somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাসের পাঠশালায়: চতুর্থ অধ্যায়: বিধান দিলেন ইষ্রা

১৭ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ইষ্রা! এক ইহুদী ধর্মাচার্যের নাম। তবে ইতিহাসে তার গুরুত্ব শুধুই একজন ধর্মযাজক হিসেবে নয়। কারণ তার রচিত ধর্মীয় বিধানই আজ আড়াই হাজার বছর পরে নারকীয় নৃশংসতায় ফিলিস্তিনী শিশু হত্যার মূল প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশুদ্ধ রক্তের জাতি এই দম্ভে দম্ভিত হয়ে যায়নবাদী ইসরাইল নৃশংস গণহত্যায় বারবার মেতে উঠছে ফিলিস্তিন ভূখন্ডের আদি বাসিন্দাদের ওপর যারা গত তিন হাজার বছরের ইতিহাসে কখনও ইহুদিদের ওপর এই ধরনের নিষ্ঠুরতা চালায়নি। এ নিষ্ঠুরতার মূলে রয়েছে আচার্য ইষ্রার বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্বের নারকীয় বিধান যা তিনি প্রবর্তন করেন ব্যাবিলন থেকে পারসিক সম্রাট আর্তাজারেক্সেসের দয়ায় ইহুদীদের শেষ দলের সাথে জেরুজালেমে ফিরে আসার পর (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ইষ্রা:৭:১)। ফিরে এসেছিলেন তিনি ৪৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারসিক সম্রাট সাইরাসের দয়ায় ব্যাবিলনের দাস্যজীবন থেকে ইহুদীদের প্রথম দলটির প্রত্যাবর্তনের ৯৪ বছর পরে সম্রাট আর্তাজারেক্সেসের অনুমতি পেয়ে আচার্য ইষ্রার নেতৃত্বে ব্যাবিলনে বসবাসরত বাদ বাকি ইহুদীরা বেরিয়ে পড়ল জেরুজালেমের পথে। এ দলে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল সতেরশ। এক সময় তারা পৌছেও গেল জেরুজালেমে। এই প্রত্যাবর্তন নেবুচাদনেজারের জেরুজালেম ধ্বংসের ১৪৩ বছর পর। এই সময় ধরে কয়েক পুরুষ গত হয়েছে। তবুও ব্যাবিলনের বন্দি ইহুদীরা ক্যালদীয় বা পারসীয় হতে পারেনি। যে শিশুর জন্ম হয়েছে ব্যাবিলনে সেও তার বার্ধক্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত স্বপ্ন দেখেছে জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার। তাই এই প্রত্যাবর্তন ছিল ইহুদীদের জন্য এমন অভাবিত আনন্দের যা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না।



সম্রাট আর্তাজারেক্সেস ইষ্রাকে জেরুজালেমের ধর্মীয় আচার্য নিযুক্ত করলেন। সেই সময়ের অন্যান্য সমাজের মতই ইহুদী সমাজও তীব্র শ্রেণি শোষণের কলংক থেকে মুক্ত ছিলনা। দাসকেন্দ্রিক অর্থনীতি ছিল তখনকার সমাজের ভিত্তি। মিসর ও ব্যাবিলনে দাস্য জীবনের যন্ত্রণার সাক্ষী ইহুদীরা নিজেদের ভেতরেও এ ব্যাবস্থাকে চালু করল। ঋণগ্রস্থ ইহুদীরা ক্রমে দাস হয়ে পড়ছিল ধনী ইহুদীদের। ধনী ইহুদীদের এই জাগতিক লালসার পথে ধর্ম কোন বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ যে মুসার অনুশাসন ও বিধি বিধান ছিল তাদের ধর্মের ভিত্তি তা সংরক্ষণের অভাবে ঢালাওভাবে বিকৃত হওয়ার অবকাশ ছিল। ইব্রাহিম থেকে মুসা সবাই বিদ্রোহ করেছেন দাস শোষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজশক্তির বিরুদ্ধে, দাস শ্রেণির কাতারে দাঁড়িয়ে। সুতরাং তাদের বিধানে দাস শোষণের বিরুদ্ধে চেতনা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ অধঃপতন দেখে মোটেও ভাবিত হন না আচার্য ইষ্রা। বরং বিপুল উৎসাহের সাথে তিনি ইহুদীদের নিয়ে গেলেন ভয়ংকর সর্বনাশের পথে। এ সর্বনাশের নাম বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্ব। এটাই আধুনিক যায়নবাদের ভিত্তি। অ্যাসিরিয়রা উত্তরের সামারিয়া দখলের পরে সেখানে অ-ইহুদীদের থাকতে দিয়েছিল (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ২বাদশাহনামা:১৭)। সেখানকার অ-ইহুদীদের সাথে মিশ্রণ ঘটে যায় স্থানীয় ইহুদীদেও ব্যাবিলন থেকে জেরুজালেমে ফিরে আসা ইহুদীদের সাথেও মিশ্রণ ঘটে স্থানীয় ইহুদীদের (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ইষ্রা:১০:১৮-৪৪)। তাতে নাকি বিশুদ্ধতা হারিয়েছে ইহুদী রক্ত।

বিজাতীয়দের সাথে ইহুদীদের এই মিশ্রণ ক্রুদ্ধ করে তোলে আচার্য ইষ্রাকে। তিনি ছিলেন ইহুদী ধর্মজগতের মধ্যমণি, মুসার ভাই হারুনের সপ্তদশ উত্তরপুরুষ! তাঁর পূর্বপুরুষদের তালিকা রয়েছে ওল্ড টেস্টামেন্টের পবিত্র বংশাবলী পুস্তকে। অতএব তিনি ইহুদীদের ওপর যাজকতন্ত্রের প্রভাব খাটাবার একচ্ছত্র অধিকারী বনে গেলেন। তার মুখ নিঃসৃত কথাই হয়ে যায় ধর্মীয় বিধান। ইহুদীরা এ বিধান না মেনে যাবে কোথায়? তাই তিনি ইহুদীদেরকে তাদের পরজাতীয় স্ত্রী ও সন্তানদেরকে প্রত্যাখ্যানে বাধ্য করার জন্য ওল্ড টেস্টামেন্টে সংযুক্ত করলেন ইহুদী জাতির বিশুদ্ধতার বিধান। যে রক্ত হিম করা বিধানটি তিনি জারি করেছিলেন তা হলো- যে সব ইহুদী পুরুষরা পরজাতীয় মেয়েদের স্ত্রী করেছে, সেই সব স্ত্রীদের এবং তাদের গর্ভজাত পুত্র-কন্যাদের ত্যাগ করতে হবে। (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ইষ্রা:১০:১১)। এ ঘোষণা একজন মানুষের হতে পারে না। একজন নিষ্ঠুর দানবের, যিনি ধর্মের আলখেল্লা গায়ে জড়িয়ে বলী দিলেন পূর্বতন নবীদের শিক্ষাকে। হাজার হাজার নারী-পুরুষ শিশুর ক্রন্দন তাকে স্পর্শ করল না। আচার্য ইষ্রার এই দানবীয় অনুশাসনের কথা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর অনুসারীরা ওল্ড টেস্টামেন্টে সংরক্ষিত করেছে। ওল্ড টেস্টামেন্টের বংশাবলীর দ্বিতীয় খন্ডে ইষ্রার নিজের কথার শ্লোকগুলোতে এটি বর্ণিত আছে।

জেরুজালেমে ফেরা ইহুদীদের সর্বশেষ দলটির প্রতি আচার্য ইষ্রার বিশুদ্ধকরণ অনুশাসন কতটা জীবন বিরুদ্ধ ও অমানবিক ছিল তা তুলে ধরেছেন প্রয়াত লেখক সাংবাদিক সত্যেন সেন তাঁর ‘পাপের সন্তান’ গ্রন্থে। এখানে পাপের সন্তান মানে হল ইহুদী পুরুষদের পরজাতীয় স্ত্রীদের গর্ভজাত সন্তানরা। আচার্য ইষ্রার অনুশাসন অনুসারে ব্যাবিলনে পরজাতীয় কন্যাদের সাথে যারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাদের ঔরসে ঐসব স্ত্রীদের গর্ভজাত সন্তানরা হল পাপের সন্তান। এদেরকে প্রত্যাখ্যান করার হুকুম তিনি জারি করলেন। সেই সাথে পরজাতীয় স্ত্রীদেরও।
ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনা থেকে জানা যায়, আচার্য ইষ্রার এই অমানবিক অনুশাসনের বিরুদ্ধে জোনাথন, যহসিয়, মশুল্লম, শব্বথয়সহ ব্যাবিল প্রত্যাগতদের অনেকেই তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে (ওল্ড টেস্টামেন্ট:ইষ্রা:১০:১৫)। কিন্তু তাদের এ প্রতিবাদ আচার্য ইষ্রাকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। নির্বিকার চিত্তে তিনি জবাব দিলেন, পরজাতীয় মেয়েদের গর্ভজাত সন্তানরা পাপের সন্তান। এরা যত শীঘ্র লোপ পাবে, যিহোবার রাজ্য তত নিষ্কলঙ্ক হয়ে উঠবে। ধর্মের নামে আচার্য ইষ্রার এই যাজকতন্ত্রের যুপকাষ্টে বলি হয়ে গেল হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, যুবা-বৃদ্ধ।

এর আগে ৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট সাইরাস ইহুদীদের প্রথম যে দলটিকে স্বদেশ ফেরার অনুমতি দিয়েছিলেন তারা ওল্ট টেস্টামেন্ট লিপিবদ্ধ করার কাজে হাত দেয়। মুসার সময়কাল ধরা হয় ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায় ৭৬২ বছর। এতদিন পরে তাঁর বাণী লিপিবদ্ধ করার কাজের শুরু। কিভাবে সম্ভব মুসা যা বলেছিলেন হুবহু তা লিপিবদ্ধ করা? বংশ পরম্পরায় চলে আসা মুসার বাণীর কতটুকু ছিল আসল আর কতটুকু ছিল অপভ্রংশ আর কতটুকু ছিল বক্তাদের নিজস্ব সংযোজন তা কে বলতে পারে? তার ওপর আবার লিপিকররাও ছিলেন ধর্মবেত্তা। তারাও তাদের সুবিধামত ভেজাল মিশ্রিত করেছেন। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ আচার্য ইষ্রার ইহুদী রক্তের বিশুদ্ধতার বিধান।



ইহুদীদের প্রথম যে দলটি জেরুজালেমে ফিরে এসে ওল্ড টেস্টামেন্ট লিপিবদ্ধ করার কাজে হাত দেয়, তাদের ৯৪ বছর পরে ইহুদীদের শেষ দলের সাথে আচার্য ইষ্রা জেরুজালেম ফিরে আসেন। এরপর তিনি ওল্ড টেস্টামেন্টে ইহুদী রক্তের বিশুদ্ধতার যে বিধান সংযুক্ত করলেন, তা একান্তই তার নিজস্ব। এটা কোনক্রমেই নবী মুসার বাণী হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ নবীরা উঠে আসতেন সাধারণ মানুষদের স্তর থেকে এবং তাদের অনুসারীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ছুটে যেতেন সাধারণ মানুষের কাছেই। এ ধরনের বর্ণবাদী জাতিতত্ত্বে সাধারণের আকৃষ্ট হওয়ার কোন কারণ নেই। বরং নবীদেরকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সাধারণের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধারণা প্রতিষ্ঠা করে অত্যাচারী রাজশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে। বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্ব নয় বরং একত্ববাদই ছিল এ লড়াইয়ের মূল প্রেরণা।

ইবরানী ও ইসরাঈলী ধর্মমতের ধারায় একটি ব্যাপার সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। তা হলো ধর্মের আদলে রাজদ্রোহ। ইতিহাসে দেখা যায়, যখনই রাজশক্তি ধর্মকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের চূড়ান্ত রূপদান করেছে, অর্থাৎ রাজা নিজেকে খোদা হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন দাস ও প্রজাদের ওপর শোষণ ও অত্যাচার সর্বোচ্চ মাত্রা অতিক্রম করেছে। আর এর বিপরীতে একজন ইব্রাহিম কিংবা মুসার আবির্ভাব ঘটেছে একত্ববাদের ঘোষণা নিয়ে, অত্যাচারী শাসকের দেবত্ব অস্বীকারের মাধ্যমে। যেহেতু সেই সমাজে ধর্ম ছিল জীবনের শক্তিশালী ভিত্তি এবং শোষণ ছিল ধর্মীয় যুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত তাই শোষিত মানুষের বিদ্রোহও এলো ধর্মীয় বিদ্রোহের আদলে। রাজশক্তির দৈব কর্তৃত্বের দাবি অস্বীকার করাই হল এই বিদ্রোহের মূল প্রেরণা। বহু দেবতাবাদ আর একত্ববাদের মধ্যকার সংঘাত হল শোষক ও শোষিতের মধ্যকার সংঘাত। ইব্রাহিম যে একত্ববাদের ধর্মমত প্রচার করেছেন তা সুস্পষ্টভাবেই রাজদ্রোহের শামিল এবং রাজতন্ত্রের জন্য একটি হুমকি। তাই তাঁকে তাঁর অনুসারিদের নিয়ে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। পরবর্তীতে ফারাও দ্বিতীয় রামেসেস একইভাবে নিজেকে খোদা দাবী করলে ইব্রাহিমের উত্তরসূরী মুসার নেতৃত্বে ইহুদীরা তা অস্বীকার করে রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে আসে। এটা থেকে প্রমাণিত হয় যে, একত্ববাদের বার্তা সুস্পষ্টভাবে পরাক্রমশালী রাজশক্তির দেবত্বকে অস্বীকার করে বিদ্রোহের প্রেরণা জাগায়। এ ধর্মীয় অনুশাসনে মানুষের জাত, বংশ, জন্মগত পরিচয় ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং এক স্রষ্টার প্রতি তার বিশ্বাস ও আনুগত্য হল আসল। যার বিধানে মানুষে মানুষে কোন দৈব প্রভেদ নেই। স্রষ্টার দৃষ্টিতে মানবজাতি এক ও অভিন্ন। এটাই একত্ববাদী ধর্মমতের মূল চেতনা।

আচার্য ইষ্রার এই বিধান যে তাঁর একান্তই নিজস্ব বিধান, একে মুসার অনুশাসনের সাথে কোনভাবেই সংযুক্ত করা যায় না, সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইতিহাসের পথ ধরে হাটলে। আমরা জানি প্রধান প্রধান ইসরাইলী নবীরা কিভাবে পরজাতীয় কন্যাদের বিবাহ করেছেন। যা ইষ্রার বিধানে মাহপাপ। বিখ্যাত নবীদের অন্য জাতীয় নারী বিবাহের ঘটনাসমূহ নিশ্চিতভাবে ইষ্রার বিধানকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। ইব্রাহিম বিয়ে করেছিলেন মিসরীয় নারী হাজেরাকে (ওল্ড টেস্টামেন্ট:তাওরাত-১ম খন্ড:১৬:৩)। হযরত ইসহাক ও ইয়াকুবের স্ত্রীরা ছিলেন ইরামীয় (ওল্ড টেস্টামেন্ট:তাওরাত-১ম খন্ড:২৪ ও ২৮)। মুসা বিয়ে করেছিলেন ইথিওপীয় মহিলাকে (ওল্ড টেস্টামেন্ট: তাওরাত-৪র্থ খন্ড:১২:১)। দাউদ বিয়ে করেছিলেন হিট্টীয় (আর্যদের একটি শাখা) নারী বৎশেবাকে। একবার রাজ প্রসাদের ছাদ থেকে তিনি এক স্ত্রী লোককে স্নান করতে দেখেন। সাথে সাথে এই নারীকে তাঁর পছন্দ হয়ে যায়। কিন্তু মহিলাটি ইহুদী বংশীয় ছিলনা। সে ছিল ইলিয়ামের কন্যা, হিট্টীয় উরিয়ের স্ত্রী বৎশেবা। এই পরজাতীয় বৎশেবাকে দাউদ তার আপন স্ত্রী বানালেন (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ২ শামুয়েল:১১:২৭) । তাঁর গর্ভেই জন্ম নেন সলোমন এবং তিনিও বিয়ে করেছিলেন ফারাওয়ের কন্যাকে। এছাড়াও মোয়াবীয়, আমোনীয়, ইদোমীয়, সিডনীয় ও হিট্টীয় রমণীরাও তাঁর পত্নী ছিল (ওল্ড টেস্টামেন্ট: ১ বাদশাহনামা :১১:১)। এই সলোমন নির্মিত ধর্মগৃহই ইহুদী ধর্মের মূল ধর্মীয় স্থাপনা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইসরাইলী নবী পিতৃসূত্রে ইসরাইলী বংশীয় হলেও মাতৃসূত্রে ছিলেন অন্য বংশীয়। শুধু নবী কেন অনেক সাধারণ ইসরাইলীরাও অন্য জাতীয়দের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে। দাউদের জেরুজালেম দখলের পর এর পতন ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে। এর মধ্যে পেরিয়ে যায় চার শতাধিক বছর। এই সুদীর্ঘ সময়কালে ইহুদী রক্তের সাথে সংমিশ্রণ ঘটে স্থানীয় কেনানীয় ও ফিলিস্তিনিদের রক্তের।



ইষ্রা সমগ্র মানব জাতিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যেখানে একটি হল তাঁর জাতি যাদের শরীরে বিশুদ্ধ রক্ত প্রবাহিত। আর অন্যটি হল বাকি দুনিয়ার সকল মানুষ যাদের শরীরে দূষিত রক্ত প্রবাহিত। কিন্তু ইহুদী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তাদের জাতিগত বিশুদ্ধতার একেবারে গোড়ায় গলদ রয়েছে এবং পরজাতীয়দের সাথে ইহুদী রক্তের সংমিশ্রণের ঘটনায় ইতিহাস সমৃদ্ধ। বর্তমান যায়নবাদ মনে করে ইহুদীরা স্রষ্টার চোখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি ও বাকি পৃথিবীর সবাই তাদের থেকে নিকৃষ্ট। তাই ইহুদীদের সাথে অন্য জাতীয় ও অন্য ধর্মীদের বিবাহ নিষিদ্ধ। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটি হল স্রষ্টার দৃষ্টিতে একমাত্র খাঁটি এই ইহুদী ধর্মে অন্য কেউ প্রবেশও করতে পারবেনা। ইহুদী ধর্মী হবে একমাত্র ইহুদী বংশজাত লোকজন। অন্য কেউ নয়। বাদ বাকী যারা ইহুদী ঘরে জন্ম নেয়নি তাদের ভাগ্যে কল্যাণ নেই। আবার তাদের ইহুদী হওয়ার সুযোগও নেই। এই বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই যায়নবাদের মূল ভিত্তি। এর সাথে মিল রয়েছে ভারতীয় ব্রা‏হ্মণ্যবাদের। অর্থাৎ শুধু জন্ম পরিচয়ই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করছে। কিন্তু জন্ম কারও ইচ্ছার বিষয় নয় এবং এতে কারও হাত নেই ।

পৃথিবীতে কি এমন কোন জাতির অস্তিত্ব সম্ভব যাদের রক্তে অন্য কোন জাতির রক্তের সংমিশ্রণ নেই? এর উত্তর এক কথায় হবে ‘না’। পরম বিশুদ্ধ জাতি বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। পরমভাবে জাতি বলেও কোন কিছু নেই। সমগ্র মানবজাতির উৎস হিসেবে তিনটি মহাজাতিকে বিবেচনা করা হয়- ককেশীয়, নিগ্রো ও মঙ্গোলীয়। এ তিনটি মহাজাতির গোড়াও আবার সুদুর অতীতে গিয়ে এক হয়ে যায়। আসলে জাতীয়তার বড়াইটা খুবই দূর্বল ভিত্তির উপর টিকে থাকে। আরেকটা ব্যাপার হল জাতিগত বিশুদ্ধতা ধরে রাখা কিংবা জাতীয় সত্ত্বাকে দীর্ঘকাল বাঁচিয়ে রাখার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কি? আজ মানব সভ্যতা এমন এক পর্যায়ে চলে এসেছে যেখানে জাতিগত সংকীর্ণতা জীবনের পথে একটি বাঁধা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

দুনিয়ার সব জাতি যদি একাকার হয়ে যায় তাহলে তাতে কি কোন সমস্যা আছে? এতে কোন সমস্যা তো নেই-ই বরং তা পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর ব্যাপার হবে। সভ্যতা আসলে সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। তবে তা মোটেও এক জাতির উপর আরেক জাতির আধিপত্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে নয় বরং প্রত্যেকের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের চূড়ান্ত বিকাশের মধ্য দিয়েই সম্ভব। অতীতে যতগুলো জাতির অস্তিত্ব ছিল তার অধিকাংশই আজ বিলুপ্ত। আজ আর সেই জাতিভিত্তিক সভ্যতার কোন অস্তিত্ব নেই। যেসব জাতি গড়ে তুলেছিল সিন্ধু সভ্যতা, মেসোপটেমীয় সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা। তারা কি আজ আর টিকে আছে? তারা হারিয়ে গেছে কালের আবর্তে। আসলে তারা হারিয়ে যায়নি। বরং তারা আজও টিকে রয়েছে এসব অঞ্চলের ভূমিসন্তানদের মধ্যে আজকের নানান জাতিগুলোর মধ্যে। এভাবে পৃথিবী থেকে জাতিসত্ত্বার বিলুপ্তিতেই জন্ম নেয় নতুন জাতিসত্ত্বা। প্রাচীন জাতিগুলোর উত্তরাধিকারেই হলো আজকের জাতিগুলো। এরাও একদিন হারিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। এত কোন সমস্যা নেই। বরং এটাই হওয়া উচিত।

তাহলে ইহুদী জাতিটার পৃথিবীতে এতদিন ধরে টিকে থাকার আদৌ কি কোন দরকার ছিল যেখানে প্রাচীন আমলের তাদের সমসাময়িক জাতিগুলোর একটাও আর স্বরূপে নেই? এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর কখনও পাওয়া যায়নি। প্রাচীন সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরীয়, ক্যালদীয়, মিডীয়, হিট্টীয় ইত্যাদি জাতির ইতিহাস থেকে বিলুপ্তি মানব জাতির জন্য কোন ক্ষতির কারণ হয়নি। তাহলে কেন ইহুদী জাতিটির এই টিকে থাকা? এর কারণ হল অন্য জাতিগুলো নতুন জাতিতে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু ইষ্রার বিধান ইহুদীদের জাতিসত্ত্বাকে বিলুপ্ত হতে দেয় নি। কিন্তু তা পৃথিবীর জন্য কোন মঙ্গলজনক বিষয় হয়নি। বরং আপদ হিসেবে এই জাতিটি ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম উঠিয়েছে।

ইষ্রা এটি কেন করেছিলেন? তার কারণ তিনি চেয়েছিলেন ইহুদীদের ওপর যাজকতন্ত্রের নিরংকুশ আধিপত্য ও দাপট। এই যাজকতন্ত্র কোন অংশেই রাজতন্ত্র থেকে কম যায় না। ইতিহাসের বিশাল অংশ জুড়ে আমরা খ্রিস্ট ধর্মীয় যাজকতন্ত্রের দাপট দেখতে পাই। এর আদি সংস্করণটি হলো এই ইহুদী যাজকতন্ত্র। যাজকতন্ত্র নামের এই নিষ্ঠুর ব্যাধিটি ইসরাইলী নবীদের বিপ্লবী ধর্মমতের সকল প্রাণশক্তি কেড়ে নিয়েছে। ধর্মকে নিয়ে গেছে প্রাণহীন আচার সর্বস্বতার দিকে। সৃষ্টিকর্তার নামে হয়েছে নোংরা ব্যবসা। ধর্মব্যবসা আর যাজকতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক। যে সৃষ্টিকর্তার বাণী দিয়ে নবীরা নিপীড়িত মানুষকে রাজদ্রোহের পতাকাতলে সমবেত করেছেন সেই সৃষ্টিকর্তার নামে যাজকতন্ত্র খেটে খাওয়া মানুষের ঘাড়ে চাপিয়েছে করের বোঝা। স্রষ্টার নামে যাজকতন্ত্র নিজেদের অনুশাসন দৃঢ় করার জন্য মনগড়া বিধান চাপিয়েছে জনসাধারণের ওপরে। আমরা দেখেছি ইহুদি সমাজে কিভাবে বৈষম্য ও শোষণ ফিরে এসেছিল। এই বৈষম্যের সুফলভোগী শোষক শ্রেণির প্রয়োজনেই জন্ম নেয় যাজকতন্ত্র যা শোষণের দৈব বৈধতা এনে দিয়েছিল। আচার্য ইষ্রার বিধান ছিল শোষণ প্রক্রিয়ার পরিপূরক এই যাজকতন্ত্র সৃষ্টির পটভূমি। যে একত্ববাদ এসেছিল দৈব শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বার্তা নিয়ে, সেই একত্ববাদের অনুসারি সম্প্রদায় এভাবেই একদিন বিসর্জন দিল একত্ববাদের মূল চেতনাকে। তাদের অভ্যন্তরেই চালু হল দৈব শোষণ, একত্ববাদী ধর্মীয় ব্যবস্থার বিকৃত রূপ যাজকতন্ত্রের মদদে।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থি, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৩
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×