পাশ্চাত্যকে উন্নয়নের রোল মডেল ধরে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো প্রতিনিয়তই উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে থাকে। তাদের যে শাসন পদ্ধতি, তাদের রাষ্ট্রীয় যে বিলাসীতা, সামরিক বাজেট, কৃষ্টি-কালচার, জীবনাচরণ ইত্যাদিকে অনুসরণ- অনুকরণ করা হয় প্রত্যেকে ক্ষেত্রে। তাদের আইন সভার সদস্যরা যে ধরনের বিলাসীতা করে, যে স্টাইলের পোশাক পরিধান করে, যে ধরনের দামি দামি গাড়ি ব্যবহার করে আমাদের উন্নয়নশীল দেশের আইনসভার সদস্যরাও তেমনি ঠাঁট-বাট করার চেষ্টা করেন, সামান্য অসুস্থ হলে দেশের হাসপাতাল রেখে বিদেশের নামী-দামি হাসপাতালে ছুটে যান। তাই বিলাসীতার যোগান পেতে তারা হাড় জিরজিরে প্রজা সাধারণের উপর করের বোঝা আরো বৃদ্ধি করেন। করের পরিমাণ কমার কোন নজীর এসব দেশে নেই। উদাহরণ হিসেবে আমাদের দেশের তেলের মূল্যকে ধরতে পারেন। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশে তেলের দাম কমানো হবে না। এভাবে কোন কিছুর দাম একবার যদি বাড়ে তবে সেটা আর কখনোই কমে না। এই যে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হচ্ছে তার কিছু অংশ দেশের উন্নয়নে ব্যবহৃত হবে (এটা একটা অজুহাত), কিন্তু অধিকাংশই ব্যয় হবে রাষ্ট্রীয় কর্ণধারদের বিলাসীতায় কিংবা দুর্নীতি খাতে। কর কমার কোন লক্ষণ তো থাকেই না বরং নিত্য নতুন কি কি খাতে কর বাড়ানো যায় সেই চিন্তায় ব্যস্ত থাকে আমাদের অর্থ সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় দপ্তরগুলো।
আমরা পাশ্চাত্যকে যেসব ক্ষেত্রে অনুসরণ করি সেগুলো মূলত পাশ্চাত্যের উন্নতির চাবি-কাঠি নয়, এগুলো তাদের উন্নতির পরের ফলাফল মাত্র। অর্থাৎ যথেষ্ট উন্নতি হলে একটি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যেমন মার্জিত ও রুচিশীল আচরণের জন্ম হয়ে থাকে, পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। পাশ্চাত্য যখন ধনী ছিল না তখন তারা ছিল পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বর্বর জাতি। আজকে আমরা কোন বর্বর কাণ্ড ঘটলে যেমন তাকে মধ্যযুগীয় শব্দ দ্বারা বিশেষায়িত করি সেটি মূলত পাশ্চাত্যের মধ্যযুগকেই বোঝানো হয়ে থাকে।
তো, প্রশ্ন হলো পাশ্চাত্যের উন্নতির পেছনে যদি তাদের শাসনব্যবস্থা, জীবনাচরণ, রীতি-নীতি না হয়ে থাকে তবে তাদের উন্নতির প্রকৃত কারণটা কী? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে কয়েক শতাব্দী আগে ফিরে যেতে হবে। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ, অন্ধত্বে নিমজ্জিত ইউরোপীয় জাতিগুলোর বিশেষ করে অপরাধপ্রবণ মানুষগুলো তাদের ভূ-খণ্ড ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। পৃথিবীর নানা প্রান্তে তারা অভিযান চালাতে লাগলো। এই অভিযানের ফলে তারা বিশ্বের অপরাপর জনপদের সাথে পরিচিত হতে লাগল। আবিষ্কার করলো ভারতীয় উপমহাদেশ, আমেরিকা মহাদেশসহ অন্যান্য অজ্ঞাত স্থান। প্রথমত ব্যবসা করা তাদের উদ্দেশ্য হলেও তারা দেখলো সম্পদ অর্জনের সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে দখল ও লুটপাট। তাই তারা তাদের আবিষ্কৃত অধিকাংশ ভূ-খণ্ডে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে দখল করে নিল। ডাচ, ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসী, আর্মেনীয়রা ভাগ বাটোয়ারা করে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল দখল করে নিল। কোন কোন উপনিবেশ দেড়-দুইশ বছর শাসন ও শোষণ, সম্পদ লুটপাট করার ফলে সেসব সম্পদ জমা হতে লাগলো ইউরোপে। সেই অর্থ ইউরোপকে দিল আভিজাত্য, শিল্পরুচি, সৌখিনতা। ফলে তাদের সাহিত্য, চলচ্চিত্র, দর্শন ইত্যাদি দ্রুত গতিতে সামনে এগিয়ে চললো। বৈজ্ঞানিক গবেষণা, নতুন নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার তাদেরকে কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবীতে অপ্রতিরোধ্য করে তুললো
সর্বোপরি আগের সেই উদাহরণের মত করে বলতে হয়, যে পরিবারে অর্থের সংকুলান নিয়ে চিন্তা করতে হয় না, যাদের মাথা সব সময় ক্ষুন্ণিবৃত্তির তাগিদে পেটে ঢুকে থাকে না, তারা রুচিশীলতা, আভিজাত্য, শিল্প-সাহিত্য, সংগীত ইত্যাদিতে উন্নত হয়ে উঠে। ইউরোপের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এই উন্নতি তাদেরকে সুস্থ চিন্তা করতে সুযোগ দিয়েছে। ফলে তারা আইন-কানুন, মানুষের অভাব-অভিযোগ, বাক স্বাধীনতা ইত্যাদির দিকে নজর দিতে পেরেছে। যার ফলাফল আজকের ইউরোপ-আমেরিকা। প্রচুর সম্পদের প্রাচুর্যতায় আধ্যাত্মিকতার ঘাটতি ছাড়া, হৃদয়ের হাহাকার ছাড়া বাইরে থেকে চোখ ধাধিয়েঁ দেওয়া চাকচিক্যতার যতটা দরকার তার সবই আছে তাদের।
তাই বলি, এই যে উন্নতির জন্য পাশ্চাত্যকে অনুসরণ, অনুকরণ- এটা কখনোই আমাদেরকে তাদের ন্যায় উন্নতি এনে দেবে না। বরং পাশ্চাত্যের কাছ থেকে টাকা ধার এনে এই যে আমরা ব্যর্থ অনুসরণ-অনুকরণ করছি, ঋণ করে ঘি খাচ্ছি- সেটা আমাদেরকে দিনে দিনে আরো ঋণী করে তুলবে। ঋণগ্রস্ত কৃষক যেমন ঋণদাতা বৃদ্ধ মহাজনের কাছে ভিটে-মাটি দিয়েও শেষ পর্যন্ত নিজের অল্পবয়সী কণ্যাকে তুলে দিতে হয়, আমাদের অবস্থা হবে তাই। তাদের ন্যায় উন্নতি করতে হলে আমাদেরকে কয়েকটা উপনিবেশ কায়েম করতে হবে, কয়েক শতাব্দী তাদেরকে শোষণ করতে হবে। সেটা করতে পারলে, যথেষ্ট বিত্তশালী হতে পারলে সেই সুযোগে আমাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনার নতুন উন্মেষ ঘটবে তা দিয়ে আমরা উপযুক্ত শাসন-ব্যবস্থা এমনিতেই বেছে নিতে পারব।
পাশ্চাত্যের ন্যায় উপনিবেশ স্থাপন করা, নতুন ভূ-খণ্ড আবিষ্কার করা- এর কোনটাই আর সম্ভব নয়। অপরদিকে পাশ্চাত্যের অনুসরণ-অনুকরণও আমাদেরকে উন্নতি এনে দেবে না। এক্ষেত্রে আমরা একটা কাজই করতে পারি- পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসরণ-অনুকরণ বাদ দিয়ে পাশ্চাত্যের যা নেই, অর্থাৎ আমাদের আধ্যাত্মিকতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের উন্নতিতে মনোযোগ দেওয়া। আমরা যদি আমাদের আধ্যাত্মিকতা, ধর্মীয় শিক্ষা, নীতি- নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটিয়ে সেসবকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি, দুঃশাসন, অপরাধ প্রবণতা দূর করতে পারি তবে আমাদের বাহ্যিক উন্নতি পাশ্চাত্যের মত না হলেও একটা ভারসাম্যযুক্ত উন্নয়ন অর্জন করতে সক্ষম হতে পারব। হৃদয়ে হাহাকার, প্রচুর বিত্তের জন্য উদগ্র বাসনা রোধ করতে পারলে সেটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:১৩