইরছত।"
"হে, হে। তালুকদারের হোগা বরাবর একটা চাপ দিলাম।" জামশেদ অকপট হয়।
"তাল্লাইর ছাগল নি? সম্বন্ধী সেদিন বাপের কাছে নালিশ দিছে- আঁই বোলে হেঁতার মাইয়্যার দিকে ফাল মারি।"
আমি কণ্ঠ ঝাড়ি, "ছাগলের মাংশে কি কাবাব বানান যায়?"
"না, মনে হয় না। মাইয়্যাগোরে জিগ্নন লাগবো।" রফিক বলে।
মেয়েরা এসে যায় আঁচলে কোমলগান্ধার নিয়ে।
"জামশেদ, লারকি জোগাড় করন লাগব। রফিক্যারে কইছি হেতে কলার বরগ আইনব, তুই যাই কিছু হুকনা ডালপালা লই আয়।" আমি বললাম।
আমি ছাগলের মাংশ কাটতে শুরু করে দিলাম। আহা! মাল একখান।
সাবেতা নারিকেল গাছের ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। আলোর শরীরে ছায়ার ওলান। জামশেদ পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আমি স্পষ্ট ওদের কণ্ঠ শুনতে পাই।
"সাবু, কেমন আছ?"
"ভালা আছি, জামশেদ ভাই। আমনের মার শরীল ভালা আছে নি?"
"হ, মাঝে মধ্যে কাশ হয়। বয়স অইগেলে আর ক'দিন!" জামশেদ বিরতি নেয়। "সাবু, আইজকা তোরে সুন্দর লাগের।"
সাবেতা কথা বলে না। সাবেতা কি জোরে শ্বাস ফেলছে? গালে লাল জমেছে? আমি ঠিক ঠাহর পাই না।
আমি হাঁক ডাকি, "জামু, তোরে না কইছি লারকি আনবেল্লাই!"
আমি উঠে গিয়ে ওদের পাশে দাঁড়াই।
"এরকুম ছিল্লাছিল্লি কররি কাঁ? যাইয়ের যে দেখরি না?" জামশেদ সূর্যে গরম বালি।
"চুপ, শালা। কথা বলবি তো পেট নামাই দিমু।" আমি ঈগলের ছায়া তখন।
জামশেদ আমার হাতে ধরা মাংশ কাটার ছুরি দিয়ে তাকায়। তাদের চোখে ভয়ের অবাক অস্তিত্ব।
সে চলে যায়। আমি সাবেতার দিকে তাকাই। সে কহে, "অবাক অই ন'।"

আমি-ও অবাক হই না।


সুখী'র একটা ফুলের বাগান আছে। সেই বনানীর সংকর প্রজাপতিদের সাথে আমার বিবাদ! সেই বাগানে সারাদিন ছায়াশরৎ খেলা করে, একটা মৌমাছি গান করে; আর রাতের বেলা একটি বেড়াল ডানা খুলে হাঁটে।
নসু কী উপায়ে সুখীকে নিকা করল সেকথা ভাবার চেয়ে আমি বরং খোলা পাথারে নৌকা নিয়ে চলা সবুজ মাঝির কথা ভাবি, তাতে ঢের সুখ হবে। অঞ্চলের তাদের বাস দু হালি এক বছর, তার পূর্ব ইতিহাস আমাদের বাপ-দাদারা দাঁড়ির ভিতরে লুকিয়ে রেখেছেন, ফলশ্রুতিতে আমরা নাগাল পাই না।
রাতের বেলা জোনাকদলের সাথী হয়ে আমি চলে এলাম শশ্মানের কাছে। অন্ধকারের ভীমরুল উড়ছে চারিদিকে, আলোর আগমন তাই সংকীর্ণ। উল্টোদিক দিয়ে চলে এলাম নসুর বাড়ির পিছনে, এখানে সুখীর বাগান- একটি বিড়ালের রাজত্ব; আমি কি কুকুর হয়ে যাব? নারিকেল পাতার মতো লকলকে জিহবা বের করে বাতাস চাটব?

ছোট ছোট আইলের দুপাশে গাছগাছালির অবস্থান। আধ-দালান, আধা খড় আর মাটিতে বাঁধানো ঘরের সীমানায় বাতির সংশ্রব নেই। বাড়িতে কি কেউ নেই? সুখী কি রাতে বাড়িতে থাকে না? ঘরস্বর-ও কি আজ অরাত্তিরে ঘুমিয়ে পড়েছে? আমি ভাবতে থাকি, পৃথিবীর ক্ষয় হয়।

দরজার বক্ষে শব্দ করে ডাকলে খিড়কী রেগে যায়! কপাট খুলে দেয় সুখী। অবিন্যস্ত আঁচল মাটির টান অনুভব করে ঝরে পড়ছে ক্রমশ। সুখীর হাতে একটি ছুরি ধরা। কসম কেটে বলছি, আমি চুরি করে কোনদিন ঠাকুরঘরে কলা খাই নি।
"আমনে কি করেন এই নিশিরাতে ইয়ানে? মায়ে পাঠাইছে?"
"না। নসু ঘরে? হেতার লগে আলাপ আছে।"
"সে রাইতক্যা ঘরে থাহে না।"
"কই থাকে?"
"আঁই কেন্নে কমু! শশ্মানে ভুত খায়, চাঁন্দের রূপ দেখে।"
"আমনে সরি খাড়ান, আঁই ঘরে দেখুম। সে ইদানীং বাজারে ঝামেলা পাকাইতেছে। মসজিদের চত্বরের পস্রাব করি দিছে সেদিন।"
আমি ঘরে ঢুকে পড়ি।
বিবস্ত্র খাটে একটা বালিশ ও একটি কাঁচুলি! প্রথম দৃষ্টিতে এই চোখে পড়ে। চেরাগ জ্বলছে বাঁশের চেয়ারের উপর, মেঝেতে নকশীকাঁথা পাতা- সেলাই চলছে বোঝা যায়। বামদিকে অন্য ঘরে যাওয়ার দরজা, সে ঘরে অদ্ভুত রহস্য।
সুখীর কথা বলতে ভালো লাগে, আমার শুনতে। নসু যৌবনে জওয়ানদার ছিল, ইস্টিশন মাস্টার; কিন্তু বিয়ের বছর চারেক পরে গ্রামে বেড়াতে গিয়ে পাগলামী দেখা দেয়- আর সারে নি। সেই থেকে সুখীর সংসার-উপবাস। ইদানীং তা প্রকট আকার ধারণ করছেই।
সুখী সেলাই-এ মনযোগ দেয়, আমি দেহপাতায়।


অনেক পরে যখন চেরাগের আলো কমে আসে তেল ফুরিয়ে গেলে- সুখীর কাঁথাসেলাইয়ে লেখা হয়ে যায় সময়ের গল্পসমূহ তখন আমি-ও দেহপাতায় গল্প লেখার আহবান জানাই। তার শরীরে ঘাম জমে।
আমি তাই নসুকে ক্ষমা করে দিই- কিছু দিয়ে যেতে হয়।


একটা ছায়া সরে যায়। আমি টের পাই- জামশেদ! দূর শালা, আমি বিড়ালই থেকে গেলাম, কুকুর হতে পারলাম না!


গর্ভবতী নদী উজানে মেলে দেয় জলশিশু- আমরা তারে বন্যা বলি।
ভেসে যায় বাঙলাবাজার- আমরা হাঁপিয়ে উঠি। আমাদের চালের টিন উড়ে গিয়ে ঘাসের বন্ধু; খড়ের দোচালা এলোমেলো পালক হয়ে উড়ে। দূরের বটগাছটা কৌতূহলে নুয়ে যায়।
চারিদিকে মানুষের লাশ। আমরা রঙ ভুলে যাই। নদীর নাম স্থগিত থাকে।
নসুকে খুঁজে পাওয়া যায় না। জলিল মাস্টার ত্রাণের খরগোশ। বাবা সাপ হয়ে চলেন।
সবুজ মাঝি নৌকা হারিয়ে ফেলেছেন। আমি কাঠ কেটে দিই আমাদের বন থেকে। বাবা টের পায় না।

সুখী পোয়াতি এখন। সবাই চোখ কচলায়। নসু তো এখন বাতাস।
আমি জানি। আমি।


'আমি?'
'সন্দেহ আছে?' পুরাতন মন্দিরের দেয়ালে একটা টিকটিকি, তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। তাহার পাশে বিকালের আলো।
'নসু না?'
'নসু শামুক। তার সামর্থ্য নাই।'
'কী করবা? আমি তো শ্যাষ।'
'কিছু করুম না। আমি ফুল পামু।'
'বাপে আমারে দেশছাড়া কইরবো। আমারে মাফ দাও। শহরে যাইবা? একদিনে খালাশ কইরে ফিরা আসা যাইব।'
এখানে দুর্গা নেই। পূজো নেই। সুখী এখন দুর্গা।
'পুরুষ চিনতে ভুল হয় না। আপনে পুরুষ না। নসু ভাবতো আমি বাঁজা। আমি ফুলের বাগান করি, পানি দিই। অথচ আমার ফুল নাই। আপনে সেই ফুল নষ্ট করতে কন?'
'ঘটনা বুঝার চেষ্টা করেন। এইটা রাষ্ট্র হইলে নির্ঘাত হারা। শহরে থাকবা, আমি মাসে মাসে টেকা পাঠামু নি।'
'আঁই নিজেই চলি যামু।'

টিকটিকিটা সব দেখে শুনে বাজারে রাষ্ট্র করে দেয়। আমি শইল মাছ হয়ে যাই। জামশেদ শেয়ানে শেয়ানে।



সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বাতি জ্বেলে দেয়া যায়। আমার ইচ্ছে করছে না।
সুখী উধাও। আমি জানি বাপজান করিৎকর্মা লোক। পুলিশঝাঁক এসেছে। তিনি সামাল দিবেন।
সাবেতা লিচুগাছ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের উঠোনে। আমার সব নাশ!
বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজের কামরা দেখি- অন্ধকারের চোখ-মুখ-চিবুক; আর আশ্চর্য এক নদী। আঁধারের নদী।
দরজায় খিড়কী নাড়ছে কেউ। আমি জবাব দিই না। শব্দ বাড়তে থাকে।
"কে?"
"আমি রফিক। দোর খুল।"
আমি দোর খুলি না। খিড়কী নাড়ার শব্দ বাড়তে থাকে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে আমার অন্ধকারের নদী খোঁড়া! কতগুলো নদী। আমি নাম দিতে থাকি- এটা কালিডাঙা, এটা শুভালক্ষ্মী, ওইটা মাতামহুরী...।
অন্ধকারের নদী খুঁড়ে...।

৬/২০০৯ [আনুমানিক]
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১১:৪৭
৩৯টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×