somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: নিষাদ-দ্বীপ

০৫ ই জুন, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সিগারেট টানতে টানতে হাঁটছিল নয়ন মাঝি। তার লম্বা, শীর্ন শরীর; পরনে সাদা ফতুয়া, সাদা পায়জামা- এক মাথা কোঁকড়া চুল, ফরসা মুখে বসন্তের দাগ। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। কাঁধে গেরুয়া রঙের কাপড়ের ব্যাগ। হাঁটতে হাঁটতে চারিদিকে তাকায় নয়ন মাঝি। শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি। রোদ ঝলমলে একটি দিন। এলোমেলো বাতাস। পিচ রাস্তার দুপাশে ঘন শালবন। বাতাসে ভাসছিল শালগুঁড়ির ভেজা গন্ধ। সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেশ লাগছিল নয়ন মাঝির।
হঠাৎই তার ঠিক পাশে একটা গাড়ি ব্রেক কষল। নীল রঙের একটা শেভ্রলে। এই যে কবি মশায়? নারীকন্ঠের চিৎকারে মুখ ঘুরিয়ে দেখল- সাদিয়া। আরে তুমি? নয়ন মাঝি ঝুঁকে দেখল ভিতরে সাদিয়ার ওপাশে ড্রাইভিং সিটে জাভেদ মুরাদ বসে আছে। নীল সানগ্লাস পরেছে সে। হাসল। সাদিয়া তাকে ঠিকই চিনেছে। বছর দুয়েক আগে একটা পার্টিতে দেখা হয়েছিল। সে সময় সাদিয়া তাকে জিজ্ঞেস করেছিল-আপনার নাম বুঝলাম নয়ন-কিন্তু মাঝি কেন?
আমার পূর্বপুরুষ ছিল মেঘনা নদীর মাঝি । রুট কী করে অস্বীকার করি বলুন?
তা ঠিক। এখন সাদিয়া বলল, এদিকে কোথায়?
এই তো। নয়ন মাঝি হাসল। সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিল।
কথা পরে হবে। এখন গাড়িতে উঠুন তো।
অনেকদিন জাভেদ মুরাদের সঙ্গে দেখা হয় না। শেভ্রলে তে উঠে নয়ন মাঝি পিছনের সিটে বসল । জাভেদ মুরাদ বলল, এদিকে কোথায় দোস্ত?
নয়ন মাঝি বলল, কোথাও না। এমনিই হাঁটছি।
সাদিয়া নীল রঙের শাড়ি পড়েছে। সাদা ব্লাউজ। চুল চূড়ো করে বেঁধেছে। ফরসা মুখ। একসময় নাচত সাদিয়া তামান্না-ফিগারটা এখনও সেরকমই-স্লিম। কী কারণে-সাদিয়ার মুখটা ম্লান। নয়ন মাঝি সংবেদনশীল বলেই টের পায়।
আরও কিছুদূর গিয়ে শেভ্রলেটা বাঁ দিকে টার্ন নিল। কিছুক্ষণ পর জাভেদ মুরাদদের বাগানবাড়ি ‘নিদ মহলের’ লোহার গেটটা চোখে পড়ল। অনেক অনেক দিন আগে নিদ মহলে জাভেদ মুরাদের সঙ্গে এসেছিল নয়ন মাঝি। ওরা তখন ছাত্র। দু’জনেই তিতুমীর কলেজে পড়ত । সাদা রঙের উচুঁ দেওয়াল। কালো রঙের লোহার গেটের দু’পাশে আমলকি গাছ। গেটের ওপাশে প্রশস্ত ড্রাইভওয়ে; দুপাশে সুপারি গাছ। সুপারি গাছের গুঁড়িতে সাদা রং করা। তারপর বেশ বড় একটা বাগান। বাগানে নানারকম ফুলের গাছ। সূর্যমূখীর ঝাড়। একবার ঈদের সময় নাকি দুম্বা কাটা হয়েছিল- রক্ত ছিটকে হলুদ সূর্যমূখীর ঝারে লেগেছিল ...বাগানবাড়িটি জাভেদ মুরাদের দাদা আদিল মুরাদের আমলের। তৃতীয় পুরুষে বাগানবাড়িতে কিছু আধুনিকায়ন ঘটেছে। এই যেমন- টেনিস কোর্ট, সুইমিং পুল ইত্যাদি। বাগানের ওপাশে সাদা রংকরা পুরনো দিনের দোতলা বাড়ি। জানালার কপাটে আর দরজার পাল্লায় সবুজ রং করা। দেড়শ-দুশো বছরের পুরনো তো হবেই। লোকে বলে-বহুকাল আগে এখানে ছিল একটা শিব মন্দির। তরবারি হাতে অশ্বারোহীরা পশ্চিম থেকে এসে সেটি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে সেসব চিহ্ন কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। সে সব কবেকার কথা ...
মাসটা শ্রাবণ বলেই পোর্টিকোয় গাড়ি থামতেই আকাশে মেঘ জমল। একতলার বসবার ঘরটা বিশাল। দেওয়ালে হরিণের ছাল। কাটা-হরিণের মাথা। সময়টা দুপুর। ওরা মুখ হাত ধুয়ে নিল। খাবার রেডিই ছিল। জাভেদরা টেলিফোন করেই এসেছে নাকি। প্রায়ই তো আসে। ডাইনিং টেবিলটা একতলায়। ওরা খেতে বসল। খেতে বসেই মুরাদের হুঙ্কার-অই মিঞা, খিজিরালি-বুরহানি কই?
খিজিরালি নামে খানসামা কাঁচুমাচু হয়ে বলল, টক দধি জোগার করবার টাইম পাই নাইক্কা ছার।
থাক। সাদিয়া নরম স্বরে বলল। সেভেন আপ তো আছে। তুমি সেভেন আপ পছন্দ কর। তাছাড়া আমরা ওকে ১১টার পর ফোন করেছি।
সাদিয়ার দিকে জাভেদ মুরাদ কটমট করে তাকাল। ঘাড়-গর্দান সমান বিশালদেহী জাভেদ মুরাদের পরনে কটকটে লাল রঙের সাফারি স্যুট। বাপদাদার মতেই লম্বা আর টকটকে ফরসা সে। থুতনির কাছে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি- অবিকল বাদশা জাহাঙ্গীরের মতন লাগছে। ভোগী মুগলের মতন একাই গোটা চারেক মুরগীর রোস্ট সাবাড় করে দিল জাভেদ মুরাদ। সাদিয়া খাচ্ছে না। তাকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। খেতে নয়নও পারলও না। শুধু বিরিয়ানি। ভাত রাখেনি। আগেও দেখেছে জাভেদ মুরাদ দিনে পর দিন তিনবেলা বিরিয়ানি খেতে পারে। নয়ন মাঝির ভালো লাগে শাকভাত। মাংস খেলে বমি আসে তার। আর তার ভালো লাগে ডাল। যে কোনও ধরনের। তবে সবচে ভালো লাগে কেবল লেবুজল খেয়ে উপবাস। খাওয়ার পর ওরা তিনজন দোতলায় যাওয়ার জন্য সিঁড়ির দিকে যেতে লাগল। সিঁড়ির কাছে দেওয়ালে জিন্নার একটি সাদাকালো ছবি টাঙানো; সেদিকে আড় চোখে তাকাল নয়ন সাধু। তার গা রি রি করে ওঠে। যেন, এখনও এই বাগানবাড়িটা একটুকরো পাকিস্তান! যেন এদেশে কখনও মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। কেন যেন এদেশে অভিজাত মুসলমানের একাংশ আজও পাকিস্তানি রয়ে গেছে-সে রহস্য সাম্প্রতিক ইতিহাসের বিশ্লেষনে বোঝা কঠিন নয়। জিন্নার সাদাকালো ছবির পাশে একটি দোররা!
ওরা দোতলায় উঠে এসে বেতের সোফায় বসেছে- বৃষ্টি নামল। ঝিরিঝিরি অবশ্য। নয়ন মাঝি সিগারেট ধরালো। সাদিয়ার মুখটা গম্ভীর। জাভেদ মুরাদের ফোন এল। স্যামসংটা অন কার সঙ্গে কতক্ষণ হু হা করল সে। তারপর ওটা অফ করে বলল, ইবনে সিনা ফোন করছিল। নতুন একটা টিভি চ্যানেল লাঞ্চ করতে যাচ্ছে সিনা গ্রুপ । দিগন্ত টিভি। আমাকে ২২% শেয়ার দিতে চায়-এক্সিস ব্যাঙ্ক থেকে লোন স্যাংসন করে দিলাম কি না। হা হা হা। দিগন্ত টিভির কনসেপ্টটা বেশ ইন্টারেস্টিং-তলায় ইসলামী আর্দশ থাকবে; আবার রবীন্দ্রসংগীতও চলবে। এর ফলে দর্শকশ্রোতাদের এমন বিভ্রম তৈরি হবে যে-ইসলাম এমন কী বাংলার গানবাজনাও লিগালাইজ করে। হেঃ হেঃ হেঃ।
ছিঃ। সাদিয়া মৃদু ধিক্কার জানাল।
ছিঃ কী? সাদিয়ার দিকে ক্রোধান্বিত হয়ে তাকাল জাভেদ মুরাদ। তারপর নরম হয়ে বলল, কি? খবর পড়বা নাকি দিগন্তে?
নাঃ!।
পড়লে কও-ব্যবস্থা কইরা দিই। খালি মালয়েশিয়া স্টাইলে সাজতে হবে। মাথার চুল ঢাকতে হবে কাপড় দিয়ে।
কেন! মেয়েদের চুলে কী সমস্যা শুনি! সাদিয়া গর্জে উঠল।
মেয়েদের চুল দেখলে পুরুষের নাকি বেসামাল হওয়ার চান্স আছে।
তা হলে মেয়েদের মাথার চুল মসৃন করে কামিয়ে ফেললেই হয়। নয়তো ছেলেরা চোখে ঠুলি পরলেই হয়!
জাভেদ মুরাদ হকচকিয়ে যায়। নয়ন মাঝি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সিগারেটে টান দেয়। জাভেদ মুরাদরা কখনোই বাংলার মাহাত্ব্য বোঝেনি- বোঝেনি বলেই এই মালয়েশিয়া-পাকিস্তান আর সৌদি আরবের সংস্কৃতিকে বড় করে দেখে। পৃথিবীর মানুষ সংস্কৃতি গড়ে ঠিকই; তবে আবহমান বাংলার সংস্কৃতি শুধু সংস্কৃতি না-তার চেয়েও বড় কিছু। এই সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিবর্তনে বিশ্ব পেল একজন বাউল লালনকে, একজন বিশ্ব কবিকে-বিশ্বের একজন শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাকে- যিনি মুগলদের এইসব বাগানবাড়িগুলি গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। নয়ন মাঝি কাতর বোধ করে। সেই কলেজ জীবন থেকেই জাভেদ মুরাদ-এর সঙ্গে মিশছে সে, তবে জাভেদ মুরাদের বিশ্বাস, আচার-আচরনের সঙ্গে নয়ন মাঝির বিশ্বাস, আচার-আচরনের সঙ্গতি নেই। কেবল এক গভীর কৌতূহলই পারস্পারিক সম্পর্কটা টিকিয়ে রেখেছে।

মাঝরাত। সময়টা মধ্যশ্রাবণ বলেই হয়তো রাতে ফুটফুটে জোছনা ফুটেছে। আর এলোমেলো বাতাস। ঘুম আসছিল না। দোতলার টানা বারান্দায় বসে ছিল নয়ন মাঝি। সিগারেট টানছিল। সাদিয় এল। বসল উলটো দিকের সোফায়। মুহূর্তেই বেলি ফুলের গন্ধ ছড়াল। ওকি ঘুমাচ্ছে?
হ্যাঁ। মদ খেয়ে চূড়।
লিভার যাবে।
যাক। আপনার বন্ধু আমাকে খুন করতে চায়।
সে কী! কেন? মাঝির হাতে সিগারেটটা নীচে পড়ে যায়; সে ঝুঁকে ওটা গুঁজে রাখল এ্যাশট্রেতে।
আপনার বন্ধু লুনা হক নামে এক সুন্দরী এয়ারহোস্টেস-এর প্রেমে পড়েছে।
বুঝলাম। তাই বলে খুন!
কেন এরা আনারকলিকে খুন করেনি!
ওহ্।
কয়েকমাস আগে এরাই পাকিস্তানের পেশওয়ারের আয়মান উদাস নামে এক গায়িকাকে খুন করল। এই নস্ট মুঘলরা!
হ্যাঁ।
খুন ওদের জন্য সহজ। খুন করা আর দোররা মারা। আর পাথর ছুড়ে মারা। দীর্ঘকাল ধরে ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টে একটি ইসলামাইজ মুগল প্রেতাত্মা হা হা করে ঘুরছে। রক্তাক্ত করছে নারীকে আর উন্নত চিন্তাচেতনার অধিকারী মানুষদের। একে এখন কফিনে ভরে কফিনের শেষ পেরেক মারা দরকার।
হ্যাঁ।
সাদিয়া বলে, জানেন, আপনার বন্ধুর বাবা -মানে আমার তথাকথিত শ্বশুড় ছিলেন ঘৃন্য কোলেবোরেটর? সেভেনটি ওয়ানে এই বাগান বাড়িতে ছিল টর্চার চেম্বার। তখন কত মেয়েকে-
জানি।
জানেন?
হ্যাঁ। সেই কলেজজীবন থেকেই জাভেদ মুরাদ এর সঙ্গে এখানে এসেছি। তখন যা জানার জেনেছি। বাগানে মাটি খুড়লে গনকবর পাওয়া যাবে। একবার ঈদের সময় নাকি দুম্বা কাটা হয়েছিল- রক্ত ছিটকে হলুদ সূর্যমূখীর ঝারে লেগেছিল; যারা কুরবানীর প্রচলন করেছে তারা মনে হয় সূর্যমুখীর ঝার দেখেনি।
সাদিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, পাকিস্তান দেখছেন না ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মিথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে বলেই দেশটা ধ্বংস হয়ে যাবে-একদা মহেনজোদারো যেমন বিরান ও পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল পাকিস্থান তেমন বিরান ও পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। পাকিস্তানের প্রগতিশীলদের ব্যর্থতা এই যে- তারা মোল্লাদের সঙ্গে তাত্ত্বিক যুদ্ধে হেরে গেল।
হ্যাঁ। কথাটা ঠিক। নয়ন মাঝি মাথা ঝাঁকাল। যদিও এই সময়ে কোনও সভ্যতাই বিরান ও পরিত্যক্ত হয়ে যায় না।
জানেন তো আমি নাচতাম। সাদিয়া বলল। ছায়ানটেও গানও শিখেছিলাম। বিয়ের পর এরা আমাকে আর নাচতেও দেয় না গান গাইতেও দেয় না। বলে, নাচগানের কি দরকার-তারায়েফ-বাঈজীরা আছে কেন? তুমি ঘরের বউ-গয়নাগাটি পরে বসে থাকবা। শোনেন কথা। কিছুতেই এদের বোঝানো যাবে না- শিল্পচর্চা ছাড়া জীবন অর্থহীন। ঈশ্বর বলে তো কেউ নেই।
নয়ন মাঝি তিক্ত কন্ঠে বলল, নাঃ, এদের এসব বোঝানো যাবে না- এরা বদলাবেও না। অথচ দেশের স্বার্থেই এদের বদলানো উচিত।
হ্যাঁ।
বাংলাদেশের অধিকাংশ জমি এদের দখলেই । নয়ন মাঝি বলে। এসব অধিকৃত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া উচিত । প্রথম দুই-পুরুষের না হয় জমিদারীর করার জন্য জমির দরকার ছিল। কিন্তু, এখন কী দরকার? জাভেদ ইংল্যান্ডে পড়েছে। এক্সিস ব্যাংকের চেয়ারম্যান সে-তার এত জমির কী দরকার। নাঃ, তারপরও জোর করে আগলে রাখবে। এই আক্ষেপ-এদের তৃতীয় পুরুষ বদলাচ্ছে না!
হ্যাঁ।
এদের পূর্বপুরুষই পূর্ববাংলার সমূদয় ভূমি নিজের নিয়ন্ত্রনের রাখার হীন উদ্দেশ্যেই ১৯০৬ সালে মুসলীম লীগ তৈরি করেছিল।
হ্যাঁ।
ভারত বিভক্ত হলে মুসলিম অভিজাতরা-নতুন মুসলিম দেশের জমির ওপর মুসলিম অভিজাত মহলের কর্তৃত্ব থাকবে। এই উদ্দেশ্যে তারা ধর্মকে টেনে আনল। সেটা না করে- সবাই ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দিলে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হত। বিশ্বাস কর সাদিয়া ভারতীয় উপমহাদেশে এত রক্তপাত হত না।
হ্যাঁ। আর, দেখুন না- মিথ্যে বলেই মুসলিম লীগ বিলুপ্ত হয়ে গেল। আর, সারা বিশ্ব এখন ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেসের দিকে তাকিয়ে তারা দলিত নারীকে আইনসভার স্পীকার করল।
হু।
আমার মনে হয় মুসলীম লীগ আসলে পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। সাদিয়া বলল।
হু। নয়ন বিস্মিত হয়নি।
১৯৭৫ সালে বিএনপির উত্থানের মাধ্যমে দলটির নবজাগরণ ঘটেছে।
হু। বলে নয়ন মাঝি সিগারেটে টান দেয়-দূরের প্রগাঢ় জোছনার দিকে তাকায়।
সাদিয়া ফিক করে হাসল।
হাসলে যে? নয়ন মাঝি বিস্মিত।
ভাবছি, দশ বছর পর কোনও পার্টিতে রাহুল গান্ধি, সজীব ওয়াজেদ জয় আর তারেক জিয়ার দেখা হলে তারেক জিয়া কী বলবে। মুগল বলেই তারেক জিয়া উচ্চ শিক্ষার কথা ভাবেনি-ক্ষমতা তো পাচ্ছিই। এরই এক বন্ধু গাজীপুরে “খোয়াব” নামে বালাখানা তৈরি করেছিল। কী আশ্চর্য না!
হু।
সাদিয়া বলল, এসব ভাবলে কী যে খারাপ লাগে। ১৯৭৪-৭৫ সালে প্রথম বাংলাদেশি সরকার ভূমি সংস্কারের কথা সিরিয়াসলি ভাবা হয়েছিল।
হ্যাঁ। নয়ন মাঝি বলল। তার আগে ফিদেল ক্যাসট্রোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হয়েছিল। ৭৫-এর পৈশাচিক হত্যাকান্ড এই ভূমিকে কেন্দ্র করেই ঘটেছিল। সে সময় মুসলিম ভূস্বামীরা সব একজোট হয়েছিল। ইসলাম ভূমির ভূস্বামীর অধিকার ও নারী ওপর পুরুষের একচ্ছত্র অধিকার স্বীকার করে বলেই ধর্মটা এত পপুলার। ব্যক্তিগত সম্পদ যে অভিশাপ-এই প্রয়োজনীয় শিক্ষা এই ধর্মে নেই।
ভাবছি। সাদিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, সব ছেড়েছুড়ে দূরে কোথাও চলে যাব।
সত্যি? নয়ন মাঝির চোখ সরু হয়ে উঠল।
হ্যাঁ। সাদিয়া বলল। আমি সিরিয়াসলি ভাবছি শিল্পচর্চা ছাড়া জীবন অর্থহীন। ঈশ্বর বলে তো নেই কেউ। মুরাদ শিল্প বোঝেনি। ফলে যা হয়- সেক্স বাড়ানো জন্য মিডল ইস্টার্ন বন্ধুদের ি নয়ে ইন্ডিয়া গিয়ে কীসব বিরল পাখির মাংস খায়-হ্যাঁ, আমি জানি লাইফে সেক্স ইমপোর্টেন্ট , তবে আমি বাঙালি মেয়ে- আমার সেক্স নিয়ে অবসেসন নেই; আমাদের রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তে হয়; নজরুলের গান শুনতে হয়; এসবের জন্য মনের শুদ্ধতা দরকার। আর এখানেই আমরা জগতের অন্যান্য জাত থেকে আলাদা। বিদেশে কত কষ্ট-তার পরও বাঙালি ছেলেরা জাপান-অস্ট্রেলিয়ায় শহীদ মিনার গড়ে -আপনি ত এসব বোঝেন?
নয়ন মাঝি গম্ভীর বলল, তোমাকে আমি এক জায়গায় নিয়ে যেতে পারি।
কোথায়? সাদিয়া দীর্ঘকাল এই মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিল।
অনেক দূর । সুন্দরবন। শিবসা নামে এক নদীর ধারে। আমরা বলি নিষাদদ্বীপ।
নিষাদদ্বীপ?
হ্যাঁ। নিষাদদ্বীপ।
কারা থাকে সেখানে?
তোমার মতন যারা। যারা ফেইক মুসলিম ভাবার্দশ থেকে বাঁচতে চায়। আসলে বহুকাল ধরেই লোকচক্ষুর অন্তরালে নির্জন প্রকৃতি উপাসক উন্নতমনের বাঙালিরা বাস করছে নিষাদদ্বীপে। নিষাদদ্বীপ মাতৃতান্ত্রিক। এক জন আদি মা আছে। তার নাম নাম রোকেয়া পালি।
আমি যাব। সাদিয়ার শ্বাস টানল।
নয়ন মাঝি ওর হাতটা তুলে নেয় হাতে। তোমার স্বামী?
ও তো আমার স্বামী নয়।
ও কে তাহলে? প্রশ্নটা করার প্রয়োজন ছিল না।
কেউ না! হিসহিস করে বলে সাদিয়া। বললাম না-আপনার বন্ধু আমাকে খুন করতে চায়। ও একটা ভিশ্যাস মুগল রেলিক!
এত ঘৃনা!
হু। আমার বাবা এক্সিস ব্যাঙ্কের লোনের লোভে বিয়েতে রাজী হলেন। পাকিস্তানি আর্দশে বিশ্বাসী সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর আপন চাচাতো ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে-মা সেই শোকে স্ট্রোক করল।
ওহ্ না।
হ্যাঁ। আমি ভালোবাসতাম বুয়েটের তরুণ প্রভাষক অরণ্য কবিরকে-দুর্দান্ত শক্তিশালী প্রাবন্ধিক ছিল সে । ওকে ওরা ইবনে সিনার সামনে থেকে কিডন্যাপ করে মীরপুর নিয়ে যায়। পাক্ষিক “মেঘ”-এ ‘তিনটে প্রশ্ন’ নামে প্রবন্ধ লিখেছিল অরণ্য-তাতে মুসলিম জাহানের কাছে অরণ্যর তিনটি প্রশ্ন ছিল- (১) ইসলাম কেন ইহুদিদের হিংস্র ঈশ্বরের ধারনাকে নমনীয় করতে পারেনি? (২) ইসলামের নবীর কী কারণে যৌনকর্মীদের ওপর অত ক্ষোভ ছিল? (৩) ত্রয়োদশ শতকের প্রথমার্ধে বিহারে অসংখ্য নিরীহ শান্তিবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করার পরও কেন ইখতিয়ারউদ্দীন মোহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী কে বাংলার মুসলিম সমাজ ‘ইসলামী হিরো’ মনে করে? এই তিনটে প্রশ্ন করার অপরাধে অরণ্যকে ওরা ইবনে সিনার সামনে থেকে কিডন্যাপ করে মীরপুরের শিয়ালবাড়িতে নিয়ে যায়। ওখানে আজও ওদের গোপন টর্চার সেল আছে। সারারাত অমানুষিক নির্যাতন করে অরণ্যকে হত্যা করে ওরা। বলতে বলতে সাদিয়া ফুঁপিয়ে ওঠে।
নয়ন মাঝি শিউরে ওঠে।
একটু পর আবেগ সামলে সাদিয়া উঠে দাঁড়াল। আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বাস্পরুদ্ধ কন্ঠে বলল, চলেন। আমি আর এই দুঃসহ পরিবেশে থাকব না। এর চে গাছপালার গন্ধ ভালো।
নয়ন মাঝিও উঠে দাঁড়াল। বলল, এসো।
তারপর ওরা নীচে নেমে হাঁটতে হাঁটতে শ্রাবণজোছনায় মিলিয়ে যায়।

পসুর নদীটি খুলনার মংলা-তে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এর পশ্চিম শাখাটি শিবসা নামে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মোহনার কাছে কুঙ্গা নাম ধারন করে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে । শিবসা-কুঙ্গার তীরেই অবস্থিত হিরণ পয়েন্ট । শিবসার চলার পথে বাড়–লিয়া, হাড়িয়া, বুনাখালী, গড়খালী, মৈনস, তাকী, বেষেখালী, বাদুরগাছা, ভেলতি, করুয়া, গাংরাইল, হড্ডা, নালী, জল্লা এবং আরও কিছু ছোট ছোট নদী ও খাল বিভিন্ন দিক থেকে এসে শিবসাকে জোরদার করেছে। নদীটি নিয়মিত জোয়ার-ভাটা দ্বারা প্রভাবিত। পূর্ণ বর্ষার কয়েস মাস ব্যতীত নদীর পানি সারা বছরই লবণাক্ত থাকে।
নৌকায় সাদিয়া জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, যেখানে যাচিছ-সেই দ্বীপের নাম নিষাদ দ্বীপ কেন? নিঝুম দ্বীপের নাম জানি- নিষাদ দ্বীপের নাম তো শুনি নি।
নয়ন মাঝি বলল, নাঃ। নিষাদদ্বীপের নাম সবাই জানে না। তবে নিষাদদ্বীপের অস্তিত্ব সম্বন্ধে বাংলার বিশিষ্ট সাধকদের অবহিত করা হয়েছে। যেমন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়া। ধারনা করা হয় জলপথে এসে নিষাদরা বাংলার দক্ষিণে নেমেছিল। জান তো-সত্তর হাজার বছর আগে ক্ষুদ্র এক মানবগোষ্ঠী আফ্রিকা ছেড়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল।
হ্যাঁ, আমি ‘আউট অভ আফ্রিকা’ তত্ত্বটির কথা জানি। আচ্ছা, আপনি বললেন, নিষাদ-দ্বীপের অস্তিত্ব সম্পর্কে বাংলার সাধকদের অবহিত করা হয়েছে। লালন কি জানতেন নিষাদ দ্বীপের কথা?
হ্যাঁ, জানতেন। লালন ভেবেছিলেন গান লিখে আর গান শুনিয়ে তিনি শরিয়তিদের মনমানসিকতঅ বদলাবেন। পারেননি। লালনের একটা গানে আছে-বিশ্বাসীদের দেখাশোনা লালন করে এ ভুবনে।
হ্যাঁ।
বিশ্বাসী মানে শরিয়তপন্থি। নয়ন মাঝি বলল। এই গানেই লালন বাংলার অন্তরের সাধনার মূলকথাগুলি বলে দিয়েছিলেন-

সহজ মানুষ ভজে দেখনা রে মন দিব্য জ্ঞানে
পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে।

সাদিয়া কেঁপে ওঠে। নয়ন মাঝির বাউলিয়ানার ব্যাখ্যাবয়ান তাকে মুগ্ধ করে। ওর বুকের ভিতরে কেমন ছলছল করে। জাভেদ মুরাদ বিনোদন বলতে বুঝত হিন্দী মুভি, মদ গেলা, পার্টি আর সেক্স। টলটলে রঙীন অন্তরের প্রকৃত বাঙালি মেয়ে অতটুকুতে কি সীমাবদ্ধ থাকতে পারে?
নয়ন মাঝি বলে, এই গানেই লালন ইসলাম সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করে লিখেছিলেন-

শুনি মলে পাব বেহেস্তখানা
তা শুনে তো মন মানে না ...

লক্ষ কর সাদিয়া। লালন কিন্তু বলছেন না-আমি বেহেস্ত-দোযখ বিশ্বাস করি না। বরং তিনি বলছেন, শুনি মলে পাব বেহেস্তখানা। এই সূক্ষ্ম পার্থক্য না বুঝেই উগ্র ডানপন্থিরা লালনের মাজারই ভাঙ্গতে গেছিল নব্য মুসলীম লীগের শাসনামলে।
হ্যাঁ। আমার মনে আছে। সাদিয়া বলল। লালনের মাজারে শপিং কমপ্লেক্স হবে শুনে মায়ের কী মন খারাপ। সে সময় একদিন কবি শামসুর রহমান আমাদের বাড়ি এলেন । তিনি প্রায়ই আসতেন, আমার বড় মামার, মানে সাইয়েদ আতিকুলল্লার বন্ধু ছিলেন। কবি বললেন, সামনে ভয়ানক সময় আসছে রুবি-রুবি, মানে আমার মায়ের নাম। যুদ্ধাপরাধীরা এদেশে মন্ত্রী হবে দেখ। ২০১৫ সালের পর বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলে ঘোষনা করা হবে । উপেন্দ্রকিশোরের সব বই পুড়িয়ে ফেলবে। বাংলাবাজারে আগুন লাগবে। ডক্টর হূমায়ূন আজাদকে হত্যা করবে। সত্যজিতের ছবি ব্যান করবে। আজিজ মারকেট থেকে বইপাড়া উঠে যাবে কাটাবনের পশুপাখির দোকানের উলটো পাশে। নজরুলের কোনও গানকে জাতীয় সংগীত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে দেখ। বলে সাদিয়া চুপ করে থাকে। নয়ন মাঝি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দূর্বল কন্ঠে বলে, হায়, আওয়ামী লীগ আর আগের মতো নেই। আওয়ামী লীগও কেমন যেন মুসলীগ লীগ হয়ে গেছে। সংখ্যালঘু শব্দটা আমি অপছন্দ করি সাদিয়া- তারপরও বলব আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে কি না সন্দেহ!

বেষেখালীর শিবসা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন রোকেয়া পালি । দু’পাশে ঘন গাছ। গাছগুলির নাম গরান। সে গাছে কাকপক্ষীর কোলাহল। এক ডাল থেকে অন্য ডালে বানরের লাফালাফি। একটা ময়ূর। অবশ্যি হরিণ চোখে পড়ল না । তখন ভোরের আলো উঠছিল। নতুন কেউ এলে তিনিই বরণ করেন। তিনি জানেন-আজ নয়ন মাঝির ফেরার কথা।
বেষেখালীর ঘাটে সাদিয়াদের নৌকা এসে থামল। ঘাটে নেমে সাদিয়া অবাক। নয়ন মাঝি বলল, ইনিই আদিমাতা। তবে প্রণাম অনাবশ্যক। সাদিয়া অবাক। আদিমাতা দেখতে অনেকটা সানজিদা খাতুনের মতন । তামাটে গায়ের রং; মাঝারি গড়ন। মাথায় জট পাকানো পাকা চুল। সত্তরের মতন বয়স। পরনে সাদা শাড়ি। আদিমাতা রোকেয়া পালি বললেন, আমি কেউ নই বাছা। আমি লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর মতন অন্যের মঙ্গলের জন্যেই বাঁচি। কিংবা আমি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের একজন তুচ্ছ অনুসারী।
ওহ্। সাদিয়া শরীর শিরশির করে ওঠে।
এসো।
ঘাট পেরিয়ে উঁচু উঁচু গাছে ঘেরা ছোট উঠান। অনেকগুলি ছোট ছোট ঘর। ঘরগুলি সব মাটির-গোলপাতার ছাউনী। উঠানজুড়ে আলো আর আলো। ওপরে ফিরোজা রঙের একটা আকাশ। সে আকাশ থেকে ঝরছে মধ্য শ্রাবণের ঝকমকে আলো। শুঁটকি মাছের গন্ধ পায় সাদিয়া। সেই সঙ্গে জলো বাতাস আর শিবসার আঁষটে গন্ধ। উঠানের বাঁ পাশে নাড়কেল গাছ। বাতাসে নাড়কেল পাতারা দোল খায়। দোল খায় টিয়ে পাখিরা। সাদিয়ার চোখেমুখে বিস্ময়।
তুমি ক্লান্ত মেয়ে, যাও তুমি বিশ্রাম কর। আমি তোমার খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। নাড়কেল কোরা আর মুড়িগুড় আজ সকালের খাবার। তুমি নাড়কেল কোরা খাও তো?
জ্বী, খাই।
দুপুরে শিবসায় øান করে আমরা একসঙ্গে নটে শাক মেখে ভাত খাব কেমন?
আচ্ছা।
দুপুরের খাওয়ার পর উঠানের নাড়কেল গাছের ছায়ায় এসে বসল ওরা। রোকেয়া পালি বললেন, বুঝেছি সাদিয়া- তোমার মনে অনেক কৌতুহল। নয়নের মুখে সম্ভবত নিষাদ-দ্বীপের উপকথা কিছু কিছু শুনে থাকবে। আমি বলছি, শোন। বাংলা আবহমান। মানে, বাংলার ইতিহাসে একটা ধারাবাহিকতা আছে। সেই সুপ্রাচীনকালে বাংলায় নিষাদরা এল। তারা ছিল প্রকৃতির ঘনিষ্ট সন্তান। তারপর নিষাদ জাতি নানা পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যায়। ধীরে ধীরে তারা সারা বাংলায় ছড়িয়ে যায়। তবে নিষাদদ্বীপে-মানে তুমি যেখানে যাবে-সেখানে একটা দল থেকেই যায়। কালক্রমে হাজার বছরে অনেক ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল নিষাদউদ্ভুত বাংলার জনমানুষের বৌদ্ধধর্ম গ্রহন ও চারশ বছর ধরে বৌদ্ধ রাজাদের অধীনে সুখেশান্তিতে বসবাস। ঐ ৪০০ বছরের বৌদ্ধযুগই হচ্ছে- সোনার বাংলা। এরপর বাংলায় নেমে আসে বিপর্যয়। প্রথমে দশম শতকে দক্ষিণ ভারত থেকে এসে সেনরা বাংলার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। তারা শান্তিবাদী বৌদ্ধদের ওপর অত্যাচার করে; বৈষ্ণবধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করে-তখনই শান্তিপ্রিয় একদল বাঙালি নিষাদদ্বীপে চলে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। পরের বড় দলটা আসে ১২০৬ সালে- আলী মর্দান খলজী ইখতিয়ারউদ্দীন মোহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করার পর; যারা শান্তিবাদী বৌদ্ধদের হত্যা করতে পারে তারা পৃথিবীর সবাইকেই হত্যা করে ফেলবে এই ধারনার বশবর্তী হয়ে তারা নিষাদ-দ্বীপে চলে আসে। ৩য় দলটা-১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় মুসলিম লীগ গঠিত হলে-বাংলা নতুন করে ভূস্বামীদের অধীন চলে যাবে এই আশংকায়। তৃতীয় দলটা এল ২০০১ সালে- বাংলাদেশে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর-দেশব্যাপী ফ্যাসিবাদ নেমে আসবে তাই। কেনন, উদ্রজাতীয়তাবাদ+উদ্র ধর্মান্ধতা= ফ্যাসিবাদ।
আদিমাতার কথাগুলি শুনতে শুনতে সাদিয়ার অরণ্য কবিরের মুখটা মনে পড়ল।
আদিমাতা বললেন, আমিও এখানে এসেছি ২০০২ সালে। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছি। আমার বিশ্বাস, শান্তিপ্রিয় মানুষের নির্জন দক্ষিণে চলে আসাই ভালো। তা ছাড়া ...তা ছাড়া বাংলায় এত বেশি লোক শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধদের হত্যাকারী ইখতিয়ারউদ্দীন মোহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী কে হিরো মনে করে-ওদের মনের পরিবর্তন সম্ভব না। বাংলার কবি পর্যন্ত বখতিয়ারের প্রশংসা করে কাব্যগ্রন্থ লেখেন -‘বখতিয়ারের ঘোড়া।’ ধিক! কাজে কাজেই নির্জন দক্ষিণে পালিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। ইখতিয়ারউদ্দীন মোহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধদের হত্যা করেছিল। কারণ? বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে ইখতিয়ারউদ্দীন মোহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর অজ্ঞতা। বাংলার মুসলিম সমাজে এই অজ্ঞতা এখনও বিরাজমান। আসলে এক গভীর অজ্ঞতাই মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য- নইলে জগতে এত এত ধর্মমত থাকার পরও কেন তারা মনে করে যে তারাই শ্রেষ্ঠ? এই মিথ্যে শ্রেষ্ঠত্ববোধের জন্যই রক্তপাত ঘটছে। আরও ঘটবে।
বাংলাদেশ সরকার কি নিষাদ-দ্বীপের কথা জানে?
জানে। কিন্তু সঠিক অবস্থান আজও জানে না। জোট সরকারের আমলে নেভির জাহাজ অনুমানের ওপর শেল বর্ষন করেছিল। দ্বিতীয়বার। প্রথবার ওরা ১৯৭৫ এর পর শুধুমাত্র পাকিস্তানকে খুশি করতে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা গ্রামগুলিতে আর্মি লেলিয়ে দিয়েছিল আর স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে কলঙ্কিত করতে।
চকিতে সাদিয়া নয়ন মাঝির দিকে তাকাল। বলল, ওহ্। সব মিলে যাচেছ।
আদিমাতা রোকেয়া পালি মাথা নাড়লেন।
এখন আমাকে কী করতে হবে? সাদিয়া নরম সুরে জিজ্ঞেস করে।
আদিমাতা বললেন, তেমন কিছু না। প্রথমে তোমার নামটা সামান্য বদলে নিতে হবে। মানে অভিজাত নামটিতে কাদামাটি লাগাতে হবে। যেমন, আগে আমার নাম ছিল রোকেয়া খানম। এখন আমার নাম রোকেয়া পালি। যেহেতু, পালি পবিত্র ভাষা। এ ভাষায় বুদ্ধ মানবতাবাদ প্রচার করেছেন। এখন তোমার সাদিয়ার সঙ্গে আদিবাসী নাম বা অন্ত্যজশ্রেণির পেশা বা ঐতিহ্যবাহী কোনও দেশজ ভাষার নাম নিতে হবে। এই ধর - তোমার নাম ... তোমার নাম হতে পারে- সাদিয়া হাজং।
সাদিয়া হাজং? ঠিক আছে। সাদিয়া হাজৎ উৎফুল্ল হয়ে উঠে বলল।
এভাবে আরবি-ফারসিভিত্তিক মুগল আভিজাত্যকে ধ্বংস করা হল। আদিমাতা রোকেয়া পালি ঘোষনা করলেন।
নয়ম মাঝি প্রতিধ্বনি তোলে-এভাবে আরবি-ফারসিভিত্তিক মুগল আভিজাত্যকে ধ্বংস করা হল।
উহ্, ফাইন। আমার কী যে নির্ভার লাগছে। সাদিয়া হাজৎ উৎফুল্ল হয়ে উঠে বলল।
আর, এখন তোমাকে ক্রমশ অরণ্যের জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে। বাঁচতে হবে নিরামিষ খেয়ে । তোমার প্রধান কাজ হবে শিকারীদের গুলির হাত থেকে হরিণ ও পাখিদের বাঁচানো। কী করে তীরধনুক চালাতে হয় তা তোমায় শিখিয়ে দেওয়া হবে। বলাবাহুল্য নিষাদদ্বীপে শাস্ত্রীয় ধর্ম বলে কিছু নেই। আছে কেবল মহাবিশ্বে আপন ক্ষুদ্র প্রবাহমানতা উপলব্দির প্রেরণা। বড়জোর বৌদ্ধ ধর্মকে মেনে নেওয়া যায়। তবে কিছুতেই বর্ণবাদী সেনদের বৈষ্ণববাদ বা আরবি-ফারসিভাষী অজ্ঞ অশ্বারোহীদের ধর্মান্ধতা নয়। এদের শ্রেষ্ঠত্ব বোধ জন্ম দেয় জিঘাংসার । আজও দিচ্ছে। আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ-এ বোধ অত্যন্ত ক্ষতিকর। জগৎ সম্বন্ধে যাদের কোনওরুপ ধারনা নেই -তারাই এই কথা বলতে পারে। বলে আদিমাতা নয়ন মাঝিকে চোখের ইশারা করলেন। নয়ন মাঝি উঠে দাঁড়াল।
এ কী! আপনি কোথায় যাচ্ছেন? সাদিয়া হাজং বিস্মিত।
রোকেয়া পালি বললেন, নয়ন মাঝি ফিরে যাবে শালবনে। যেখানে তোমার সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল। আবার হয়তো কারও সঙ্গে ওর দেখা হয়ে যাবে। এখন বাংলার শহরে শহরে বাউলের ভাস্কর্য ভাঙা হচ্ছে। এখন অনেকে অনুভূতিশীল মানুষই ফিরতে চায় নির্জন দক্ষিণে । ফিরতে চায় শাস্ত্রীয় ধর্মহীন নিষাদজীবনে। মানবরচিত শাস্ত্রের নির্দেশে জীবন কলঙ্কিত করবে না। নয়ন মাঝি ওদের এখানে নিয়ে আসবে।
কথা বলতে বলতে ওরা ঘাটের দিকে যেতে থাকে।
নয়ন মাঝি নৌকায় উঠল।
রোকেয়া পালি ও সাদিয়া হাজং পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ না নৌকাটা দেখা যায়।
আমি কি এখানেই থাকব? সাদিয়া হাজৎ জিজ্ঞেস করে।
না। এটি প্রাথমিক অভ্যর্থনা কেন্দ্র। নিষাদ-দ্বীপ বাদাবনের আরও গভীরে- সেই কচিখালীর কাছে হরিণঘাটা নদীর মোহনায় ।
ও ।
জান তো, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে জানত সমুদ্রের জল বাড়ছে?
হ্যাঁ।
নিষাদ-দ্বীপের অবস্থান বাংলার দক্ষিণে হওয়াতে দ্বীপটি সবচে আগে ডুবে যাবে। মানে আমরা সবার আগে ডুবে যাব। মানে, আমরা সবাই মিলে ডুবে যেতে চাই। মানে আমরা বাংলার ইতিহাসের ভুলগুলি আর মনে না করে প্রকৃতিকে মিশে যেতে চাই।
ওহ্।

(উৎসর্গ: আরিফুর রহমান। যিনি সাহসী ও স্বচ্ছ চিন্তাধারার অধিকারী একজন মুক্তমনের অসাম্প্রদায়িক মানুষ। )
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০০৯ দুপুর ১:৪৭
১৫টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×