আরাফাত আল মাসুদ
শেষ পর্যন্ত কুবেরকে ময়না দ্বীপে নিয়েই গেলেন মানিক। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের মূল চরিত্রকে হোসেন মিয়ার মাধ্যমে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেলেন যা তখনও মনুষ্য বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠেনি। সঙ্গে দিলেন কপিলাকেও। ধর্ম, সমাজ, সংস্কার সবকিছুকে মাড়িয়ে নিয়ে গেলেন আধো চেনা এমন একটি দ্বীপে যা সম্পর্কে মানিক নিজেও পুরোপুরি স্বচ্ছ কিনা প্রশ্ন থেকে যায়। উপন্যাসের শেষদিকটা এত দ্রুত এগুচ্ছিল যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেন কুবেরকে ময়না দ্বীপে পাঠানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন। আসলে ময়না দ্বীপ নিয়ে মানিক কী পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে চাইলেন? কেন এই ময়না দ্বীপ?
ময়না দ্বীপের বিষয়টি না এনেও মানিক যে বেশ ভালভাবেই পদ্মার জেলেপাড়ার মানুষদের জীবন যন্ত্রণাকে তুলে আনতে পারতেন, উপন্যাসটি পড়লেই বোঝা যায়। কিন্তু মানিক কল্পিত এই দ্বীপকে মূল কাহিনীর কেন্দ্রে নিয়ে আসলেন। উপন্যাসের সপ্তম পরিচ্ছেদের অনেকটুকু অংশজুড়ে পাঠককে কুবেরের চোখ দিয়ে ময়না দ্বীপ দেখালেন। মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী এই দ্বীপটি প্রাগৈতিহাসিক যুগের ভূপ্রকৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়।
মানিক নতুন করে কিছু কি সৃষ্টি করতে চাইলেন? ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটি যখন লিখছেন তখনও তিনি পুরোপুরি মার্ক্সবাদী হয়ে উঠেন নি। কিন্তু তার আলোড়ন তাঁর ভিতর তখন থেকেই শুরু হচ্ছিল। নতুন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার যে আকাঙ্ক্ষা চেতনায় ও চিত্তে ধারণ করেছিলেন তারই প্রারম্ভিক একটি নিরীক্ষা কি ময়না দ্বীপ? অনেক সমালোচক এভাবে ভাবতে পছন্দ করেন। ধর্ম বর্ণ সবকিছু ছাড়িয়ে নতুন সমাজব্যবস্থা যেহেতু, আপাত দৃষ্টিতে তা মনে করাই স্বাভাবিক।
কিন্তু ময়না দ্বীপ তো মার্ক্সবাদী ধারণার সাথে মেলে না। এটা তো এক অর্থে উপনিবেশ। হোসেন মিয়া যার সর্বময় ক্ষমতার মালিক। ময়না দ্বীপকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সমাজব্যবস্থা মনে করতে গেলে তো হোসেন মিয়াকে মার্ক্সবাদী বলতে হয়! যা আদপেই অসম্ভব ও হাস্যকর। বুঝলাম, হোসেন মিয়া হয়ত অনন্ত তালুকদারের মত (এ উপন্যাসের ভূস্বামী) পুরোপুরি শোষক শ্রেণির নন। কিন্তু তিনি তো বুর্জোয়া সমাজেরই একজন প্রতিনিধিত্বকারী, খেটে খাওয়া মানুষদের সাথে যার শ্রেণিগত দূরত্ব অনেকখানি। তার হাতে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি আসবে এটা মানিক নিজেও বিশ্বাস করতেন না। হোসেন মিয়ার অনেক ধূর্তামি তো তিনি নিজ বয়ানে বা কুবেরের চোখ দিয়ে উন্মোচন করে দিয়েছেন।
আর ময়না দ্বীপে ধর্ম নেই এটাও তো ঠিক নয়। হোসেন মিয়া যতই বলুক তার দ্বীপে মসজিদ মন্দির কোনটাই হবে না, অর্থাৎ সব লৌকিক ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে একটা অসাম্প্রদায়িক সমাজ হবে তার দ্বীপ, কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি প্রচলিত ধর্ম না থাকলেও নতুন একটি ধর্ম তো থাকছেই, হোসেন মিয়ার তৈরি করা ধর্ম। হোসেন মিয়া যেখানে অঘোষিত খোদা। তারও আছে কিছু নিয়মকানুন। সন্তান জন্মদানে অক্ষম নারী পুরুষের কোন মূল্য নেই তার দ্বীপে। তাই বৃদ্ধ বশিরের স্ত্রীর সাথে যুবক এনায়েতের সাথে অবৈধ প্রণয় স্বীকৃতি দিয়েছেন হোসেন মিয়া। কেতুপুরে বরং তারা হোসেন মিয়াকে এতটা ভয় করে না, কিন্তু ময়না দ্বীপে গেলে তো তারা পুরোপুরি অসহায়। হোসেন মিয়ার মতের বাইরে যায় এমন সাহস সেখানে কোথায় তাদের! আর ময়না দ্বীপে তো তারা কেউ স্বেচ্ছায় যায় না। যায় নিতান্ত বাধ্য হয়ে।
কাজেই প্রশ্ন থেকে যায় কেন উপন্যাসের পরিণতি হয়েছে একটি কল্পিত দ্বীপে নিক্ষিপ্ত হবার মধ্যদিয়ে। মার্ক্সবাদী চিন্তাচেতনার সাথে আদতেই মেলানো যায় না এই রহস্যপূর্ণ আধো চেনা ময়না দ্বীপকে। ময়না দ্বীপে দেড় হাজার নারী পুরুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকম অদ্ভুত ইচ্ছার বাইরে হোসেন মিয়ার আর কোন ইচ্ছা নেই এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। হোসেন মিয়ার চরিত্রের সাথে তার এ আকাঙ্ক্ষা মেলে না। বরং এর ভিতরে যে তার একজন সামন্তপ্রভু হয়ে উঠার আকুতি বিদ্যমান তা বুঝতে পাঠকের খুব বেগ পেতে হয় না। কুবেরের ময়না দ্বীপে আসা মানে ধীরে ধীরে একটা সময় পুরো জেলে পাড়াই এখানে উঠে আসবে। জেলে জীবন ত্যাগ করে পুরোপুরি শ্রমিক জীবন। তাতে কি তাদের মানসিক বা অর্থনৈতিক কোনক্ষেত্রেই বিন্দুমাত্র অগ্রগতি হবে?
বুঝতে পারছি মানিক একটা পরিবর্তন চেয়েছেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা শোষিত জেলেপাড়ার অচলাবস্থায় চেয়েছেন একটা ধাক্কা দিতে। মানিক তখন ধীরে ধীরে মার্ক্সবাদে দীক্ষা নিচ্ছেন। নতুন সমাজব্যবস্থার চিন্তা তার চেতনায় জন্ম নিতে থাকে। ময়না দ্বীপ সেই চিন্তারই ফসল বলে সমালোচকদের ধারণা। এ ধারণা হয়ত অমূলক না, তবে নতুন এই সমাজ ব্যবস্থা এর ভিতর দিয়েই সমাজতান্ত্রিক ধারায় বিনির্মিত নিশ্চয়ই না। বরং তা সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থারই অন্য রূপ। শোষণের রূপ বদলেছে, মাত্রা কমেনি। ধর্মীয় শিকলও আছে, ভিন্ন পরিচয়ে। মানিকের সাম্যবাদী চেতনা এখানে হোসেন মিয়ার প্রভুত্বে হোঁচট খেয়েছে। তিনি জানতেন, বিদ্যমান অচলাবস্থা না ভাঙ্গলে শোষিত শ্রেণির মুক্তি নেই। কিন্তু সেই অচলাবস্থা ভাঙ্গার পথ কিরকম হবে, তা মানুষের প্রকৃত মুক্তি আনবে নাকি নতুন কোন শিকলে বন্দী করবে মানিক কি বিষয়টি সম্পর্কে তখনও পরিষ্কার নন?
একটা ব্যপার প্রথমেই বলেছি ময়না দ্বীপ প্রাক-সভ্যতার যুগকে মনে করিয়ে দেয়। তবে কি তিনি সভ্যতা পূর্ববর্তী যুগের মত অনুপযোগী একটি কল্পিত ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ নির্বাচন করে শ্রমজীবী মানুষদের দিয়ে নতুন করে সভ্যতা নির্মাণ করতে চেয়েছেন? নবনির্মিত সভ্যতার কর্তৃত্ব আপাতত শোষক শ্রেণির হাতে দেখা গেলেও তাঁর কি ধারণা ছিল কোন এক সময় তা শোষিতের হাতেই আসবে?
ময়না দ্বীপে তিনি শোষিতের জয়জয়কার দেখাননি। দেখাতে গেলে অবশ্যই তা আরোপিত হত। দুর্বল মার্ক্সবাদী লেখকদের মত এত দ্রুত সমাপ্তি টানেননি তিনি। তিনি জানেন মুক্তি এত সহজ নয়। কাঙ্ক্ষিত সমাজ পরিবর্তন অনেক সাধনার বিষয়। কেতুপুর থেকে ময়না দ্বীপে গমন শুধু একটা অচলাবস্থা ভাঙ্গবে, কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন নয়। কিন্তু এর গুরুত্বও কম নয়। কেতুপুরে ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল মানুষদের ভিতর শিকর গজিয়ে উঠা পূর্ব পুরুষদের সংস্কার বিশ্বাস কিছুটা হলেও দূর করে তাদের বাস্তববাদী করে তুলবে। নিশ্চয়ই একদিন তা শোষকের বিরুদ্ধেও লড়তে শিখাবে। কুবেরের সাথে আপাত অসংযমী কপিলাকে সঙ্গে দেয়াও হয়ত সে চিন্তারই ধারাবাহী। ভাগ্যের পুতুল মালা নয়, ভাগ্য অস্বীকার করে নিজের চাওয়া পূর্ণ করতে পারার অভিপ্রায়ী কপিলাই দুর্গম ময়না দ্বীপে কুবেরের সঙ্গী হবার যোগ্য। কপিলা এ উপন্যাসের দ্বিতীয় জীবন্ত চরিত্র। তবে সবচাইতে জীবন্ত চরিত্র অবশ্যই হোসেন মিয়া, কুবের নয়। পুরো উপন্যাসের কাহিনীর মূল চালিকাশক্তি তো তিনিই। মানিক তাঁর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটালেন হোসেন মিয়ার মধ্য দিয়ে। অথচ হোসেন মিয়া কোন অবস্থাতেই মানিকের আদর্শে গড়া চরিত্র নয়।
তাই এ উপন্যাস যেন ছোট গল্পের মতই ‘শেষ হইয়াও হইলনা শেষ’। নতুন একটা গল্প শোনার আগ্রহকে জিইয়ে রাখে। ময়না দ্বীপ এক অনিশ্চিত যাত্রা। কিন্তু অনিঃশেষ সম্ভাবনাময়। পাঠকের ভিতর নতুন এক গল্প হয়ে উঠার অপেক্ষমাণ ক্ষেত্র।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:০৩