somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিলেকোঠার সানাই

৩১ শে আগস্ট, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিসমিল্লাহ হোটেল

আয়ান রশীদ খাঁ গৌতম ঘোষের বিখ্যাত তথ্যচিত্র 'মিটিং আ মাইলস্টোন'-এ বিসমিল্লাহ খাঁ'র সঙ্গে কথা বলতে বলতে খুব গভীর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। খাঁ সাহেবকে নিয়ে এ ছবিটা ছিল অসাধারণ। কথা বলতে বলতে বাড়ির ছাদে হেলান দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে একসময় তিনি পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার দিকে তাকালেন। বেশকিছু ধোপা কাপড় কাচছিলো। বললেন- এই ধোপারা কি করে জানেন, কাপড় কাচার শব্দের সঙ্গে তান ধরে। ধীর্ঘদিন বেনারসে কাটিয়েছি আমি আর এদের যখন আমার সুর কাপড় কাচার সঙ্গে ধরতে দেখি, প্রাণ ভরে ওঠে। এইতো বেনারস।

তিনি যে ভালো গাইতে পারেন সেটা প্রথম দেখলাম ওই ছবিটিতে। বেনারস ঘরানার এ শিল্পীর পরিবারে কোনো বিখ্যাত গায়ক নেই বলে কি হবে, ভালো গাইতেন সবাই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যে ঠোঁট দিয়ে তিনি সুর ধরতেন, আঙুল নাচাতেন তার অনেকটাই অপার্থিব ঠেকতো- এতো দম পেতেন কোথায়! প্রিয় নেশা ছিল উইলস সিগারেট, তাতে টান মেরে হয়তো বলতেন- 'দম আতে কেয়া, লাগাতে হ্যায় হাম।'

'বিসমিল্লাহ হোটেল'-এর কথাই ধরুন। ৬৬ জনের বৃহৎ পরিবারে খাবারের খামতি ছিল না কিছু। আড্ডাবাজ মানুষের ভিড় জমেই থাকতো। যেন এক সরাইখানা। গঙ্গাতীরের এই সরাইখানার নাম দেয়া হয়েছিল 'বিসমিল্লাহ হোটেল'। তার মৃত্যুতে কোথাও এমন খবরও ছাপা হয়েছিল- 'বন্ধ হয়ে গেছে বিসমিল্লাহ হোটেল'। বেনিয়াবাগ নিবাস হতে তার মৃতদেহটি নেয়া হয়েছিল ফাতিমা দরগাহ'তে শেষকৃত্যানুষ্ঠানের জন্য। প্রতি মহররমে তিনি সানাই বাজাতেন সেখানে। শিয়া অনুরাগী খাঁ সাহেব যখন বাজাতেন, কারবালার হৃদয়বিদারক ইতিহাসের সঙ্গে তার মরমী চেতনার মিশ্ররূপ প্রকাশ পেত। যে বেদীতে বসতেন তার আশপাশ ঘিরে বসতো অসংখ্য মানুষ, দালানের নারীরা ঝুলবারান্দা কিংবা ঝরোকায় এস ঘন হতো করুণ সুরের মোহন আবেশে। প্রায় ঘন্টা দুই ধরে যা বাজাতেন তার বর্ণনা মুশকিল। শেষে একপাশে যখন সানাইটি রেখে দিতেন বুক তখন চোখের জলে জবজবে। শ্রোতাদের মর্সিয়া তখন গভীর অশ্রুপাতের নিঃশব্দ ঢেউ তুলছে চোখে। শোকের এমন ভিন্নরূপ প্রকাশ পেতো তার সুরে, মহররমের অষ্টম দিনে যা বাজাতেন তিনি।

আমার কাছে সঙ্গীত আমার ঈশ্বর, আমার আল্লাহ- এমন বলতেন। সঙ্গীতকে ব্লাসফেমি বলে উল্লেখ করা এক মওলানাকে শুনিয়েছিলেন গান। তাকে বলেছিলেন সঙ্গীত আল্লা’র অপর নাম। মওলানা যতই সঙ্গীত পাপ, শয়তানের ধোঁকা বলছেন, তিনি ততোই তাকে সঙ্গীতের মহিমার কথা শোনাচ্ছেন। একসময় গান ধরলেন, আল্লা'র নাম জপে যে গানটি গাইলেন তা ছিল 'রাগ ভৈরবী'তে। শেষ করার পর প্রশ্ন করলেন, একেই কি ব্লাসফেমি বলছেন? মওলানা নিশ্চুপ।


শত পুষ্পের ফুটে ওঠা মোহন রূপ

আপনি কি রহমত খাঁ'র কথা শুনেছেন? বেচারা। অর্থকড়ি নেই অথচ গান ছাড়া কিছুই বোঝেন নি। বউতো জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতো। একদিন একটি তানপুরা নিয়ে এসে জুটলো আমার সঙ্গে। বললো, টাকাই কি সব! টাকা আছে আর গান নেই তো কিছুই নেই। সে আমার সঙ্গে সুর ধরলো। আমি তাকে মহান বলে ভাবি। সেইতো গানের রাজা। আবদুল করিম খাঁ'র কথাই ধরুন, টাকা যে কিছু একটা তা কখনোই মাথায় ঢোকেনি তার। বর্ষার দেবীকে যখন ইচ্ছা গান শোনাতেন- রাগ মল্লার। আমরা আন্তরিকভাবেই তা দেখেছি। হৃদয় থেকে বের হওয়া সঙ্গীত যে কোনো কিছুই পারে। অর্থ আকাঙ্ক্ষার বিস্তর দূরে ছিলাম আমি। স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে এ কথাগুলো তিনি বলেছিলেন। আর বলেছিলেন সাদামাটা জীবনের প্রতি তার আগ্রহের কথা।

যদিও তার জীবন খুব একটা সুখে কাটেনি। আর্থিক দৈন্য লেগেই ছিল। ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই প্রকাশ পেত তার করুণ অবস্থার কথা। অথচ বিসমিল্লাহ খাঁ ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা 'ভারতরত্ন' পেয়েছেন। পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও এম এস সুব্বুলক্ষ্মীর পর তৃতীয় ব্যক্তি যিনি সঙ্গীতে এ পুরস্কার পান। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও শান্তিনিকেতনের অনারারি ডক্টরেট এ শিল্পী ভারতের সকল রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন। পড়ে রয়েছিলেন বেনারসের সেই পুরানো চিলেকোঠায়, সাধারণ জীবনযাপনের জীর্ণ বাড়িটিতে। যে বেনারস ছেড়ে যাবার কথা শুনলেই তিনি আঁৎকে উঠতেন- আমি, বেনারস ছেড়ে! কখনোই নয়। বেনারসের রূপ, বালাজি মন্দিরের মায়া আর এই গঙ্গা! এই গঙ্গা কোথায় পাবেন তিনি।

সানাই ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে এর শ্রুতিমধুরতার জন্য জনপ্রিয়। ছোট্ট এই বাদ্যযন্ত্রটি, বড়জোর দুই ফুট লম্বা, তার ভেতরে যে ম্যাজিক ও সুরসম্মোহন; শুধু বিয়েবাড়ির আবহযন্ত্র হিসেবে পরিচিত সানাইকে খাঁ সাহেব ধ্রুপদী সঙ্গীতের একটি অনন্য শিল্প উপকরণে পরিণত করলেন। যখন বাজাতেন তখন তার চোখেমুখে ভেসে উঠতো জীবনের সুন্দরতম প্রতিমূর্তি, শতপুষ্পের ফুটে ওঠার এক মোহন রূপ দেখতে পাওয়া যেতো। যার ছিল ঐশ্বরিক সুর নির্মাণের দুর্লভ ক্ষমতা।


শেষ বিকালের আলো

১৯১৬ সালের ২১ মার্চ সোমবার বিহারের বকসার জেলার একটি ছোট্ট গ্রাম দুমরোন-এ জন্মান তিনি। চাচা আলী বক্সের কাছে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে সানাই শিখতেন। তার মরমী ধর্মচেতনায় ছিল মুসলিম ও হিন্দু আধ্যাত্মিকতার মিশ্ররূপ। দেবী সরস্বতী তার কাছে প্রেরণার আধার হিসেবে প্রকাশ পেতো। ভারতীয় মিশ্র সংস্কৃতির এই প্রাণপুরুষ সাধারণ মানুষের কাছাকাছি ছিলেন বলেই হয়তো জনমানসের সারল্যের সঙ্গে তার প্রতিভার মেলবন্ধন ঘটেছিলো। জন্ম নিয়েছিলো একটি মানবিক চেতনার।

লতা মঙ্গেশকরের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন। তার গলার বিরল গুণের কথা বলতেন। আরেকজন, যার কথা প্রায়ই তার মুখে শোনা যেতো- বেগম আখতার। আখতারের নাম শুনলেই তিনি অন্যমনষ্ক হয়ে পড়তেন। তার 'দিওয়ানা বানা দে' গজলটির কথাই ধরুন, অনেকেই তা গেয়েছেন কিন্তু আখতারের গলায় এ গান হয়ে উঠতো অসামান্য সুন্দর। এক রাতের ঘটনা বলছিলেন খাঁ সাহেব- মধ্যরাতের কোন এক সময়, কেউ চালিয়েছিল বেগম আখতারের সেই রেকর্ড 'দিওয়ানা বানা দে'। তিনি জেগে উঠলেন মুহূর্তে, উপভোগ করতে লাগলেন, ডেকে তুললেন বউকে। তার স্ত্রী বললেন, 'এই গভীর রাতে কী হয়েছে তোমার?' মেজাজ বিগড়ে গেল, বউকে তিরস্কার করে বললেন, 'এ তুমি বুঝতে পারবে না, জাহান্নামে যাও।' পরদিন জানতে পারলেন গত রাতে যা শুনেছিলেন তা মোটেই রেকর্ড ছিল না, বেগম আখতার নিজেই গাইছিলেন সেই গান।

ভারত স্বাধীন হবার পর ১৫ আগস্ট লালকেল্লায় তিনি সানাই বাজিয়েছিলেন। একে তার জীবনের একটি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বলে উল্লেখ করেছিলেন। পৃথিবীর বড় বড় প্রায় সব রাজধানী শহরেই তিনি বাজিয়েছেন কিন্তু 'ইন্ডিয়া গেট'-এ সানাই বাজানোর শেষ ইচ্ছাটি তার পূরণ হয়নি। তার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রায়ই বলতেন- ধর্মতো একটাই, তা হলো 'সুর'। এই সুর যাতে নিবদ্ধ সে সানাইকে আত্মা বলে মানতেন। জীবনের শেষদিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- 'আমার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীত শেষ হয়ে যাবে এমন ভাবা অসম্ভব। আমার পরও সানাইয়ের সুর থেকে যাবে, আর আমার তো মনে হয় যখন পৃথিবী থাকবে না তখনো অন্য কোন রূপে সুর বেঁচেই থাকবে।'

গঙ্গা'র বুক থেকে উড়ে আসা ভরাট হাওয়া হয়তো এখনো মুছে দিচ্ছে তার বাড়ির সামনের সব ধূলি-ধূসরতা, হয়তো রঙীন কাপড়গুলো ধোপার কাচছে তীরে, শেষ বিকালের আলোয় পায়রার ঝাঁপি খুঁজে বেড়াচ্ছে সুমধুর সুরের ঐকতান। বিসমিল্লাহ খাঁ সিড়ি বেয়ে উঠছেন; কাঠের দরজা খুলে চিলেকোঠার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে শেষ সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে বলে উঠছেন-

যব ভি দেতা হ্যায় কোয়ি দা'দ সামঝ কর গওহার
য্যায়সে ফংকার কো জীনে কি তামান্না দেতে হ্যায়।

যখনই কেউ বুঝেশুনে বাহবা দেয় গওহর
যেন সে শিল্পীকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়।


এ লোকটি মারা গেছেন কি না কী করে বলি? আগস্টের ২১ তারিখ ২০০৬ তো তাই বলছে।


দৈনিক যায়যায়দিন
০৫.০৯.২০০৬


সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:১৯
১২টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×